ব্যক্তিত্ব বিষয়ক লেখাগুলোর সর্বজনীন এক ফরমুলা লক্ষণীয়। কীভাবে তিনি শুরু করলেন, অনিঃশেষিত প্রতিকূলতা, কিছু কাকতালীয় ঘটনা বা সৌভাগ্য, এরপর ক্রমাগত উত্থান এবং একসময় স্বর্ণশিখরে আরোহণ। এ ধরনের লেখাগুলো তথ্যভিত্তিক যা ব্যক্তিটি সম্বন্ধে জানতে সহায়তা করে, তবে তাকে পর্যালোচনা করার ক্ষেত্রে এগুলো খুব তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে না। পাঠকচাহিদাতেও পর্যালোচনার অবস্থান যথেষ্ট নিচে, পাঠক শুধু সাফল্যের গল্প শুনে স্বপ্ন দেখতে চায়।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত, খেলোয়াড় ব্যতীত যে কোনো মানুষের মূল্যায়নের জন্য ৫০ বছর যথার্থতম সময়সীমা। এর আগ পর্যন্ত যা হয় সবই ডাটাপূর্তিকরণ। ৫০ এর কমেই যাদের আয়ুসীমা থেমে যায় পর্যালোচনা করার ক্ষেত্রে তারা কিছুটা বঞ্চিত থেকে যায়, ঠিক পরিপূর্ণতা পাওয়া যায় না।
এই কথা লেখার পরই মনে পড়লো নায়ক শাকিব খানের বয়স ৩৯, বাংলাদেশী রীতি মানলে এর সঙ্গে হয়তোবা আরো ২-৩ বছর যোগ করে নেয়া যায়, তবুও ৫০ হতে অনেকটাই বাকি থেকে যাবে।তাছাড়া এখনো যেহেতু তিনি মূল নায়ক চরিত্রেই অভিনয় করেন এবং আরো ৫-৭ বছর পর্যন্ত হয়তোবা করবেন, তাকে পর্যালোচনা করলে সেটা আংশিক দৃশ্যায়ন হবে।
***
শাকিব খানের ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৯৯ সালে, তার মানে ২০ বছর হয়ে গেছে ফিল্ম অঙ্গনে। এর মধ্যে প্রথম ৬-৭ বছরকে তার স্ট্রাগলিং অধ্যায় ধরা যায় যখন আলেকজান্ডার বো, মেহেদী, শাহীন আলম, সোহেলদের মতো তিনিও একজন সাইডনায়ক হয়ে ছিলেন, সাইডনায়িকা হিসেবে পেয়েছেন মুনমুন, ময়ূরী বা অন্যান্যদের। পরবর্তী ২-৩ বছরকে ধরা যেতে পারে তার উত্থানের চিহ্ন নির্দেশক, কেটেকুটে তার ২দশকের ক্যারিয়ারের অর্ধেককে প্রস্তুতি-প্রতিকূলতা এবং বাকি অর্ধাংশকে প্রাপ্তি কিংবা প্রতিপত্তি হিসেবে বিভাজিত করা যেতে পারে।
২০ বছরে শাকিব খানের গণইমেজ আদতে কেমন? অনলাইন প্লাটফরমকে যদি বাংলাদেশের গণমানসের প্রতিচ্ছবি বলি, শাকিব সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে ৩ শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে।
শ্রেণি১- শাকিব খান মানে হিজড়া/হাফলেডিস খান। রিকশাওয়ালা আর গার্মেন্টসকর্মীরাই কেবল তার সিনেমা দেখে। তবে সিনেপ্লেক্স বা অন্যান্য দামী হলগুলোতে যখন শাকিব খানের সিনেমা চলে এবং সেখানে দর্শক সমাগম চোখে পড়ার মতো থাকে, সেই মানুষগুলো কোন্ অঞ্চলে রিকশা চালায় অথবা কোন্ গার্মেন্টস এ চাকরি করে সেই পরিচয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় না। শ্রেণি১ কে আমরা চায়ের দোকানে, লোকাল বাসের ভ্যাপসা গরমে অথবা গলির মোড়ে বসে রাষ্ট্রোদ্ধার করা সেইসব মানুষের দলভুক্ত ভাবতে পারি যারা হীনম্মন্যতায় ভুগতে ভুগতে কেবল ইস্যুর পেছনে ছোটেন এবং সবকিছুতে সমস্যা দেখতে পান;তার প্রেক্ষিতে অনবরত ট্রল করতে থাকেন।
শ্রেণি২- শাকিব খান বর্তমান বাংলা সিনেমার একমাত্র সুপারস্টার। এককালে প্রসেনজিত একাই যেমন টেনে নিয়ে গেছেন টালিগঞ্জের ইন্ডাস্ট্রিকে, একই কাজ আরো বেশি চাপ নিয়ে করে চলেছেন শাকিব খান। যে কারণে গুণগত মানের দিকে না তাকিয়ে একের পর এক সিনেমা করে গেছেন ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে। এরা শাকিব খানের অন্ধভক্ত, সংখ্যায় এরাও যথেষ্ট বড়ো, তবে ট্রলিংয়ের ভয়ে কিংবা তথাকথিত বোদ্ধাদের দৃষ্টিতে ‘ক্ষ্যাত’ তকমা পেয়ে ইমেজহানির আশঙ্কায় তারা ভক্তি প্রকাশ করেন ঠারেঠুরে। এরা সাধারণত প্রবল জাতীয়তাবাদে আক্রান্ত। ক্রিকেটে বাংলাদেশের বাইরে অন্যদের খেলা দেখেই না বলতে গেলে, গ্রাজুয়েশনের পর যেসমস্ত শিক্ষার্থী দেশের বাইরে পড়তে গিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয় তাদের দোষারোপ করে ব্রেইনড্রেইন তত্ত্ব আউড়ান, এবং যে কোনো বিরোধপূর্ণ আলোচনায় ‘আমাদের ট্যাক্সের টাকায়’ লাইনটি প্রায়শই ব্যবহার করেন। এরা বাংলা, এবং হিন্দি সিনেমার বাইরে অন্যান্য সিনেমা দেখেই না সেভাবে।
শ্রেণি৩- শাকিব খান এরকম ফিটনেস এবং এক্টিং স্কিল নিয়ে একটা দেশের ফিল্মের প্রধান সুপারস্টার, এটাই যথেষ্ট সেদেশের ফিল্মের হাড্ডিসার দশা এবং অন্তঃসারশূন্যতা নির্দেশ করতে। জাতি হিসেবে আমরা কতটা অর্বাচীন সকল শাখার সম্মিলিত রূপায়ণ যেন শাকিব খানের সানগ্লাস দিয়ে ঠিকরে বেরোয়। এই শ্রেণিটি অনলাইনে সেলিব্রিটি হিসেবে চিহ্নিত, প্রায় প্রতি বিষয়েই তাদের জ্ঞানগর্ভ অভিমত দেখতে পাওয়া যায়। অনলাইনের রুচি তাদের ইজারায় থাকে। তারা ইংরেজি সিনেমা, বিভিন্ন টিভি সিরিজ দেখে ফিদা হয়ে যান এবং শিল্পের কোনো ভাষা আর সীমানা হয় না জাতীয় উদারনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে চিন্তাশৈলীর প্রদর্শন রাখেন। মূলত শ্যালো চিন্তাধারা আর অতিমাত্রায় জাজমেন্টাল, ইমোশনাল কনটেন্টের ছড়াছড়িতে তারা হয়ে উঠেছেন ‘সোস্যাল মিডিয়া কুতুব’ (গত সপ্তাহে ‘ঢাকার কুতুব’ সিনেমাটা দেখার পর থেকে কুতুব শব্দটা মাথায় ঘুরছিলো।)।
***
৪ মাস আগেও বাংলাদেশী সিনেমা নিয়ে আমার প্রধান অভিযোগ ছিলো প্রেডিক্টেবল স্টোরিলাইন আর বাজে আর্ট ডিরেকশন। গত মাসে হঠাৎ উপলব্ধি করি ‘কমার্শিয়াল সিনেমা’ উপমহাদেশের প্রায় সকল ইন্ডাস্ট্রিতেই কম-বেশি একই রেসিপি মেনে চলে। মারামারি-গোলাগুলি, নায়ক-নায়িকার রোম্যান্স, ৪-৫টি বা ততোধিক গান, ক্লাইমেক্স, কমেডি, প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য যৌনতা এবং অতঃপর তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকলো, মিথ্যা পরাজিত হলো ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো।
কমার্শিয়াল স্টোরিলাইন যেমন হয় বাংলাদেশের সিনেমাতেও তো তা-ই দেখা যায়। সমস্যাটা হয় উপস্থাপনে। ইলিয়াস কাঞ্চন বা ওয়াসিমরা একশন দৃশ্যে অভিনয়ের সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে যে সাউন্ড শোনা যেতো, শাকিব খানদের আমলেও সুখ-দুঃখ-একশনকালীন ব্যাকগ্রাউন্ডকালীন মিউজিকে কোনোই পরিবর্তন আসেনি। কিছুদিন ধরে সুপারম্যান এর বাংলাদেশী ভার্সন অনলাইনে ঘোরাঘুরি করছে। ড্যানি সিডাক, নাসির খান, নূতনদের অভিনয় দেখে লোকজন হাসাহাসি করছে। ৮০ এর দশকে প্রচুর সংখ্যক সাপের সিনেমা নির্মিত হতো। এখনকার কৃশ বা রা-ওয়ান জাতীয় সিনেমার মতো ওগুলোকেও ফ্যান্টাসি জনরায় ফেলে দেয়া যেতো,কিন্তু ওগুলো হাসির পাত্র হয় নির্মাণ অদক্ষতা আর বাজে অভিনয়ের দোষে।
শাকিব খানকে পর্যালোচনা করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলা সিনেমার আঙ্গিকগত বিষয়গুলো উঠে আসছে। বাংলা সিনেমায় কাটপিস ঢুকানো, অশ্লীলতা প্রভৃতি কাহিনীর এক সুদীর্ঘ ইতিহাসের খবর জানি আমরা। অশ্লীলতার জন্য কেউ ডিপজলকে, কেউ অসাধু প্রযোজকদের দায়ী করে থাকেন। এমনকি কলকাতার ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের দিকেও আঙ্গুল তোলা হয়।
কিন্তু আমি বরং অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাই বিষয়টাকে। শুনেছি এককালে এদেশে নাকি ১২০০ এর বেশি সিনেমা হল ছিলো, কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম হলসংখ্যা ২০০ এর কাছাকাছি তার কিছু কম। এতো বিপুলপরিমাণে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কী? ২০০০ সালে হলের সংখ্যা কত ছিলো, সেই তথ্য জানা নেই, তবে অতি অবশ্যই সংখ্যাটা ১২০০ এর চাইতে অনেক কম হবে। একটা প্রতিষ্ঠান কি হুট করে বন্ধ হয়ে যায়? শুরু হয় লোকসানের মধ্য দিয়ে, ধার-দেনা করে কিছুদিন লোকসানের মধ্যেও চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়, তবু্ও যখন শেষ রক্ষা হয় না, তখনই আসলে বন্ধ করতে হয় নিতান্ত বাধ্য হয়ে।
অশ্লীলতা বা কাটপিস সংযোজনকে বলবো লোকসান পূরণের জন্য মরিয়া কৌশলের সর্বশেষ ধাপ। লগ্নিকৃত টাকা ফেরত পেতে হলে সিনেমা চলতে হবে, বৈধ পথে চলছে না যেহেতু অবৈধ পথেও একটা মরণকামড় দেয়ার চেষ্টা করে দেখি।
কিন্তু এর মধ্যেও কিছু সিনেমা সুপার-ডুপার হিট হয়েছে। এগুলোকে বিবেচনায় নেয়ার যৌক্তিকতা নেই। বছরে যদি ৫০ টা সিনেমা মুক্তি পায়, সেখান থেকে ২-৩টা হিট হলেও সামগ্রীক চলচ্চিত্র ব্যবসার মন্দাভাব তাতে কাটে না। এককভাবে ২-১ জন প্রযোজক হয়তোবা লাভবান হন এতে।
চলচ্চিত্র ব্যবসার মন্দার কারণ কী এটা খুঁজতে গিয়ে একটা কথাই বারেবারে মনে আসে-‘চুরি বিদ্যা বড়ো বিদ্যা যদি না পড়ো ধরা’। বাংলা সিনেমার ইতিহাস নকলবাজি আর চুরিচামারির ইতিহাস। ১৯৫৬ থেকে ২০১৯ এই সুর্দীর্ঘ ৬৩ বছরে বাংলাদেশে ৬৩টা মৌলিক গল্পের সিনেমা কি দেখানো সম্ভব? অনেকটা নিশ্চিন্তেই বলতে পারি, একদমই নয়। আমরা যাদের কিংবদন্তী নায়ক বা পরিচালক হিসেবে মান্য করি, তারা তাদের সমগ্র ক্যারিয়ারে মৌলিক কাজ কয়টা করেছেন বুকে হাত দিয়ে কি বলতে পারবেন?
তবু তারা পার পেয়ে গেছেন, কারণ সেই সময়ে পৃথিবী এতোটা সংকীর্ণ হয়ে আসেনি। ইংরেজি. হিন্দি, ইরানী, কোরিয়ান মুভি দেখা মানুষের সংখ্যা ছিলোই নিতান্তই উপেক্ষণীয়। কিন্তু নব্বই দশকের পর থেকেই বিপ্লব আসতে থাকে বিশ্বজুড়ে; তথ্যের প্রবাহ আর আটকে রাখা যাচ্ছিলো না, যত দিন এগিয়েছে তথ্য আরো বেশি প্রতিবেশী হয়ে উঠেছে, এতোটাই তার সাথে নৈকট্য যে সে স্থান পেয়েছে পকেটে অথবা বুকপকেটে। ফলে চাইলেই যেখানে মূল কাহিনীর সিনেমাটি দেখে নেয়া যাচ্ছে, সেখানে নকল জিনিস দেখে সময় নষ্ট করার তো যৌক্তিকতা নেই। কলকাতার সাম্প্রতিক হিট সিনেমাগুলোর তালিকা দেখলে বিষয়টা আরো ভালোমতো বোঝা যায়। তামিল-তেলেগু রেসিপির সিনেমা চলছে না; ব্যোমকেশ, প্রাক্তন, বেলাশেষে, জাতিস্মর, চতুষ্কোণের মতো গল্পনির্ভর কনটেন্ট ব্যবসা করছে।
ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ওয়েবসিরিজ। ফলে শাকিব খানরা যদিওবা শ্যুটিং করছেন বাংলাদেশে, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীত
া করতে হচ্ছে বিশ্ব মার্কেট স্ট্যান্ডার্ডের সাথে। সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য যতটুকু বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ প্রয়োজন তা কি আছে আদৌ? দর্শক কিন্তু বাংলা সিনেমা দেখার আগ্রহ পোষণ করে এখনো। যারা প্রচুর সিনেমা দেখেন আয়নাবাজি, ঢাকা এটাক জাতীয় সিনেমাগুলো তাদের কাছে নিছকই ট্র্যাশ মনে হবে, তবু তারা দেখেছেন, কারণ কনটেন্ট বিচারে এগুলো তুলনামূলক মন্দের ভালো।
যাদের আমরা কিংবদন্তী আখ্যা দিয়েছি তারা যদি এখনকার মুক্ত বাজার বিশ্বে সিনেমাগুলো করতেন, বেশিরভাগই হয়তো জায়েদ খান, বাপ্পী বা সায়মন পর্যায়ের মিডিওকর তারকা হিসেবেই ক্যারিয়ার শেষ করতেন। এরমধ্যে শাকিব খান টিকে আছেন কীভাবে এটা প্রশ্নের বিষয় হতে পারে। তার সময়ে যারা মূল নায়ক থাকতেন (মান্না, রিয়াজ, ফেরদৌস, আমিন খান,অমিত হাসান), তাদের মধ্যে মান্না মৃত্যুবরণ করেছেন; রিয়াজ-ফেরদৌস-আমিন খান চলচ্চিত্র ব্যবসার মন্দাভাব বুঝতে পেরে বিকল্প ক্যারিয়ারে মনোনিবেশ করেছেন, অমিত হাসান নায়ক হিসেবে সুবিধা করতে না পেরে ভিলেন হয়ে গেছেন; সাইডনায়কেরা (শাহীন আলম, মেহেদী, আলেকজান্ডার বো, সোহেল) অশ্লীলতার ক্লিনহার্ট অপারেশনে বলির পাঠা হয়েছেন। প্রাক্তন হিসেবে টিকে ছিলেন কেবল শাকিব খান।
শাহীন আলম বা আলেকজান্ডার বো দের সাথে তিনিও সারথি কেন হননি, এর কারণ হিসেবে ফিল্ম পলিটিক্স বা লিয়াজো রক্ষা করার যোগ্যতাকে সামনে আনা যায়, কিংবা তার চেষ্টা-অধ্যবসায়কে ফ্যাক্টর বানানো যেতে পারে। নায়কশূন্যতার সময়ে কোনো একজন নায়ককে সুপারস্টার বানাতে হতোই, সেক্ষেত্রে মিডিয়া বাকিদের তুলনায় তাকেই কেন প্রায়োরিটি দিলো? সম্ভবত তার আউটলুক অন্যদের চাইতে কিছুটা সুবিধা দিয়েছে। কিংবা চাষী নজরুল ইসলাম তাকে ‘শোভা’ সিনেমায় কেন বাছাই করেছিলেন সেটাও চাষী নজরুলই ভালো বলতে পারতেন। লাইফলাইন পেয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শোভাকে অবশ্যই এক টার্মিনাল পয়েন্ট বলতে হবে।
আসলে একজন আর্টিস্টের জীবন অনেক যোগ-বিয়োগ-গুণন-
ভাগের জটিল সমীকরণ মেনে এগোয়, আমরা কেবল দূর থেকে অনুমাননির্ভর হাইপোথিসিস দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে পারি। শাকিব খানের ক্ষেত্রেই একই প্রযোজ্য বটে।
***
শাকিব খান যদি ৭০ বা ৮০ এর দশকে সিনেমায় আসতেন আজকের যুগের দর্শকেরা তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করতেন? ওয়াসিম আর মাহমুদ কলিকে মানুষ যেভাবে স্মরণ করে তিনি হয়তোবা সেই কাতারে থাকতেন,কিংবা ইলিয়াস কাঞ্চন নায়ক হিসেবে যে অবস্থান অর্জন করেছিলেন তিনি হতে পারতেন কাঞ্চনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী; হয়তোবা ‘বেঁদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’ গানের চিত্রায়ণে কাঞ্চনের পরিবর্তে শাকিব খানকে দেখতাম। তবে তখন তার নাম শাকিব খান না হয়ে মেহেদী হাসান কিংবা সুমন খান জাতীয় কিছু একটা হতো।
কারণ কী? সুদর্শনের যে সকল প্রচলিত মানদণ্ডে আছে প্রতিটিতেই তিনি ‘সুদর্শন’ হিসেবে উতরে যাবেন। নায়কের মতো চেহারা বললে গ্রাম বা শহরের লোকজন যে বর্ণনা মনে মনে সেট করে নেন তিনি খাপে খাপে মিলে যান।বাংলা সিনেমার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এখানে ম্যানলি রাফ এন্ড টাফ নায়কের চাইতে সুদর্শন চেহারার (রাজ্জাক, রহমান, জাফর ইকবাল, সালমান শাহ) নায়কেরা হার্টথ্রব হয়েছেন। জসিম, মান্না এবং রুবেলকে এ ধারায় আশ্চর্য ব্যতিক্রম বলবো, কারণ তাদের একটি পৃথক অডিয়েন্স গ্রুপ ছিলো। (ফারুক, আলমগীর,বুলবুল আহমেদ, ইলিয়াস কাঞ্চন জনপ্রিয়তা পেলেও হার্টথ্রব বলতে যা বোঝায় তেমনটি হয়ে উঠতে পারেননি সম্ভবত।)
মৌলিকতাশূন্য কোনো ইন্ডাস্ট্রি কখনোই টিকতে পারে না, ধ্বংস সেটি হতোই, শাকিব খানকে বলা যেতে পারে ইংরেজ শাসন পাকাপাকি হওয়ার পূর্বের শেষ স্বাধীন নবাব। ২০০০ সাল থেকেই যেহেতু চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারছে ফাঁকিজুখি দিয়ে টেকা যাবে না, এবং সিনেমা নিয়ে সত্যিকারের আগ্রহী কিংবা উচ্চশিক্ষিত ক্রিয়েটিভ মানুষেরা সিনেমা নির্মাণের সাথে যুক্ত হচ্ছেন, অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায় ২০৩০ এর আশপাশে বাংলা সিনেমা তার কলঙ্কমুক্ত হয়ে স্বকীয়তা অর্জন করবে। যে কোনো পরিবর্তনের ফলাফল পেতে অন্তত ২০-২৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়, আমরা জাতিগতভাবে চরম অধৈর্য বিধায় পরিবর্তনগুলোকে হুট করে ঘটা কোনো কারণ বলে ধরে নিই। মূলত ভার্টিকাল থিংকিংয়ে অপারদর্শীতা থেকেই এসকল বৈকল্য ঘটে মানুষের।
***
শাকিব খান কেমন অভিনেতা এ প্রশ্ন নিয়ে অনেকদিন ভেবেছি। রেফারেন্স ফ্রেম পাচ্ছিলাম না বলে হাসাহাসি করতাম। কলকাতায় সিনেমা করতে যাওয়ার পর নিশ্চিত হয়েছি, অভিনেতা হিসেবে তিনি সি ক্যাটেগরির। নকল সিনেমা তিনি অনেকই করেছেন, কিন্তু সেগুলো যেহেতু বাংলাদেশের অদক্ষ পরিচালক আর বাজে আর্ট ডিরেকশনের মধ্যে করা, তিনি বেনিফিট অব ডাউট পেয়েছেন। কিন্তু কলকাতায় গিয়ে যে সিনেমাগুলো করেছেন তার মধ্যে ২-৩টি দেখার সুযোগ ঘটেছে। সেগুলোর মূল তেলেগু/তামিল সংস্করণটি দেখা থাকায় দৃশ্য বাই দৃশ্য অভিনয় এপ্রোচ তুলনা করা গেছে, এবং তিনি সফলভাবে ১০ এ ৩ পেয়ে ফেইল করেছেন। হিউমার, একশন, সংলাপ, এক্সপ্রেসন সবকিছুতেই চরম আনাড়ীপনা।
তবে সমকালীন অন্যান্য বাংলাদেশী নায়কের তুলনায় তবুও তিনি সহস্র যোজন এগিয়ে। আমি মনে করি এটাই তার স্থবিরতার একমাত্র কারণ। দেশে বিরোধী দল না থাকলে সরকার যেমন স্বৈরাচারী হয়ে উঠে, তেমনি যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে যোগ্য মানুষরেও গ্রোথ থেমে যায়। আমরা যে প্রায় কোনোকিছুতেই বিশ্বমানে পৌঁছাতে পারি না তার কারণও এই স্থবিরতা। কোনোভাবে অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান হয়ে গেলে বাড়তি পরিশ্রম করার ইচ্ছাটুকুর ভবলীলা সাঙ্গ হয়।
২০৩০ এ শাকিব খানের ভূমিকা কী হতে পারে? যদি সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকেন তবে আমিন খান বা রিয়াজরা এখন যেভাবে সময় কাটাচ্ছেন শাকিব খানও সেই দলে ঢুকে পড়বেন। তাদের কনটেন্টহীনতা দিয়ে যে ২০২৫ পর্যন্তই টানতে পারবেন এটা ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পেই লিখে দেয়া যায়।
তাতে কি সুপারস্টার শাকিব খানের যথার্থ মূল্যায়ন হয়?
আসলে মূল্যায়ন করে কারা? যারা প্রচুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে লেখালিখি করে তারাই তো? তাদের লেখার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয় কে কোথায় অবস্থান করছেন? কিন্তু সেইসব মানুষ বরাবরই সংখ্যালঘু, তাদের লেখা পড়েই বা ক’জনে। বরং টিকিট কেটে যারা তার সিনেমা দেখেছে, তার ঘাড় কাত করে হাঁটা দেখে শিটি বাজিয়েছে তাদের কাছে তার আসন কখনোই টলমল হবে না।
হেরিটেজ অন্য জিনিস, এগুলো সবার জন্য প্রযোজ্য নয়, তা খুব জরুরীও নয়। যা রাজ্জাক, তা-ই সালমান শাহ, তা-ই শাকিব খান, কেবল সময়ের পৃথিবী এবং প্রযুক্তি আলাদা।
আমরা বরং ২০৩০ সালের বাংলা সিনেমার আঙ্গিক কীরকম হতে পারে সেসব নিয়ে পর্যালোচনা করতে থাকি। শাকিব খান বুবলি কিংবা নুসরাত ফারিয়ার সাথে উথালপাথাল নাচতে থাকুক।
লেখাটা লেখার পুরোটা সময় শাহেনশাহ সিনেমার একটা গানই শুনছিলাম। সেখান থেকে কয়েকটা লাইন
প্রেম পিরিতের ছন্দে ময়না, এমন কোমর দুলাইছে
রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইছে
মন মজানো রসের কথায় প্রেমের জালে ফাঁসাইছে
রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইছে