করোনার এই দীর্ঘ সমরে একজন ব্যক্তিকে ভাবি প্রায় প্রতিদিনই, কিছু সময় ব্যয় করি। যৌক্তিকতা ব্যতিরেকেই করি আপাত অযৌক্তিকতার ভরপুর ইন্তেজাম। তাতে অস্বস্তি নয় পুলক স্পার্কিত হয়।
তিনি ব্যান্ডশিল্পী জেমস। দিনে অন্তত ২ বার মনে হয়- জীবনে যে পরিমাণ মদ-গাঁজা সেবন করেছেন ফুসফুসের অবস্থা তো ভয়াবহ হওয়ার কথা, করোনায় ধরলে ফিরতে পারবেন এই ৫৬ বয়সে?
মৃত্যু নিয়ে ভাবি না তেমন; এটা দৈবচয়নের মতো ব্যাপার, যার যখন সিরিয়াল আসবে রওয়ানা হবে সেই মহাযানযোগে। যতক্ষণ সচল আছে অস্তিত্ব, প্রতিটি মুহূর্ত কর্মমুখরতায় ব্যাপিত হোক।
তবু জেমস করোনায় কী করছেন প্রায়ই কেন ভাবি– যথাযথ কারণ জানা নেই। জেমসের থেকে আর কী কী পাওয়ার থাকতে পারে? সুস্মিতার সবুজ ওড়না, চিরহরিৎ কিংবা পথের বাপ টাইপ গান কি আসতে পারে? তার বয়স বেড়েছে, আমিও নেই কিশোর যুবা; আমাদের ক্ষিপ্রতা এবং প্রায়োরিটি কি দুদিকে বেঁকে যায়নি?
এতদিন বাদে ইউটিউবের বাইরে জেমসের স্বাধীন অস্তিত্ব কোন আবেদনটা বহন করছে? জানি না। নিরাবেগ হওয়াটা হতে হতেও হয় না কেন যেন!
বাংলাদেশী ব্যক্তিত্বদের প্রতি একদম শৈশব থেকেই বিকর্ষণ বোধ করি, এরা যে আহামরি মেধাবী নয় শিশু বয়সেই হয়তবা উপলব্ধি করেছিলাম। সত্যজিত রায়, শচীন টেন্ডুলকার, ওয়াকার ইউনুস, রাহুল দ্রাবিড়, মাইকেল মধুসূদন, জুলভার্ন, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন, গৌতম বুদ্ধ— কেউই তো বাংলাদেশী নয়। ( অবশ্য বড় হয়ে জেনেছিলাম মাইকেল মধুসূদনের নিবাস যশোরে।)
জেমস প্রথম বাংলাদেশী যার প্রতি সচেতনভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। যতটা না গানের কারণে তার চেয়ে বেশি গান পরিবেশনকালীন নিস্পৃহতা আর নির্বিকারত্বের প্রতি। আইয়ুব বাচ্চু, শাফিন, মাকসুদ, হাসান, তপন চৌধুরী, আজম খান– কার পারফরম্যান্স দেখিনি জীবনে, তাদের প্রত্যেককে একই প্যাটার্নের লেগেছে পরিবেশনের ধরনে, জেমসের স্বকীয়তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই চোখে পড়েছিল।
আমার জীবনে জেমস তিনটি পৃথক টাইমলাইনে বিচরণ করেন।
টাইমলাইন১: ১৯৯৫ থেকে ২০০৩; এই সময়টাতে ছিলাম মানিকগঞ্জে, এসএসসি পাশের পূর্ব পর্যন্ত। গানের লিরিক বা কম্পোজিশন নিয়ে ভাবিনি, জেমস গেয়েছে, শুনতে হবে– এটাই ছিল মানসিকতা।
টাইমলাইন২: ২০০৪ থেকে ২০১৫; কলেজ জীবন থেকে রকমারি গ্রুপের ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্ট হিসেবে ৫ বছর অতিক্রান্ত। এই সময়ে সরাসরি জেমসের কনসার্ট দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে অসংখ্যবার। কৈশোরের মুগ্ধতার পাশে জড়ো হয়েছে সমপরিমাণ সমালোচনা। জেমসকে আর অপার্থিব লাগেনি, একজন চিরাচরিত চতুর এন্টারটেইনার হিসেবেই মেনে নিয়েছি, এবং উন্মত্ত গান তৈরির সামর্থ্য আর অবশিষ্ট নেই তার এটাও নিশ্চিত হয়েছি। পুরনো দিনের সঞ্চয় ভাঙিয়ে(মানে পুরনো গান) বাকি জীবনে করে খেতে হবে, বুঝতে পারি। তার প্রতি সেই টানটা শিথিল হয়ে আসে।
টাইমলাইন৩: ২০১৫ থেকে বর্তমান। জেমস এই সময়ে হয়ে উঠেন আমার নিত্য কর্মসঙ্গী। জগতবিচ্ছিন্ন হয়ে ল্যাপটপে লেখালিখির ক্ষেত্রে নতুন এক কৌশল রপ্ত করি এসময়। কানে হেডফোন গুজে ইউটিউবে গান শুনতে থাকি, দ্রুতই বিস্মৃত হই চারপাশ। ৪৭-৫৯ টা গানের একটা প্যানেল তৈরি করা, গত ৬ বছরে কাজ করার সময় সেগুলোই শোনা হয়। গান শোনাটা মূখ্য নয়, মনোযোগ নিরবিচ্ছিন্ন রাখার টুলস এগুলো। সেই প্যানেলে সর্বাধিক সংখ্যক গান জেমসের। পদ্ম পাতার জল, জিকির ওঠে, লেইস ফিতা, দুঃখিনী দুঃখ করো না, বিজলি চলে যেও না, সেলাই দিদিমনি, বাংলার লাঠিয়াল, বেদের মেয়ে জোছনা, কথা আছে তোমার সনে, লুটপাট হয়ে যাবে, নিমন্ত্রণ, ঈশ্বর আছে— সর্বমোট ১১টি। জেমসের গাওয়া আরো অনেক গানই পছন্দ, তবু কাজে নিমগ্নতা তৈরিতে এই গানগুলো বেশি কার্যকর প্রমাণিত গত ৬ বছরে। বিশেষত ইউটিউবে লেইস ফিতা গানের যে লাইভ পারফরম্যান্স পাওয়া যায়, ইন্ট্রোটা শোনামাত্র শব্দ আর চিন্তার সমাবেশ শুরু হয়ে যায়, আমি পেয়ে যাই গতিশীলতা।
কর্মসঙ্গী হিসেবে জেমসকে যখন অনুভব করি তার বর্তমান বয়স কত, শেষ কবে নতুন ট্র‍্যাক রিলিজ হয়েছে, তার কি অর্থের এতই সংকট চলছে যে বাংলা সিনেমায় গান গাইতে হচ্ছে— এসব কোনো প্রশ্নই তৈরি হয় না। আমি তাকে মাইক্রোফোনের সম্মুখে স্থির দণ্ডায়মান ঋষিরূপে দেখতে পাই কল্পনায়।
জেমসের সঙ্গে আমার পরিচয় ‘জেল থেকে বলছি’ গানের মাধ্যমে। বিটিভিতে ঈদে ব্যান্ড সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হত, সেখানেই গানটি প্রথম শোনা হয়, সকলে কয়েদির পোশাক পরিধান করায় আলাদা নজরে পড়ে।
সেই যুগে এলাকায় সমবয়সীদের মধ্যে প্রধান তর্কের বিষয় ছিল জেমস নাকি আইয়ুব বাচ্চু কে সেরা। বাচ্চুর সমর্থকেরা জেমসকে বলতো ফাঁটা বাঁশ, চিল্লাচিল্লি ছাড়া কিছুই পারে না। জেমসের অনুসারীরা বাচ্চুকে বলত হাম্বা, তার ভোকাল নাকি গরুর ডাকের সাথেই মিলে যায়।
আমি অবশ্য জেমসের আগে বাচ্চুকেই চিনতাম, কষ্ট পেতে ভালোবাসি গানের কল্যাণে; খুবই পছন্দ হয়েছিল গানটা। তবে জেমসকে চেনার পরে বাচ্চুর প্রতি সেই ভালো লাগাটা আর থাকেনি একইরকম।
শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ক তর্কাতর্কি একদমই পছন্দ করি না। ভিরাট কোহলি আসার পূর্ব পর্যন্ত আমি টেন্ডুলকারকে শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান মানতাম, বোলার হিসেবে ওয়াকার ইউনুস। এখন কেউ যদি লারা বা ওয়াসিম আকরামকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, এমনকি পন্টিং বা ম্যাকগ্রা হলেই বা সমস্যা কী; খেলা দেখ উপভোগ কর, তর্ক করে এনার্জি নষ্টের কারণ তো দেখি না।
তবু জীবনে ১ বারই সিরিয়াস পর্যায়ের তর্ক করেছিলাম, সেটাও জেমস বনাম হাসান ইস্যুতে।
১৯৯৯ সালে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের নবীনবরণে হাসান তথা আর্ক ব্যান্ডকে নেয়া হয়েছিল মূল আকর্ষণ হিসেবে৷ সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। দেবেন্দ্র কলেজের মাঠে মুষলধারে মানুষের বৃষ্টি। পাড়ার বড়ো ভাই, এবং সমবয়সীরা বলছিল- ‘হাসানের পাশে জেমস কিচ্ছু না, ওর তো গানই হয় না। বছরের অধিকাংশ সময় গলায় সমস্যা থাকে’৷ মেজাজ খারাপ করে বলেছিলাম- ‘দুঃখিনী টাইপ গান গলায় তুলতে হাসানের আবার জন্ম নিতে হবে, তবু পারবে না। বাংলাদেশ বইলা চিল্লানি দিলেই যদি সেরা গায়ক হওয়া যাইত তাহলে মোরগের উপরে কোনো গায়ক থাকতো না দেশে’!
এই মন্তব্যের দরুণ বড়ো ভাইদের ব্যাপক রোষানলে পড়েছিলাম। গানের কী বুঝি, কয়টা গান শুনেছি জীবনে, বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় শিখিনি সহ বহু মন্তব্য জুটেছিল। সেই নিগ্রহটা আমাকে পরিণত হতে শিখিয়েছিল, উপলব্ধি করেছিলাম কাদের সঙ্গে তর্কে জড়ানো উচিত, কাদের আমলেই নেয়া যাবে না। শ্রেণি সচেতনতা এবং সংবেদনশীলতা তৈরিতে সেই নিগ্রহটা সঞ্জিবনীর কাজ করেছিল।
কিন্তু আত্মীয়-অনাত্মীয় বা অন্য কোনো মানুষ নয়, করোনাকালে জেমসকেই কেন মনে পড়ে বারবার; প্রশ্নটার সদুত্তর বের করতে পারিনি। এক যুগের বেশি হয়ে গেছে জেমসের উল্লেখযোগ্য গান নেই। ব্যান্ড গায়কদের প্রাইম টাইম থাকে সাধারণত ১০ বছর; এসময়ে তারা সবচাইতে প্রোডাক্টিভ দশা পার করে৷ জেমসের ক্ষেত্রে সময়টা ১৫ বছরের বেশি হয়ত, তাই তার কোয়ালিটি কাজের সংখ্যা এত বেশি যে অন্য কোনো আর্টিস্ট ৩০ বছর প্রোডাক্টিভ থেকেও সমপরিমাণ কাজ ডেলিভার করতে সমর্থ নাও হতে পারে। এবং সম্ভবত একই কারণে নিম্নমানের কাজের সংখ্যাতেও সমসাময়িকদের তুলনায় তিনি এগিয়ে থাকবেন। সখি যমুনায় জল আনতে যেও না, কুসুম কুসুম প্রেম, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, দেওয়ানা মাস্তানা প্রভৃতি চটুল গানও আমরা জেমসের থেকে পেয়েছি! মান্নার সিনেমায় যখন ‘আসবার কালে আইলাম একা’ গানটা ব্যবহৃত হয় এবং কিম্ভুতকিমাকার সজ্জায় মান্না কোরিওগ্রাফি করে ভুলে যেতে ইচ্ছা করে এই জেমস ‘বর্ষা আমার চোখের প্রিয় ঋতু’ গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন।
তবু যে জেমসকে আমি ভাবছি, সেই জেমস আসলে কোনজন? লেইস ফিতা গানের জেমস, নাকি মা-বাবা গানের জেমস, নাকি ইদানীং ফটোগ্রাফি করে বেড়ানো ফারুক মাহফুজ আনাম?
মা, বাবা, বাংলাদেশ প্রভৃতি গানের মাধ্যমে জনপ্রিয়তায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলেও এই গানগুলো একেবারেই স্পর্শ করতে পারেনি আমাকে। বারবারই মনে হয়েছে এসব গানের লিরিক এবং কম্পোজিশন যেরকম তাতে সঞ্জীব চৌধুরী ঘরানার কেউ গাইলে শ্রুতিমধুর লাগতো; জেমসের কন্ঠ এধরনের গানের জন্য মানানসই নয়। বাঙালি জনতা যেরকম স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল মা-বাবা শব্দের উপস্থিতিই বালতি ভরার জন্য যথেষ্ট; এটা জেমসের পরিবর্তে হাসান চৌধুরি, মনি কিশোর গাইলেও হু হু কান্নায় কমতি ঘটতো না। বাঙালি সকাল-দুপুর-রাত ৩ বেলা ওষুধ খাওয়ার রুটিন মেনে শুধু কাঁদতে চায়। এই গানগুলোতে জেমস তাই নিমিত্ত মাত্র।
উদ্ভট লাগতে পারে, তবু জেমসের সঙ্গে শৈশবে ডব্লিউডব্লিউই রেসলার কেইনের সাদৃশ্য পেতাম; ভাবলেশহীন কর্ম করে যাচ্ছে নিজেদের।
কয়েকমাস আগে হুট করে এক হাইপোথিসিস তৈরি হয় খ্যাতি বিষয়ে। একজন ব্যক্তি তখনই খ্যাতিমান যখন তার নিজের অঙ্গনের বাইরের মানুষও তার সম্বন্ধে জানে। যে ব্যক্তি সারাজীবনে ১ দিনও ক্রিকেট দেখেনি, ক্রিকেটের নিয়ম নীতি সম্বন্ধেও অজ্ঞ সে যদি আশরাফুলের নাম জানে তার মানে সে খ্যাতিমান। জেমস কি খ্যাতিমান? প্রশ্নটা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে ১০০ জন ব্যক্তিকে মেসেজ পাঠাই whatsapp, মেসেঞ্জার মিলিয়ে, যারা ব্যান্ডের গান একদমই পছন্দ করে না, জেমসের গানও শুনেনি। তাদের নিকট প্রশ্নটা ছিল অতি সাধারণ- জেমসের জনপ্রিয়তার কারণ কী! ১০০ এর মধ্যে ৬৩ জন উত্তর দিয়েছিল, বাকিরা উত্তর দেবার সৌজন্য দেখায়নি।
সেসব উত্তরের সারমর্ম যা পাই- জেমসের লাইফস্টাইল, মিডিয়াকে পাত্তা না দেয়া, গানের বাইরে খুব একটা কথা না বলা, মা-বাবাকে নিয়ে গাওয়া গান, ব্যতিক্রমী কন্ঠস্বর এসবই তাকে খ্যাতিমান বানিয়েছে। বাঙালি রহস্যপ্রিয়, জেমস নিজেকে নিয়ে সেই রহস্যময়তা ধরে রেখেছেন দীর্ঘদিন যাবৎ — ৬৩ জনের বক্তব্যকে ১ লাইনে আনলে এভাবেই উপস্থাপনযোগ্য বানানো যায়। বিখ্যাত এনজিও ওয়াটার এইডের ইন্টারভিউ বোর্ডে কনসালট্যান্ট থাকার সুযোগ ঘটেছে বারকয়েক। একবার এক নারী সাংবাদিক ইন্টারভিউ দিচ্ছিল, সে বিনোদন বিভাগে কাজ করত। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেলিব্রিটিদের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা হয়, এমন কোনো অভিজ্ঞতা কি হয়েছে যেটা বিশেষ রেখাপাত করেছে। সে বলে- ‘ জেমস ভাইয়ের ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম; উনি একজন চেইন স্মোকার। ইন্টারভিউয়ের শুরুতে জিজ্ঞেস করেন আমি স্মোক করি কিনা, আমি না বলায় ইন্টারভিউ চলাকালে যতবার স্মোক করতে ইচ্ছে হয়েছে উনি বারান্দায় গিয়েছেন। আমি একজন জুনিয়র রিপোর্টার, উনার মতো স্টারের এটা তো করার দরকারই ছিল না৷ বা অন্য কোনো স্টার করেও না এমন। আমি খুবই সম্মানিত বোধ করেছিলাম’।
করোনা ভাইরাস একসময় যক্ষ্মা বা কলেরার মতো স্থানীয় রোগে পরিণত হবে। তার পূর্ব পর্যন্ত মানুষের যে আতংক তা চলমান থাকবে, বিশেষত মাসে কমপক্ষে ৮০ হাজার টাকা উপার্জনকারী শ্রেণিতে এই আতংক কাটবে না সহসা। তবু সবকিছু স্বাভাবিক হতে ২০২৩ সাল পেরিয়ে যেতে পারে। আমরা কৈশোর-তারুণ্যে কনসার্টে যেভাবে মেতেছি, স্টেডিয়ামে ২০-২৫ হাজার দর্শকের উল্লাসে খেলা দেখেছি সেসব কি হারিয়ে গেল? এক তীব্র ইনডিভিজুয়ালিস্টিক পৃথিবীর যে মানচিত্র অংকিত হচ্ছে সেখানে সামষ্টিকতার জন্য জায়গা কি থাকবে বরাদ্দ আদৌ?
জেমসও কি মিস করছেন কনসার্ট? গত ৩৫ বছরে আনুমানিক কতগুলো কনসার্টে অংশ নিয়েছেন তিনি? মাসে গড়ে ৭টা ধরলে বছরে ৮৪টা; পিক সিজন, ডাউন সিজন বিবেচনায় নিয়ে ২ হাজারের বেশি কনসার্ট করেছেন এটা বোধহয় বলা যায় নিশ্চিন্তে। এথলেটদের সঙ্গে আর্টিস্টদের এখানেই পার্থক্য; এথলেটরা অবসর নেয়ামাত্রই একাউন্ট ক্লোজড। সাকিব আল হাসান বিশাল তারকা, ক্যামেরা তার পিছু পিছু ছুটে, টাকার ব্যাগ নিয়ে ঘুরে স্পন্সর কোম্পানি; সাকিব আজ অবসর নিক, পরশুদিন থেকেই সে আর কোথাও নেই। কিন্তু আর্টিস্টদের পুরনো কাজের কারণে হলেও ভোলা যায় না তাদের, চিরসবুজ হয়ে থাকে। তাই প্রায় ১৫ বছর ধরে আলোচিত কোনো সৃষ্টি ছাড়াই এখনো জেমস মানেই পয়সা উসুল।
কিন্তু
করোনার এই দীর্ঘ বিরতিতে কনসার্টহীন, দর্শকহীন অবস্থাটা কেমন প্রভাব ফেলছে জেমসের মনোজগতে? তিনি কি বিষন্নতায় ভুগছেন? নাকি বই পড়ে আর ফটোগ্রাফিতে মানিয়ে নিয়েছেন দ্রুত?
জীবন থেকে জেমসের আর চাওয়ার বা পাওয়ার কি বাকি রয়ে গেল কিছু? তাত্ত্বিকভাবে বললে বব মার্লি বা জিম মরিসনের মতো গ্লোবাল স্টার হতে পারেননি, এ নিয়ে আক্ষেপ থাকতে পারে। কিন্তু ভাষার অবস্থান তো অনেকাংশেই নির্ভর করে ভূরাজনীতিতে সেই দেশের অবস্থানের উপর। বাংলা বিশ্বরাজনীতি এবং অর্থনীতিতে একেবারেই গুরুত্বহীন এক ভাষা, টাকা অতি দুর্বল মুদ্রা— এরকম ডেমোগ্রাফির এক আর্টিস্ট এলভিস প্রিসলি হবে না এ তো নিয়তি নির্ধারিত। নয়তো ‘তলে তলে তল্লাটে জিকির উঠে’ গানটা যেভাবে গাওয়া হয় ভিন্ন ভাষাভাষি মানুষ যারা বাংলা বোঝে না তারাও শিউরে উঠার কথা।
কিন্তু তাত্ত্বিক আলোচনা যদি বাদ দিই, বাংলাদেশী তরুণদের একটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধ রাখার কাজটা তার চাইতে সুনিপুণভাবে করতে পেরেছেন আর কোন এন্টারটেইনার? তার গিটারের কর্ড যদি আর কাজ নাও করে, তাতেও কি এই বাস্তবতার এক বর্ণও বদল হবে?
করোনার এই জঘন্য রাজনৈতিক বাস্তবতায় বারবার যে মনে হয় ‘জেমস কী করছেন’ এটা কৃতজ্ঞতা স্বীকার, নাকি অতীত হয়ে যাওয়া বা বয়সের বারান্দায় রোদ পোহানো তারকার ভবিষ্যৎ চিন্তা সংক্রান্ত কৌতূহল; জানি না সঠিক!
লেখক বা সাহিত্যিক কারো সঙ্গেই কি জেমসের ঘনিষ্ঠতা নেই? উত্তম কুমারের একটি জীবনি পাওয়া যায় ‘আমি উত্তম কুমার বলছি’; এক সাংবাদিক উত্তম কুমারের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে তার জীবনি লিখেছেন। জেমসের যে ব্যক্তিত্ব এবং বর্তমান যে সময়, তাতে এক বা একাধিক লেখকের উচিত তার জীবনি লেখার কাজ শুরু করে দেয়া। বাংলাদেশের মানুষগুলো বেশিরভাগই বড্ড লিনিয়ার, সফল অথবা অসফল যেমনই হোক এদের আপনি আলাদা করতে পারবেন না। জেমসকে পছন্দ করুন অথবা নিন্দা, তার ধরনের মানুষ চোখে পড়বে না সচরাচর।
করোনাকালে কী করছেন জেমস, ভাবনার উৎস সম্ভবত এটাই। তিনি এন্টিক!