‘মান্না’ নামটার সামাজিক এন্টারপ্রেটেশন বাংলাদেশে ৪ রকম:

১.আপনি যদি পুরনো দিনের সঙ্গীতপ্রেমী হন, আপনার মাথায় চলে আসবে ‘ কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’

২. আপনি যদি দেশের দলীয় রাজনীতি বিষয়ে বিভোর থাকেন আপনার ইমপ্রেসন হবে ‘ফোনালাপ ফাঁস হয়ে কারাগারে আটক এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’

৩. আপনি যদি ভার্সিটি পড়ুয়া এবং হিউমারপ্রিয় মানুষ হন আপনি নামটা শোনামাত্র হেসে উঠে গলার স্বর বদলে নিয়ে বলবেন ‘ আমি তোকে ছাড়বো না শুয়োরের বাচ্চা’

৪. আপনি যদি ৩ শ্রেণির কোনোটিই না হন এবং পেপার পত্রিকা পড়ার অভ্যাস থাকে, সামাজিক অবস্থানভেদে আপনার ২ টি ইমপ্রেসন হতে পারে। প্রথমত ‘বাংলা সিনেমার একজন নায়ক যার অভিনয়ে চিৎকার চেচামেচি বেশি’, দ্বিতীয়ত ‘বাংলা সিনেমার মহানায়ক যার অভিনয় দেখে লাখো মানুষের চোখে জল চলে আসতো’

বাংলাদেশে ৩য় আর ৪র্থ এন্টারপ্রেটেশনের মানুষেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমার লেখার বিষয়বস্তুও এটাই।

আমার জীবনের একটা বড়ো সময় পর্যন্ত টেলিভিশন দেখা বলতে ছিল শুধু ক্রিকেট ম্যাচ দেখা; নাটক-সিনেমা কিছুই দেখার সুযোগ পেতাম না। কলেজ, ভার্সিটিতে পড়াকালীন ছুটিতে বাড়ি গেলে আমার প্রধান কাজ হতো বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরে ঘুরে বাংলা সিনেমা দেখা। সেই অভ্যাস এখনো জারি রয়েছে। বাংলা সিনেমা হয়ে উঠেছে স্থূল বা গ্রস দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের রুচিবোধ বুঝতে যাওয়ার অন্যতম শিক্ষণীয় মাধ্যম।

জীবনে ২-৩ টা বিরল ব্যতিক্রম বাদে যতবার বাংলা সিনেমা দেখতে বসেছি হাস্যরসের উপকরণ সংগ্রহ ব্যতীত ভিন্ন কোনো চিন্তা কাজ করেনি।

তাতে সমস্যা যেটা হয়েছে, হাস্যরসের ব্যঙ্গাত্মক অভিযানে ছুটতে গিয়ে জীবনে বিপুল সংখ্যক বাংলা সিনেমা দেখা হয়ে গিয়েছে। বুয়েটে পড়াকালে নিয়মিত বলাকা, ঝিনাকা হলে বাংলা সিনেমা দেখেছি, কর্মজীবনে আনন্দ আর পূর্ণিমা হলে টিকিট কেটে বাংলা সিনেমা দেখেছি, এরপর ইউটিউবে যতগুলো বাংলা সিনেমা আপলোড করা হয়েছে, তার বোধহয় ৯০% ই দেখে ফেলেছি।

এত বিপুল পরিমাণ বাংলা সিনেমা দেখার দরুণ চিন্তার স্থূলতা, রুচিবোধের ভিন্নতা জাতীয় সূক্ষ্ম প্রবণতাগুলো বিষয়ে আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়েছে। বাংলা সিনেমা (এপার বাংলা-ওপার বাংলা) এর নায়ক, নায়িকা, ভিলেন এবং পার্শ্বচরিত্র, প্রায় প্রত্যেকের ব্যাপারেই পর্যবেক্ষণ তৈরি হয়েছে।

***
যে শ্রেণি/চিন্তাধারার সাথে আমার প্রাত্যহিক যোগাযোগের সম্পর্ক, সেখানে নায়ক মান্না আর দশজন তথাকথিত ক্ষ্যাত বাংলা সিনেমার নায়ক হিসেবেই হাস্যরসের পাত্র; এর বাইরে তার বিশেষ কোনো আবেদন নেই। তবে মান্নার এক্সপ্রেসনের মিমিক্রি করা এই শ্রেণিতে অন্যতম স্থূল বিনোদনের অংশ, কীভাবে তিনি ‘ওই কুত্তার বাচ্চা’ সংলাপ বলতেন তার অনুকরণের মধ্যে কিছু খুচরো তালি জুটে যায়।

তবে এই শ্রেণিটি সম্ভবত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু। হলিউড, কোরিয়ান, চাইনিজ, ইরানি, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান সহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার সিনেমা দেখে যাদের মনন এবং নান্দনিকতা বোধ তৈরি হয়েছে, এফডিসির খুপড়িঘরে শ্যুট করা বাজে স্টোরিলাইন, যাত্রা ঢঙের অভিনয় রীতি আর নিম্নমানের প্রিন্টের প্রোডাকশনকে তাদের কাছে এমেচার মনে হওয়াই সঙ্গত। চিন্তা এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের বসবাস ম্যাক্রো লেভেল রিয়েলিটিতে।

সিনেমার দর্শক হিসেবে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণি হিন্দি ভাষার সিনেমা দেখে অভ্যস্ত। হিন্দি শেষ করে তামিল, তেলেগু, মালায়লাম সিনেমার দিকে ধাবিত। এই শ্রেণি বাংলা সিনেমা সেভাবে দেখে না তা বলার উপায় নেই, দেখে, তবে পছন্দের ক্রমে বাংলা সিনেমা বেশ খানিকটা পিছনের দিকে থাকে। গ্রামে-গঞ্জে, নিম্নবিত্ত পেশাজীবীদের কাছেও পৌঁছে গেছে হিন্দি সিনেমা।

শুধুই বাংলা সিনেমা দেখে এই শ্রেণিটিকেও সংখ্যালঘু বলবো। তবে ১০-১৫ বছর আগেও এই শ্রেণিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ছিল। প্রযুক্তির কল্যাণে অন্যান্য ভাষার সিনেমা দেখার সুযোগ তৈরি হওয়ার পাশাপাশি কর্মজীবনের চাপে সিনেমা দেখার সুযোগ কমে যাওয়াও একটি কারণ। ফলে ১০-১৫ বছর আগে দেখা সিনেমাগুলোই তাদের স্মৃতিতে জমা হয়ে আছে।

ফলে মান্নাকে নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে কোন শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিনিধি ধরবো সেই নির্বাচন একটু জটিল চিন্তা।

আমি যদি নিছক বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দৃষ্টিকোণে দেখি, মান্না একজন সুপারস্টার এবং লিংকিং রোড বলতে পারি। তিনি যখন ফিল্ম লাইনে আসেন রাজ্জাক, আলমগীর, ফারুক,জসীম, সোহেল রানা প্রমুখ তখনো সিনিয়র নায়ক হিসেবে কাজ করেন; ইলিয়াস কাঞ্চন, রুবেল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, পরবর্তীতে সালমান শাহ ক্রেজ এলো, সমসাময়িককালে ওমর সানী-নাঈম- অমিত হাসান-আমিন খানদের ব্যাচ হিট সিনেমা করছে, বাপ্পারাজ ট্রাজেডি কিং হয়ে উঠেছেন, রিয়াজ-ফেরদৌস- শাকিল খানরা এসেছে, অনেক আগে অভিষিক্ত হয়েও শাহীন আলম-মেহেদী-ইমরানরা সাইড নায়ক থেকে উত্তরিত হতে পারছে না, উঠতি তারকা হিসেবে শাকিব খানের আগমন।

অর্থাৎ বাংলা সিনেমার উল্লেখযোগ্য সকল নায়ককেই তিনি পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। বাংলা সিনেমায় তিনিই সম্ভবত একমাত্র নায়ক যিনি ১০০ এর বেশি পরিচালক এবং ৬১ জন নায়িকার সাথে কাজ করেছেন।

বাংলা সিনেমার প্রেক্ষাপটে এগুলো বড়ো অর্জন। কমার্শিয়াল সাকসেস প্রশ্নেও তিনি এগিয়ে থাকবেন। তাতে এফডিসি সংশ্লিষ্ট মানুষদের উপকার হয়েছে, কিন্তু বাংলা সিনেমা এবং সিনেমার দর্শকদের কতটা মানোন্নয়ন ঘটেছে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

আবার মান্নার পারসপেক্টিভে দেখলে, তার নামে সিনেমা হিট হয়েছে, প্রযোজক লগ্নিকৃত টাকা ফেরত পেয়েছে; দর্শককে শিক্ষিত করার ইজারা তো তিনি নেননি। তাছাড়া কোটি টাকা ব্যবসা করেছে যে সিনেমা সেখানে কি কেবলই গার্মেন্টসকর্মী, নির্মাণশ্রমিক আর রিকশাওয়ালা- ড্রাইভারদের টাকা, মধ্যবিত্তের কোনোই অংশীদারীত্ব নেই? প্রোবাবিলিটির সূত্র বলে, একটা ন্যূনতম পারসেন্টেজে হলেও মধ্যবিত্তের টাকা সেখানে রয়েছে।

কারা সেই মধ্যবিত্ত এবং কেন তারা মান্নার সিনেমা দেখার আগ্রহ বোধ করে।

পক্ষান্তরে,,কলেজ বা ভার্সিটি পড়ুয়াদের মধ্যে মান্নার সিনেমা ক্রেজ তৈরিতে ব্যর্থ, অথচ এদের হাতেই সময় এবং সুযোগ সবচাইতে বেশি। সালমান শাহ এটা পেরেছিলেন, কেন মান্না নয়?

মান্নার ক্যারিয়ার যদি দেখি, প্রথম ৬-৭ বছরে তিনি ছিলেন নির্ভেজাল সাইড নায়ক, এসময়ে হিট সিনেমায় অভিনয় করলেও সেগুলোর কৃতিত্ব প্রধান নায়কের। একক নায়ক হিসেবে তার প্রথম হিট সিনেমা ‘কাশেম মালার প্রেম’; সিনেমার নাম শুনেই কনটেন্ট অনুমান করে নেয়া যাচ্ছে। প্রত্যেক প্রজন্মেই সময়ের চাইতে চিন্তায় এগিয়ে থাকা মানুষ থাকে, তারা কাশেম মালার প্রেম দেখার জন্য হলে যাবে না। একজন নায়কের যখন কোনো সিনেমা হিট করে যায়, দর্শকরা তাকে সেই ঘরানাতেই ট্যাগ করে ফেলে।

সাইড নায়ক হিসেবে মান্নার অভিনয়শৈলী আলাদাভাবে চোখে না পড়লেও অতি অভিনয় প্রবণতাতেও দুষ্ট ছিল না; একজন গড়পড়তা অভিনেতা বলা যায়। বরং উচ্চতা তার জন্য এডভান্টেজ হিসেবে দেখা হতো।

মান্নার যে অভিনয়রীতি আমরা দেখে অভ্যস্ত বা হাস্যরসের সৃষ্টি করে সে দিকটাতে যাওয়ার পূর্বে পরিচালক কাজী হায়াত প্রসঙ্গে কিছু বলা উচিত। আমরা জানি তিনি অসংখ্য সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন। তার অভিনয়রীতি খেয়াল করেছেন কেউ? কিংবা তার পুত্র, যাকে মান্নার বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে বিফল হয়েছেন, সেই কাজী মারুফের অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য কী? এই দুজনের অভিনয়ের সাথে মান্নার অভিনয় রীতির তুলনা করতে গেলেই একটি প্যাটার্ন পেয়ে যাওয়ার কথা। অভিনয়ের এই প্যাটার্নের জনক পরিচালক কাজী হায়াত। হায়াত যেহেতু পরিচালক হিসেবেই পরিচিত বেশি, তার উদ্ভট অভিনয়রীতি মান্নার ব্রান্ড হয়ে উঠেছে, এটারই মার্কেটিং হয়েছে ক্রমাগত।

মান্নার সিনেমাগুলোতে ম্যাসকুইলিন ফ্যাক্টর অনেক বেশি। সাধারণত সিনেমাগুলোতে আমরা দেখি নায়িকা শুরুতে নায়ককে পাত্তা দেয় না, নায়ক বহু চেষ্টা তদবির করে হৃদয় হরণ করে। কিন্তু মান্নার সিনেমাগুলোতে সাধারণত দুটি প্রবণতা লক্ষণীয়- ১. তার পৌরুষদীপ্ততায় মুগ্ধ হয়ে নায়িকা বরং তাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে। ২. তিনি এতোটাই পরাক্রমশালী নায়িকা তাকে পছন্দ করেন কিনা জানা জরুরী নয়, তিনি পছন্দ করেছেন এটাই যথেষ্ট। যে সিনেমায় দুটোর কোনোটাই নেই সেখানে সিনেমার শুরু থেকেই তার প্রেমিকা থাকে একজন।

এবং সম্ভবত একারণেই, আমি আজ পর্যন্ত কোনো নারীকে পাইনি যার পছন্দের নায়ক মান্না। মান্না ভক্তদের বৃহত্তম অংশই পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রতিনিধিত্ব করে।

মান্নার সিনেমাগুলো মূলত প্রতিবাদনির্ভর; কখনো তিনি পুলিশ, কখনোবা মাস্তান, কিংবা কখনোবা অন্য পেশা থেকে কনভার্টেড মাস্তান, এমনকি ঘটনাচক্রে পুলিশ থেকেও মাস্তানে কনভার্টেড। অর্থাৎ, মান্না আর মাস্তান প্রায় সমার্থক। তার অসংখ্য সিনেমার নাম চরিত্রের নামে। মান্না ভাই, মুসা ভাই, মোস্তফা ভাই, বিদ্রোহী সালাউদ্দিন, আব্বাস দারোয়ান।

মানুষ হিসেবে আমরা ভীতু প্রকৃতির, অন্যায় হলে বুঝতে পারি, প্রতিবাদের সাহস না পেয়ে মনে মনে গালি দিই। মান্নার সিনেমা অথচ গালিগালাজ নেই, ৯৯ সাল পরবর্তী সিনেমায় এমন দৃষ্টান্ত বিরল বলা চলে। এই মুহূর্তে গালিবিহীন সিনেমা হিসেবে ‘স্বামী ছিনতাই’, ‘দুই বধু এক স্বামী’, ‘কাবুলিওয়ালা’ এর নাম মনে পড়ছে। তবে ৪০০ এর বেশি সিনেমায় কাজ করা একজন নায়ক ( সাইড নায়ক বা স্ট্রাগলিং নায়ক হিসেবে ৪০ টি সিনেমা বাদ দিলাম) যদি ১০-২০ টা গালিবিহীন সিনেমায় অভিনয় করে সেটাকে উপেক্ষা করা যায়।

মান্নার জনপ্রিয়তার পেছনে গালিগালাজের অবদান রয়েছে। কারণ, আপনি সভ্যতাবশত গালাগাল করতে পারছেন না, আবার অন্যায় সইতেও পারছেন না, এমতাবস্থায় স্ক্রিনে যখন কাউকে গালাগাল দিতে দেখেন যে অন্যায়ের দমন করছে তার প্রতি সহমর্মীতা জন্ম নেয়।

অন্যরা গালিগালাজ করে সুবিধা করতে পারলো না কেন?

প্রথমত, গালিগালাজকে রুচিহীনতা হিসেবে দেখা হয়। একজন অজনপ্রিয় নায়ক সেটা প্রয়োগ করে ইমপ্রেসনই খারাপ হয় উলটো। দ্বিতীয়ত, ডিপজল ইফেক্ট। বাংলা সিনেমায় গালিবাজির প্রবাদপুরুষ ডিপজল, সে সিনেমায় থাকা মানে নায়কের চাইতেও বেশি ফুটেজ পাওয়া। যে কোনো কারণেই হোক মান্না-ডিপজল রসায়ন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গালির বিপরীতে গালি; সিনেমাগুলো যেন গালির অভিধান হয়ে উঠতো।

বাংলা সিনেমার যে সময়টাকে কাটপিস এবং অশ্লীলতার যুগ বলা হয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সময়ের সুপারস্টার হিসেবে মান্নার নাম চলে আসবে। এতে কি মান্নাকেও দায়ী সাব্যস্ত করা যায়৷ জটিল প্রশ্ন।

একটি সিনেমার ঔনার মূলত প্রযোজক, এবং ইন্টেলেক্টসূত্রে পরিচালক; আর্টিস্ট সেখানে একজন পারফরমাত্র। মান্না অশালীন ভাষার ব্যবহারে রেকর্ড গড়েছেন, সিনেমাজুড়ে ভায়োলেন্স থাকতো তার পারফরমার ছিলেন, নিজের সুপার স্টার ইমেজ ব্যবহার করে এই দৃশ্যায়নে হয়তোবা প্রভাব খাটাতে পারতেন। তিনি নিজে কি অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয় করেছেন? অশ্লীলতার গ্রেডিং করলে প্রাথমিক গ্রেডিংয়ে হয়তোবা তাকে রাখা যেতে পারে, কিন্তু শাহীন আলম, সোহেল বা মেহেদী নাম শুনলে অশ্লীলতার যেরকম রগরগে চিত্রায়ণ মনে পড়ে, মান্নাকে সেই গ্রেডিংয়ের অশ্লীলতায় অভিযুক্ত করা যায় না। কাটপিস ঢুকানো হলমালিক, প্রযোজক আর পরিচালকের ভিন্ন সিন্ডিকেট; সেখানে একজন আর্টিস্টের খুব বেশি কিছু করার সুযোগ থাকে না। পরিচালক বা প্রযোজক নয়, মানুষ মান্নার নামে টিকিট কেটে সিনেমা দেখে, সুতরাং মান্নার ইনফ্লুয়েন্স বেশি, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদ করতে পারতো—- এগুলো হাইপোথেটিকাল চিন্তা। সিনেমাকে ব্যবসা করতে হবে, প্রযোজক আর ডিস্ট্রিবিউটর যেভাবে প্রফিট ম্যাক্সিমাইজ করতে চায় করুক, ব্যবসা না করলে তো আমার পারিশ্রমিকও কমে যাবে, মার্কেটে টিকতে পারবো না— এমন আত্মচিন্তা থেকে চুপ থাকাটা এক ধরনের স্ট্র‍্যাটেজিক সমঝোতা।

কিন্তু মান্নার সিনেমাগুলো জনপ্রিয়তা পেত কেন, কিংবা মান্নার সিনেমা বললেই মানুষ আম্মাজান, তেজী, শান্ত কেন মাস্তান, কষ্ট, কুখ্যাত খুনী, দাঙ্গা, সমাজকে বদলে দাও, ধর, জেল থেকে বলছি প্রভৃতি নামগুলোর উল্লেখ করে; কী আছে এসব সিনেমায় যার জন্য বাংলা সিনেমার দর্শক এগুলোকে রেফারেন্স হিসেবে দেখায়?

আমি প্রায় প্রতিটি সিনেমাই অন্তত ২ বার দেখেছি। শুধু মান্না কেন, যে কোনো বাংলা সিনেমাই আমাকে দেখতে হয় ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে, নইলে সময় অপচয় মনে হয়। ৩ ঘন্টার সিনেমায় ৩টা দৃশ্যও পাওয়া যায় না যা দেখে চিন্তা জাগে বা বিনোদন পাই, এমেচারিতাই চোখে পড়ে বেশি।

মান্না অভিনীত আম্মাজান আর কষ্ট সিনেমা দুটি আদতে একই ঘরানার, প্লটে সামান্য এদিক-সেদিক করে দুটো আলাদা সিনেমা বানানো হয়েছে মাত্র।

ছেলের সামনে মা ধর্ষিত হচ্ছে অথবা পরপুরুষের মনোরঞ্জন করছে— এই লজ্জাজনক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এক মা আত্মহত্যা করে, অন্যজন ছেলের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়; মূলত এই সেন্টিমেন্টটাই বাঙালি দর্শককে প্রবলভাবে আবিষ্ট করেছে।

আপনার মনে হতে পারে এই স্টোরিলাইনে সেন্টিমেন্টাল হওয়ার কী আছে!

কিন্তু আপনাকে অনুভব করতে হবে, অধিকাংশ বাঙালি চিন্তাজগতে কতটা মাইক্রো লেভেলে জীবন পার করে দেয়। বিশ্বসাহিত্যের কয়টা বই তারা পড়েছে, বিভিন্ন ভাষার কয়টা চলচ্চিত্র তারা দেখেছে, কিংবা ব্যক্তিজীবনে কতজন খুব ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার মানুষের সংস্পর্শে তারা আসতে পেরেছে বা আসতে চেয়েছে; এদেশে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মানুষ মানে সে রাজনৈতিকভাবে কতটা ক্ষমতাশালী অথবা প্রশাসনের কোন স্তরে আছে, কিংবা কতটা অর্থ-বিত্তের মালিকানাপ্রাপ্ত। উল্লিখিত মানুষেরাও তো আদতে মাইক্রো স্কেলেই জীবন পরিমাপ করে।

যে কারণে ‘আমার আম্মাজান আমার সাথে কথা কইছে’ ডায়ালোগ শুনে লাখ লাখ মানুষ যখন কেঁদে উঠে সেটাকে অভিনেতার সাফল্য বা সার্থকতা হিসেবেই দেখা উচিত।গণতন্ত্র যতোই নির্বোধ সিস্টেম হোক, সংখ্যার শক্তিকে তো মানতে হবেই।

অতি মান্না-ভক্তরা তার নামের পূর্বে মহানায়ক বিশেষণ ব্যবহার করছে সম্প্রতি।

মহানায়ক শব্দটাকেই কমেডি লাগে। কলকাতার নায়ক উত্তম কুমারের পূর্বে কে কবে এই বিশেষণের ব্যবহার শুরু করেছিল জানা নেই, তবে সেই বিশেষণ এতোটাই চটকদার যে দ্রুতই মার্কেট পেয়ে যায় এবং উত্তম কুমার আর মহানায়ক একে অপরের ছায়াসঙ্গী হয়ে গিয়েছে৷ সিনেমা সম্বন্ধে খোঁজ রাখেন না এমন কেউ যদি ‘মহানায়ক উত্তম কুমার’ এটাই একটা স্বতন্ত্র নাম ভেবে বসে, অবাক হওয়া সমীচীন নাও হতে পারে। অথচ দীলিপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন বা ধর্মেন্দ্র যথেষ্ট জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রি তাদের পূর্বে মহানায়ক ব্যবহারের আদিখ্যেতা দেখায় না।

বাংলাদেশে মহানায়ক শব্দের মার্কেটিং করেছেন বুলবুল আহমেদ। তার অভিনীত ‘মহানায়ক’ সিনেমাটি জনপ্রিয় সব গানের কারণে বেশ পরিচিতি পেয়ে যায়। যে কারণে বুলবুল আহমেদের নামের পূর্বে পরিচিতি হিসেবে অনেকে মহানায়ক শব্দটি ব্যবহার করেন, সেটি নায়ক হিসেবে তিনি কত বড়ো মাপের ছিলেন তা বোঝানোর উদ্দেশ্যে নয়, বরং সেই সিনেমাটি কতটা জনপ্রিয় তা বোঝানোর্থে। অন্যদিকে রাজ্জাকের পূর্বে জুটে গেছে ‘নায়করাজ’ বিশেষণ। তাই বুলবুল আহমেদের ট্যাগ তার জন্য কিছুটা বিব্রতকরও বটে।

কিন্তু মান্নাভক্তদের আরোপিত ‘মহানায়ক’ বিশেষণ সম্ভবত বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম নায়ক দাবি করার প্রয়াস থেকেই উদ্ভূত।

আমি জীবনভর বাংলা সিনেমা দেখেছি হাস্যরসের খোঁজে, কখনোই বাংলা সিনেমার ব্যাপারে উচ্চ ধারণা পোষণ করি না, কিন্তু যারা বাংলা সিনেমা অন্তঃপ্রাণ তাদের তো বাংলা সিনেমা আরেকটু ভালোমতো দেখা উচিত ছিল। স্টোরি লাইনকে প্রাধান্য দিলে ৬০-৭০ দশকের সিনেমার কাছে মান্নার সিনেমা হাস্যকরভাবে হেরে যাবে, ব্যবসায়িক সাফল্যে ইলিয়াস কাঞ্চনের বেঁদের মেয়ে জোসনা, সালমান শাহ এর তুমি আমার, স্বপ্নের ঠিকানার চাইতে পিছিয়ে পড়বে, এর বাইরে অশ্লীলতা যুগের প্রতিনিধিত্বের দায় কিছুটা তো থাকেই।
এবং অতি অবশ্যই বাংলা সিনেমায় রাজ্জাকের যে ইমপ্যাক্ট এবং ইনফ্লুয়েন্স, তার সাথে মান্না কি আদতেই মানানসই?

মহানায়ক কমপ্লেক্সের উৎস সম্ভবত শাকিব খানের সুপারস্টার হিসেবে এককভাবে মার্কেট লিড করা। মান্নার ক্যারিয়ারকালে বাংলাদেশে ফেসবুক আসেনি বা এলেও প্রভাববিস্তারী হয়নি।

অন্যদিকে ফেসবুকভিত্তিক বাংলা সিনেমার কিছু গ্রুপ তৈরি হয়েছে যারা বাংলা সিনেমা প্রমোট করে, অনেকেই পেইড রিভিউ লিখে। এই গোষ্ঠী শাকিব খানের বিকল্প হিসেবে কাউকে না পেয়ে আরেফিন শুভকে প্রমোট করার চেষ্টা করে, কিন্তু সিনেমাটিক অর্জনে বা স্টারডমে শুভ এখনো শাকিবের লেভেল থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। একমাত্র যোগ্য বিকল্প অপশন হতে পারে মান্না, যার সুপারস্টার থাকাকালে শাকিব রাইজিং স্টার ইমেজে ছিল এবং শাকিবের উত্থানের ক্ষেত্রে মান্নার আকস্মিক মৃত্যুকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মান্নাকে দিয়ে শাকিবকে ওভারটার্ম করার ক্ষেত্রে কিছু গ্লোরিফিকেশন আরোপের প্রয়োজন ছিল মান্নার ক্যারেক্টারে। ‘মহানায়ক’ বিশেষণ সেই গ্লোরিফিকেশন প্রক্রিয়ারই অংশ

মান্নার সময়ে চলচ্চিত্রে আরো বেশ কয়েকজন নায়ক ছিল, শাকিবের কালে যারা আছে তারা আমলেই নেয়ার মতো নয়। এটাই ইঙ্গিত করে, চলচ্চিত্র ব্যবসা কোন গন্তব্য এগুচ্ছে। ২০০০ সাল বা তারও কিছু আগে থেকেই বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ডুবন্ত জাহাজ; মান্না-শাকিব সেই জাহাজের নাবিকের দায়িত্ব পালাক্রমে পালন করেছে মাত্র; যে জাহজ ডুবছে বা ডুববেই র নাবিকের যোগ্যতা বা দক্ষতা নিয়ে ভাবনারই অবকাশ নেই আসলে।

তবু মান্নার ইমপ্যাক্ট তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা দেখেই অনুমান করা যায়। মান্নার মৃত্যুকালে বুয়েটে পড়তাম, হলে থাকতাম। আমার হল থেকে শহীদ মিনার নিকটবর্তী দূরত্বে অবস্থিত। মৃত মান্নার জানাযায় যে পরিমাণ মানুষের সমাগম ঘটেছিল সেটাই তার মানবজন্মের সার্থকতা নির্দেশ করে। বাংলাদেশের আর কোনো সেলিব্রিটি কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে এতো বেশি সংখ্যক মানুষ ব্যথিত হয়েছে কিনা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি না।

নায়ক হিসেবে মান্নাকে নিয়ে যতোই হাসাহাসি করি, এতো সংখ্যক মানুষের ভালোবাসা যিনি পান, তার মাহাত্ম্য উপলব্ধিতেও গবেষণার দাবি রাখে।

তার ৪০০+ সিনেমার একটিও মনে দাগ কাটেনি আমার( বাংলা সিনেমার পক্ষে সেটা দুষ্করই বটে), তার চিৎকার এবং ফাঁপড়বাজি ভিত্তিক অভিনয়রীতিতে আকর্ষণীয় কিছুই পাইনি, নিম্নবুদ্ধির মানুষের জন্যই উপযুক্ত মনে হয়েছে, তবু মানব পর্যবেক্ষক এবং হিউম্যান বিহেভিয়ার এনালিস্ট হিসেবে আমার পক্ষে মান্নাকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

আমার ঘনিষ্ঠ মহলের অনেকেই অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকা নিয়ে দীর্ঘ আর্টিকেল লিখে সময় নষ্ট কেন করি।

আমার ব্যাখ্যা খুবই সরল। হিউম্যান বিহেভিয়ার বুঝতে হলে আপনাকে ধর্ম, রাজনীতি, সেক্স, অর্থনীতি, সাইকোলজি, সম্পর্ক এবং বিনোদন বিষয়ে লিখতে হবে, এবং প্রতিক্রিয়া খেয়াল করতে হবে। আমি সব বিষয়েই সমানভাবে চিন্তা করি না; আমার জন্য সাইকোলজি, পারসোনালিটি আর বিনোদনই তুলনামূলক সহজ মাধ্যম।

লিখতে লিখতে মান্নার এক অদ্ভুত গানের দৃশ্য মাথায় চলে এসেছে। লাল উইগ পরিহিত মান্না উদ্ভট স্টাইলে নেচে গাইছে- ‘মান্না ভাই, আমি মান্না ভাই’

এটা মনে পড়ামাত্র আরেকটা সংলাপ মনে পড়লো, হুবুহ নাও হতে পারে, তবু লাইনগুলো- ‘ আমি কঠিন মানব, ধ্বংস করি দানব, আমি গরীবের ভাই, আমি মুসা, মুসা ভাই’।

অতঃপর হলের দর্শকদের করতালি এবং আমার হাসি চেপে রাখার চেষ্টা। মান্না নয়, দর্শকের আনন্দে দেখে হাসি। আমার অভিলাষ বুঝতে পারলে দর্শকও হয়তো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো।

হাসলে নাকি হার্ট ভালো থাকে, অথচ যাকে ঘিরে হাসির সাজ-সজ্জা সেই মান্না স্বয়ং লোকান্তরিত হলেন হার্টের জটিলতায়!