বাংলাদেশের বাইরে এক সেকেন্ডের জন্যও কোনো দেশে যাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় অপূরণীয় এক ক্ষতি হচ্ছে আমার।

আরো ৪-৫টি দেশে গড়ে ১ বছর অবস্থান করতে পারলে দেখা আর কল্পনার জগতটা সম্প্রাসারিত হতে পারতো। নদী-পাহাড়-সমুদ্র-স্থাপনা দর্শনকেন্দ্রিক দেশভ্রমণ স্রেফ জঘন্য লাগে, একাধিক দেশে ন্যূনতম ১ বছর হারে অবস্থান করতে চাই কেবলমাত্র ১টি কারণে— সেখানকার সংস্কৃতি সম্বন্ধে ধারণা বা অভিনিবেশন তৈরি করতে।

প্রায় সমস্ত রেফারেন্স পয়েন্ট ভৌগলিক বাংলাদেশ হওয়ায় নিশ্চিত হতে পারি না মানুষের বিভিন্ন কার্যক্রম আর আচরণ সংক্রান্ত যে সমস্ত পর্যবেক্ষণ তৈরি হয় সেগুলো সার্বিক, নাকি নিছক সংকীর্ণ স্থানিকতায় সীমাবদ্ধ।

পড়ুয়া এবং লিখিয়ে— উভয়শ্রেণির মানুষের মধ্যে অভিন্ন এক প্রবণতা দৃশ্যণীয়।

ধরা যাক ফারুক মুত্তাকিন নামের জনৈক লেখকের একটি সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধে নিবন্ধ লেখা হবে। যিনি লিখছেন তিনি পাঠক নাকি নিজেও একজন সাহিত্যিক, বিবেচ্য নয়, দুজনের লেখাতেই কয়েকটি বাক্যাংশের উপস্থিতি অনিবার্য: ‘তার নির্মেদ সরল সম্মোহনী গদ্য। কিংবা, মখমলের ন্যায় ভাষা। কিংবা, আড়ষ্টতাহীন ঋজু মাধূর্যময় ভাষাশৈলী। কিংবা তার ভাষায় গতি এবং মায়া দুটোই উপস্থিত— প্রভৃতি’।

একই ফারুক মুন্তাকিনের লেখাকে কাটাছেঁড়া করলেও বর্শাটা ছোঁড়া হবে ভাষার বুক বরাবর: ‘তার বিশেষত্বহীন নির্জীব ক্লান্তিকর একঘেয়ে গদ্য। কিংবা, দুর্বল মাধূর্যহীন ভাষাশৈলী।’

পড়া এবং লেখা উভয় ক্ষেত্রেই ভাষাকেন্দ্রিক কূটনীতি অথবা কৌলিন্যপনা, এগুলোকেই বাংলা সাহিত্যের প্রধান স্খলন সাব্যস্ত করি, যার প্রভাবে এই অঞ্চলের সাহিত্যকে হাস্যকররকম চাকচিক্যময় লাগে (অনেকটা স্নো-পাউডার মেখে মুখ ধবধবে করার মতো)। আবেগজর্জরতার ভারে চোখে জল আসতে পারে, স্থায়ী অথবা ক্ষণিক মুগ্ধতা তৈরি হতে পারে—- কিন্তু ভাবনা নির্মাণকল্পে যে আঁচড় সেই যোগ্যতা কি বাংলা সাহিত্যের তৈরি হয়েছে?

হ্যাঁঁ অথবা না তে উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে, শত-সহস্র বছরের পড়ুয়া মনন কেন ভাষা ডোমিন্যান্ট হলো? একই ভাবার্থ প্রকাশক বাক্য আমি লিখলে যেমন শোনাবে, শহীদুল জহির অথবা বুদ্ধদেব বসু লিখিত হলে শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে নির্ঘাত।

‘সৌন্দর্য ফ্যাক্টর’ কেন এতটা শক্তিশালী?

কারণ খুঁজতে গিয়ে সাহিত্যে ভাষার প্রাসঙ্গিকতার প্রতি ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত ফয়সালা করতে চাই। একটি দৃশ্যকল্প তৈরি করা যাক।এই মুহূর্তে আপনার সবচাইতে প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য/উপকরণগুলো কী কী হতে পারে?

–সাহস। কারণ এরকম জনমানবহীন অন্ধকার জঙ্গলে গভীর রাতে ছেড়ে দেয়া হলে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে পড়বে অধিকাংশ মানুষেরই।

–উপস্থিত বুদ্ধি। জঙ্গলে আপনি দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করতে চাইবেন না। যে কোনো উপায়ে নতুন পথ খুঁজে নিতে হবে। সেই পথ খোঁজার জন্য অনবরত কৌশল চিন্তা করতে হবে।

— মশাল বা আলোকবর্তিকা। যেহেতু অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা, আপনাকে আলোর কোনো উৎস যোগাড় করতেই হবে। নইলে বুঝতেই পারবেন না কোথায় আছেন এবং যাচ্ছেন কোথায়।

—জুতা বা বুট। যেহেতু আপনাকে হাঁটতে হবে অবিরাম, পায়ে বুট থাকলে বিষাক্ত পোকামাকড়ের আক্রমণ বা কাঁটাজাতীয় কিছু বিঁধবার ঝুঁকি কিছুটা কমে যাবে।

এর বাইরেও আরেকটি উপকরণ রয়েছে, পোশাক। জঙ্গল থেকে লোকালয়ে ফিরলে পোশাকহীন থাকতে পারবেন না।

গভীর রাতে আপনি এক গহীন জনমানবহীন অন্ধকার জঙ্গলে হাঁটছেন, বা আপনাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে শাস্তিস্বরূপ।

কিন্তু

এমন কি হতে পারে, টি-শার্ট বা স্যান্ডোগেঞ্জি পরিধান করলে অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরতে পারবেন না, স্যুট বা দামী পোশাক পরলে ফেরা সহজ হবে?—– আপনি বলতে পারেন, দামী পোশাক পরিধান করা মানে সামাজিক স্ট্যাটাসের দিক থেকে আমি উপরে অবস্থান করি। স্ট্যাটাস উপরে মানে আমার বুদ্ধি আর সাহস বেশি। টি-শার্ট পরিহিত মানে সে ক্যাজুয়াল, কোনো ব্যাপারেই সিরিয়াস নয়— তার পক্ষে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব।

কিংবা বলতেই পারেন, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই যাবে, জঙ্গল-শ্মশান যেখানেই হোক; একেও আলাদাভাবে প্রকরণ বলতে হবে নাকি!

—– একজন ব্যক্তি যখন সাহিত্যের সংস্পর্শে আসে সেও মূলত গভীর রাতে নির্জন নিকষ অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলেই প্রবেশ করে; লেখক এবং পাঠক– দুয়ের জন্য জঙ্গলের অবস্থানটা হয়তো আলাদা, তবে জঙ্গল অনিবার্য।

যেহেতু বাংলাদেশী ব্যতীত ভিন্ন জাতিসত্তার অনেক মানুষের সাথে মিশতে পারিনি, একদেশদর্শী পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আপাত অভিমত হলো, বাংলা সাহিত্যের পাঠক এবং লেখকদের বৃহত্তম অংশই জঙ্গলে ঢুকে সকল ভাবনা বাদ রেখে পোশাক নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভুগছে।

জঙ্গল থেকে বেরুতে পোশাকের যতটুকু গুরুত্ব, সাহিত্যে ভাষার অবস্থানও ঠিক ততটুকুই হওয়া উচিত।

তবু

হয়নি কেন?

প্রশ্ন হলো,

ক্রমাগত পুনরাবৃত্তীয়, পুনরাৎপাদনমূলক এবং প্রতিধ্বনিসূচক পৌনঃপুনিক ভাবনার একঘেয়ে নিঃসরণের ক্ষেত্রে ভাষাকেন্দ্রিক ফ্যান্টাসির দায় কতটুকু?

যখন থেকে লিখতে শুরু করেছি ভাষার অলংকরণকে বাহুল্য ভাবি, এবং অন্যদের ভাষাস্তুতিকে প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেছি।

দার্শনিকতার এই সংকট থেকে গ্রহণযোগ্য উত্তরণের উপায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশী ক্রিকেটার লিটন দাস।

ক্রিকেটকে যদি সাহিত্য ধরি সেখানে ভাবনা, বিষয়বস্তু/দর্শন, বিন্যাস এবং ভাষা— ৪টি উপাংশকে প্রতীকায়িত করলে কীরূপ হতে পারে?

ভাবনা: ক্রিকেটারের গেম সেন্স, মেন্টাল টাফনেস এবং এন্টিসিপেশন’।

বিন্যাস:পারফরম্যান্স

বিষয়বস্তু: ‘এপ্রোচ’ বা ‘স্কিল প্রশিক্ষণ’

ভাষা: ‘স্টাইল’

লিটন দাসের ব্যাটিং দেখতে সবরকম প্রায়োরিটি বিসর্জন দিয়ে হলেও টিভিস্ক্রিনে তাকিয়ে থাকি কেন?

ভাবনা, বিন্যাস, বিষয়বস্তু ৩টি শর্তেই সে বিলো এভারেজ, কিন্তু ভাষা (ব্যাটিং স্টাইল) জাদুকরি এবং মনোহরী।

এক্ষেত্রে ভাবনাকে কেন ভাষার উপরে স্থান দিতে অসমর্থ হলাম?

দর্শকের অবস্থান থেকে ক্রিকেট খেলা একটি পারফর্মিং ভিজুয়াল আর্ট; পাঠপ্রক্রিয়া ভিজুয়াল নয়, উৎপাদনমুখী— শুধু চোখ দিয়ে শব্দ দেখলেই হচ্ছে না, মাথার ভেতরে প্রতিটি পৃথক শব্দের ধ্বনি উচ্চারিত হয়, যা শুনে অনুভূতি বা অনুভব তৈরি করে নিতে হয়।

ব্যাটিং বা বোলিং দেখতে চিন্তা করতে হয় না, এর পরে কী হবে বা হতে পারে সংক্রান্ত সাসপেন্স বা উত্তেজনাই প্রাধান্য পায়।

লিটন দাসের ব্যাটিংশৈলী(ভাষা) সংক্রান্ত মোহগ্রস্ততা ঠেলে দিয়েছে নতুন প্রশ্নের মুখে: অধিকাংশ পডুয়ার পাঠও কি মূলত ভিজুয়াল আর্টের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন? ফিকশনের ক্ষেত্রে ভাষাকেন্দ্রিক যে রুচিগ্রস্ততা ননফিকশনে তা বহুলাংশে কম।

ফিকশন মানেই কি ভিজুয়াল নির্মাণতা? কেন?

জটিল এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেই মুহূর্তের ঋণ বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। তবু সন্তোষজনক উপলব্ধি তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছি।

কোটি মানুষের কমন প্রবণতাকে স্রেফ বিরোধীতার উদ্দেশ্যে খারিজ বা ক্রিটিক করা চলে না; গভীর এবং ব্যাপক তল্লাশি প্রয়োজন। জানি না মহাসমুদ্র মন্থনের আজগুবি খেয়ালের বন্দীশালা থেকে মুক্তি মিলবে কিনা।