সময়ের হিসেবে বাংলাদেশের হয়ে দীর্ঘতম ক্যারিয়ার কোনো খেলোয়াড়ের? তিনি শুরু করেছিলেন আকরাম খান-বুলবুলদের সাথে, খেলেছেন হাবিবুল বাশার-পাইলটদের সাথে, সমসাময়িক আশরাফুল-শাহরিয়ার নাফিস, জুনিয়র সাকিব-মুশফিক, তার পরের ব্যাচ লিটন-সৌম্য এবং সর্বশেষ মিরাজ-শান্তদের সাথেও মাঠে নেমেছেন। ব্যাচ এসেছে, চলে গেছে, আসছে নতুন ব্যাচ, কিন্তু তিনি খেলে গেছেন ১৭ বছর, এবং ২০১৯ বিশ্বকাপের পর যদি অবসর নেন, ততদিনে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়স দেড়যুগ হয়ে যাবে। টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারের বয়স ২৪, এই তথ্যটা জানার সঙ্গে কী-ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিয়েন- তিনি একজন ফাস্ট বোলার, যতবার অপারেশন করতে হয়েছে, তার মাত্র একটা ইনজুরি/অপারেশনে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে নুয়ান জয়সা, সাইমন জোন্সের, অসময়ে ইতি টেনেছেন এন্ড্রু ফ্লিন্টফ; এইবার ১৮ আর ২৪কে পাশাপাশি রাখুন; গণিতের হিসেবে যতোই দক্ষ হোন ১৮>>২৪ মনে হতে বাধ্য! তুলনাটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ছিলো, তবু লেখার কনটেক্সটে এটাকে রাখতে চাইলাম।

২০১৫ তে তাকে নিয়ে ১টা ছোট্ট পোস্ট লিখেছিলাম যার সারমর্ম ছিলো, তাকে সুপারহিরো ইমেজ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেটা তার নিজের জন্য এবং ক্রিকেটের জন্য ক্ষতিকর। সেখানে উৎসাহী এক পাঠক মন্তব্য করে বসেছিলেন- মাশরাফির নখের যোগ্যও নন আপনি।

মন্তব্যটাকে কমপ্লিমেন্ট হিসেবে নিয়েছিলাম। আমি ক্রিকেট ভালোবাসি, ক্রিকেটার নয়। একমাত্র শচীন-দ্রাবিড় ব্যতীত কোনো ক্রিকেটারের প্রতিই আগ্রহ জন্মায়নি কখনো। মাশরাফির আগেও বহু ক্রিকেটার এসেছে, পরেও আসবে, যখন থেকে তার জীবন থেকে ক্রিকেট বিয়োগ ঘটবে, তাকে নিয়েও আলোচনা-পর্যালোচনা সমাপ্ত। ক্রিকেট ইতিহাসের জনপ্রিয়তম খেলোয়াড় শচীন টেন্ডুলকার কোথায় এখন? মাশরাফির নখ, সেটারও যোগ্যতা আছে যা আমি ২৯ বছরে অর্জন করিনি, এরকম কমেডিপ্রাণ মানুষ আছে বলেই তো প্রতিদিন নিয়ম করে ৫ বেলা হিউমারচর্চা করা যায়।

ইন্টারটেইনমেন্ট ক্যাটেগরিতে পড়ে সাধারণত মিউজিক, ফিল্ম, স্পোর্টস। তবে ফিল্ম বা মিউজিকের সাথে স্পোর্টস এন্টারটেইনমেন্টের বিস্তর প্রভেদ রয়েছে। ফিল্ম, মিউজিক প্রচণ্ড ব্যক্তিগত ক্যারিশমা নির্ভর ইন্টারটেইনমেন্ট। একজন গায়ক বা নায়কের সাথে ওয়ান টু ওয়ান কানেকশন গড়ে উঠে শ্রোতা-দর্শকের। শাকিব খান বা জেমসের প্রতি মানুষের যে আবেগ সাকিব আল হাসান বা তামিম ইকবালের প্রতি আবেগের সাথে মিলবে না সেটা। ধরা যাক, ভোক্তাশ্রেণী আলাদা, অর্থাৎ যিনি সিনেমা বা গান শোনেন, তিনি খেলা খুব বেশি দেখেন না, তবু নায়ক বা গায়কের প্রতি তার ভালোবাসাটা খেলোয়াড়কেন্দ্রিক আবেগের সাথে তুলনীয় নয়। ব্যক্তিগত খেলায় অবশ্য সে সমস্যা নেই। যেমন, রেসলিং বা টেনিস। কেইন-জন সিনা বা ফেদেরার-নাদাল কেন্দ্রিক ফ্যাসিনেশনের সাথে জেমস-আমির খান কেন্দ্রিক ফ্যাসিনেশনে তফাৎ সামান্যই।

কিন্তু যে কোনো দলীয় স্পোর্টসই কম-বেশি ন্যাশনালিজমকে প্রমোট করে। এটা দোষের নাকি অদোষের সেই নৃতাত্ত্বিক গবেষণা নিরর্থক। ন্যাশনালিজম একটি তীব্র পলিটিক্যাল কনসেপ্ট। রাষ্ট্রকে টিকে থাকতে হলে ইয়ুথ বা তারুণ্যের সমর্থন লাগে। যে কারণে প্রায় সকল প্রফেশনাল দলীয় স্পোর্টসগুলো তারুণ্যকে টার্গেট করে ডিজাইন করা। বয়স বাড়লে যেহেতু ফিটনেস কমে, বয়স্করা চাইলেও সিরিয়াস লেভেলে দলীয় স্পোর্টসের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না। খেয়াল করে দেখলে, মিউজিক-ফিল্মও তারুণ্যকেই উপজীব্য করে, তারাই মূল টার্গেট। সেই তারণ্যের শুরু হয় কৈশোরে (১৩-১৪ বছরে), শেষ হয় পরিণত বয়সে (৩৫-৪০ এর আশপাশে)। মানুষের জীবনের যে সময়টাকে গোল্ডেন এজ বলা হয় (১৩-৩৭), প্রায় সকল ইন্টারটেইনমেন্ট সেটাকে টার্গেট করে টিকে থাকে। তবে ৩০-৩৭ আবার এই টার্গেট মার্কেটের পিছিয়ে পড়া এজগ্রুপ, কারণ জাগতিক প্রায়োরিটিতে আরো অনেক কিছু ঢুকে পড়ে বলে এই বয়সের মানুষ চাইলেও ১৯ বা ২৩ বছরের কোনো তরুণের মতো করে পারে না ইন্টারটেইনমেন্ট মাধ্যমগুলোকে এক্সপ্লোর করতে।

পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেই কোনো না কোনো দলীয় স্পোর্টস জনপ্রিয়। এটা একটা পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি। ফলে তামিম ইকবাল যখন জার্সি পরে মাঠে নামে, একটা বাউন্ডারি হাঁকায়, উন্মাতাল ক্রিকেট দর্শকরা ভুলে যায় স্থান-কাল-পাত্র, তারা উদ্দীপ্ত হয়; কিংবা তামিম যখন হাতে আঘাত পায়, সেটা তার একার আঘাত থাকে না, সমস্ত দর্শকের হয়ে যায়। বলে বলে উত্তেজনা, টেনশন, ক্ষোভ, উচ্ছ্বাস এগুলোর সাথে বাকি ইন্টারটেইনমেন্ট মাধ্যমগুলো সঙ্গত কারণেই পেরে উঠে না।

একবার এক গবেষককে ইন্টারভিউয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, স্যার গবেষকরা কখনো পরিচিতি পান না অথচ ইন্টারটেইনাররা হয়ে যায় সোসাইটির আইকন; পৃথিবী জায়গাটা কি খুবই আনফেয়ার জায়গা একটা? তিনি প্রচণ্ড তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন. তুমি কি চাও এখন সারা দেশের মানুষ গবেষককে মাথায় তুলে নাচবে, লেখককে ফলো করবে? সেটা হয় কখনো? তাহলে গবেষকের গবেষণারই বারোটা বেজে যাবে। সাকিব ১টা চার মারলে লক্ষ লক্ষ মানুষ খুশি হয়; একটামাত্র চার মেরে লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুশি করা এটা কি চাট্টিখানি ব্যাপার? এই আনন্দকে তুমি ছোট করে দেখবে কেন? ইন্টারটেইনাররা আছে বলেই তো আমরা তাদের নিয়ে গবেষণা করে খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। ধরো, তুমি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে গবেষণা করো তাতে বাসের হেলপার, বা হোটেলের মালিকের কী; কিন্তু ভাবো একবার, মেসি গোল দিয়েছে, তারপর ওদের প্রতিক্রিয়া কী! এটাই পৃথিবী, ৩০০ বছর আগেও এমন হয়েছে, ৩০০ বছর পরেও এমনই হবে, তোমার চাওয়াটাকেই বরং আনফেয়ার লাগছে আমার’।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফিনামাকে সাড়ে ৪ পর্বে বিভক্ত করি আমি। একক মাশরাফিকে নিয়ে যতো লেখালিখি হয়েছে বা হচ্ছে, ২০০০ সালের পরে খেলতে নামা সকল ক্রিকেটার মিলিয়েও সমপরিমাণ লেখা (অনলাইন+অফলাইন) বরাদ্দ পায়নি এটা নিশ্চিত। ফলে মাশরাফিকে ক্রিটিকালি এনালাইসিস করে লিখতে যাওয়া, বিশেষত অনলাইন প্লাটফরম, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অনাকাঙ্ক্ষিত এবং ফালতু কমেন্ট, ব্যক্তি আক্রমণের বাড়াবাড়িতে আলোচনার পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যায়। তবে এ্যারোগেন্ট প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় নিন্দা-প্রশংসা দুটোকেই নিছক ডাটা হিসেবে দেখতে পারার সাহস রাখি।

প্রথম পর্ব- স্ট্রাইক বোলার মাশরাফি(২০০১- ২০০৭ বিশ্বকাপ)
শাহাদাত রাজিব আসার আগ পর্যন্ত মাঠে মাশরাফি ছিলো দীর্ঘতম খেলোয়াড়, বাকিদের মধ্য থেকেও আলাদা করা যেতো অনায়াসেই। কলার উচু, তেড়েফুড়ে এসে বোলিং করছেন বাংলাদেশী পেসার, এমন দৃশ্য ছিলো অভূতপূর্ব। ২০০০ সালে অভিষিক্ত জহির খান ততদিনে তারকা, ‘এ’ দলের হয়ে ভারত সফর করার সময় তাকে দেখে স্থানীয় অনেকেই আফসোস করেছিলো ভারতে এমন গতিশীল পেসার নেই কেন (তৎকালীন প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুসারে। সাংবাদিকরা বরাবরই একটু বাড়িয়ে লিখেন পাবলিক ইমোশনকে উস্কে দিতে; তবু ফিল্টার করে হলেও ধরে নেয়া যায় ভারত সফরে তিনি দৃষ্টি কেড়েছিলেন)। ২০০৭ বিশ্বকাপ পর্যন্ত বাংলাদেশ যেসব ম্যাচে জিতেছে, একটা প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়- মাশরাফি তার প্রথম ৬ ওভারের স্পেলে টপ অর্ডারের ১-২টি উইকেট ফেলে দিয়েছেন। এমনকি হেরে যাওয়া ম্যাচগুলোতেও কোনটাতে প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে তাও নির্ভর করতো মাশরাফির ৬ ওভারের প্রথম স্পেল। মাশরাফি দলের মোরাল বুস্ট আপ এর জন্য আদর্শ এক সৈনিক ছিলেন ক্যাপ্টেনের। ড্রেসিংরুমে তার নিক ছিলো ‘পাগলা’, তার ভূমিকা ছিলো চিয়ার লিডারের। শাহাদাত আর তাঁর এক যৌথ ইন্টারভিউ প্রকাশিত হয়েছিলো একবার, সেখানে তিনি শাহাদাতকে পাগলা সার্টিফাই করার কারণে রিপোর্টের ভাষা ছিলো- এক পাগলা আরেকজনকে পাগলা বলছেন, তিনি এখন পরিণত।

বোলিংয়ের পাশাপাশি আমি ব্যাটিংয়ে তার পিঞ্চ হিটিং এবিলিটির দিকে আলাদাভাবে নজর রাখতাম। ২০০১ এর সেই বিস্মরণীয় নিউজিল্যান্ড সফরে পুরো দল যখন নিউজিল্যান্ডের সিমিং কন্ডিশনে খাবি খাচ্ছে, শেন বন্ডের বলগুলো গোলা হয়ে উঠছে, সেই সময়ও টেস্টে বন্ডকে তিনি ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন। অবশ্যই ক্রিকেটিয় শট ছিলো না, নির্ভেজাল স্লগিং ছিলো, তবু সেই সময়ের বন্ডকে এভাবে ছক্কা হাঁকাতে সাহস লাগে। এখানেই তিনি বাংলাদেশের সকল (সাকিব বাদে) ক্রিকেটারের চাইতে ব্যতিক্রম। অথচ, কোনো এক অজানা কারণে পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে ব্যাট করতে গেলেই তাঁর মধ্যে আড়ষ্টতা চলে এলো একসময়। স্পিন বলে ছক্কা মারতে পারলেও ২০০৭ বিশ্বকাপের পর থেকে পেস বোলারদের বিপক্ষে তাঁকে খুব কনফিডেন্টলি স্লগ করতে দেখিনি সেভাবে।

শেওয়াগকে বল করতে ভয় পেতো না এমন বোলার ২০১১ পর্যন্ত খুব কমই ছিলো। কিন্তু শেওয়াগের সাথে তাঁর লড়াইটা বরাবরই উপভোগ্য ছিলো। বরং আপাত নিরীহ গৌতম গম্ভীরকে বোলিং করতে গিয়েই তাঁক ধুঁকতে দেখা যেতো। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম যে দুটো জয়, ম্যান অব দ্য ম্যাচ মাশরাফি এবং দুই ম্যাচেই শেওয়াগ মাশরাফির বলে যেভাবে বোল্ড হয়েছে তাকে বলা যেতে পেরে একশন রিপ্লে। কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জেতা ম্যাচে শুরুতেই গিলক্রিস্টকে লেগবিফোর করা।

ওয়ানডেতে একজন বোলার ১০ ওভার বোলিং করতে পারে, তবু মাশরাফি সংক্রান্ত আলোচনায় প্রথম স্পেলের ৬ ওভারই আলোচনায় আসে বারবার, কারণ ডেথ ওভার বোলিংয়ে তিনি কখনোই পারদর্শী ছিলেন না। প্রথম স্পেলে যত রান দিতেন, পরের ৪ ওভারে দেখা গেছে রান দিয়েছেন তার চাইতে বেশি। ওয়াসিম-ওয়াকার, ম্যাকগ্রা-ব্রেট লি, যে কোনো পেস বোলারের রিদমের জন্য একজন যোগ্য পার্টনার লাগে। ২০০৭ পর্যন্ত মাশরাফি কখনোই পাননি সেটা; তার সাথে দারুণ জুটি হতে পারতো তালহা জুবায়েরের, কিন্তু সেও তো আরেক উদাসী-বেখেয়ালি প্রকৃতির ক্রিকেটার (আমার পর্যবেক্ষণমতে)। বাঁহাতি সৈয়দ রাসেলের সাথে তার একটা জুটি হতে পারতো হয়তোবা, কিন্তু সৈয়দ রাসেল কি আদৌ পেস বোলার ছিলেন? একজন পেস বোলারের ২য় বা ৩য় ওভার থেকেই কিপার শর্ট কিপ করছে এ দৃশ্য বড়োই বেদনাদায়ক, যদিও রাসেল উইকেট পেতেন। ক্যারিয়ারের শুরুতে যদি মুস্তাফিজ বা রুবেলকে পেতেন, মাশরাফির উইকেটসংখ্যা, স্ট্রাইকরেট আরো ভালো হতো, অবলীলায় বলা যায়।

আর কোনো বোলারই সম্ভবত প্রথম ৬ ওভারে এতোটা ইমপ্যাক্ট রাখতে পারেনি সেই সময়ের ক্রিকেটে যেটা মাশরাফি পারতো। তবে বাংলাদেশের বোলিং অত্যন্ত সাদামাটা হওয়াতেই তাঁর ইমপ্যাক্টটা বেশি চোখে পড়ে। নইলে বিশ্বক্রিকেট প্রেক্ষাপটে তখনকার মাশরাফি কি খুব আমলে নেয়ার মতো কোনো বোলার ছিলেন? বা কিছুদিন পরে যখন ২৫১+ উইকেট নিয়ে অবসর নিবেন, তখনো কি মাশরাফি নামের কোনো ফাস্ট বোলারের নাম শীর্ষ ১৯ এ থাকবে? কোনো যৌক্তিক কারণ দেখি না। ধরা যাক, তিনি ইনজুরিতে পড়েননি, তবু উত্তরটা না-ই হবে। মাশরাফির যা গতি ছিলো, তা বাংলাদেশের মানদণ্ডে সন্তোষজনক হলেও বিশ্বক্রিকেটের বড়ো মঞ্চে সেটা আহামরি কিছু ছিলো না। সেই সময়ে তার ডিসমিসালের বড়ো অংশই এলবিডব্লিউ আর কট বিহাইন্ড; অর্থাৎ লেন্থই তাঁর বলের প্রধান অস্ত্র ছিলো সবসময়। তিনি স্লোয়ার দিতে জানতেন না, ইয়র্কার এখনো দিতে পারেন না, সুইংটাও ন্যাচারাল ছিলো না; আমার বিবেচনায় তিনি ছিলেন মোহাম্মদ আসিফের কিছুটা কাস্টমাইজড সংস্করণ। কিন্তু বোলার হিসেবে আসিফের যেসব অস্ত্র ছিলো, তিনি সে তুলনায় অনেকটাই দীনহীন। তবু অন্য পেসাররা গুণগত মানে এতোটাই পিছিয়ে ছিলো, তিনি এক্ষেত্রে কিছুটা এডভান্টেজ পেয়েছেন।

তবু বোলার হিসেবে আরো বেশি শাণিত হওয়ার জন্য যতোটা আন্তরিক অনুশীলনের প্রয়োজন ছিলো সেই সময়ের মাশরাফির মধ্যে সে-তাড়না ছিলো না, বড়ো কোনো ভিশনও ছিলো মনে হয়নি। স্থানীয় পেশাদার ক্রিকেটারদের মধ্যে যেমন ক্ষ্যাপ খেলোয়াড় মানসিকতা কাজ করতে দেখা যায়, তাঁর মধ্যেও হয়তোবা সেরকম কিছু ছিলো। খেলবো, ম্যাচ ফি নিবো, ম্যাকগ্রা-ব্রেটলি এর সাথে ছবি তুলবো এটাই তো যথেষ্ট। মাশরাফি বিশ্বক্রিকেটে বড়ো নাম না হওয়ার পেছনে অনেকে তৎকালীন এমেচার ক্রিকেট বোর্ডকে দায়ী করেন। আমি কখনোই সেই দলে থাকি না। সাকিব যখন খেলা শুরু করেছিলেন, তখনকার বোর্ড কি খুব পেশাদার হয়ে উঠেছিলো, রাতারাতি ফ্যাসিলিটি সব বেড়ে গিয়েছিলো? তবু তিনি সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে দীর্ঘদিন রেংকিংয়ে শীর্ষে থাকলেন কীভাবে? এখানেই চ্যাম্পিয়ন আর এভারেজ ক্রিকেটারের পার্থক্য। স্ট্রাইক বোলার মাশরাফি অনেকগুলো ম্যাচ জিতিয়েছেন, স্লগ ওভারে ক্যামিও ইনিংস খেলেছেন, কিন্তু লোকালিটি বা স্থানীয় সত্তাকে অতিক্রম করতে পারেননি। কেন পারলেন না, বা আদৌ কি তার মধ্যে ততটুকু সম্ভাবনা ছিলো? একজন সরফরাজ নেওয়াজ ছিলেন বলেই ইমরান খান, ওয়াসিম, ওয়াকার, শোয়েব, আসিফ, আমিরের পরম্পরা রক্ষিত হয়েছে। কিংবা ডেনিস লিলি-থম্পসনের পরম্পরায় ম্যাকডারমট-ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি-ডেমিয়েন ফ্লেমিং-ব্রেটলি-জনসন- টেইট- স্টার্ক। বিশ্বক্রিকেটে ফাস্ট বোলিংয়ের স্ট্যান্ডার্ড যেখানে উঠেছে সেখানে যাওয়ার মতো রসদ মাশরাফি কোথায় পাবে? স্রেফ প্রকৃতিদত্ত প্রতিভার জোরে একটা নির্দিষ্ট লেভেল পর্যন্ত উঠা যায়, আরো উপরের ধাপে যেতে পরম্পরা ইতিহাস লাগে। বাংলাদেশে সেটা ছিলো না। গোলাম নওশের প্রিন্স- হাসিবুল হোসেন শান্ত এরা কি পাইয়োনিয়ার হওয়ার মতো পেসার ছিলেন যে কোনো বিচারে? এচিভার হওয়ার জন্য যে পরিমাণ পরিশ্রম, ডেডিকেশন আর শৃঙ্খলার প্রয়োজন ছিলো, মাশরাফি আত্মজিজ্ঞাসা শেষে প্রতিটিতে কি নিজেকে পাশমার্ক দিতে পারবেন?

ফলে লোকাল হিরো হিসেবেই তাঁকে থেমে যেতে হলো। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তিনি জনপ্রিয়তম ক্রিকেটার, এই অর্জনের ওজনকেও হালকা ভাবার ন্যূনতম অবকাশ দেখি না।

পর্ব-২: বিস্মৃতপ্রায় মাশরাফি(২০০৮-২০১৩)
আশরাফুলকে সরিয়ে মাশরাফিকে অধিনায়ক করা হয় যখন, অধিনায়ক হিসেবে তিনি সম্ভবত কয়েকটা মাত্র বল ডেলিভারি দিতে পেরেছিলেন তৃতীয় সারির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। বোলিং করতে গিয়ে বোলিং মার্কে পড়ে বড়ো ধরনের ইনজুরিতে পড়ে সিরিজ থেকে ছিঁটকে পড়েন। বলা যায়, স্ট্রাইক বোলার মাশরাফিরও পতন সেই মুহূর্ত থেকেই। ইনজুরিতে আগেও পড়েছেন। প্রথমবার যখন ইনজুরিতে পড়েন বলা হয় তার বোলিং একশনটাই ত্রুটিপূর্ণ, এর কারণে পিঠে চাপ বেশি পড়ে। একশনে সামান্য বদল করেন। ২০০৩ বিশ্বকাপেও ফিরে আসতে বাধ্য হন মাঝপথে, তার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে দলে যোগ দেন আকরাম খান! ইনজুরিতে কীভাবে পড়েছিলেন? ১৫ বছর আগে পড়া পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, প্র্যাকটিসে ফুটবল খেলতে গিয়ে। নিউজিল্যান্ডে প্রথমবার ইনজুরিতে পড়েছিলেন অধিনায়ক পাইলটের অপরিপক্বতায়, কিন্তু পরের ইনজুরিগুলোর আসলে ব্যাখ্যা নেই তেমন। একে স্রেফ অক্রিকেটিয় ক্যাজুয়াল এপ্রোচ বলা যায়; নইলে একজন ফাস্ট বোলার বোলিং মার্কে পড়ে যাবেন কেন। এটা নিছকই দুর্ভাগ্য? তাহলে ইনজুরিতে থেকে ফিরেই বাসের পিছনের সিটে বসে নড়াইলে চলে যাওয়ার ব্যাখ্যা কী {দেবব্রত মুখার্জীর মাশরাফি বইয়ের আলোকে। যদিও সেখানে মাশরাফির চিত্রানদী, হোমসিকনেস প্রভৃতিকে হাইলাইট করে ব্যাপারটাকে রোমান্টিসাইজ করার চেষ্টা করা হয়েছে, আমি এটাকে সরাসরি আনস্পোর্টসম্যানশিপ আচরণ বলবো। বিসিবি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে আপনার চিকিৎসা করাচ্ছে, আপনি খেয়াল খুশিমতো বাড়ি চলে যাবেন বাসে চড়ে; এটা কোনো এথলেটের লাইফস্টাইল হতে পারে না]

২০০৭ পর্যন্ত মাশরাফি যখনই বোলিং করুক, যাকেই করুক, একটা তেজোদ্দীপ্ত মনোভঙ্গিতে খেলা দেখতে বসতাম। বাংলাদেশের পেস বোলাররা অনেকটাই ছিলো প্রতিপক্ষের টপ অর্ডারের জন্য মহার্ঘ্য টাইপ, সেখানে তেড়েফুড়ে আসা এক বোলার ওপেনারকে বিট করছে, ইনসাইড এজ করাচ্ছে, কিংবা টপ এজড হচ্ছে তার বলে- এটা খেলা দেখার আনন্দই অন্যমাত্রায় নিয়ে যেতো। কিন্তু ২০০৭ পর্যন্ত এমন খুব কমই হয়েছে তাঁকে টানা ২-৩টা সিরিজ পুরো ফিট অবস্থায় পেয়েছি আমরা। তাপস বৈশ্য, মোহাম্মদ শরীফ, মঞ্জুরুল ইসলাম, আহমেদ কামাল কর্নেল, তারেক আজিজ কিংবা আলমগীর কবিরেরা যখন প্রতিপক্ষের ওপেনারদের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করতো, কিংবা তালহা জুবায়ের যখন ১-২ বার বিট করতো, প্রতিবার মনে হতো, ইশ মাশরাফি থাকলে ম্যাচের চেহারাটাই বদলে যেতো। ফলে মাশরাফি থেকে কী করেছেন এর চাইতে মাশরাফি থাকলে কী করতে পারতেন এই আক্ষেপ নিয়েই ম্যাচের পর ম্যাচ কেটেছে।

বোলিংপ্রান্তে পড়ে যাওয়া থেকে স্ট্রাইক বোলার মাশরাফির যে হারিয়ে যাওয়ার শুরু, তা স্থায়ী হয় ২০১১ বিশ্বকাপের আগে। নিজেকে ফিট রাখার জন্য লীগে অফস্পিন বোলিং করেছেন, সেই বোলারকে ফিজিও রিপোর্ট দিলো ম্যাচফিট হিসেবে; এটা এখনো উদ্ভট এবং হাস্যকর লাগে। যে বোলার বল করবে নতুন বলে তিনি লীগের ম্যাচে অফস্পিন বোলিং করে ফিটনেস দেখালে চলবে? নেটে ফুল রান আপ এ বোলিং করেছিলেন কয়দিন? অথচ মিডিয়াতে এলো, দেশের মাটিতে বিশ্বকাপে খেলতে পারছেন না মাশরাফি, আলোচনায় শোনা গেলো সাকিব নিজের আধিপত্য নিরঙ্কুশ করতে সিনিয়র খেলোয়াড় দলে রাখতে চায় না; তাছাড়া সাকিব তো তখনো পর্যন্ত প্রক্সি ক্যাপ্টেনই ছিলো বেশিরভাগ সময়; মূল ক্যাপ্টেন হয়েছে অনেকদিন পরে। যার কাছ থেকে ক্যাপ্টেন্সি পাওয়া সে দলে থাকলে এবং বয়সে সিনিয়র হলে স্বাধীনভাবে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছুটা অস্বস্তি হতেও পারে। শত হলেও মানুষ তো। এক্ষেত্রে একটা ইঙ্গিত হতে পারে, ২০১০ এর ইংল্যান্ড সিরিজ। সিরিজের মাঝপথেই টিম হোটেলে ছেড়ে চলে যান মাশরাফি। এর কারণ কী ছিলো তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।

অস্বস্তির ব্যাপারটা আরো ভালোভাবে বোঝা যায়, ২০১১ বিশ্বকাপের অব্যবহিত পরে অস্ট্রেলিয়া যখন বাংলাদেশ সফরে আসে। প্রথম ওয়ানডেতে একাদশে সুযোগ পান মাশরাফি; ওজন বেড়েছে কমপক্ষে ১১ কেজি, চেনাই যাচ্ছিলো না। মাঠে বসে দেখেছিলাম ম্যাচটা। খুবই বাজে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিলো মাঠের মধ্যে; যেন মাশরাফি অনাহূত কেউ; উইকেট পড়লে দল সেলিব্রেশন করে মাশরাফি দূরে দূরে থাকেন। অথচ এটা তো মাশরাফির স্বভাবের সাথে একদমই মানানসই নয়। মাঠের অবস্থান দেখেই অনুমান করা যায়, দলের ভেতরে তিনি কিছুটা কোণঠাসা হয়ে ছিলেন। ২য় ওয়ানডেতে একাদশে রাখা হয় না।

রুবেল, শফিউলদের উত্থান, নাজমুলের প্রত্যাবর্তন+স্ট্রাইক বোলার পরিচয় বিলুপ্ত হওয়া, মাশরাফির থেকে লাইমলাইট অনেকটাই কেড়ে নেয়। মাশরাফি তখন পারফরমারের চাইতে ইনজুরিজেতা যোদ্ধা, স্পিরিট অব স্পোর্টসম্যানশিপের বড়ো উদাহরণ। এমনকি টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরি করার ম্যাচে ভারতকে হারিয়েছিলো বাংলাদেশ, সেই ম্যাচে মাশরাফি একাদশে ছিলেন, টেন্ডুলকারের উইকেটটিও লাভ করেছেন, কিন্তু তার কোনো গল্প শোনা যায় না। এমনকি ২০১২ এশিয়াকাপ ফাইনাল পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানে হারের পর সাকিব, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহর বিষন্ন চেহারার ছবি ইউটিউব-গুগলে এখনো পাওয়া গেলেও মাশরাফির কোনো ফুটেজ পাওয়া যায় না। কেন? এতোটাই শীতনিদ্রা অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন তিনি।

স্ট্রাইক বোলার মাশরাফিকে আমরা কতটা মিস করি, এটা বোঝানোর জন্য একটা তথ্য সংযুক্ত করা উচিত। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানোর পর মাশরাফি আবারো গেম চেঞ্জার (ম্যান অব দ্য ম্যাচ) হয়েছেন ২০১৭ এর ইংল্যান্ড সিরিজে ২য় ওয়ানডেতে ৪ উইকেট পাওয়ার পর। মাঝে কেটে গেছে প্রায় ১০ বছর। মাঝের এই সময়টাতে তিনি বোলিং করেছেন, উইকেট পেয়েছেন, কিন্তু বলের সেই বাইট অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন, যেটা ফেরত পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১৫ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। তবে ২০১৫ পরবর্তী বোলিংয়েও বাইট নেই বিশেষ, ১২৫-২৬ কি:মি:/ঘণ্টা গতিতে বল করেন, একটা নির্দিষ্ট চ্যানেলে বল রাখেন, কাটার চেষ্টা করেন। উইকেট টেকিং ডেলিভারির জন্য রুবেল-মুস্তাফিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তার ভূমিকা প্রধানত রান নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবু উইকেট পান এখনো, যদিও সেই উইকেট টেকিং ডেলিভারিতে ফাস্ট বোলারসুলভ আগ্রাসন থাকে না, মূলত ব্যাটসম্যানকে ধোঁকা দেয়াজনিত সাফল্য থাকে।

এমনকি তাঁর পুনর্বার অধিনায়কত্ব পাওয়াটাও একটা লটারি জেতার মতো ব্যাপার। মুশফিকের ডিফেন্সিভ ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে সরব মিডিয়া, দর্শকসহ সকল শ্রেণি। তামিম ইকবাল তখন ভাইস ক্যাপ্টেন, অথচ ফ্রম নোহোয়ার শ্রীলংকার বিপক্ষে টি২০ তে ক্যাপ্টেন বানানো হলো মাশরাফিকে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও পাওয়া গেছে প্রচুর। টেস্ট আর ওয়ানডে-টি২০ এর জন্য আলাদা ক্যাপ্টেন নীতিতে যখন যাওয়া হলো, মাশরাফি ছাড়া আর অপশনও ছিলো না তেমন। সাকিবকে হটিয়েই মুশফিককে ক্যাপ্টেন করা হয়েছিলো, তাকেই পুনরায় ক্যাপ্টেন করাটা বোর্ডের নৈতিক পরাজয় হতো তখন, তামিমের প্রতিও আস্থা ছিলো না কোনো কারণে, মাহমুদুল্লাহ তখনো ‘ভায়রা ভাই’ খেতাব বয়ে বেড়াচ্ছে, নাসির অধিনায়কত্ব পাওয়ার মতো ম্যাচিউরড না; বাকি ছিলো কেবল একজন- মাশরাফি।

অধিনায়কত্ব খোয়ানো এবং পুনরুদ্ধারের মধ্যবর্তী সময়টুকুতে কোথায় ছিলো মাশরাফি, কীভাবে কেটেছে তার স্ট্রাগলের মুহূর্তগুলো- এসব গল্প সেভাবে শোনা যায় না, কারণ এই গল্পে গ্ল্যামার নেই। বরং ১০বার সার্জারি করে পঙ্গুত্বের হুমকি নিয়েও দেশের টানে খেলে যাচ্ছেন- এই ফালতু সেন্টিমেন্টাল গল্পেই সয়লাব সর্বত্র। একজন পেশাদার ক্রিকেটারের আয়-রোজগারের মাধ্যমই হলো ক্রিকেট; খেলা না থাকলে তো সে কমপ্লিট বেকার। মাশরাফি তার যা করণীয় শুধু সেটুকুই করেছেন, অথচ তার খেলোয়াড়ি সকল অর্জন আড়ালে চলে যায় ১০ সার্জারির গল্পের শৌর্যে-বীর্যে। এই গল্পের সেলিং ভ্যালু বেশি, যদিও ইথিকালি এই গল্পটা সেভাবে প্রচারই পাওয়া উচিত না। যুবরাজ সিং ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি জয় করেও তো ফিরে এসেছিলো, সেটা কিন্তু বাড়াবাড়ি গল্পের জায়গা দখল করেনি। হয়তোবা সে পারফরম করে দলে জায়গা ধরে রাখতে পারলে ক্যান্সার নিয়ে গল্প যতটুকু হয় ততটুকুও থাকতো না।

মাশরাফির সার্জারি তবু গল্প হয়, কারণ আমাদের এখানে দান-খয়রাত করা মহত্ত্বের লক্ষণ, আমাদের রিয়েলিটি শো গুলোতে নোলক বাবু-সালমা আক্তাররা চ্যাম্পিয়ন হয় মানুষের সিমপ্যাথিজনিত অন্তঃসারশূন্যতায়। ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে ২৫০+ উইকেট পাওয়া একজন বোলার তার সকল কৃতিত্ব ছাপিয়ে ইনজুরির কারণে আলোচনায় থাকেন। এই দৈন্যের দায় আসলে কার!

পর্ব৩- ম্যাজিকাল মাশরাফি:
ক্যারিয়ারের ১৪তম বছরে সত্যিকারের অধিনায়কত্বের সাথে পরিচিত হন মাশরাফি। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানো, দেশের মাটিতে পাকিস্তান, ভারত, সাউথ আফ্রিকাকে সিরিজ হারানো, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন, এশিয়া কাপ টি২০ তে পাকিস্তান-শ্রীলংকাকে হারানো প্রভৃতি সাফল্যের মধ্য দিয়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় হয়ে উঠে যার কৃতিত্ব কেউ দেয় কোচ হাথুরিসিংহকে, কেউবা ক্যাপ্টেন মাশরাফিকে, যদিও দলীয় অলআউট এফোর্টের তুলনায় ইনডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্সই বেশি করে নজরে পড়ে [মুস্তাফিজ, সৌম্য]।

একদার পাগলা, এলোমেলো, মাঝের ৮ বছর বিস্মৃতপ্রায় মাশরাফি হঠাৎ করেই হয়ে উঠেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের ফাদার ফিগার। জুটে যায় কোটি কোটি অন্ধভক্ত। ভক্তি আর শ্রদ্ধা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। ভক্তি হলো মুগ্ধতার প্রাবল্যে নিঃশর্ত সমর্পণ, যা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির জন্য ক্ষতিকার। শ্রদ্ধা হলো, কোনো সুনির্দিষ্ট কারণে কারও প্রতি ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি হওয়া যা ঐ ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। শ্রদ্ধার মধ্যে ক্রিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, যে কারণে সহসা শ্রদ্ধায় ফাটল ধরে না পরিস্থিতি যা-ই হোক। পক্ষান্তরে ভক্তি অনেকটা আফিমের নেশার মতো, নেশা কেটে গেলে ভক্তিও ছুটে যায়।

মাশরাফির এতো কীভাবে তৈরি হলো সেটা বোঝার জন্য তার ব্যক্তিসত্তা বোঝাটা জরুরী।

মাশরাফি বন্ধু পরিবৃত অবস্থায় চলাফেরা করতেন ছোটবেলা থেকেই, ডানপিটে-দুরন্ত প্রকৃতির। ফলে মানুষকে আকৃষ্ট করা এবং মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার সহজাত এক ক্ষমতা আছে তার, সহজ ভাষায় যাকে বলা যায় সারল্য বা সিম্পলিসিটি। যে কোনো সেলিব্রিটির কাছে আমরা স্টারডম প্রত্যাশা করি, যা সাধারণ মানুষের সাথে তাদের পার্থক্যটা বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু মাশরাফি জীবনাচরণে প্রোটোকলের ধার ধারেন না, যা তাকে সাধারণের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। বিস্ময়-চমক এগুলো হলো এট্রাকশন মেকানিজম।

‘এট্রাকশন মেকানিজম’ শব্দবন্ধটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তার আগে দুটো ভারতীয় সিনেমার উদাহরণ স্মরণ করা যাক- ‘পেজ থ্রি’, ‘হিরোইন’। নাম আলাদা হলেও সিনেমাদ্বয়ে সেলিব্রিটি লাইফস্টাইল নিয়ে বেশ কিছু চিরাচরিত বাতচিতই প্রদর্শিত হয়েছে। এর মধ্যেও একটা বিশেষ পয়েন্ট এ লেখার জন্য উপাদেয় হতে পারে, চিন্তাশীলদের চিন্তার খোরাক যোগাতে পারে। দুটি সিনেমাতেই আমরা সাংবাদিক এবং সেলিব্রিটির মধ্যে ইন্টারপারসোনাল রিলেশনশিপের একটি স্পেস খুঁজে পাই, যেটা সেলিব্রিটির ‘পিআর এজেন্ট’ হিসেবে সাংবাদিকদের কাজ করার স্ট্র্যাটেজির সাথে পরিচিত করে আমাদের। পিআর কৌশল হিসেবে বিভিন্ন স্ট্যান্টবাজি দেখি।

সিনেমা কোনো আরব্যরজনীর রূপকথা নয়, আমাদের ব্যক্তিগত ফ্যান্টাসিরই ম্যাগনিফিকেশন মাত্র।

ডিভাইন জাস্টিস কনসেপ্ট নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তারামাত্রই জানেন এর শক্তিমত্তা কতখানি। যে মেকানিজমের প্রভাবই হোক, বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফি বর্তমানে যে জায়গায় অধিষ্ঠিত এটাই তিনি ডিজার্ভ করেন। বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারের জীবন এতোখানি চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যায়নি। তাই এট্রাকশন মেকানিজমের প্রভাবে ভক্তকুল যদি জুটেও যায় আমি এটাকে বেনিফিট অব ডাউট দিতে চাই।

এট্রাকশন মেকানিজমের কিছু উদাহরণ দিই:
সৈয়দ রাসেল চিকিৎসার জন্য ৪-৫ লাখ টাকা ধার চেয়েছিলো মাশরাফির কাছে। তিনি বলেছেন, ধার দিবো না, বন্ধুকে চিরতরে দিয়ে দিবো।– এই খবর আমরা জানলাম কী করে?

মুস্তাফিজের অভিষেক ওয়ানডেতে প্রথমবারের মতো ৪ পেসার দিয়ে একাদশ সাজিয়েছিলো বাংলাদেশ। কোচ হাথুরুসিংহে কোনোভাবেই মুস্তাফিজকে একাদশে রাখবেন না। মাশরাফি ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে একাদশে রাখেন, নিজের পছন্দের নতুন বল তার হাতে ছেড়ে দেন। ড্রেসিংরুমের অতি সংবেদনশীল মিটিংয়ের খবর বাইরে বেরিয়ে এলো কীভাবে?

কিরে ব্যাটা, সৌম্য আর রিয়াদরে বোলিং দিয়াই তো পাকি গো হারাইয়া দিলাম।– এই মেসেজই বা দর্শক জানে কোন্ সূত্রে?

মাশরাফির ছোট ভাই শ্রীলংকার বিপক্ষে টি২০ এর আগে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলো সবাইকে টসের দিকে চোখ রাখার জন্য। টস তো প্রতি ম্যাচেই হয়, কিন্তু ওই ম্যাচের টসের বিশেষত্ব কী? ওই ম্যাচে টসের সময়ই আমরা প্রথম জানতে পারি, টি২০ থেকে অবসর নিচ্ছেন মাশরাফি। মানলাম তার সাথে কোচের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিলো, বোর্ড থেকে প্রেসার ছিলো, কিন্তু প্ল্যান করে টসের সময় অবসরের ঘোষণা দিয়ে তিনি কি প্রতিশোধপরায়ণ আনাড়ি মানুষের মতো কাজ করেননি? টি২০ ছাড়ার পর একই কোচের অধীনে আরও কিছু ওয়ানডেম্যাচ তো খেলেছেন, তাহলে কোচ-বোর্ড, এদের দর্শকের চোখে ভিলেন বানানোর মানে কী আসলে? ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও তো বলা যেতো এটা।

২০১৬ তে আফগানিস্তানের সাথে ম্যাচ চলাকালে মাঠে ঢুকে পড়েছিলো এক দর্শক, জড়িয়ে ধরেছিলো মাশরাফিকে। নিরাপত্তারক্ষীদের কাছ থেকে মাশরাফি বাঁচিয়েছিলেন তাকে; এখনো অনলাইনে সেই ছবির অজস্র কপি লক্ষ্য করা যায়। সবাই মাশরাফির ঔদার্যের প্রশংসা করে। কিন্তু সেদিন ওই দর্শককে উপযুক্ত শাস্তি না দেয়ায় তার পরিণতি হয়েছে আরো ভয়াবহ; সিলেট টেস্টে ২ বার মাঠে ঢুকে পড়েছে দর্শক, যার একজন আবার ডিএসএলআর নিয়ে প্রস্তুত হয়েই এসেছিলো। এটেনশন সিকার বিকারগ্রস্ত মানুষদের অনেকেই ভবিষ্যতে মাঠে ঢুকে পড়বে হয়তোবা। এই আনস্পোর্টিং কালচার প্রোমোট করার দায় এড়াতে পারবেন মাশরাফি?

তামিম বা সাকিব পারফরমার হিসেবে বহুযোজন এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও তাদের ইন্টারভিউ বা এক্সপোজার মাশরাফির তুলনায় এতো কম কেন? এখানেও মাশরাফির সেই সিম্পলিসিটি বা প্রটোকলহীনতাই মূখ্য হয়ে উঠেছে। তারা হয়তোবা ভাবে, আমার কাজ খেলা, আমি মাঠেই কথা বলবো ব্যাট-বলের ভাষায়, সাংবাদিক পোষার সময়-ইচ্ছা নাই। যে কারণে তাদের কাছে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।

কিন্তু মাশরাফির কাছে সেই সমস্যা নেই। চেষ্টা করলেই এন্ট্রি পাওয়া যায়। মাশরাফি বিভিন্ন বিষয়ে অনর্গল বলতে থাকেন; সেইসকল কথা ক্রিকেটানুরাগী-ক্রিকেটবিরাগী উভয়শ্রেণিকেই আকৃষ্ট করে। তাতে সাংবাদিক-মাশরাফি দুইপক্ষেরই উইন-উইন কেস। এটাকে বলা যায় তার পিআর বা মার্কেটিং ইনভেস্টমেন্ট।

কিন্তু কী হবে এই ইনভেস্টমেন্ট দিয়ে? আমরা যদি মাশরাফির বক্তব্যগুলো বোঝার চেষ্টা করি, তিনি কেয়ারফুলি কেয়ারলেস পারসন, তার মধ্যে দূরদর্শীতা রয়েছে। সেই দূরদর্শীতাকে এনক্যাশ করার কোনো সুযোগ যদি কখনো চলে আসে! কী সেই সুযোগ তা হয়তো জানা নেই তার, কিন্তু এটা বুঝেন জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। যার কাছে যত বেশি মানূষ, তিনি ততবেশি ক্ষমতাশালী এবং রিসোর্সফুল মানুষ।
প্রায় ১৪ বছর আক্ষেপের নাম কিংবা নিভৃতচারিতার অসীম ধৈর্য ধরে ১৫তম থেকে ১৭ তম, মোট ৩ বছরে যে মোমেন্টাম তিনি অর্জন করেছেন আগামীদিনের বাংলাদেশে আর কোনো ক্রিকেটার তা পারবেন সেই সম্ভাবনা একদমই দেখি না। লক্ষতে ১টা ক্রিকেটার মাশরাফি হয় বলেই তিনি বা তাঁরা ম্যাজিকাল ফিগার হয়ে থাকেন।

ক্যাপ্টেন মাশরাফি:
ক্যাপ্টেন্সির দুটো পার্ট থাকে: স্ট্র্যাটেজিক, লিডারশিপ। ক্রিকেট মস্তিষ্ক বলতে যা বোঝায় সেই সংজ্ঞায়নে মাশরাফি কখনো ভালো নম্বর পাবেন, কখনো বেশ বাজে নম্বর পাবেন। অর্থাৎ তার ডাটা পর্যালোচনা করে কনক্লুসিভ কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। তিনি অনেক বেশি ইনটিউশননির্ভর মানুষ। খেলা চলাকালে তিনি এমন অনেক কাজ করেন যার ক্রিকেটিয় ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু ইনটিউশনের উপর এতোটাই আস্থা তার, অনেক রেন্ডম মুভই পেঅফ করে। এশিয়া কাপ ফাইনালে মিরাজকে ওপেন করানো, আফগানিস্তানের বিপক্ষে রশিদ খানকে খেলার অংশ হিসেবে ইমরুলকে ৬এ নামিয়ে দেয়া, কিংবা ভারতের বিপক্ষে টি২০ তে ২ রানে হারা ম্যাচে নিজে ৫ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে যাওয়া, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে খেলার ধারার বিপরীতে মোসাদ্দেককে বোলিংয়ে আনা (ম্যাচের মোড়ই পাল্টে দিয়েছিলো মোসাদ্দেক)- প্রতিটি সিদ্ধান্তকেই আপনি স্ট্র্যাটেজিক বলতে পারেন, কিন্তু ক্রিকেটিয় দৃষ্টিকোণে সেগুলোর ভিত্তি নাজুক।

তবে একজন সাধারণ দর্শক বা ধারাভাষ্যকার যা ভাবছেন অধিনায়ক যদি তা-ই করেন সেটাকে ক্রিকেটসেন্স বলতেও দ্বিধা কাজ করে। বরং অন্যরা যা ভাবছে না, ক্যাপ্টেন যদি সেটাই করে দেখাতে পারে এবং পে অফ করে তাহলে ক্রিকেট সেন্সের নতুন সংজ্ঞায়নেই রাজি আমি।

তবে ফিল্ড প্লেসিংয়ে খুবই এলোমেলো মাশরাফি। এটাকে স্ট্র্যাটেজিক বলার সুযোগ নেই। সাকিবের ফিল্ড প্লেসমেন্টগুলো লক্ষ্য করলে এই জায়গায় মাশরাফির এমেচারিতা আরও প্রকট হয়ে উঠে।

লিডারশিপ প্রশ্নে মাশরাফির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। তাসকিনের সাথে ম্যাশকিন সেলিব্রেশন মনে আছে যাদের তারামাত্রই বুঝবেন লিডারশিপটা কোত্থেকে আসে। কিংবা মাহমুদুল্লাহকে যখন শ্রীলংকার বিপক্ষে ওয়ানডে থেকে হুট করে বাদ দেয়া হলো, তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। তামিমের যখন দুঃসময় যাচ্ছিলো তখনো পাশে দাঁড়িয়েছেন, এবং সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ লাগে, ২০১১-১২ তে সাকিবের সাথে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো সেটাকে ম্যানেজ করে দলকে একসূত্রে গ্রথিত রাখা; এটা বিশেষ ক্যারিশমাটিক যোগ্যতা, খুব কম মানুষই ধারণ করে তা। দলের জুনিয়র ক্রিকেটারদের প্রায় সবাই-ই তার অনুগত। এটা লিডারশিপের একটি পলিটিক্যাল এপ্রোচ, যার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীকে অবদমিত রাখা যায় এবং নিজেকে আরো অবিসংবাদিত বানানো যায়। সাদা চোখে ব্যাপারগুলোকে নিছক ইন্টিমেসি বা মেন্টরিং মনে হলেও এর মধ্যে যে কন্ট্রোল মেকানিজমের একটা আবহ আছে তা বুঝতে হলে খেলা এবং খেলার বাইরের অনেক কিছুতেই দৃষ্টি দিতে হয়, ডটগুলো কানেক্ট করতে হয়।

আপনি যদি কানেক্ট করতে পারেন করুন, না পারলে ইউটিউবে শেওয়াগকে বোল্ড করা ডেলিভারিটা দেখে উচ্ছ্বাসে বলে উঠুন- ওয়াও!

নির্বাচনী ক্রিকেটার:
বিসিবির কোড অব কন্ডাক্টে নিশ্চিতভাবেই কোনো রানিং প্লেয়ারের দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার অনুমতি নেই। সুতরাং মাশরাফির নির্বাচন করাটা ওখানেই অবৈধ হয়ে যায়। তবে মাশরাফি নিজেকে এমন এক ব্র্যান্ডে উন্নীত করেছেন যেখানে নিয়ম-নীতি তার জন্য পুনর্লিখিত হয়। তবে ক্রিকেটারদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বরাবরই ওপেন সিক্রেটের মতো। ক্রিকেটার দুর্জয় এমন কোনো ফর্মে ছিলেন না যে কারণে আমিনুল ইসলামকে সরিয়ে তাকে অভিষেক টেস্টের অধিনায়ক করা যেতে পারে। আবার, এতোটাও বাজে ফর্মে চলে যাননি যে তৎকালীন নির্বাচক তার বোলিং নিয়ে কটূক্তি করতে পারে (ও তো স্রেফ দৌড়ে গিয়ে বল ছুঁড়ে দিচ্ছে, ওরকম বল আমিও করতে পারি), এবং অধিনায়কত্ব হারানোর সাথে সাথে দল থেকেও বাদ। কোনোরকম যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও খালেদ মাহমুদের জাতীয় দলে খেলা, খেলা ছাড়ার পর বোর্ডের প্রভাবশালী পদ পাওয়া, বুলবুলের বোর্ডে গুরুত্ব না পাওয়া কিংবা আরো অনেক লক্ষণ দেখলেই বোঝা যায়, ক্লাব রাজনীতি আর দলীয় রাজনীতির সরাসরি প্রভাব পড়ে জাতীয় দল নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।

মাশরাফির নমিনেশন ফরম কেনাটা দীর্ঘদিনের পরিকল্পনারই অংশ বলা যায়। নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশনের ভিশন কী এটা নড়াইলের মানুষদের জিজ্ঞেস করলেই সবচাইতে ভালো উত্তর পাওয়া যাবে। যে কোনো রাজনৈতিক নেতা মনোনয়ন পাওয়ার উদ্দেশ্যে নির্বাচনের ২-৩ বছর আগে থেকে এলাকাতে যে সমস্ত গণসংযোগমূলক কার্যক্রম চালান মাশরাফিকে সেই কাতারে ফেলতে একটুও কি অসুবিধা হয়?

মাশরাফি ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলবেন এটা হয়তোবা তার নিজেরও বিশ্বাস ছিলো না। ২০১৫তে সাউথ আফ্রিকাকে সিরিজ হারিয়ে বাংলাদেশ যখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো, মিডিয়া এবং অনলাইনে বেশ কয়েকবারই ফিসফিসানি পাওয়া গেছে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলেই অবসরে যাবেন তিনি। বিপিএলে খুলনা টাইটানসের হয়ে মাহমুদুল্লাহর পারফরম্যান্স দেখে অনেকেই তাকে ভবিষ্যত অধিনায়ক ভাবতে শুরু করেছিলেন।

২০১৭ এর শুরুর দিকে নিউজিল্যান্ড সফর থেকেই মাশরাফিকে দেখতে ক্লান্ত-অবসন্ন লাগে। আইয়ুব বাচ্চুর শেষের দিকের বা জেমসের এখনকার কনসার্টগুলো দেখলে যেমন তাদের প্রতি মায়া হয়, স্রেফ টিকে থাকতে গান করছেন, ওই সিরিজে মাশরাফির বোলিং দেখেও মনে হতে থাকে শরীরের বিরুদ্ধে গিয়ে খেলছেন। এটা আরো স্পষ্ট হয় ২০১৮ এর এশিয়া কাপে। ভয় হতে থাকে কোন ম্যাচে গুরুতর ইনজুরিতে পড়েন তিনি। জিম্বাবুইয়ে সিরিজেও দেখা গেছে ক্লান্তির ধকল।

আগেই বলেছি মাশরাফি কেয়ারফুলি কেয়ারলেস। খেলা ছাড়ার পর কী করবেন তিনি? আর তো মাত্র ৩টা সিরিজ; তারপর কী গতি হবে তাঁর? আইয়ুব বাচ্চুর বিখ্যাত গান ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো, অনেক কথায় মুখর আমায় দেখো/ দেখো না কেউ হাসি শেষে নীরবতা’- এটা তো যে কোনো এন্টারটেইনারের জীবনের সকরুণ সত্যি। তাহলে জনপ্রিয়তাকে এনক্যাশ করা যায় কোন্ প্রকারে?

এর উত্তর দেয়ার আগে বাংলাদেশের যে কোনো মানুষকে মাশরাফির পজিশনে বসিয়ে নিজেকে চিন্তা করতে অনুরোধ করবো। অধিকাংশ মানুষের ন্যায় মাশরাফিও অপরটুনিস্ট বা সুযোগসন্ধানী। এবারের নির্বাচন মিস করলে আবার ৫ বছরের ফেরে পড়তে হবে, ততদিনে মাশরাফি নামটা পাস্ট পারফেক্ট টেন্সে পরিণত হয়েছে। জিম্বাবুইয়ে সিরিজে যেহেতু বিশ্রাম নেননি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে বিশ্রামটা পাওনা হয়েই আছে। বাকি রইলো নিউজিল্যান্ড সিরিজ আর বিশ্বকাপের ৯টা ম্যাচ। তারপর?

এই ২টা সিরিজের জন্য কি ৫ বছরের অপেক্ষায় পড়বেন? মাশরাফির জায়গায় যে কোনো সুযোগসন্ধানী মানুষ থাকলে যা করতেন তিনিও তা-ই করেছেন। একটি দেশের সেলিব্রিটি আর অনুসরণীয় মানুষদের ব্যক্তিচরিত্র সেখানকার গড়মানুষদের নৈতিক চরিত্রেরই রিফ্লেকশনমাত্র।

অনেকে বলছেন তিনি নিজে নতুন দল গঠন না করে সরকারি দলে যোগ দিলেন কেন, যে দলের প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যতে নেমে গেছে। তাঁর পারিবারিক ইতিহাস ঘাঁটাঘাটি করলে এই প্রশ্নটাও ইনভ্যালিড হয়ে যায়।

নতুন দল গঠন কি রসিকতা নাকি মেয়ের হাতের খেলনা? ডক্টর ইউনুসের মতো নোবেল বিজয়ী দল গঠন করতে গিয়ে রোশানলে পড়েছেন, ডক্টর কামালের মতো প্রাজ্ঞ সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিকল্প দল গঠন করে হাসির পাত্র হয়েছেন/ হচ্ছেন, সেখানে ৩৫-৩৬ বছরের এক ক্ষ্যাপাটে তরুণ যার জীবন কেটেছে মাঠে মাঠে আর ডানপিটেপনায়, তিনি একটি দল গঠন করে নির্বাচন করবেন, এটা ভাবলেও তো গোপাল ভাঁড় ফিলিং কাজ করার কথা মনের মধ্যে!

আমি বরং মাশরফির নির্বাচনে দাঁড়ানো দেখে ভিন্ন এক ভাবনায় পুলকিত। বিসিবি আপাদমস্তক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিসিবি প্রেসিডেন্ট অচিরেই এসিসি সভাপতির দায়িত্ব নিবেন। ফলে অবসরে যাওয়া মাশরাফি যদি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কখনো বিসিবিতে ফিরে আসে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিঃসন্দেহে এগিয়ে যাবে।

তবে এটাও ফ্যান্টাসি। কারণ বাংলাদেশের সবখানেই চলে সিন্ডিকেটবাজি, ফলে শীর্ষ ক্ষমতায় থেকেও সিন্ডিকেটকে চটানো যায় না, নীতিগতভাবে একমত না হয়েও তখন কেবলমাত্র সিগনেচার করেই ক্ষমতা আর মুখ রক্ষা করতে হয়। মাশরাফিও তাই শেষ পর্যন্ত প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার যিনি বাঁহাতি স্পিনপ্রধান বাংলাদেশকে ৩ পেসার নিয়ে খেলার সাহস যুগিয়েছিলেন, এরকম এক স্বীকৃতি নিয়েই ক্রিকেটমোদীদের মনোজগতে থেকে যাবেন। এর কম বা বেশি যা-ই বলি সবই বাহুল্য দোষে দূষিত!

মাশরাফি ম্যাশ নিকেই পরিচিত সর্বত্র। হ্যাশ আর ম্যাশ শুনতে একইরকম। হ্যাশট্যাগের বহুলপ্রসার আর মাশরাফির বিপুল এবং তুমুল জনপ্রিয়তা আমাকেও শেষপর্যন্ত নতুন এক ট্যাগ খুঁজতে প্ররোচিত করে , যার নাম ম্যাশট্যাগ!

মাশরাফি কে ছিলেন, কী হয়েছেন, কী হতে পারেন এইসকল আলোচনা কেবলই শব্দক্ষয়। মাশরাফি একজন স্বশিক্ষিত দার্শনিক, ক্রিকেট যাকে কী দিলো এর চাইতে তিনি ক্রিকেটকে কোন দর্শনের সাথে একীভূত করলেন, এই সমীকরণটাই মোহময় থাকুক।

একটা প্রেডিকশন দিয়ে শেষ করি। ১১ বছর পরে বাংলাদেশে কোন নামের নামের শিশু-কিশোরের সংখ্যা সর্বাধিক হবে? পোস্ট যদি পড়ে থাকেন, উত্তর চাহিয়া সময় অপচয় করিবেন না। দ্যাটস অল অ্যাবাউট ম্যাশট্যাগ!

#himalay777