প্রতিটি মানুষের একটি স্পার্কিং মুহূর্ত থাকে যা তার জীবনকে ডিফাইন এবং ডিজাইন করে দেয়। আমার জন্য সেই স্পার্কিং মুহূর্তটি ছিল ২০০৯ এ বুয়েটের টার্ম ব্রেক এ নির্মাণ করা ৩৭ মিনিটের ড্রামা @মনীষী সিনড্রোম। সেই যুগে প্রফেশনাল টিভি ক্যামেরা, ভিডিও এডিটর আর এফডিসি থেকে আনা যন্ত্রপাতি আর ক্রু এর বিরাট টিম এর সমন্বয়ে নির্মাণ ব্যয় পড়েছিল ৬২ হাজার টাকা। বন্ধু, সিনিয়র রুমমেট, পরিচিত সিনিয়রদের অনুদানের বাইরেও ব্যাচমেট Shohel Azam এর থেকে এককালীন ১৫ হাজার টাকা ধার করে প্রোডাকশন খরচ পূরণ করেছিলাম।
কাজটা এতটাই এমেচার মানের হয়েছিল এবং নাটকের অন্যতম আর্টিস্ট Sangita Dutta আপুর তীব্র তিরস্কার জুটে যে এর কোনো স্মৃতি রাখারই প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি তখন। নাটক দেখে সঙ্গীতা আপু ফোন করে প্রায় ২০ মিনিট অনর্গল কটূ কথা শুনিয়ে যায়; তার বন্ধু এবং পরিবারের লোক হাসাহাসি করেছে, জীবনে সে এত বাযে পারফর্ম করেনি, এবং এতখানি বিব্রতও বোধ করেনি, তার কান্না এসেছে। প্রত্যুত্তরে স্যরি বলা ব্যতীত অপশন খোলা ছিল না আমার।
তখন টার্ম ব্রেক চলছে। এসময় হলের ডাইনিং বন্ধ থাকে, যে কারণে রশিদ অথবা আহসান উল্লাহ হলের ক্যান্টিন থেকে কিনে খেতে হত খাবার। পকেটে টাকা মোটে ১০০, ও দিয়েই কলা-বিস্কুট আর পাউরুটি খেয়ে কাটিয়ে দিই ৭ দিন। সোহেল আজম তখন ডেস্টিনির সঙ্গে যুক্ত ছিল, সে আত্মবিশ্বাসী ছিল বৈশাখী টিভিতে সম্প্রচার করা সম্ভব হবে। কিন্তু কাজটা এতই অপরিপক্ব সে পেরে উঠেনি। সে সময় সামহোয়ারইন ব্লগে ছিলাম নামজাদা ব্লগার, ক্রিটিকাল কমেন্ট করার সৌজন্যে নানা পেশার মানুষের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল সখ্য, তন্মধ্যে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অনেক সাংবাদিকও ছিল। তাদের সূত্রে ইটিভি, আরটিভি, এনটিভি, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, বাংলা ভিশন প্রতিটি চ্যানেলে জমা দিই নাটক। এর মধ্যে ইটিভি থেকে সরাসরিই বলে দেয় নাটকে অন্তত ২ জন স্টার আর্টিস্ট না থাকলে সেটা অন এয়ার করা সম্ভব না; বাকিরা পরে জানাবো বলে বিদায় করে দেয়।
Salah Uddin Shuvro ছিলেন প্রথম আলো ব্লগের মডারেটর, তার সূত্রে কথা হয় জাহিদ রেজা নুরের সঙ্গে। বুয়েটের ছেলেরা নাটক বানিয়েছে, শুনে প্রথমে এপ্রিসিয়েট করেন, বলেন একটা ফিচার লিখ, ছাপিয়ে দিচ্ছি। লেখা জমা দেয়ার পরে বলেন কম্পোজ করতে দিয়েছি। কয়েকদিন পর নক করলে বলেন- আমি ভেবেছিলাম নাটক করাকালীন মজার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু লিখবা; লিখছো না খাইয়া ছিলা, ধার-দেনা করেছ; এগুলা তো সবাই করে কাজে নামলে, এটা ছাপানোর কী হলো; ধুর মিয়া, ক্যাম্পাসে চইলা যাও।
মাহবুব মোর্শেদ তখন সমকালের সাব-এডিটর ছিলেন, ব্লগসূত্রে পরিচয় ছিল। তিনি সমকালে ফিচার করার প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ নাকি রাজি হয় না। সেই যাতায়াতেই তিনি প্রস্তাব দেন মিলান কুন্ডেরার আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং বইটা অনুবাদের, তার বন্ধু প্রকাশক, ছাপানোর ব্যবস্থা করতে পারবেন। সেখান থেকেই অনুবাদ শুরু ও সমাপ্ত করা।
সঙ্গীতা দত্ত নিজেও হয়ত উপলব্ধি করেছিল রাগবশত দুর্ব্যবহার একটু বেশি করে ফেলেছে, প্রলেপের অংশ হিসেবে পরদিন ফোন করে বলে- ‘নাটকটা আসলে অতটা বাজে হয় নাই যতটা প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল। তুই হিমেল, তোর কাছে আমার এক্সপেক্টেশন অনেক হাই। তুই আমার ব্যবহারে কিছু মনে করিস না’।
বুয়েট জীবনে সঙ্গীতা দত্ত এর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া হয়েছে হাতে গোনা, তার সহপাঠী প্রয়াত নিশাত আপুর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ছিল সবসময়। তবু সঙ্গীতা দত্তের প্রতি আগ্রহের মূল কারণ ছিল ভোকাল টোন এবং হিউমার। কিন্তু নাটক দেখবার পরে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল তার প্রভাবে আরো ৪১ বছর বেঁচে থাকলেও তাকে মনে রাখতে বাধ্য। রিজেকশন হ্যান্ডলিং তথা মেন্টাল টাফনেস বৃদ্ধিতে তার সঙ্গেকার ২০ মিনিটের সেসনটার আর্থিক মূল্য কমপক্ষে ১৭ মিলিয়ন ডলার হওয়া উচিত।
নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বুয়েটেরই সিনিয়র ভাই তথা বন্ধু Amimul Ehsan চুন্নু ভাই। নাটকের কয়েকদিন পরই তার বিয়ে, ভাবী শুটিংয়ে এসেছিলেন একদিন, ভ্যাপসা গরমে ওভারব্রিজ এ বসে শট দিচ্ছে কীভাবে এটাই ছিল তার মূল কনছার্ন।
রাকিবুল কাদির মাত্র ১টা দৃশ্যে অভিনয় করলেও তার ভরাট কণ্ঠস্বর টেকনিশিয়ানদের মুগ্ধ করেছিল।
সহপাঠী Fahim Rahman ইমুকে সবসময়ই অত্যধিক পছন্দ করতাম, কিন্তু অজানা কারণে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা একটা নির্দিষ্ট লেভেলের বেশি আর উঠলো না; এটা আফসোসেরও কারণ কিছুটা। নাটকের পূর্বে সঙ্গীতা দত্ত আর তাকে নিয়ে পৃথক রিহার্সেল করেছিলাম।
Aminul Mehedi ছিল অন্যতম পছন্দের জুনিয়র। নাটক দেখে সে সংকল্প নেয় বাকি জীবনে আর কখনো অভিনয়মুখো হবে না। হয়তবা সংকল্প রক্ষাও করেছে।
সহপাঠী Adnan Mousharraf সঙ্গে গান তৈরির এক নেশা তৈরি হয়েছিল। সে রিদম বাজাত, সে অনুসারে কথা লিখে দিতাম। এই প্রক্রিয়াতেই জন্ম নেয় ‘নীলিমা’ গানটি; মূলত কাছাকাছি সময়ে 41 এর বিয়ে হওয়ার মনোকষ্ট থেকেই গানটি লেখা। ইস্কাটনের এক স্টুডিওতে রেকর্ড করেছিলাম, ওর ভগ্নিপতির পরিচিত হওয়ায় ১৫ হাজার টাকার রেকর্ডিং আমরা পাই মাত্র ২ হাজারে। সেই গানটিও ব্যবহৃত হয়েছিল নাটকে।
বুয়েটে প্রিয়তম জুনিয়র ছিল Saiful Haque Misha , অভিনয় করবার কথা ছিল তারও, ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে সে অপারগতা প্রকাশ করে শেষ মুহূর্তে। তার স্থলাভিষিক্ত হয় অপর জুনিয়র নাঈম, সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডব ইস্যুতে সে আমাকে ফেসবুকে ব্লক করে দিয়েছে।
নাটকে সবচাইতে সুন্দর অভিনয় করেছিল সিলভি, নীলিমা চরিত্রে; সর্বশেষ ১১ বছরে তার কোনো ট্রেস জানি না, শুনেছি সে নর্থ আমেরিকায় স্থায়ী হয়েছে। অপর জুনিয়র নাজিব আর ফায়েকা মানসুরা এর সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ১ দশকের বেশি হয়ে গেল।
প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে Faruque Hasan যে অনবদ্য অবদান রেখেছিল ভোলা অসম্ভব।
আমার যে কোনো সৃজনশীল কাজে বন্ধু Arman Hussain জন্য বিশেষ স্লট বরাদ্দ থাকতোই, এখানেও রয়েছে।
আমার প্রথম প্রকাশিত বই প্রযত্নে-হন্তা এর দ্বিতীয় গল্প @মনীষী সিনড্রোম; পরিচালক হিসেবে অতি নবিশ না হলে মর্মস্পর্শী এক নাটক নির্মিত হতে পারত। বয়স সবে ২২, বুয়েটে অনবরত ল্যাগ খাচ্ছি, প্রয়াত কার্নি স্যার প্রায়ই বলেন- ‘ এভাবে চললে তো ইন্টার পাশ হয়ে থাকতে হবে’। বাসার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রায়, ভবিষ্যত অনিশ্চিত, ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন পর্যন্ত হয়েছি— কতটা ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছি; সেই সময়ে মনীষী সিনড্রোম গল্পটা আবিষ্কার করি।
আজ ১৪ বছর পরে সেই গল্প বা নাটকের ১টা লাইনই মনে পড়ে শুধু- ভাই আপনার কাছে কি ৫০০ টাকার ভাঙতি হবে?কবি থেকে দলিল লেখক বনে যাওয়া মোনায়েম তথা মৃন্ময় আকাশ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলছে- ‘এ মাসে তো হবে না, সামনের মাসে হতে পারে’!
সংলাপ আনাড়ি, লোকেশন হাস্যকর তবু এই নাটকটাই আমার জীবনের গতিপথ রচনা করেছে।
রীতিমত বিস্মৃত হয়েছিলাম এর ব্যাপারে। কারো কাছে কোনো কপি নেই, মেনে নিয়েছিলাম এর কালের অতলে তলিয়ে যাওয়াই নিয়তি। হঠাৎ ২ দিন পূর্বে ভাই মাহবুব সিদ্দিকী রুমেল ফোন করে শোনালো সেই অবিশ্বাস্য গল্পটি, ওর ল্যাপটপের পুরনো ফোল্ডারে পাওয়া গেছে আমার প্রথম যৌবনের প্রেমচিহ্ন অথবা স্পার্কিং মুহূর্ত। ইউটিউবে আপলোড দেয়া সম্ভব হবে না, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে কপিরাইট ইস্যুতে। তবে আমার ব্যক্তিগত ব্লগ himalaypiডট কম এ আগামীকালই আপলোড করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েই গেল।
১৩ বছর আগে যা করেছিল বিব্রত, সময়ের পরিক্রমায় সেটিই রূপান্তরিত হয়েছে পরম আরাধ্যে। সর্বশেষ ৩ বছরে এর সমতুল্য খুশির সংবাদ পাইনি জীবনে।