ঈদের আগের বিকেলে গল্প কিনবার তাড়না বোধ করলাম। গল্পের বাজার চিনি, দোকান অচেনা হওয়ায় প্রদর্শক রূপে নিলাম ফরহাদ জনিকে৷ বিনিময়ে কিনতে হলো তার বানানো ‘আমের মোরব্বা’
বেউথা বাজারে গরুর দুধের চা অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য৷ চায়ে চুমুক দিয়ে জানলাম ফরহাদ এক গাড়ি বিক্রির কোম্পানিতে চাকরি করে, অথচ এত বছর জেনে এসেছি সে ‘নৈশপ্রহরী’! আমরা চেনা মানুষদের সম্বন্ধেই অসম্পূর্ণ গল্প জেনে বেঁচে থাকি দিব্যি, অর্ধচেনা মানুষদের গল্পগুলো তাহলে ভেজালের গোবী মরুভূমি কেন নয়!
ফরহাদ আড়াইশো টাকায় ভাড়া করে অটোরিকশা, গন্তব্য পোদ্দারবাড়ি, ঝিটকা। হাজারী গুড় নামের এক সাদা হাতির প্রাপ্তিস্থান এই ঝিটকা, শুনলাম বাংলাদেশের পঞ্চগড় থেকে মহেশখালি, সর্বত্রই নাকি এই গুড়ের কদর নায়িকা জয়া আহসান পর্যায়ের!
পথিমধ্যে চোখ পড়লো মিষ্টির দোকানে। নানা চেহারার মিষ্টিতে মনে পড়লো শিমুল ম্যাগপাইকে। এমনই এক গল্প কেনা অভিযানে ম্যাগপাই আমায় চিনিয়েছিল মিষ্টি এবং তার পরিজনদের। ম্যাগপাইয়ের প্রতি নস্টালজিয়ায় খাওয়া হলো মিষ্টি। ফরহাদ প্রতি দিন ২ লিটার সেভেন আপ সেবন করে, ভারতে গেলে হলুদ স্প্রাইট, কিন্তু মিষ্টির বেলায় সে চিনিত্যাগী, ৫ বছর ধরে নাকি ডায়বেটিস। মিষ্টিতে সুগার বাড়বে, কিডনি নষ্ট হবে৷ তাকে যখন বললাম- কিডনি তো নষ্ট হয়েই আছে, শুনে দুটো চমচমকে মুখে টেনে নিল, ১টা পারসেল নিল অটোচালকের জন্য।
দীর্ঘ পথ ভ্রমণে ফরহাদ শোনালো ডালডামিশ্রিত রুটিগল্প।
‘তোমাকে আমাদের ক্লাসমেটদের সবাই পাগল বলে, কেউ পছন্দ করে না, মিশতেও চায় না। কিন্তু আমি তোমার সঙ্গ পছন্দ করি’
আমার জবাবে সে নিজেই রূপান্তরিত হলো কোলাব্যাঙের খসখসে ত্বকে
‘তোমার থেকে যদি আমের মোরব্বা কিনতো জায়েদ খান, তুমি তাকেও নিজের আইডল ঘোষণা করতে। আমার একমাত্র কৃতিত্ব আমের মোরব্বা কেনা’
পোদ্দার বাড়ি পৌঁছে দেখি এলাকাজুড়ে ব্যাপক খেজুরায়ন করেছে জেলা প্রশাসক। খেচুরের চারা রোপণ করে দেয়া হয়েছে লাল রঙের ঘেরবেড়া৷ সারি সারি লালটে ঘেরবেড়ায় ঘাসের উপরে ধ্যানমগ্নতার ভেকধারী আমি। মানিকগঞ্জে নাকি রাসেল ভাইপারের উপদ্রব বেড়েছে, প্রাণবিয়োগ ঘটেছে ৬ জনের। ঘাস দেখে ভয়ার্ত ফরহাদ আমায় রাসেল ভাইপারকে স্মরণ করালে থামিয়ে দিই- ‘মোরব্বার টাকা পেয়ে গেছ, আমায় দংশন করলো রাসেল ভাইপার নাকি সপ্তমী, does it matter any more’?
ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকানো ফরহাদ ফোন করে স্ত্রীকে- ‘তুমি না মাস্টার্স করেছ, ডাজ ইট ম্যাটার এনিমোর, এর বাংলা বলতে পারো’?
পোদ্দার বাড়ির ইতিহাস জানলাম৷ পোদ্দার ছিলেন একজন জমিদার। তার বাড়ির সামনের অংশটিকে বানানো হয়েছে ভূমি অফিস। পরিত্যক্ত ভবনে বসবাস করে আশ্রয়হীন কয়েক পরিবার, ভবনে লাগোয়া দীর্ঘাকৃতির পুকুর৷
ফরহাদের কাছে চাওয়া ছিল মোরব্বার বিনিময়ে কয়েকজন ক্যারেক্টার৷ সে ডেকে আনলো তার বন্ধু শামীমকে।
শামীমের সাথে গল্প করছি, দেখি পোদ্দার বাড়ির চৌহদ্দিতে ফুটবল খেলছে স্থানীয় কিশোর দল৷ ফরহাদকে বললাম- আমাকে যদি ১৩ জন মানুষ চিনে ১২ জনই জানে আম খাই না, সেই ১২ জনের ১ জন তুমি, তবু নিজের আচার ব্যবসা জমানোর লোভে আমায় মোরব্বা গছিয়ে দিয়েছো। সমস্ত মোরব্বা ওই ফুটবলপ্রেমি বাচ্চাদের মধ্যে বিতরণ কর’
শামীম জানালো ঝিটকায় প্রতি ২০ মিটার রেডিয়াসে মাজার। তার বাইকে চেপে রওয়ানা হলাম জিন্দা শাহ এর মাজারে। শুনলাম এই মাজারের যিনি পত্তন করেছিলেন, তার কাছে একবার এক মৃত ব্যক্তিকে আনা হয়েছিল, তিনি দোয়ার মাধ্যমে জীবিত করেন। সেই থেকে তিনি জিন্দা শাহ। প্রতি বছর ওরশ হয়, প্রচুর জমায়েত। মাজারের হতশ্রী দেখে অবশ্য খটকা রয়েই গেল।
শামীম রড-সিমেন্টের ব্যবসা করে। বয়স অনুযায়ী এখনো তরুণ লাগে। মনে মনে ভাবলাম- একটা মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করা দরকার, যেখানে শামীম হবে মডেল৷ শামীমের বাইকে ঝিটকা বাজারমুখে পৌঁছানোকালীন চোখে পড়লো আরো ৪ খানা মাজার।
গরুর দুধের চায়ে আপ্যায়ন করাকালীন জানলাম শামীমের জীবনের লক্ষ্য মনের সুখ অর্জন। কী ঘটলে মনের সুখ অর্জিত হয়েছে বুঝতে পারবে, জিজ্ঞাসায়, পেলাম না সদুত্তর।
শামীম অটো রিকশা ভাড়া করে দেয়, গন্তব্য মহাদেবপুর, বাহের পাগলার মাজার। শৈশব থেকে বাহের পাগলাকে ঘিরে নানা মিথ শুনে বড় হয়েছি৷ অটোচালক সিগারেটের ধোয়ায় হারিয়ে ফেলে পথ, বাহের পাগলার মাজার ফেলে এসেছে অনেকটা পেছনে। আমরা নামি মহাদেবপুর বাজারে।
আকৃষ্ট হলাম সেলুনের সেট আপ এ। নাপিতের আলাপে ফিরে এলেন বাহের পাগলা।
‘উনি বাঁইচা থাকতে সবসময় আমিই যাইয়া চুল কাটতাম। শেষবার যখন গেলাম আমারে কয় আমি আর থাকুম না রে৷ ভাবলাম আস্তানা সরাইয়া নিবে। পরদিন থিকা খাতায় লেখা শুরু করলো, ২ দিন ধইরা লিখছে। তারপর একবার উইঠা দাঁড়ায় একবার বসে, এমনি উঠাবসা করতে করতে একদিকে কাত হইয়া পইড়া গেল’
কৌতূহলবশত জানতে চাই খাতায় লেখার কারণ
‘এইটাই উনার তরিকা আছিল৷ সারাদিন খাতায় লিখত৷ ওইভাবে লিখাই হাজার হাজার মানুষের রোগ সারাইছে। না দেখলে বিশ্বাস করবো না কেউ’
সেলুন শেষে সিএনজিযোগে তরা। এক দশক আগেও ঈদের সময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাসের দীর্ঘ জ্যাম তৈরি হত। আরিচা থেকে সেই লাইন এসে ঠেকত বানিয়াজুরি অবধি। প্রতি বছর বহু লোক ঈদের নামায পড়ত রাস্তাতেই। ঈদের আগের সন্ধ্যায় সেই রাস্তায় নি:সীম নীরবতা। বাসের চলাচল অতি সীমিত, দেখা মেলে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে৷ একটা জনপদের গল্প এভাবেই বদলে যায়। উনিশ-তেইশ যখন পরিণত বয়সে পৌঁছবে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক সবটাই ওদের জগতে মিথ!
তরা নেমে রিকশা আগায় তরা বাজারপানে৷ ফরহাদ যোগাড় করে রেখেছে ক্যারেক্টার। রাত্রির রিকশা রাস্তায় মনে পড়লো স্কুলবন্ধু গালিসম্রাট জাহাঙ্গীরকে। তার বাড়ি গুলাটিয়া গ্রামে। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন বাবা। সকালে স্কুলপাঠীদের কয়েকজন গিয়েছিল দেখা করতে। মানুষের জন্ম-মৃত্যু-বৈধ যৌনতার উপলক্ষগুলোতে করণীয় ঠাহর করতে পারি না বিধায়, সাধারণত এগুলো এড়িয়ে চলি।
তরা বাজারে অপেক্ষার পরেও পাওয়া গেল না ক্যারেক্টার। ১০টাকা খরচে একটা বাজারের ব্যাগ কিনলাম৷ ফরহাদের বসা রিকশাটাকে মনে হলো সিংহাসন, একটা মুকুট দরকার। প্লাস্টিকের ব্যাগটাই পরানো হলো মুকুটরূপে৷
রিকশা ছেড়ে দিচ্ছে, এলো ফরহাদের নির্দিষ্ট ক্যারেক্টার। তার মোবাইল, বাইকের চাবি পতিত হয়েছে কমোডে। জমাদার খুঁজছে। ফরহাদ শ্লেষাত্মক ব্যঙ্গ করলো আমায়- ‘তোমার ফোনে একজনও মেথরের নম্বর নাই, দরকারের সময়ই যদি না পাওয়া গেল, এত মানুষের গল্প শুইনা করলা টা কী জীবনে’
তরা থেকে ম্যাক্সিযোগে প্রথমে যেতে হবে পল্লীবিদ্যুৎ পর্যন্ত। এরপরে অটো। ম্যাক্সিতে ঠেসাঠেসি করে বসতে যাব, আবিষ্কৃত হলো সিট ভাঙা৷ অন্য পাশে বসলাম। পরের স্টেশনে উঠা নারী যাত্রীর ভাগ্য ফেভারে ছিল না, ভাঙা সিট তাকে খানিকটা ব্যথা দিল শরীরে, হেলপারের সঙ্গে শুরু হলো ঝগড়া। তার পরিচিত এক পুলিশের পোস্টিং মানিকগঞ্জ সদর থানায়। বাস স্ট্যান্ডে ম্যাক্সি থামবার পরে হয়ত ক্ষমতার চোটপাট প্রদর্শিত হবে।
নতুন অটোতে গুলাটিয়া বাজারগামী যাত্রা, সেখানে অপেক্ষারত গালিসম্রাট জাহাঙ্গীর। চা খাচ্ছি মনে পড়লো হাবুকে।
হাবু জাহাঙ্গীরের এলাকাতো বন্ধু। গান-বাজনার লোক। গত ঈদে তাকে একটা জারিগানের লিরিক দিয়েছিলাম৷ সপ্তমীর সঙ্গে ইডেনে দেখা হওয়া উপলক্ষে রংপুরের বিখ্যাত ‘ফুলমালা’ জারির সুরে লিখেছিলাম
কন্যার হাসিতে বাঁশি ইডেনের গ্যালারি
দৃষ্টি দিয়াই ৯০০ মাইল ক্ষয় হইলো ক্যালরি
আবেগ ছাইড়া আবেগ ধইরা আবেগ রোগে কন্যা ভুগতাছে
এক ঈদ শেষে চলে এলো নতুন ঈদ। হাবুর গান তবু আসে না৷ স্মরণ করলাম তাকে। অন্য একজনের বাইক যোগাড় করে চলে এলো দ্রুত। গানের বায়না দেয়া হলো। প্রতিশ্রুতি পেলাম প্রাপ্তির। হাবুর সঙ্গে এসেছে তার সারিন্দা একজন।
যে অটোতে এসেছিলাম সে-ই ডাউটিয়া বাজার আর ভাটবর হয়ে পৌঁছে দিবে মানিকগঞ্জে৷ কিন্তু ডাউটিয়া বাজারে তার কথা এবং কর্ম গেল বদলে৷ সম্ভবত আমাদের সে ভেবেছিল অন্য জেলার পর্যটক৷ নতুন অটোতে যাচ্ছি। পথিমধ্যে অটোচালক তুলে নিল তার পরিচিত ২ যাত্রী। দাদা এবং শিশু নাতি। দৃশ্যটা সিম্বলিক।
রিকশাযোগে ফিরতে হবে ঘরে। নামবার পরে মুখোমুখি বাসাটায় নজর পড়লো৷ ছেলেবেলায় কৃষ্ণকলির প্রতি সিরিয়াসনেস দেখালে ওই বাসাটায় পরিণত বয়সে যাতায়াত বাড়ত। তাতে কী: কৃষ্ণকলি তো আছেই বাসায়। বাসার সামনের চায়ের দোকানে একত্রে রং চা খাওয়া যায়, গল্পটা মেটাফরিকাল হবে। ফোন করা হলো, ২ বার, কৃষ্ণকলি রূপায়িত হয়েছে কাল্পনিক ক্যারেক্টারে। ফরহাদ জনি জার্নির শুরুতে ঠিকই বলেছিল- ‘তোমাকে কেউ পছন্দ করে না, সবার চোখে তুমি উৎপাত, বদ্ধ পাগল’
দোকান, চা, মানিব্যাগ, ইচ্ছা সবই যেহেতু বর্তমান, সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে কেন বিরতি নিতে হবে চা-পানে।
সুতরাংং শুরু হোক একাকী চা-ভোজন পর্ব৷ ফেলে আসা চায়ের স্মৃতি নিয়ে বাসার গেটে ঢুকবার মুহূর্তে পিলারে বাঁধা গরুর দিকে তাকালাম৷ মীনা এবং রাজু বোধহয় একে দেখেই নামকরণ করেছিল- লালি!