ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল কিংবা পাবলিক-প্রাইভেট ভার্সিটির সাইন্স ফ্যাকাল্টিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী সেমিস্টার পরীক্ষাগুলোতে ফেল করে। ভার্সিটিগুলোর তুলনায় ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিকেলে ফেলের হার বেশি। ফেল করাকে বুয়েটে বলা হয় ল্যাগ খাওয়া, বন্ধুসূত্রে শুনেছি কুয়েট-রুয়েটে এর নাম ব্যাকলগ; মেডিকেলে কী বলে জানি না। যেহেতু বুয়েটেই সাড়ে ৬ বছর কেটেছে, ফেল করা ব্যাপারটিকে বাকি নিবন্ধে ল্যাগ শব্দ দিয়েই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো, এবং স্যাম্পল হিসেবে বুয়েটকেই ব্যবহার করবো। দু-একটা বিষয়ে অমিল ব্যতীত আমার ধারণা প্রায় সকল ইনস্টিটিউটের জন্যই কথাগুলো প্রযোজ্য হবে, কারণ আমি ল্যাগ নয়, ল্যাগার বিষয়েই আলোচনা করতে মনস্থির করেছি।

২-১টা কোর্সে ল্যাগ খেলে সাধারণত ল্যাগার ট্যাগ দেয়া হয় না, কারণ কোনো এক বা একাধিক টার্মে অতিরিক্ত কোর্স নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই গ্রাজুয়েশন শেষ করা যায়। ল্যাগার ট্যাগটা সাধারণত তখনই জুটে যখন ল্যাগের সংখ্যা ৫-৬টার বেশি হওয়ার দরুণ অতিরিক্ত এক বা একাধিক টার্ম লেগে যায় গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করতে। ল্যাগের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কারো কারো ক্ষেত্রে ২০-২২টা হয়ে যায়; এদের অনেকেই তখন আর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার আগ্রহ-উদ্যম হারিয়ে ফেলে। সার্টিফিকেটনির্ভর সামাজিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় তারা তখন স্বীকৃত হয় ইন্টার পাশ হিসেবে। ফলত, ইন্টার ফেল কিংবা কোনোভাবে ইন্টার পাশের পর অন্য কাজে ঢুকে পড়া একজন, আর ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলে চান্স পাওয়া মেধাবী ছেলে বা মেয়েটি কেবলমাত্র গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে না পারার অপরাধে একই মানদণ্ডে বিবেচিত হয়। কতটা ভেগ বা অন্তঃসারশূন্য এক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় একটি সমাজ ধারণা চলতে পারে, এই ক্রুয়েল রিয়েলিটি আমাদের সেই সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়। আমরা চোখ বন্ধ করে কাকের কা কা ডাক শুনতে থাকি।

বুয়েটে আমার সর্বোচ্চ জিপিএ ছিলো ২.৭৭, ল্যাগ খাওয়া কোর্সসংখ্যা ১৩; এর মধ্যে ৩টা কোর্সের প্রতিটিতে ২ বার করে ল্যাগ খাওয়ার দরুণ সর্বমোট ল্যাগ দাঁড়ায় ১৬টি; নির্ধারিত সময়ের দেড় বছর পর অতিরিক্ত দুটো টার্ম নিয়ে বের হওয়ার স্কোপ পাই, তখনো ২টা ল্যাগ জোটে, যে কারণে আরো ৭ সপ্তাহ পরে ২টা সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে গ্রাজুয়েশনের স্বাদ পাই, সিজিপিএ ২.৩৮!

তবে ইন্টারেস্টিং তথ্য হলো, ল্যাগার কমিউনিটিতে আমি খুবই মাঝারি মানের ল্যাগার ছিলাম, ২০ টার বেশি ল্যাগ এরকম অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠতা ছিলো, যাদের অনেকেই এখনো ল্যাগের ঘানি টানছে। নিজেরা উদ্যোক্তা হয়েছে, তাদের কোম্পানীতে বিবিএ,এমবিএ কিংবা একাডেমিক মেধাবীরা চাকরি করে, আর তারা বুয়েটে গিয়ে ক্লাস টেস্ট দেয়, কিংবা টার্ম ফাইনালের আগে হলে গিয়ে জুনিয়রের কাছ থেকে সিলেবাস শোনে! ল্যাগ শব্দের বাংলা পরিভাষা সম্ভবত পিছিয়ে পড়া। কিন্তু ঠিক কোন্ সেন্সে ‘পিছিয়ে পড়া’ তার সুনির্দিষ্ট সদুত্তর কি দিতে পারবে কেউ? পিছিয়ে পড়া কথাটার মধ্যে যে চরম হিউমিলিয়েশন ইনটোনেশন আছে, সেই ফ্যাক্টকে কি অস্বীকার করা যায়?

মেডিকেলের ব্যাপারে জানি না, তবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাশ করার চাইতে ল্যাগ খাওয়া অনেক বেশি কঠিন। চরম লেভেলের তপস্যা ব্যতীত চাইলেও ল্যাগ খাওয়া সম্ভব নয়। সর্বনিম্ন গ্রেড ডি, যার রেঞ্জ ৪০-৪৪% মার্ক। মার্ক ডিস্ট্রিবিউশনটা খেয়াল করা যাক, কেবলমাত্র নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকলেই ১০% নম্বর এসে যায়, ৪টা ক্লাস টেস্ট হয়, এর মধ্যে বেস্ট ৩ এর নম্বর বিবেচনায় নেয়া হয়, যার ওয়েট ২০%; মূল টার্ম পরীক্ষা হয় ৭০% এর উপর। এরকম ফ্লেক্সিবল সিস্টেমের মধ্যেও যদি কেউ ৪০% নম্বর তুলতে না পারে, সেটা তার মেধার ঘাটতি নয়, এটা নিশ্চিত। কারণ, ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলে যারা ভর্তি হয়, ইন্টার পর্যন্ত তাদের একাডেমিক পারফরম্যান্স পর্যালোচনা করলেই স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায়, তারা গড়পড়তার চাইতে বেশি মেধাবী। ৪০% নম্বর তারা উঠাতে পারবে না এটা স্রেফ অবিশ্বাস্য। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

তবে মার্ক ডিস্ট্রিবিউশন শুনে ৪০% নম্বরকে যতোটা সহজ মনে হচ্ছে, এর মধ্যে একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। বেশিরভাগ ল্যাগারদের একাডেমিক প্যাটার্ন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাদের এটেনডেন্স আর ক্লাস টেস্টের অবস্থা থাকে শোচনীয় পর্যায়ের; ৩০% থেকে বড়োজোর ১০-১২% নম্বর থাকে। ফলে মূল টার্মের ৭০% এর উপরই নির্ভর করতে হয়। এই ৭০% আবার ৩৫% হারে দুইভাগে বিভক্ত থাকে। এক ৩৫% নম্বর থাকে এক্সটারনালের হাতে। অন্যদিকে, এটেনডেন্স আর ক্লাস টেস্টের অবস্থা বাজে মানে সে সেমিস্টারজুড়েই অন্য জগতে ছিলো, পিএল (প্রিপারেটরি লিভ) এর সময় বিরাট সিলেবাস শেষ করতে হিমশিম খায়। মূলত তখনই ল্যাগের লুপ শুরু হয়।

ল্যাগার তৈরির ক্ষেত্রে সবচাইতে ভাইটাল হয়ে উঠে প্রথম ৩টি টার্ম। প্রথম টার্মে অসতর্কতাবশত জিপিএ ৩ এর নিচে নেমে আসে; সারাজীবন ১০ এর মধ্যে রোল নম্বর থাকা একজন ছাত্র বা ছাত্রী যখন গ্রেড শিটে সি বা বি মাইনাস গ্রেড দেখে নিজের অহমে মারাত্মক আঘাত লাগে, মনে হয় দুঃস্বপ্ন দেখছে। সেটা কাউকে উদ্দীপ্ত করে, কাউকে হতাশ করে। উদ্দীপনায় সে পরের টার্মে ভালো করার জন্য মরিয়া হয়, কেউ কেউ জিপিএ উপরে তুলতে পারে, কেউ কেউ তবুও পারে না। উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে। আর যারা হতাশ হয়, পরের টার্মে রেজাল্ট আরো খারাপ হয়। হতাশাটা তখন হাল ছেড়ে দেয়াতে রূপান্তরিত হয়। যেহেতু পূর্বজীবনে পর্যাপ্ত ব্যর্থতার ইতিহাস নেই, হঠাৎ আসা ব্যর্থতার ধাক্কাটাকে মনে হয় জগদ্দল পাথর। ৩য় টার্মে এসে ১টা বা ২টা ল্যাগ চলে আসে, প্রথমে প্রচণ্ড অনুশোচনা, অসম্মানের ভয় কাজ করে। আমাদের সময় প্রথম টার্মের গ্রেডশিট বাসায় পাঠানো হতো। এখনো এই নিয়ম বলবৎ আছে কিনা জানি না, তবে এটা সাইকোলজিকালি চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। যা বলছিলাম, ৪র্থ টার্মে যখন আবারো ল্যাগ আসে, তখন ল্যাগ ব্যাপারটাতে নির্বিকারত্ব চলে আসে। তখনই মূলত ল্যাগের লুপ তৈরি হয়, এবং ক্রমাগত সংখ্যা বাড়তে থাকে।

প্রশ্ন হলো কেন এই ল্যাগ। প্রাথমিক লেভেলের পর্যবেক্ষণ থেকে ল্যাগারদের কয়েকটা প্যাটার্ন পাওয়া যায়। আবারো বলছি, এটা প্রাথমিক পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ। কথাটার কেন পুনরাবৃত্তি করলাম পরের প্যারায় বলার চেষ্টা করবো। প্যাটার্নগুলো বলি। টিউশনি বা কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে বয়সের তুলনায় প্রচুর উপার্জনের সুযোগ তৈরি হয়; পরিমিতি বোধের অভাবে ব্যালান্স রক্ষা করার তাগিদটা আসে কম। বাংলাদেশের অধিকাংশ একাডেমিক মেধাবীদের ইন্টার পর্যন্ত লাইফ স্টাইল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, পারিবারিক শাসন এবং নিয়ন্ত্রণের এক ঘেরাটোপে থাকতে হয় তাদের, যার কারণে আত্মকেন্দ্রিকতাটাই এপ্রিসিয়েট করা হয় বেশি। ভার্সিটিতে এসে হঠাৎ পাওয়া অবাধ স্বাধীনতাটা কারো কারো ক্ষেত্রে উদ্দামতায় রূপ নেয়। সেই উদ্দামতায় কেউ রাতভর কম্পিউটারে গেমস খেলে, সকালে ক্লাস মিস করে; কেউ এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিসে অনেক বেশি মজা পেয়ে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে; কেউ কেউ উদোক্তা হওয়ার চেষ্টা চালায়, সেদিকেই সময় দেয়; কেউ রোমান্টিক সম্পর্কের টানাপোড়েন মানতে না পেরে বিষণ্নতায় ভুগে; ইন্টার পর্যন্ত প্রাইভেট টিউটরের প্রতি অতি নির্ভরতার কারণে কারো কারো স্ব উদ্যোগে পড়ার অভ্যাসটাই তৈরি হয় না। খুঁজলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরো বেশ কিছু প্যাটার্ন আবিষ্কার করা যাবে। কিন্তু বললাম তো, এগুলো মূল কারণ নয়।

মূল কারণ, সিস্টেমের সাথে ফিট করতে অনীহা। এটা খুবই শক্তিশালী স্টেটমেন্ট। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমরা যেখানে আপোষকামী, সেখানে দেশের অন্যতম কঠিন এডমিশন টেস্টের বৈতরণী পার হয়ে হাজারো প্রতিদ্বন্দ্বীর ভিড়ে একজন তরুণ বা তরুণী যখন ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলে সুযোগ পায়, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তার মনোজগতে হঠাৎ এমন কী ঘটে যে সিস্টেমের সাথে ফিট করতে অনীহা প্রকাশ করে, এটা গভীর উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি, বরাবরই এই বিষয়টা নিয়ে নীরবতা পালন করা হয় বা একধরনের ঔদাসীন্য প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু আমি মনে করি, এই বিষয়টাকে সিরিয়াসলি আমলে নেয়া উচিত। একজন ইন্টার ফেল স্টুডেন্ট আর আজীবন মেধাবী বিবেচিত হওয়া একজন সিস্টেমে ফিট না করতে চাওয়ার দরুণ গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট না করা, দুটো কখনোই একপাল্লায় বিবেচ্য হতে পারে না।

আমি কীভাবে ল্যাগার হয়েছিলাম? ইন্টারে পড়ার সময়ই জানতাম, জীবনে কখনোই চাকরি করবো না, এবং যে কোনোভাবে ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচলেই যথেষ্ট। ফলে আমার মধ্যে কোনোরকম স্পার্কই ছিলো না। আমার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো, নানারকম থট প্রসেসের মেধাবী মানুষের সংস্পর্শে নিজেকে সমৃদ্ধ করা। আমি তাই ক্যাফেটেরিয়া, হলক্যান্টিন, শহীদ মিনার প্রভৃতি জায়গায় বসে থাকতাম মেধাবী মানুষের কথা শুনবার প্রত্যাশায়। বাকি সময় ব্লগিং, লেখালিখি, ভাষা শেখা, ওয়ার্কশপ, ফিল্মমেকিং প্রভৃতিতে মজে থাকতে চেয়েছি। একের পর এক ল্যাগ খাচ্ছি, এটা মাথায়ই আসেনি। ১০ নম্বর টার্মে উঠার পর উপলব্ধি করি, ১ বছর পরই ব্যাচমেটরা সব চলে যাবে, আমাকে থেকে যেতে হবে। জুনিয়রদের সাথে ক্লাস করতে হবে, নিজের ব্যাচমেট টিচার হয়ে গেছে, তার ক্লাসেও এটেন্ড করতে হবে, এমনকি টিচার আমার জুনিয়রও হতে পারে। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ৯৬ বা ৯৭ ব্যাচের ভাইয়ারা আমাদের সাথে ক্লাস করছে, টিচার হয়তোবা ২০০১ বা ২০০২ ব্যাচের। সিনিয়র শিক্ষকরা ল্যাগারদের প্রতি চরম তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ করতো; ল্যাগারদের চোখেমুখে একধরনের অপরাধীসুলভ এক্সপ্রেসন লক্ষ্য করতাম। এমনকি ল্যাগার ভাইরা ক্লাস টেস্টের আগে এসে বিরক্ত করবে এই ভয়ে ক্লাসের অনেক ছেলেই তাদের এড়িয়ে চলতে চাইতো। আমি তখন থেকেই নিজেকে ল্যাগারদের জায়গায় বসিয়ে কল্পনা করতে থাকি। তাতে বিশেষ বিচলিত হই না, হীনম্মন্যতা বোধ বরাবরই কম থাকার এডভান্টেজ পেয়েছি। কিন্তু গ্রাজুয়েশনের মাত্র ১ টার্ম পরেই হলের সিট বাতিল হয়ে যায়, এটা জানার পরই প্রথম নার্ভাসনেসটা আসে। স্যাররা উপহাস করেছে, ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছে, ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছে, ক্লাস টেস্টের খাতা জুনিয়রদের সামনে পড়ে শুনিয়ে অপদস্থ করেছে, এগুলো কিছুই সমস্যা করেনি। কিন্তু হলের সিট বাতিল হয়ে গেলে গ্রাজুয়েশনটা আর করা হবে না, এ ব্যাপারে ৯৭% নিশ্চিত ছিলাম।

সিস্টেমে আসলে কেন ফিট করতে চায় না বা পারে না? ল্যাগারদের একটা বড়ো অংশই কিন্তু পরীক্ষা না দেয়ার দরুণ ল্যাগার, মানে পরীক্ষার দিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে, কিংবা অন্য কোনো কাজে অধিক প্রায়োরিটি দেয়ায় পরীক্ষায় বসাটাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। প্রচুরসংখ্যক ল্যাগারের সাথে কথা বলার সুবাদে, ইন্টারেস্টিং একটা পর্যবেক্ষণ পাওয়া গেছে, যদিও এটা ফিট করতে অনীহার সরাসরি কারণ নয়। স্যারদের পড়ানো এবং পারসোনালিটি দুটোই বোরিং লাগে, যে কারণে ক্লাসে বসে থাকার পুরো সময়টুকুই অপচয় মনে হয়। ভার্সিটি যদিও ইউনিভার্সিটির সাথেই মেলে বেশি, তবুও আমি ব্যক্তিগতভাবে ভার্সিটি আর ভারসেটাইলিটিকে সমগোত্রীয় ভাবি। অধিকাংশ শিক্ষক এই বৈশিষ্ট্যটায় এসে চরমভাবে পিছিয়ে পড়ে। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কটা অনেক ক্ষেত্রেই এমপ্লোয়ার-এমপ্লোয়ি ধাঁচের হয়ে যায়। যে কারণে ভিশনের জায়গায় একটা বড়োরকম মিসএলাইনমেন্ট তৈরি হয়। যেসব টিচার ছাত্র/ছাত্রীদের কাছে জনপ্রিয়, তাদের প্যাটার্ন কিন্তু একই- স্টুডেন্টের প্রতি তাদের ইমপ্যাথি কাজ করে। কেবলমাত্র ইমপ্যাথি দিয়েই বাকি সকল বৈশিষ্ট্য আড়ালে সক্ষম হন তারা। ইমপ্যাথির প্রধান শর্তই হলো, তুমি অপরের কথা শোনো এবং তাকে বোঝার চেষ্টা করো।

সাধারণত শিক্ষক তারাই হয় যারা একাডেমিক লাইফে টপার হয়। অধিকাংশ টপারদের সোসালাইজেশন স্কিলে মারাত্মক ঘাটতি থাকে। এটার পেছনে তাদের শৈশব-কৈশোরের বিল্ড আপ প্রসেসটাও বোঝা জরুরী। পরীক্ষার সময় বাসায় মেহমান আসা নিষেধ, কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া বারণ; ফলে সর্বক্ষেত্রে বাবা-মা তার আত্মকেন্দ্রিকতাকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। ইমপ্যাথি বোধটাই তার মধ্যে অনুপস্থিত।

ল্যাগার হওয়া কি অন্যায়? বুয়েটে পড়াকালে এক ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছিলো। সে নিজে কোম্পানী দিয়েছে, কিন্তু ডিউ কোর্সগুলো শেষ করার জন্য এতো বছর পর ফিরে এসেছে, কারণ তার ছেলে বড়ো হলে যদি জানে বাবা ইন্টার পাশ, সেটা অসম্মানের ব্যাপার হবে। আরেক ভাইয়া, খুবই ভালো প্রোগ্রামার; গ্রাজুয়েশন না করার অপরাধে বিয়ে আটকে যাচ্ছে বারবার। যতোই প্রতিভাবান হোক, ইন্টার পাশ ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দেবে না। ২০১২ তে সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তিনিও একজন ল্যাগার ছিলেন। চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়ার পুরো সময়টুকুই ডাক্তারি বাদে অন্য সবরকম পড়াশোনায় সময় কেটেছে। কিন্তু পরিবারের মাত্রাতিরিক্ত চাপ ছিলো। তিনি বলেছিলেন, মেডিকেল পাশ করে সার্টিফিকেটটা বাবার উদ্দেশে পার্সেল পাঠিয়েছিলেন। সার্টিফিকেট হয়তোবা একটা কাগজমাত্র, ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে এটা সবসময় প্রয়োজনীয় নাও হতে পারে, কিন্তু সামাজিক কাঠামোতে এই একটা কাগজ থাকা না থাকার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে।

ড্রপ আউট কনসেপ্টটাকে ওভারগ্লোরিফাই করা অত্যন্ত বিপজ্জনক লক্ষণ। কথায় কথায় বিলগেটস, জাকারবার্গ এর উদাহরণ টেনে ড্রপ আউটে গ্ল্যামার যুক্ত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবীতে যদি ৭ কোটি ড্রপ আউট থাকে, তার মধ্যে ৬ কোটি ৯৯ লক্ষ্য ৯৯ হাজার ৯৯৮জনই কিন্তু বিলগেটস বা জাকারবার্গ হয়নি, হবেও না। তাদের জীবনযাপন ও সামাজিকতাকে আপনি কীভাবে ডিফেন্ড করবেন?

ডি আর এফ গ্রেডের মধ্যে আদতে তেমন কোনো পার্থক্যই নেই। আমার গ্রেডশিটে সবচাইতে বেশি যে গ্রেডটা স্থান পেয়েছে সেটা ডি, এরপরেই এফ। কিন্তু একটা ডি একজন মানুষকে ল্যাগার হওয়ার যন্ত্রণা থেকে রেহাই দেয়, এফ সেই যন্ত্রণাকে দীর্ঘায়িত করে। মাদকাসক্ত ব্যতীত প্রায় সকল ধরনের ল্যাগারকেই ওয়ার্কেবল করা যায়, তাদের পটেনশিয়ালিটিকে নারচার করা যায়। ট্যালেন্ট নারচারিং কনসেপ্টটাই অধিকাংশ শিক্ষকের কাছে অপরিচিত। প্রত্যেক ছাত্রের জন্যই ডিপার্টমেন্ট থেকে একজন শিক্ষককে এডভাইজার হিসেবে রাখা হয়। অর্থাৎ সমগ্র একাডেমিক ক্যারিয়ারে সেই ছাত্র উক্ত শিক্ষকের সাথে কানেক্টেড থাকবে। সুন্দর কনসেপ্ট। কিন্তু বাস্তবে এটা আদতে কী? গ্রেডশিট তোলা এবং নতুন টার্মের রেজিস্ট্রেশন ব্যতীত খুব কম ক্ষেত্রেই উক্ত এডভাইজারের সাথে ছাত্রের ইন্টারেকশন হয়। কিন্তু একটা ছেলে বা মেয়ে কেন ১০টা কোর্সে ল্যাগ খায়, এটার রুট খুঁজে বের করার তাড়না খুব কম সংখ্যক এডভাইজারের মধ্যেই লক্ষ্য করেছি আমি; বরঞ্চ ল্যাগারকে বোঝা মনে করার সবরকম লক্ষণ তাদের আচরণে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। ক্যারিয়ার এবং একাডেমিক পড়াশোনা দুটো আলাদা জগত। ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলে পড়ে তাকে সেই ফিল্ডেই ক্যারিয়ার গড়তে হবে এই বাধকতা আসলে কে তৈরি করেছে? একটা ক্লাসে ৬১ জন স্টুডেন্ট থাকলে ল্যাগার থাকবে বড়োজোর ৩-৫ জন, বাকি ৫৮জনই কম-বেশি নিজস্ব ফিল্ডে ক্যারিয়ার গড়তে ইচ্ছুক। ফলে তথাকথিত ল্যাগারের পারসেন্টেজটা খুবই ছোট।
একজন ছাত্র যখন ৯-১০টা ল্যাগ খেয়ে বসেছে, বোঝাই যাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সে ইন্টারেস্টেড না। তখন এডভাইজারের টার্গেট হওয়া উচিত তার ইন্টারেস্টের জায়গাটা খুঁজে বের করা, এবং সেই সেক্টরে সে কীভাবে এগিয়ে যেতে পারে সেজন্য তাকে অনুপ্রাণিত করা। ট্র্যাকের বাইরে যে যেতে চায় তার পথ সে নিজেই তৈরি করে নিতে পারে, কিন্তু ওই যে অনুপ্রেরণা দেয়া, এটাই একটা আদর্শ ইকোসিস্টেম তৈরি করে দিতে পারে। সেই ছাত্রের তখন জুনিয়রদের সাথে ক্লাস করা, জুনিয়র টিচারের ক্লাস করার মতো যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হবে না, সে কেবল পরীক্ষা দেবে, এবং ডি গ্রেড নিয়ে খুশিমনে সার্টিফিকেট নিয়ে ঘরে ফিরবে। ল্যাগার হলেও সে কিন্তু তার সেক্টরে এস্টাব্লিশড হবেই; এতে আদতে উপকৃত হবে কে বা কারা? অবশ্যই সমাজ এবং রাষ্ট্র।

কিন্তু ল্যাগারকে যদি ক্রমাগত অপদস্থ করা হয়, পরিবার থেকে চাপ বাড়তে থাকে, সে এক গভীর অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। বুয়েটের সাড়ে ৬ বছরে পরিবার থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্নই ছিলাম বলা যায়, কেবলমাত্র দুই ঈদে বাসায় যেতাম, এবং সবার থেকে লুকিয়ে থাকতাম। মনে হতো, চুরি করে ফেরারী হয়েছি। এই যে অনুভূতি, এটা মানুষকে মানসিকভাবে হত্যা করে। ডিরেইলড করে দেয়। টাকার গায়ে লেখা থাকে না এটা মাছের আড়তদার, নাকি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের টাকা। মানুষ না ঠকিয়ে যে কোনো নৈতিক উপায়ে মেধা খাটিয়ে উপার্জন করাকেই সম্মান জানানো উচিত। কিন্তু আমরা হয় বিলগেটস হবো, নয়তো হবো বেকার বেলাল। বিলগেটস আর বেলালের মধ্যবর্তী বিশাল অঞ্চলটুকুতে চোখ পড়ে না বলে মোহভঙ্গ ঘটে, যেখানে পৌঁছানো উচিত ছিলো তার বহু আগেই যাত্রার সমাপ্তি ঘটে। প্যাশন একটা ওভাররেটেড ধারণা। এটা মানুষকে গ্ল্যামারাস করেমাত্র, ভ্যালু যুক্ত করতে পারে না, কারণ প্যাশন কী তা-ই বোঝে না বেশিরভাগ মানুষ। বরং থ্রিডি (ডিটারমিনেশন, ডেডিকেশন, ডেসপারেটনেস) ইফেক্ট দিয়েই মানুষ তার ট্যালেন্টকে আউটপুটে কনভার্ট করতে সমর্থ হয়। ল্যাগার শব্দটাই সেক্ষেত্রে আপত্তিকর এবং উস্কানীমূলক। তার চাইতে ‘বাইপাস’ শব্দটা অনেক বেশি মিনিংফুল লাগে। বাইপাস ক্যাটেগরির একটা প্যারামিটার থাকবে। যেমন, ৫ টার্ম শেষে সিজিপিএ ২.৬ এর কম, ল্যাগসংখ্যা ৫ বা তার বেশি। তখন সে তার নিজের ফিল্ডের ওপর একটি থিসিস লিখে জমা দিবে। সে এডভাইজারের কাছে কাজের ব্যাপারে আপডেট জানাবে। ধরা যাক, সে ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে স্পোর্টস জার্নালিস্ট হতে চায়, এবং বাইপাস ক্যাটেগরির শর্তপূরণ করে। বাকি ৩টা টার্মের শুরুতে সে স্পোর্টস জার্নালিজম সংক্রান্ত বিভিন্ন এসাইনমেন্ট করে এডভাইজারকে জমা দিতে থাকবে, এবং ব্যাচের বাকিরা যখন গ্রাজুয়েশন শেষ করবে, সেও বাইপাস ক্যাটেগরিতে গ্রাজুয়েট হিসেবে বের হবে।

কাস্টমাইজড পলিসি না থাকার দরুণ ল্যাগারকে অতিরিক্ত দেড় বা আড়াইবছর অহেতুক নানা গঞ্জনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এটা তার জীবনে কোনো ভ্যালু এড তো করেই না, বরং প্রতিদিন সে মনের ভেতরে মরে যায়। অথচ, ইন্টার পর্যন্ত টেনেটুনে পাশ করা মানুষগুলো ঠিকই কোনো না কোনো একটা পেশায় নিয়োজিত হয়ে সমাজে টিকে আছে। সে তখন খারাপ উদাহরণের স্যাম্পল হয়ে থাকে আত্মীয়স্বজন আর চেনা পরিমণ্ডলে। তারা বলে- ‘অমুকে ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়ছে, কী লাভ হইছে তাতে ; শেষ তো করতে পারে নাই’। আমার বরং এইসমস্ত মানুষকে ল্যাগার মনে হয়; তারা মানসিকতা, বোধ এবং বহিঃপ্রকাশ সবকিছুতে পিছিয়ে। এরাই তো আদতে পারফেক্ট ল্যাগার!

ফিট করতে না চাওয়াটা দোষের নয় যদি সে যেখানে ফিট হতে চায় তার পেছনে সর্বস্ব উজাড় করে দেয়। কিন্তু সমাজ ভরে গেছে মিস্ত্রিতে, তারা সবসময় গজফিতা নিয়ে গিজগিজ করতে থাকে ফিটনেস পরিমাপ করতে। এবং ভার্সিটিগুলো শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রীয় দর্জিবাড়ি হয়ে উঠে। কিন্তু দর্জিবাড়ি না হয়ে যদি কুমোরবাড়ি হতো, তাতে হয়তোবা হাড়ি, পাতিল সহ প্রয়োজনীয় যে কোনোকিছুই গড়ে দিতে পারতো। দর্জিবাড়িও আদতে ল্যাগার। তারা পিছাতে পিছাতে একসময় ভুলেই যায়, কোথাও হয়তোবা যাওয়ার ছিলো…

সবই ভাড়ায় চালিত