প্রিয়ম মজুমদার অভি বুয়েটে আমার ব্যাচমেট ছিলো, ফেসবুকে ক্যাচি স্ট্যাটাস দিতো, ব্যাচমেট-সিনিয়র-জুনিয়র নির্বিশেষে সেইসব স্ট্যাটাসে লাইক দিতো; লাইকের প্রাচুর্যে ব্যাচমেটরা লাইকের নামই বদল করে দেয়, লাইকের অন্য নাম PMO। বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায় বিবিধ কারণেই আমাদের মধ্যে সেটা গড়ে উঠেনি, কিন্তু আমি যেহেতু বাল্যকাল থেকেই মানুষে বাঁচি মানুষে হাসি, কৌতূহলী কাউকে দেখলে সে আমার নোটবুকে ঢুকে পড়তো। প্রিয়ম ফুটবল খেলতো, বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা, বুয়েট ০৫ ব্যাচের যে কোনো প্রোগ্রামেই তার সক্রিয় সম্পৃক্ততা ছিলো অনিবার্য অনুমান।

২০১০ এ আমরা ছিলাম র‍্যাগ ব্যাচ। র‍্যাগ প্রোগ্রাম উপলক্ষ্যে ৭১ মিনিটের একটি টেলিফিল্ম নির্মাণ করি আমি। আগ্রহীরা ইউটিউবে Ekoda Eksomoy লিখে সার্চ দিলেই টেলিফিল্মটি পেয়ে যাবেন, এবং প্রথম দৃশ্যেই ভ্যানে চড়ে হলে আসতে থাকা এক কিশোরকে দেখতে পাবেন। ২০১০ এর ৯ ই অক্টোবর দৃশ্যটি শ্যুট করা হয়েছিলো। আজ সেপ্টেম্বর২, ২০১৮, অথচ ৮ বছরেও প্রিয়ম সেই কিশোর চেহারাটিই ধরে রেখেছে। হয়তোবা মানুষিক বৈশিষ্ট্যেও আজও সেই কিশোরপনাটিই ধরে রেখেছে সে।নইলে আমাদের ব্যাচের বেশিরভাগ মানুষই যেখানে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশগামী হয়ে সেখানেই চাকরিতে ঢুকেছে, কিংবা দেশেই ক্যারিয়ার গড়ে সেটেল্ড বলতে যা বোঝায় হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে, সেখানে প্রিয়ম গ্রাজুয়েশনের পর আইবিএ থেকে পড়াশোনা শেষ করে মসৃণ এবং নিরাপদ মানি মেকিং অপশন এ না ছুটে সমাজের দৃষ্টিতে অলাভজনক (সুতরাং আনপ্রোডাক্টিভ!!)এক ভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়লো। স্পোর্টস পোর্টাল প্যাভিলিয়ন ডট কম এর নাম অনলাইন কমিউনিটিতে খুব আনকোড়া কিছু নয়, তবে এর নেপথ্যের মানুষগুলো হয়তোবা এখনো পর্যন্ত নিভৃতেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এককালে যেমন লাইকের সমার্থক ছিলো PMO, তেমনি আমি এখন P বলতে যা যা বুঝি তার মধ্যে প্রিয়ম আর প্যাভিলিয়নও অন্তর্ভুক্ত।

প্রিয়মের এই প্যাভিলিয়নমুখী যাত্রায় তার সাথে হয়তো আরো অনেকেই আছে, তবে আমি এদের মধ্যে মাত্র ২ জনকে চিনি- অমলান মোস্তাকিম এবং ফুয়াদ, যারা বুয়েটে আমাদের এক ব্যাচ জুনিয়র এবং সামহোয়ারইন ব্লগসূত্রে সহব্লগার ছিলো। ব্লগ ছেড়েছি ৯ বছর আগে, কিন্তু অদ্রোহ আর অপরিচিত আবির নিকের আড়ালের মানুষ দুজনকে মনে রেখেছি।

২০১২ সালের পর আচমকাই বাংলাদেশে ক্রিকেট ফলোয়ারের সংখ্যা প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে, কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণদের একটা বড়ো অংশই বিভিন্ন দেশের ফুটবল লীগ দেখে নিয়মিত। অভিজাত শ্রেণির কাছে গলফ, পুল যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সিদ্দিকুরের স্টোরি পত্রিকাতে আসে প্রায়ই। সাইক্লিং,সুইমিংয়ের কদর বাড়ছে। টেনিস খুব বেশি জনপ্রিয় না হলেও হাল আমলে টেবিল টেনিসের আকর্ষণ বাড়ছে কিশোর-তরুণদের মধ্যে। এছাড়া হকি, বাস্কেটবল, ভলিবল জাতীয় খেলাগুলো স্বল্প পরিসরে হলেও ভোক্তাগোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছে।

এই সমস্ত প্লেইন বর্ণনা থেকে আমি এটাই বলতে চাই, বাংলাদেশে স্পোর্টস ক্রেজ আছে। আপনি বলতে পারেন মাঠের খেলার চাইতে কম্পিউটার গেমসগুলোই বেশি জনপ্রিয় আজকের মানুষদের কাছে, কিন্তু আপনার স্টেটমেন্ট সত্য হওয়া মানেই আমার স্টেটমেন্ট ভুল নয়, এইটুকু বোঝার মেধা আপনার আছে আশা করতেই পারি।

স্পোর্টস ক্রেজ টার্মটাতে জোর দেয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই নেশাখোরের মতো ক্রিকেটের নেশায় মেতে থাকতাম, স্পোর্টস জার্নালিস্ট- স্পোর্টস কমেন্টেটর-রেফারি-আম্পায়ার- কোচ-ফিজিও প্রভৃতি পেশাগুলোর প্রতি মারাত্মক ফ্যাসিনেশন কাজ করতো। টনি গ্রেগ, মাইকেল হোল্ডিংয়ের কমেন্ট্রি, ডেভিড শেফার্ড, রুডি কোয়ার্টজেনের আম্পায়ারিং,পিটার বোরাকের স্পোর্টস আর্টিকেল ৩১৭৯ এর মতো আকর্ষণ করতো আমায়। বাংলাদেশের খেলার সময় যখন জাফর উল্লাহ শারাফতের যাত্রার ঢঙে বলা ধারভাষ্য, কিংবা আতহার আলি খান বা শামিম আশরাফ চৌধুরীর মেরিটলেস এবং লিমিটেড শব্দভাণ্ডারের ধারাভাষ্য শুনি, যারপরনাই হতাশ হয়ে ভাবতাম এতো এতো স্পোর্টস লাভারের দেশের ধারাভাষ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে এই সমস্ত মানুষ! কুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার Utpal Shuvra সেই ১৯৮৫-৮৬ সালে যদি ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার ছেড়ে স্পোর্টস জার্নালিস্টের মতো অনিরাপদ ক্যারিয়ারে ঢোকার সাহস করতে পারে, একুশ শতকে, যখন ক্যারিয়ার স্কোপ সম্প্রসারিত হয়েছে, তখনো কেন মেধাবীরা কেবল স্পোর্টস লাভার হিসেবেই দায় সারবে, কেন স্পোর্টস ক্যারিয়ার কিংবা স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রিতে সরাসরি ইনভলভ হওয়ার সাহস করে না! গত বছর যখন বিসিবিতে যাই কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম স্যারের ইন্টারভিউ নিতে, জানতে পারি তিনি এক্স নটরডেমিয়ান। তার ক্রিকেটপ্রজ্ঞায় অভিভূত হয়ে আবারো ভাবি, ফাহিম স্যারদের যুগে যদি তিনি সাহস করেন, আমাদের যুগে কেন নয়?

কেন বাংলাদেশে স্পোর্টস কমেন্ট্রি নিয়ে সিরিয়াস কোর্স করানো হয় না, কেন স্পোর্টস জার্নাল হয় না, কেন আম্পায়াররা যথেষ্ট স্মার্ট না, কেন স্পোর্টস জার্নালিজম নিয়ে ইনস্টিটিউশন বেইস কাজ হয় না? যে ব্যক্তি ফুটবল নিয়ে রিপোর্ট করছে, সে- ই ক্রিকেট, হকি, সুইমিং সবকিছুর রিপোর্ট করছে; এ কেমনতর স্পোর্টস ডায়নামিক্স!

প্রিয়মরা যখন ২০১৪ এর দিকে প্যাভিলিয়ন ডট কম শুরু করে আমি উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিলাম। আমার প্রত্যাশা তৈরি হতে থাকে ওর প্রতি। এই প্রত্যাশা তৈরির পেছনে ওর নিজেরই দায় বেশি। টেন্ডুলকারের রিটায়ারমেন্ট উপলক্ষ্যে টেন্ডুলকারকে ট্রিবিউট করে একটা পোস্ট লিখেছিলো ও, পড়ে অপরূপ বিমোহতায় বিবশিত হয়ে পড়েছিলাম। আমার জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় ২৬টি অবসেসন দ্বারা, তার একটি টেন্ডুলকার। তার প্রতি অবসেসনের তীব্রতা বোঝাতে ছোট্ট একটা তথ্য শেয়ার করি। ১০ বছর বয়সে জানতে পারি তার স্ত্রী বয়সে তার চাইতে বড়ো। তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আজ অব্দি, বয়সে ছোট কোনো মেয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়নি, আমার আগ্রহের নারী ক্যারেক্টারদের ২-৩ জন ব্যতীত সকলেই বয়সে বড়ো। তো সেই টেন্ডুলকারকে নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো পূর্ণ লেখা লিখিনি আমি। লিখিনি বললে অসম্পূর্ণ থাকে বাক্যটা, বলা উচিত লিখতে পারিনি। এর অন্যতম কারণ, লিখতে বসলেই প্রিয়মের সেই পোস্টটা মনে পড়ে যায়।

একারণে প্রিয়ম যখন প্যাভিলিয়ন ডট কমকেই ওর ফুলটাইম ক্যারিয়ার বানিয়ে ফেলে, আমি এটা ভেবে ভেতরে ভেতরে উদ্দীপ্ত হই, অবশেষে বাংলাদেশে স্পোর্টস ইকোনমির একটা প্রফেশনাল এবং স্ট্যান্ডার্ড ইকোসিস্টেম গড়ে উঠতে যাচ্ছে। অধীর আগ্রহে তার অপেক্ষায় থাকি এবং গভীর মমতায় পর্যবেক্ষণ করতে থাকি ওদের এক্টিভিটি।

কিন্তু আমার উচ্ছ্বাসের বিপরীতে ওদের পরিকল্পনা আমাকে প্রত্যাশার ডানা ছেঁটে ফেলতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে ক্রমাগত। প্যাভিলিয়ন ডট কম নিছক একটি স্পোর্টস পোর্টালের ন্যায় বিকশিত হতে থাকে। কন্টেন্ট মার্কেটিং, বিজ্ঞাপন, আর অনিয়মিতভাবে কিছু পাবলিকেশন দিয়ে রেভিনিউ জেনারেটের চেষ্টা লক্ষ্য করতে থাকি। এইটুকু অপারেশনের জন্য তো প্রিয়ম-অম্লান- ফুয়াদদের সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজন ছিলো না। অন্য ১৭টা পোর্টাল মানি মেকিং অপশন হিসেবে যা করে, প্রিয়মও যদি সেভাবেই অপারেশন চালায় তাহলে ও প্রিয়ম কেন তবে?

সাধারণ কেউ হলে আমি বলতাম ইনভেস্টমেন্ট পাওয়া যায় না, যে কারণে ইচ্ছা থাকলেও অধিকাংশ চিন্তা-পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা যায় না। কিন্তু প্রিয়ম বলেই একই স্টেটমেন্টকে ওর ক্ষেত্রে আমি এক্সকিউজ এবং দূরদর্শীতার অভাব হিসেবে বিবেচনা করবো। ৪ বছর পেরিয়েও প্যাভিলিয়ন নিজের কোনো জোরালো ভ্যালু প্রোপোজিশন ক্রিয়েট করতে সমর্থ হয়নি। নিছকই এক স্পোর্টস পোর্টাল। অথচ প্যাভিলিয়নের হওয়া উচিত ছিলো স্পোর্টস সেন্টার। সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে গুগলের যা অবস্থান, প্যাভিলিয়নের হওয়া উচিত ছিলো সেরকম ইউনিক কোনো স্পোর্টস কমার্স। ক্যাম্পেইন, কোলাবরেশন, এফিলিয়েশন এসব থেকে যা ইনকাম হয় তা দিয়ে তো প্যাভিলিয়ন ডট কমের অফিস ভাড়াই হওয়ার কথা নয়। এবং এই টাইপ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে ইতিপূর্বে অনেকগুলো পোর্টাল কাজ শুরু করেছিলো, বেশ কয়েকটি হারিয়েও গেছে। এইসব করার জন্য নিশ্চয়ই জীবনের এতো বড়ো স্যাক্রিফাইস করেনি প্রিয়ম।

বলা সহজ, করা কঠিন। এটা তো সবার জন্যই সত্য। কিন্তু চ্যালেঞ্জ জিততে পারে বলেই কেউ কেউ এক্সেপশনাল হয়, কেউ সারাজীবনই চায়ের দোকানে বসে রাজা-উজির মারে।

সুতরাং প্রিয়মের চ্যালেঞ্জপ্রিয়তাকেই উস্কে দিতে চাই।ব্যাচমেট, শুভাকাংখীর বাইরেও আমি একজন স্পোর্টস লাভার। যদি দেশে স্পোর্টস সেন্টার গড়ে উঠে কোনোদিন যার অন্যতম উদ্যোক্তার ব্যাচমেট ছিলাম এবং নিজের বানানো টেলিফিল্মে তাকে ডিরেকশন দিয়েছি, আমার জন্য এই কল্পনা সুখের এবং অবারিত আনন্দের। প্রিয়ম তার প্যাভিলিয়নের বিজনেস মডেল আমূল বদলে ফেলুক সেই অযাচিত দাবিটুকু রেখেই প্যাভিলিয়নে বসলাম ওর নৈপুণ্য দেখবো বলে।

এবার ছোট্ট একটু বিজ্ঞাপন করে দিই প্যাভিলিয়ন ডট কম এর। সম্প্রতি ওরা স্পোর্টস রাইটিংয়ের ওপর এক কর্মশালা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কর্মশালা পরিচালনা করবেন ইএসপিএন ক্রিকইনফো এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইশাম। এই লোকটার ক্রিকেট ইনসাইট আমাকে মুগ্ধ করে অবিরাম। ইচ্ছা আছে কোনো একদিন তার সাথে ক্রিকেট বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করার, যেখানে আমার মনে জমা ভাবনাগুলো তার কাছ থেকে যৌবন লাভ করবে। যদিও এই টাইপ ওয়ার্কশপগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে বরাবরই স্কেপটিকাল থাকি, তবু ব্যক্তিটি মোহাম্মদ ইশাম বলেই তার সাথে কাটানো সময়গুলো স্পোর্টস ফিলোসফি, এথিক্স এবং এসথেটিক্স সম্বন্ধে মানুষের মধ্যে যোগ্যতা বৃদ্ধির প্রভাবক হতে পারে ধারণা করছি। তবে একই সাথে এটাও স্মরণযোগ্য, ওয়ার্কশপ থেকে আপনি কতটা উপকৃত হবেন এটা ইশামের উপরে নয়, বরং আপনি ইশাম ভাইয়ের ধ্যানধারণা কতটুকু হৃদয়াঙ্গম করতে পারছেন সেই ব্যক্তিগত দক্ষতার উপরই বেশি নির্ভর করবে।

তাই নিজের প্রতি যত্ন নিন, তাহলেই যত্নকে রত্নে রূপান্তরে সমর্থ হবেন।

ইভেন্টের বিস্তারিত প্যাভিলিয়ন ডট কম এর ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইটে দেয়া আছে। এইখানে সেসব লিখে লাইনসংখ্যা না বাড়াই। পুশ সেলিংয়ে সর্বসময়ের বিরক্তি আমার। একটা প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের ভ্যালু বুঝতে পারলে মানুষ এমনিতেই তার প্রতি আগ্রহী হয়। আকৃষ্ট করা অনৈতিক, আগ্রহী করতে চাওয়া বিশুদ্ধতা।

প্রিয়ম আর প্রিজম শুনতে প্রায় একইরকম। প্রিজমের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে প্যাভিলিয়ন প্রতিফলিত করুক ক্রীড়াপ্রজ্ঞা সম্পন্ন মননের শীলন।

প্রিয়মে প্রিজমে প্রীত হোক প্রত্যাশার পারদ।