অভিযোগ শুনতে পাই দুদিক থেকেই। লক্ষাধিক বেকার জনগোষ্ঠী কোম্পানীগুলোকে দোষারোপ করে নেপোটিজম, দুর্নীতি আর অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেয়ার কারণে। তাদের কথা, সবাই শুধু অভিজ্ঞতা খুঁজলে ফ্রেশাররা যাবে কোথায়, কিংবা মামা-চাচা না থাকলে চাকরিরও আশা নেই। একটা উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী দিনের পর দিন বসে থাকে কেবল সরকারি চাকরির আশায়। কিছুদিন পূর্বে এক অনলাইন পোর্টালে পড়েছিলাম, বেকার গোষ্ঠী চাকরিতে আবেদনে যে পরিমাণ টাকা খরচ করে সেটা নাকি আমাদের রাজস্ব অর্থনীতির তৃতীয় বা চতুর্থ বৃহত্তম খাত। জানি না এটা ফ্যাক্ট, নাকি স্যাটায়ার- তবে আমার ধারণা ওই প্রতিবেদনটি একেবারে উড়িয়ে দেয়ার নয়।

অন্যদিকে বিগত ৯ বছরে বেসরকারি খাতের বহু উদ্যোক্তার সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে। তাদের কমন অভিযোগ নেয়ার মতো লোক পাচ্ছেন না; হাজার হাজার সিভি জমা পড়ে কিন্তু একজনকেও পছন্দ হয় না। অবধারিত প্রশ্ন আসে, পছন্দ হয় না কেন, ঘাটতিটা কিসের? উত্তর অবশ্য অভিন্ন আসে না। গ্রাজুয়েশন করেছে অথচ গ্রাজুয়েট/কলিগ বানান ইংরেজিতে লিখতে ভুল করে, নিজের সিভিটাও নিজে লিখে না, কোন্ পোস্টে আবেদন করেছে তাও জানে না, কোনোরকম ম্যানার জানে না, ন্যূনতম স্কিলটুকুও নেই।

উদ্যোক্তাদের এইসব অভিযোগ শোনার পর সম্পূরক প্রশ্ন করি, তাহলে যাদের নিয়ে কাজ করছেন তাদের কোয়ালিটি নিয়ে আপনার মনোভাব কী। এই প্রশ্ন যতজনকেই করা হোক উত্তরে হেরফের সামান্য। তাদের বক্তব্য হলো, কর্মীদের মধ্যে শেখার সামান্যতম আগ্রহ নেই, প্রফেশনাল এথিক্সের বালাই নেই, ৫০০ টাকা বেশি বেতন পেলেই বিনা নোটিশে চাকরি ছেড়ে দেয়, ঔনারশিপ ফিলিংস নেই কোনোরকম।

পক্ষান্তরে, জীবনে ১৩৪৪ জন মানুষের চাকরির ইন্টারভিউ নেয়াসূত্রে জেনেছি, একজন কর্মী যখন চাকরি ছাড়ে কোম্পানী ম্যানেজমেন্ট খুবই খারাপ হয়ে যায়, অতিরিক্ত খাটায়, ছুটি দেয় না, এক মাসের বেতন অন্য মাসে দেয়, চাকরির শুরুতে যে কমিটমেন্ট দিয়েছিলো সেটা রাখেনি, এবং এদের বেশিরভাগই পারিবারিক কারণে চাকরি ছেড়ে দেয় (যদিও আমার ধারণা চাকরি আসলে চলে যায়, সেটা স্বীকার করার সততায় ঘাটতি থাকে)। বর্তমান চাকরি কেন ছাড়ছেন, এই প্রশ্নের বেশিরভাগ উত্তরই পাওয়া যায়, সবাই তো বেটার অপরটুনিটি খোঁজে।

যদি সম্পূরক প্রশ্ন করা হয়, বেটার আসলে কতটা বেটার? কত টাকার বেতনের চাকরি হলে মনে হবে অন্য কোথায় পরবর্তী ৩ বছরের মধ্যে সিভি ড্রপ করবো না, এর সদুত্তর মেলে কদাচিৎ।

এতোক্ষণ ফ্যাক্ট এবং ফিগার বিষয়ে কথা বললাম, যেখান থেকে খুব সহজেই অনুসিদ্ধান্ত আসা যায় বাংলাদেশের চাকরি বাজার, বিশেষত বেসরকারি খাতে, খুবই অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে আগাচ্ছে এবং এমপ্লোয়ি-এমপ্লোয়ারদের মধ্যে অমোচনীয় আস্থার সংকট রয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধান করলে কমপক্ষে ১৭টি কারণ পাওয়া যাবে, যেগুলোর কোনোটাই ফেলনা নয়, ফ্যাবুলাসও নয়। সেইসমস্ত কারণ নিয়ে গো+এষণা করলে গরু খোঁজাখুঁজিতেই সময় ব্যাপিত হবে, মূল প্রেক্ষাপট রয়ে যাবে বোধের বিপরীতে অবোধ্য কোথাও।

এবার তবে ফিকশন এবং ফিউশনে দৃষ্টিপাত করি যা ভাবনাকে তরতাজা করতে পারে।

দৃষ্টিপাতের ফলস্বরূপ, একটিমাত্র কারণ আবিষ্কার করেছি যা এই ঐতিহাসিক অচলাবস্থার জন্য দায়ী। তা হলো, অর্বাচীন রিক্রুটমেন্ট কালচার।

মনে হতেই পারে, এ আর কী এমন আলাদা কথা বলেছি; রিক্রুটমেন্ট পলিসি ত্রুটিপূর্ণ এটা তো সকলেরই জানা। কিন্তু চাকরি না হওয়া এবং কাঙ্ক্ষিত কর্মী না পাওয়ার জন্য রিক্রুটমেন্ট পলিসি দায়ী হয় কীভাবে? খেয়াল করে দেখুন, আমি বলছি ‘কালচার’, আপনি ২বারই ‘পলিসি’ শব্দটা ব্যবহার করলেন। সমস্যাটা এখানেই।

অনেকেই বলেন বিজনেস নির্ভর করে তিন ‘আই’ য়ের উপর- idea, investment, innovation; এর সাথে দ্বিমত করি না, তবে এগুলোকে বরাবরই ২য় বা ৩য় স্তরে রাখি, গ্রেট বিজনেস দাঁড়িয়ে থাকে তিনটি H এর উপর- Hiring, Healing, Having

শীর্ষে যেহেতু ‘হায়ারিং’, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ‘হায়ারিং’ এর গুরুত্ব বাকি দুই ‘এইচ’ এর চাইতেও বহুলাংশে বেশি। আপনার আইডিয়া, ইনভেস্টমেন্ট, ইনভেনশন/ইনোভেশন আছে, কিন্তু ভুল কাজের জন্য ভুল মানুষকে হায়ার করেছেন, কোনোকিছু্ই পরিকল্পনামাফিক কাজ করবে না। গুগল, মাইক্রোসফট, এ্যাপল বা ইন্টেল- কোম্পানীর নাম যা-ই হোক, বিজনেস ফিল্ড যা-ই হোক, তাদের বিজনেস কেইস নিয়ে যদি পর্যাপ্ত পড়াশোনা করেন দেখবেন তারা ১ নম্বর প্রায়োরিটি দেয় সঠিক হায়ারিংয়ে। একজন উদ্যোক্তা নিশ্চয়ই মাইক্রোম্যানেজিংয়ে তার মেধা, সময় খরচ করবেন না; তার হয়ে কাজ করার ভার নিবে কেউ না কেউ। কিন্তু সেই মানুষগুলো যদি ভুল চয়েজ হয়, এর চাইতে বেশি ক্ষতির কী হতে পারে আর!

নিজের ভালো তো পাগলও বোঝে, যারা বিজনেস করে তারা কি বোঝে না? তারা হায়ারিংকে এতো অগুরুত্বপূর্ণ মনে করে কেন; ব্যাপারটা দ্বিধাগ্রস্ত লাগে না?

দ্বিধাকে উস্কে দিতে আরো প্রশ্ন করি একটা। মানুষ আসলে কী; টুলস নাকি কনটেন্ট? যদি বলেন উভয়ই, এটা চরম এমেচারের মতো উত্তর। ধরা যাক, একজন মানুষ ভালো বক্তব্য দিতে পারে, এটা তার স্কিল। এই স্কিলগুলো যেভাবে সে রপ্ত করে- যেমন নার্ভাস না হওয়া, মানুষের সাথে সহজে কমিউনিকেট করতে পারা, পড়াশোনা করা বা ভিডিও দেখা- প্রতিটি বৈশিষ্ট্য বা প্রক্রিয়াই একেকটি স্বতন্ত্র টুলস। পক্ষান্তরে তিনি যে বক্তব্যটি দেন, সেটি তার কনটেন্ট। মানুষ চিন্তা করে, মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, মানুষ কল্পনা করে- এগুলো তার কনটেন্ট, কিন্তু সে চিন্তা করে প্লেন উদ্ভাবন করলো, কাউকে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নিলো- এইসব প্রায়োগিক রূপায়ণ হলো টুলস।

কনটেন্ট যদি উৎকৃষ্ট হয়, টুলস খুব বেশি ম্যাটার করে না, বেশিরভাগ সময় টুলসও উতরে যায়। কিন্তু কনটেন্ট খারাপ হলে, টুলসের উৎকৃষ্ট হবার কোনোরকম সম্ভাবনাই নেই।

মানুষ তাই পুরোমাত্রায় কনটেন্ট, কিন্তু আমরা মোহাবিষ্ট থাকি টুলসের প্রতি। যার প্রভাব পড়ে আমাদের নিয়োগসিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও।
আমরা স্কিলড কর্মী খুঁজি, যে কারণে ধরে নিই পূর্বাভিজ্ঞতা থাকা স্কিলের পূর্বশর্ত। স্কিল একটি ওভাররেটেড বিষয়, স্কিল তৈরি করে নেয়া যায়। কিন্তু আগ্রহ, উৎসাহ, কৌতূহল এগুলো মানুষের মৌলিক প্রবণতা। এগুলো থাকলে যে কোনো এমেচার মানুষকেও স্কিলড বানিয়ে ফেলা যায়, পক্ষান্তরে এগুলো না থাকলে সেই স্কিলও একটা নির্দিষ্ট সময় পরে স্থবির হয়ে পড়ে। কোন্ বলে কোন্ শট খেলতে হয় এটা প্রায় সব ব্যাটসম্যানই জানে, তবু কেউ ভিরাট কোহলি হয়, কেউ হয় ইমরুল কায়েস। পার্থক্যটা কিসে?

আগ্রহ, উৎসাহ, কৌতূহল বোঝার উপায় কী? এর চাইতেও আগে জানা দরকার, আমাদের অধিকাংশ কোম্পানীতে যে ধরনের রিক্রুটমেন্ট প্রসেস প্রচলিত তাতে কি এই ৩টি যোগ্যতা বোঝার সূক্ষ্ম কোনো প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়? নির্দ্বিধায় ‘না’ বলা যায়।

কেন নেই, স্কিলের প্রতি এতো ফ্যাসিনেশনের উৎসই বা কী?
বাংলাদেশের অধিকাংশ স্মল এবং মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ অতিমাত্রায় মালিকনির্ভর, বড়ো কোম্পানীগুলো আমলাতান্ত্রিকতাপূর্ণ। মালিকনির্ভরতা অনেকটা মুদি দোকানী পর্যায়ের, প্রধান উদ্যোক্তাই বিজনেস ডেভেলপ করবে, সে-ই মার্কেটিং দেখবে, তার দরকার কেবল কয়েকজন কামলা যারা অন্ধ অনুসরণে সক্ষম এবং সকালে-বিকালে মালিকতোষণে সিদ্ধহস্ত।
যেহেতু বিজনেস প্রায় পুরোটাই মালিকনির্ভর, পরম্পরা রক্ষার কোনো ইকোসিস্টেম গড়ে উঠে না, মালিক মারা গেলে বিজনেসও বন্ধ। এই অবস্থায় মালিকের প্রয়োজন বিশ্বস্ত অনুচর, তার বিজনেস কত বড়ো হতে পারে এর চাইতে বিজনেস থেকে নগদ কত টাকা আসছে সেটাই বড়ো প্রশ্ন হয়ে উঠে। ফলে বাংলাদেশের কোম্পানীগুলো গ্রেট বিজনেস স্তরে উঠতে পারে না, আবার ধ্বসেও পড়ে না; এক অদ্ভুত মিডিওক্রিটি রোগ বহন আর ধারণ করে টিকে থাকে।

উচ্চবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে অন্ধ অনুসরণ করা সম্ভব নয়, প্রসেস বা সিস্টেমের গলদ চোখে পড়লে সে মানসিক অসহিষ্ণুতায় ভুগে, কিন্তু কর্মীর এই সাহসিকতায় মালিক নিজেকে গুরুত্বহীন ভেবে বসে, নিজের পজিশন ভুলে কর্মীর সাথে সে অদৃশ্য মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু অনুচর প্রকৃতির কর্মী তাকে উঠতে-বসতে ‘স্যার স্যার’ বলবে, যা তাকে সামন্তপ্রভুর সন্তুষ্টি উপহার দিবে। এর মূল্য বিজনেস গ্রোথের চাইতেও অনেকটাই বেশি।

কিন্তু এই চরম সত্য মেনে নেয়ার সাহস-শক্তি মালিকপক্ষের থাকে না। তারা ঢাল হিসেবে সামনে এনে ‘স্কিল’ কে, তাদের যুক্তি হলো স্কিলড লোক হলে সে খুব দ্রুত আউটপুট দিবে, নরমাল কর্মী নিলে তার পেছনে ৩-৪ মাস ইনভেস্ট করতে হবে; অত সময়-সাধ্য নেই আমার।

যদি জিজ্ঞেস করা হয়, স্কিল বলতে কী বোঝেন, তারা বলবে যে কাজটা করার জন্য তাকে নেয়া হয়েছে সেটা যেন ভালোমতো করতে পারে, এটার জন্য অভিজ্ঞতা থাকা জরুরী। অথচ প্রত্যেক কোম্পানীর নিজস্ব কালচার থাকা উচিত। ধরা যাক, দুটো কোম্পানীর প্রোডাক্ট অভিন্ন- বদনা, কিংবা সার্ভিস অভিন্ন- আউটসোর্সিং। তবু বদনা বানানো দুই কোম্পানীর মধ্যে বিশাল প্রভেদ থাকবে, আউটসোর্সিং কোম্পানীদ্বয়ের মধ্যেও থাকা উচিত প্রভেদ। প্রভেদ হবে কোম্পানীর কোর ভ্যালু, প্র্যাকটিস, সিস্টেম, কালচার এ। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলো, বাংলাদেশের কোম্পানীগুলোতে কেবল নামটাই আলাদা, বাকি সবকিছু প্রায় একইরকম। ফলে ওয়াই গ্রুপ আর জেড গ্রুপে মাত্রাগত কোনো পার্থক্য আমরা আবিষ্কারে অসমর্থ হই।

এতোটাই চিন্তাবন্ধ্যাত্ব চলে।

কোম্পানীগুলোর এইচআর প্র্যাকটিস কীরকম? ট্যালেন্ট নারচারিং শব্দটার সাথে বাংলাদেশের কতগুলো কোম্পানী পরিচিত, কিংবা সাকসেসন ম্যানেজমেন্ট বা ভবিষ্যৎ কর্মসারথী তৈরি (পরম্পরা রক্ষা) কনসেপ্টটারই বা চর্চা কেমন? ট্যালেন্ট ম্যানেজমেন্ট নামে কেতাবি এক শব্দ আছে এইচআর ম্যানুয়ালে, কিন্তু তার আউটলাইন কেমন হওয়া উচিত সে সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট চিন্তা আছে কি আদৌ?

এইচআর নামে আলাদা কোনো ডিপার্টমেন্টই থাকার কথা নয়। কোম্পানীতে কাজ করা প্রতিটি মানুষই হিউম্যান রিসোর্স। এইচআরএম একটা ডিপার্টমেন্ট হতে পারে। কিন্তু সেই ডিপার্টমেন্টের কাজ কী? লেবার ল সম্বন্ধে কতটুকু জানা আছে তা যাচাই করা, স্যালারি আর এটেনডেন্স শিট দেখা, বছর শেষে ইনক্রিমেন্ট, প্রমোশন প্রভৃতি নিয়ে কাজ করা, রিক্রুট করা। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কিসের ভিত্তিতে পারফরম্যান্স এপ্রাইসাল করা হয়, বুকিশ কিছু টুলস এর নাম উঠে আসবে, যেখানে ক্রিয়েটিভিটির অভাব প্রকট।

মালিকপক্ষও বিষয়গুলো বুঝে, যে কারণে বহু কোম্পানীতেই এইচআরএম কে সেভাবে মূল্যায়নই করা হয় না। অথচ এটা হওয়া উচিত কোম্পানীর মস্তিষ্ক (মার্কেটিং হার্ট, সেলস ফুসফুস, একাউন্টস কিডনি, সাপ্লাই চেইন লিভার)। এই ইন্টারপ্রেটেশনের ইন্টারেস্টিং দিক হলো, মাথা খাটানোতে আমাদের গড় বাঙালিদের অনীহা; আমরা কেবল শর্টকাট আর চিপাবুদ্ধি আবিষ্কারে খরচ করি, ফলে মাথা আমাদের কাছে বারডেন মনে হয়; আমরা বরং পানি খেলে কিডনি ভালো থাকে, ধূমপান করলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, লবণ হার্টের জন্য হুমকিস্বরূপ প্রভৃতি তত্ত্বের চর্চা করি। কিন্তু মাথার যত্ন কীভাবে নিতে হয়, আজ পর্যন্ত কোনো আলোচনা-পর্যালোচনা শোনা গেলো না।

যে কারণে হায়ারিং একটা রুটিনওয়ার্কের বাইরে কিছু নয়। এর লেভেল অব এক্সিলেন্স নিয়েও গবেষণার প্রয়োজন কম বোধ করা হয় হরদম। সিভি দেখা হয় গৎবাঁধা কিছু নির্দেশনা মোতাবেক। কয়েকটা প্যারামিটার সেট করা থাকে- শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, রেসপনসিবিলিটিস, জব সুইচিং টেন্ডেন্সি, এগুলোই তো? এর ভিত্তিতে একটা শর্টলিস্ট হবে, লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাকা হবে, সেখান থেকে উত্তীর্ণদের নিয়ে মৌখিক পরীক্ষা বা ভাইভা, স্যালারি নেগোশিয়েশন; এই তো?

কিংবা কয়েকটা এমএনসি গ্রুপ ডিসকাসনের আয়োজন করে। সেখানে প্রার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে কেইস দেয়া হয়, সেই কেইস সমাধান করে প্রেজেন্টেশন দিতে হয়, তার ভিত্তিতে শর্টলিস্ট এবং ইন্টারভিউ। ফলে এক্সট্রোভার্ট প্রকৃতির মানুষগুলো ফটরফটর করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয়, ডিপ থিংকার বা ইন্ট্রোভার্টরা অসহায়ত্বজনিত কারণে বেকুবের মতো বসে থাকে। গ্রুপের মধ্যে কোম্পানীর নিজেদের লোক বসে থাকে ছদ্মবেশে, তারা প্রার্থীদের এটিচুড পর্যবেক্ষণ করে। এটা প্রার্থীরাও কম-বেশি অবগত থাকে, যে কারণে তারাও এক ধরনের এক্টিংয়ের মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত করে।

উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় একজন কর্মীর ব্যক্তিমানস বোঝার উপায় কী? যদি সেটা না থাকে তাহলে সঠিক হায়ারিংয়ের সম্ভাবনা কতটুকু?

জব রিসার্স কি হয় আদৌ? এ নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। যেমন, কোন পোস্টের জন্য কোন্ বৈশিষ্ট্যের মানুষকে প্রাধান্য দেয়া হবে সে সংক্রান্ত কোনো গভীর পর্যালোচনা? যদি আমি জব ন্যাচারই না বুঝি, সেখানে যাকে ফিট করছি তার কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে কিনা তা বুঝবো কীভাবে? কিছু পোস্ট প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির মানুষ ডিমান্ড করে, কিছু পোস্ট এক্সট্রোভার্ট, কিছু পোস্ট এম্বিভার্ট। আমাদের প্রায় সবারই ভুল ধারণা আছে, সেলস এ কাজ করতে হলে গুছিয়ে কথা বলার যোগ্যতা থাকতে হবে, অথচ বলার চাইতে শোনার যোগ্যতা দিয়েই বেশি সেলস করা যায়, এটা ডাটা দেখেই বুঝতে পারবেন। কারণ আপনি যখন কারো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন সে নিজেকে সুপেরিয়র পজিশনে ভাবতে শুরু করবে, তাকে প্রায়োরিটি দেয়া হবে, তার লিডে কনভার্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে বহুগুণ। কিন্তু আপনি গিয়ে তার সাথে পাল্লা দিয়ে কথা বলা শুরু করলেন, আপনার প্রতি তার বিশেষ কোনো ইমপ্রেসনই তৈরি হবে না।

জব রিসার্স না থাকার একটা প্রধান কারণ, অধিকাংশ সময় মালিকপক্ষের জানাই থাকে না একজন কর্মীর কাছ থেকে তার এক্সাক্ট প্রত্যাশাটা কী; তারা কেবল পারফরম্যান্স চায়। কিন্তু পারফরম্যান্স বলতে কী বুঝেন এটা জিজ্ঞেস করলেও থতমত খেতে হবে।

১৩৪৪ জন মানুষের চাকরির ইন্টারভিউ নিলেও জীবনে কখনোই কারো সিভি দেখিনি। আমার ফিলোসফি খুবই সরল- make the entry so tough that the exit becomes the toughest
সিভি দেখার পরিবর্তে আমি গ্রুপ ইন্টারভিউ করি। ১০, ২০, ৩০ সংখ্যাটা যতো বড়োই হোক, সকল প্রার্থী একত্রে বসে। তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করি; বেশিরভাগই অগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন- ব্যাঙের সাথে কচ্ছপের শত্রুতার হেতু কী হতে পারে, ক্লাস ফাইভে আপনি কয়টা প্রাইভেট পড়তেন, মিঠুন চক্রবর্তী লোকটাকে নিয়ে এতো মাতামাতির কারণ কী। এর সঙ্গে প্রচুর হিউমারচর্চা করা হয়, যে কারণে অচিরেই একটা আনকনভেনশনাল পরিবেশ তৈরি হয়, এর মাঝেই হুট করে প্রশ্ন করে বসি- আপনার আগের অফিসের কলিগের ফোন নম্বর আছে? এইসকল ইন্টারেকশনের মাধ্যমে খুব সহজেই এক্সট্রোভার্ট আর ইন্ট্রোভার্টকে আলাদা করে ফেলা যায়। তারপর ইন্ট্রোভার্টদের বেশি বেশি প্রশ্ন করা হয়, বোঝার চেষ্টা করি সে পর্যবেক্ষণপ্রিয় নাকি নার্ভাস। এক পর্যায়ে প্রত্যেককে ৭ পৃষ্ঠা বায়োগ্রাফি লিখতে দিই। আমার ৩০০০+ মানুষের বায়োগ্রাফি পড়ার ক্ষেত্রে ইন্টারভিউয়ের বায়োগ্রাফিগুলোর বড়ো অবদান রয়েছে।

অনেকেই মন্তব্য করে, যে ব্যক্তি চাকরি করতে এসেছে সে কি বায়োগ্রাফিতে সত্যি কথা লিখবে? কিংবা যার লেখালিখির অভ্যাস নেই তাকে কি বায়োগ্রাফি লেখা দিয়ে যাচাই করা সম্ভব? যাদের লেখার ক্ষেত্রে সমস্যা তারা ১৭ মিনিট অডিও রেকর্ড করে দেয়। এখান থেকে কোনো তথ্য নেয়া হয় না, আদতে প্রবণতা লক্ষ্য করা হয়। বায়োগ্রাফি লেখাটাকে কে কীভাবে নিচ্ছে সেটা দিয়েও পারসোনালিটি প্যাটার্ন বোঝা যায়। মিডিওকর মানুষেরা শুরুতে লিখতে গাইগুই করে, পরে লেখা শুরু করলে দেখা যায় প্রচুর লিখে ফেলেছে এবং এক পর্যায়ে বলে অনেক কিছুই বাদ পড়ে গেছে। ফাঁকিবাজ প্রকৃতির মানুষেরা কোনোভাবেই লেখা শেষ করতে পারে না। আর গভীর চিন্তাধারার মানুষেরা বায়োগ্রাফি ধারণার সাথেই একমত না হয়ে শুরুতে ইন্টেলেকচুয়াল ডিবেট করে, তারপর ২-৩ পৃষ্ঠা লিখে জমা দিয়ে দেয়; সেই লেখার মধ্যেও এমন কিছু উপাদান থাকে যা আপনাকে ভিন্ন কিছু ভাবতে বাধ্য করবে।

বায়োগ্রাফির পরের ধাপ মেন্টাল এটাচমেন্ট। স্যালারি নিয়ে আমি কখনোই নেগোশিয়েট করি না। একটা মিনিমাম এবং ম্যাক্মিমাম লিমিট সেট করা থাকে যা প্রার্থীরা অবগত থাকে। এরপর তাকে ২ থেকে ৩টি এসাইনমেন্ট জমা দিতে বলা হয়, যার জন্য তাকে আরো ২-৩ বার অফিসে আসতে হয়। ফলে চাকরিতে নিয়োগের পূর্বেই কোম্পানীর প্রতি তার এক মেন্টাল এটাচমেন্ট এবং এলাইনমেন্ট তৈরি হয়ে যায়।
প্রার্থীকে বলা হয়, এই এসাইনমেন্টগুলোর গ্রেডিং করা হবে। সবগুলো এসাইনমেন্টের গ্রেড নিয়ে যে সিজিপিএ আসবে তার ভিত্তিতে স্যালারি। সিজিপিএ ৩ এর কম হলে নিয়োগ দেয়া হবে না। ৩-৩.১ পর্যন্ত এক বেতন, ৩.১১-৩.২০ পর্যন্ত অন্য বেতন; ফলে একই পজিশনে একাধিক ব্যক্তি কাজ করলেও সিজিপিএ এর পার্থক্যের কারণে বেতনেও হেরফের হয়; সমগ্র প্র্রক্রিয়াটিই তাই স্পোর্টিং থাকে।

প্রশ্ন হতে পারে, এতোবার ঘোরার মতো এনার্জি সবার থাকে কিনা? ‘সবার’ শব্দটাই তো ভুয়া। একটা পোস্টে ভ্যাকেন্সি থাকে কয়টি? সর্বোচ্চ ৩-৪টাই তো। অথচ, সিভি জমা পড়ে কতগুলো? সেখান থেকে মাত্র ৩-৪ জন মানুষ পাওয়া যাবে না যার মধ্যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহস আছে, লেগে থাকার তীব্র ধৈর্য আছে; তাও হয় নাকি?

মনে পড়ে একবার এক তরুণকে এসাইনমেন্ট দিয়েছিলাম, ঢাকা শহরের কোন্ রুট থেকে কোন কোন বাস ছাড়ে তার তালিকা, ভাড়া এবং প্রতিটি কোম্পানীর বাসে অন্তত ১ বার উঠে তার হেলপারের চরিত্র সম্বন্ধে রিপোর্ট বানানো। বাসে চলাচলের খরচ অবশ্য আমি দিয়েছিলাম। এবং প্রমাণ দাখিলের জন্য ছবি অথবা মোবাইল নম্বর নিয়ে আসতে হবে।

এতো কষ্ট করে পাওয়া চাকরির মূল্য নিশ্চয়ই বুঝে মানুষ। এবং এই সকল এসাইনমেন্ট করতে গেলে অনেকগুলো সফট স্কিল এমনিতেই তৈরি হয়ে যায়। কমফোর্ট জোন ভেঙ্গে যায়, ইগো কমে, মেন্টাল স্ট্রেন্থ বাড়ে, টিমম্যানশিপ তৈরি হয়, ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা বাড়ে।

কোম্পানীগুলো এসব করে না কেন? কোম্পানী চালায় কারা; মানুষই তো? অধিকাংশ মানুষই পরচর্চা-পরনিন্দায় আনন্দ পায়, কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোনো মানুষকে বুঝবার আগ্রহ দেখায় না। আমিত্বের কঠিন শৃঙ্খলে যেহেতু আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, সেটা ছিড়ে কাউকে আবিষ্কারের চিন্তাও মাথায় আসে না। আমরা না পারি কাউকে আপন করতে, না পারি আপন হতে। আমরা কতিপয় ফ্যান্সি কীওয়ার্ড শিখেছি- প্রফেশনালিজম, কর্পোরেট কালচার, স্ট্যাটাস। চাচ্ছি প্রফিট ম্যাক্সিমাইজ করতে, কিন্তু ইনপুট দিচ্ছি মিনিমাম।

তবু অনেকটাই ভোজবাজির মতো মিনিমাম ইনপুট থেকেই কিছুটা প্রফিট হয়, লোক ঠকিয়ে প্রফিট বাড়েও মাঝেমধ্যে, কিন্তু সাসটেইনেবল গ্রোথ বলতে যা বোঝায় তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।

এটা কেবল বিচ্ছিন্নভাবে একটা-দুইটা প্রতিষ্ঠানে নয়, রিক্রুটমেন্ট কালচারটাই আমাদের জনপদে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইংরেজি জব এর বাংলা বানিয়েছি চাকরি, অন্যদিকে ভৃত্যের সমার্থক শব্দ চাকরি। চাকর+ই যোগ করলেই তো চাকরি হয়ে যায়। জবের বাংলা যখন চাকরি হয়ে যায়, তার নৃতাত্ত্বিক প্রভাব তো পড়বেই। আমরা কর্মীদের আদতে ভৃত্যের বাইরে ভাবতেও পারি না সচরাচর। তাকে বেতন দিই মানে তার ২৪ ঘণ্টাই কিনে নিয়েছি , যে কারণে সময়মতো অফিস থেকে চলে না গিয়ে স্রেপ বসতোষণের উদ্দেশ্যেও যদি কেউ অতিরিক্ত সময় অফিসে থাকে সেটাকে দেখা হয় দায়িত্বশীলতা হিসেবে, অন্যদিকে নির্ধারিত সময়ের ১ মিনিট পরে কার্ড পাঞ্চ করলেও এবসেন্ট দেখানো হয়। সফটওয়্যার এবং এমএনসি ব্যতীত বেশিরভাগ কোম্পানীতেই সাপ্তাহিক ছুটি মাত্র ১দিন; অথচ ইফিশিয়েন্ট সিস্টেম ডিজাইন করলে কোনো অফিসের পক্ষেই ৫দিনের বেশি স্ট্যান্ডার্ড ওয়ার্কলোড থাকারই সম্ভাবনা নেই।

অতিরিক্ত ১ দিন কাজ করানোর দরুণ যে এক্সপেন্স বাড়ে এবং এমপ্লোয়ি ইফিশিয়েন্সি কমে এই সরল অংক বোঝার মেধা মালিকপক্ষের আদৌ কি থাকে? নাকি তারা ধরেই নেয় কর্মীরা ফাঁকি মারে কাজে, বেশিদিন অফিস চালু রাখলে সিস্টেম লসটুকু কমানো সম্ভব? কিন্তু ডাটা দিয়েই যে প্রমাণ করা সম্ভব, বাড়তি ১দিনের কারণে সামগ্রীক প্রোডাক্টিভিটি বিপুল পরিমাণে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, এই চ্যালেঞ্জ মানার মানসিক ঔদার্য মালিকপক্ষের আছে বলে মনে হয় না।

নেই তার কারণ আমাদের এদিকটাতে ইন্টেলেকচুয়াল শ্রমকে কোনো শ্রম হিসেবেই গণ্য করা হয় না। আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলা ব্যতীত তাকে শ্রম বলতে রাজি নই। তো মাথার ঘাম যে মাথার ভেতরেই শুকিয়ে যেতে পারে এই বোধ কি জাগ্রত হয় কখনো? আমাদের প্রচলিত প্রবাদ এই জাগরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়; শ্রমের মর্যাদা রচনায় আমরা কেবল কুলি-মজুরদেরই শ্রমিক হিসেবে দেখে এসেছি। কিংবা সফটওয়্যার বা এপস বানানোকেও আমরা বিরাট মর্যাদার জায়গায় দেখতে রাজি আছি, যেহেতু এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই টেকিমূর্খ। ফলে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট আরো অনেকদিন অত্যন্ত সফিসটিকেড কাজ হিসেবে রায় পাবে।

কিন্তু একজন পলিসি মেকার, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানারের মাথার ভেতরে ঘটে চলা ঝড়কে আমরা নিদারুণ স্মার্টনেসে উপেক্ষা করতে পারি, আমাদের চোখে তারা অলস মানুষ, কিংবা কর্মবিমুখ।

এতো অজস্র ভুল কনসেপ্টের দেশে হায়ারিং সম্বন্ধে ইন্টেলেকচুয়াল এনলাইটেনমেন্ট আসবে, এবং তার বাস্তবায়ন হবে এ আশা করা হিরো আলমের বিপুল গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার মতোই বিব্রতকর এবং অন্তঃসারশূন্য উপসংহারের প্রতীক্ষায় থাকা।

আমার কী সুখে যায় দিন-রজনী, কেউ জানে না
কুহু সুখে মনের আগুন আর জ্বালাইয়ো না..

তবুও এখনকার তরুণ উদ্যোক্তাদের দেখে মনের কোণে ঈষৎ আশা উঁকি মারে। তাদের শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তার প্যাটার্ন দেখে ভাবি I নয় H-কেই তারা বিজনেসের মূলশক্তি হিসেবে অগ্রাধিকার দিবে।

আরে ভাই, বর্ণমালার ক্রমধারাতেও তো I এর আগে H আসে; ঠিক বলছি তো?

#himalay777