৫টি প্রশ্ন দিয়ে লেখা শুরু করতে চাই, উত্তর আমিই দিচ্ছি।
প্রশ্ন১- বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচাইতে বেশিবার বাদ পড়া এবং সর্বাধিক সংখ্যক বার ফেরত আসা খেলোয়াড় কে? নিঃসন্দেহে ইমরুল কায়েস। এবং দলে তার প্রত্যাবর্তন পারফরম্যান্সের জোরে যতখানি তার চাইতে বেশি অন্যদের ব্যর্থতায়। সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলে এন্ডু বিচেল নামে একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার খেলতো, কিন্তু মূল একাদশে জায়গা তেমন পেতোই না। একারণে, অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া বিচেলকে নাম দিয়েছিলো ‘সর্বকালের সেরা টুয়েলভথ ম্যান’। বাংলাদেশী স্পোর্টস মিডিয়া স্পোর্টস বাদে সবই বোঝে; নইলে সর্বকালের সেরা ‘স্ট্যান্ড বাই প্লেয়ার’ খেতাবটা ইমরুল কায়েস পেয়ে যেতো এতোদিনে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১১ বছর পার করেও কোনো ক্রিকেটার স্ট্যান্ডবাই অপশন হিসেবে থাকতে পারে, এটা বিশ্বক্রিকেটেই দুর্লভ বোধহয়।

প্রশ্ন২- চূড়ান্ত ইনকনসিসটেন্ট হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশিদিন ধরে অনবরত সুযোগ দিয়েছে একজন প্লেয়ারকে; দর্শক বিসিবির মুণ্ডপাত করতো কেন সে দলে আছে, তার কারণে অন্য যোগ্য খেলোয়াড়রা জায়গা পাচ্ছে না; কে সে? আপনি যদি ২০১১ এর আগে থেকে বাংলাদেশের খেলার খোঁজ-খবর রাখেন চোখ বন্ধ করেই বলতে পারবেন, সে আর কেউ নয়, মোহাম্মদ আশরাফুল। প্রশ্ন হলো, কেন সুযোগ দিয়েছে? আশরাফুল দলে সুযোগ পেয়েছে ২০০১ এ, তখনো অনুর্ধ্ব ১৭ এর খেলোয়াড় সে। তৎকালীন খেলোয়াড়দের তালিকা দেখুন; জাভেদ ওমর, অপি, আলশাহরিয়ার, বুলবুল, আকরাম খান, হাবিবুল বাশার, দুর্জয়, সুজন, পাইলট প্রমুখ। বিশ্বক্রিকেট মানদণ্ডে এদের একজনও উত্তীর্ণ হওয়ার মতো নয়, শুনতে যতোই খারাপ লাগুক। পক্ষান্তরে সাকলাইন মুশতাকের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জিতে মুরালিধরন ক্রমশ আনপ্লেয়েবল হয়ে উঠেছে, বিশেষত টেস্টে। এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে শ্রীলংকার বিপক্ষে বাংলাদেশের বোলিং এতোটাই নির্বিষ ছিলো যে, অন্যদের ব্যাটিংয়ের সুযোগ দিতে দুজন ব্যাটসম্যান ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাটিং ছেড়ে দেয়। সেই ম্যাচে অভিষিক্ত এক কিশোর মুরালিধরন আর ভাসকে দোর্দণ্ড শাসন করে সেঞ্চুরি করে ফেলে। সে ব্যাটিংয়ে নামলেই দর্শকরা প্রত্যাশায় থাকতো, আজও একটা কিছু করে ফেলতে পারে; কিন্তু অন্যরা যা-ই করুক, সেটা প্রত্যাশা জাগানোর মতো কিছু নয়। ৯৯বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পরবর্তী ৪-৫বছর জয়হীন ছিলো বাংলাদেশ; জিম্বাবুইয়ে বাংলাদেশের তুলনায় মহাপরাক্রমশালী দল। সেই জিম্বাবুইয়েকে হারিয়ে দীর্ঘ জয়ক্ষরা কাটায় বাংলাদেশে। ঝড়ো এক ইনিংস খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলো আশরাফুল। তবে সবচাইতে বড়ো বিস্ফোরকটা জমিয়ে রেখেছিলো আরও কিছুদিন পরে ব্যবহার করবে বলে। ১৯৯৯-২০০৭, এই ৯ বছরে ক্রিকেট খেলাটাকে চূড়ান্তরকম একঘেয়ে বানিয়ে রেখেছিলো অস্ট্রেলিয়া। কোনো দল সামান্যতম প্রতিদ্বন্দীতাই করতে পারতো না অধিকাংশ ম্যাচে। সেই অস্ট্রেলিয়াকেও অবিশ্বাস্যভাবে আচমকা হারিয়ে বসে বাংলাদেশ; আবারো আশরাফুলের সেঞ্চুরি।

প্রশ্ন৩- ২০১৫থেকে ২০১৮ এর ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন ক্রিকেটারকে নিয়ে সবচাইতে বেশি আশাবাদী এবং সমপরিমাণ বা তারও কিছু বেশি ক্ষোভসূচক লেখালিখি হয়েছে সোস্যাল মিডিয়ায়? এটাই ট্রিকিতম প্রশ্ন। এককভাবে কাউকে বেছে নেয়াটা দুঃসাধ্য। সৌম্য সরকার আর লিটন দাসের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে, তবু নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। ম্যাচসংখ্যা ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিলে, সৌম্য আবার সমতায় চলে আসে। ফলে থার্ড আম্পায়ার রড টাকার না দিলেও আমি বেনিফিট অব দ্য ডাউট দেবো লিটন দাসের পক্ষে। সে লেগ সাইডের প্লেয়ার, ঘরোয়া লীগের প্রোডাক্ট, স্যার-লর্ড-ফ্ল্যাট ব্যবসায়ী, ২০ বলের প্লেয়ার, রান না পাইলে স্টাইল ধুইয়া পানি খামু নাকি’- প্রভৃতি তীর্যক মন্তব্যের বিপরীতে ‘মার্ক ওয়াহ এর মতো দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং, হাতে সবরকম শট আছে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের নেক্সট বিগ থিং’- প্রভৃতি অতি উচ্ছ্বসিত লেখালিখিও তার জুটেছে।

প্রশ্ন৪- তিন ফরম্যাটেই একইরকম কার্যকর, অবিশ্বাস্য ধারাবাহিক এবং কখনোই হাল ছাড়ে না, আপনি যত বছর ধরেই ক্রিকেট দেখুন না কেন, মাত্র একজন ক্রিকেটারের নাম বলুন যে, আপনার মতে, এই ৩টি শর্তই পুরোপুরি পূরণ করে। — আমি বিরাট কোহলির নাম বলে রাখছি; পারলে বিরোধীতা করুন।

প্রশ্ন৫- আপনি কি এমন কোনো দেশের নাম জানেন যেখানে কোনো জনপ্রিয় খেলাই নেই? আমি জানি না। সম্পূরক প্রশ্ন, কোনো না কোনো খেলার জনপ্রিয়তা থাকতে হবেই, এটা কি তবে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম পূর্বশর্ত? চিন্তা করে দেখিনি। আপনি জানলে জানিয়েন।

এবার মূল লেখায় প্রবেশ করি।

যে কোনো সেক্টরে রিমার্কেবল কিছু এচিভ করে যারা তাদের একটা দীর্ঘ ক্রাইসিস এবং স্ট্রাগলের গল্প থাকে; স্ট্রাগলটা তখন প্রাইড হয়ে যাওয়ায় কিছুটা অধিসত্য বয়ান থাকে, তবু ক্রাইসিসটা বানোয়াট নয় একদমই। অন্যদিকে অধিকাংশ প্রডিজি বা বিরল মেধার মানুষেরা পরিণত বয়সে ক্যালিবার অনুযায়ী আহামরি কিছু করতে হিমশিম খায়, অনেকে পারেও না। এই দুটো স্টেটমেন্টকে সমণ্বিত করলে দাঁড়ায়- ক্রাইসিস ছাড়া কোনো কিছু পেয়ে গেলে মানুষ তার ভ্যালু বোঝে না। আজ যদি সকল আইফোন ফ্রি করে দেয়া হয়, এবং ছাঁইয়ের দাম করা হয় লক্ষ টাকা; বেশি না, মাত্র ৭ মাসের মধ্যেই দেখবেন আইফোন নিয়ে কারো মধ্যে সামান্যতম বিকারত্ব নেই, কিন্তু ছাঁই সংগ্রহে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

প্রডিজি বা বিরল মেধাবীরা ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে কম যায়, অন্যদের যেটা করতে গলদঘর্ম দশা, তারা তা অবলীলায় করে ফেলে বলে সময় বাড়ে আর অন্যরা শাণিত হয়, আর প্রডিজিরা এক্সিলেন্সের একটা লেভেলে স্থির হয়ে থাকার দরুণ এক পর্যায়ে গ্রোথ আটকে যায়। অনভ্যাসে বিদ্যাহ্রাস বলতে যা বোঝায়। যেহেতু ক্রাইসিসের সাথে ইতিপূর্বে পরিচয় থাকে না, অনভ্যস্ততার দরুণ হঠাৎ আসা চ্যালেঞ্জকে তারা মানতে ভয় পায় কিংবা মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। চিন্তা হওয়া উচিত সিকোয়েন্সিয়াল, আর গ্রোথ হওয়া উচিত ইনক্রিমেন্টাল, অথবা ফিবোনাক্কি সিরিজের আদলে। অন্যথা হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানো হয় না মানুষের।

সকল ক্ষেত্র বাদ দিয়ে ক্রিকেটেই মনোনিবেশ করা যাক। বিশ্বক্রিকেটে যাদের আমরা নমস্য গণ্য করি- ওয়াকার ইউনুস, ব্রেট লি, ব্রায়ান লারা সহ গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদে প্রায় প্রত্যেকেরই একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় ব্যয় করতে হয়েছে লাইমলাইটে আসতে। কিংবা শুরুতেই লাইমলাইটে আসাদের মধ্যে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত কেউ সেটা ধরেও রাখতে পারেনি। বরং টেন্ডুলকার, ওয়ার্ন, পন্টিং, ম্যাকগ্রাথ বা ওয়াসিম আকরামরা ক্যারিয়ারের একটা বড়ো সময় পার করে তবেই অবস্থান অর্জন করেছে। টেন্ডুলকারের বিষয়টা নিয়ে অনেকের সন্দেহ থাকতে পারে, কারণ স্কুলক্রিকেটেই সে রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো, কিন্তু ভারতীয় দলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সে ব্যাট করেছে মিডল অর্ডারে, প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি পেতে খেলতে হয়েছে ৭৮ বা ৭৯ টা ম্যাচ। এই স্ট্যাটিসটিক্সগুলো মাথায় রেখে যে অবস্থানে থেকে টেন্ডুলকার ক্যারিয়ার শেষ করেছে- দুটো ফ্যাক্ট মেলালেই বোঝা সম্ভব তার ক্রাইসিসের তীব্রতা কত বেশি ছিলো।

বাংলাদেশের ক্রিকেট চলে মিরাকলের আশায়। সাকিব আল হাসান ব্যতীত আর একটিও উদাহরণ নেই যে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই প্রতিশ্রুতিশীল এবং সেটা ১ যুগ ধরে রক্ষা করেছে। তবে সাকিবের উদাহরণটিকে আমি যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট থেকে সরিয়ে বিশ্বক্রিকেটে নিয়ে আসি, তাহলে আফসোস তৈরি হতে বাধ্য। ক্যালিবার অনুসারে তার রেকর্ড আরো সমৃদ্ধ হতে পারতো, হলো না, কারণ তাকে বড়ো কোনো ক্রাইসিসে পড়তে হয়নি; দলে জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি। এবং অন্যদের তুলনায় পারফরম্যান্সে এতোটাই এগিয়ে থেকেছে যে, নিজের টার্গেটটাই ছোট হয়ে গেছে। ২০১০-২০১৩ এই ৩ বছরে সে যদি ফর্ম নিয়ে স্ট্রাগল করতো, তার ইফেক্টিভিটি নিশ্চিতভাবেই বাড়তো। তখন সে নিজের ফিটনেস, টেম্পারমেন্ট, স্কিল সবকিছু নিয়েই আরো অনেক বেশি সিনসিয়ার হতো।
কিন্তু ক্যালিবার সাপেক্ষে ক্যাজুয়াল থেকেও যেহেতু রান করা যাচ্ছে, উইকেট আসছে- বাড়তি কিছুর তাগিদ হয়তো সেভাবে বোধই করেনি। ক্যারিয়ারের মধ্যাহ্ন পেরিয়ে অদূরেই সায়াহ্নে দেখা যাচ্ছ, এখন আর নতুন করে নিজেকে ভাঙ্গা-গড়ার তাড়না কাজ করবে না তার মধ্যে, বরং এতোদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সেটা থেকে আউটপুট নিয়ে আসার নিরাপদ প্রয়াস। প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান ব্যাটিংয়ের সময় তাকে তুলনামূলক সমীহ করবে, কারণ সে সাকিব, কিন্তু তার চাইতে বেটার ডেলিভারি দিয়েও নাজমুল অপু হয়তোবা চার-ছক্কা হজম করবে, কারণ তার সম্বন্ধে ব্যাটসম্যানের মনে কোনো ইমপ্রেসন কাজ করে না।

মাশরাফির জীবন থেকেও উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জাতীয় দলে ঢোকার আগেই সে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলো। অভিষেক টেস্টে খেলতে নেমেই ডিওন ইব্রাহীমের স্ট্যাম্প ছত্রখান, অভিষেক ওয়ানডেতে গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারকে বোল্ড করা মাশরাফি নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে প্র্যাকটিস ম্যাচে স্থানীয় এক ব্যাটসম্যানকে ক্রিজের মধ্যে রক্তাক্ত করেছিলো বিষাক্ত বাউন্সারে। নিউজিল্যান্ড মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলো- ১৫০ কি:মি: গতিতে বল করতে চাই, শোয়েব আখতার-ব্রেট লি এর মতো দ্রুতগতির হতে চাই। আমার সবকিছু মনে থাকে, হয়তোবা মাশরাফিরও মনে আছে সেই ইন্টারভিউয়ের কথা। এরপর ইনজুরি আর মাশরাফি একে অপরের হরিহর আত্মা বন্ধু। ফলে ১৫০ কি:মি: গতিতে বল করতে চাওয়া মাশরাফি ইনজুরির কাছে বশ্যতা স্বীকার করে লাইন-লেন্থ নির্ভর ইফেক্টিভ বোলার হওয়ার চেষ্টা করে এখন, সফলও হয়েছে সেই চেষ্টায়। কিন্তু ২০০১-২০০৭ এই সময়টাতে আমরা যে নড়াইল এক্সপ্রেসকে দেখেছি, জেনুইন ফাস্ট বোলার যা কিনা এমনকি তখন ভারতেও ছিলো না, ২০১০ এর পর থেকে খেলা মাশরাফির মাঝে কি সেই আগুনে তেজ দেখতে পাই? এতোবার ইনজুরিতে পড়ার পর এখনো খেলছে এটাই তো মিরাকলের মতো লাগে। কথা সম্পূর্ণ নির্ভুল। ইনজুরির কারণে ২০১১ তে দেশের মাটিতে হওয়া বিশ্বকাপও খেলতে পারলো না। আশরাফুলকে সরিয়ে তাকে যখন অধিনায়ক করা হলো, প্রথম টেস্টেই বোলিং মার্কে পড়ে গিয়ে বিরাট ইনজুরিতে পড়ে; সম্ভবত ২০০৮ এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর ছিলো সেটা। এবার সেই অপ্রিয় প্রশ্নটা করতে চাই, ক্যারিয়ারজুড়ে এরকম ইনজুরিপ্রবণ মাশরাফি ২০১৩ এর পরে সাধারণ ক্রিকেটিয় চোট ব্যতীত আর বড়ো ধরনের কোনো ইনজুরিতে পড়লো না কেন, অথচ ক্যারিয়ারের শুরুতে ইনজুরি আর ইনজুরি। আগে সতর্ক ছিলো না তেমন, বয়স আর অভিজ্ঞতা বাড়ায় এখন নিজের মূল্য বুঝেছে; এটাই কারণ, নাকি অন্য কিছু? আমি কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চাই না। কেবল কয়েকটা ক্লু রেখে যেতে চাই।

ধরা যাক, অনুর্ধ্ব ১৭ টুর্নামেন্টে সে ১৭ বলে ৬৭ রানের ক্যামিও ইনিংস খেললো না, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কিংবদন্তী এন্ডি রবার্টস তাকে আর তালহা জুবায়েরকে স্পেশাল বললো না; কিংবা দুটো শর্ত সত্য মেনেও অভিষেক টেস্ট-ওয়ানডেতে চোখে পড়ার মতো কিছুই করতে পারলো না। প্রথম নজরে আসার মতো পারফরম্যান্স পেতেই অপেক্ষা করতে হলো ৭ ওয়ানডে, ৭ টেস্ট। দুটো প্রশ্ন। প্রথমত, সেই মাশরাফি কি আজকের মাশরাফি হতে পারতো? দ্বিতীয়ত, মাশরাফি কি তাহলে এতোখানি ইনজুরিপ্রবণ থাকতো? ক্রিকেট বোর্ডের মধ্যে ভিশন বা দূরদর্শীতা নেই, এটা পুরনো প্রতিষ্ঠিত সত্য, কিন্তু মাশরাফি নিজেও কি খুব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে দীর্ঘদিন। বিগত ৪-৫ বছরে বাংলাদেশের ম্যাচ খেলার পরিমাণ বেড়েছে, মাশরাফি কি ইনজুরির কারণে শিরোনাম হয়েছে, নাকি লিডারশিপ প্রশ্নে? এটুকু ভাবলেই, ক্রাইসিস বিষয়টা বোঝা যাবে।

আরো স্পষ্ট বোঝা যাবে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম আর মাহমুদুল্লাহ এর উদাহরণগুলো বিবেচনায় নিলে। ২০১২ এর আগে তামিমের ক্যারিয়ার বয়স ৫ বছর হয়ে গেছে। তখনো স্পিন বল এলেই আকাশে তুলে দেয়া, পার্টনারের সাথে ভুল বোঝাবুঝিতে পিচের মাঝখানে পড়ে গিয়ে রান আউট হওয়া এবং শর্ট বলে দুর্বলতা বেশ ভালোমতোই বিদ্যমান। ফোর্থ স্ট্যাম্পে পিচ পড়া বল এ ফ্ল্যাশি ড্রাইভ করতে গিয়ে স্লিপ বা কিপারকে ক্যাচ দেয়া তার জন্য নিয়ম। ২০১২-২০১৫, এই ৩ বছরে ‘তামিম চাচার জোরে খেলে, তামিম কালা পারা না’ কথাগুলো প্রবাদ প্রবচন। বিগত ৩ বছরে তামিমের আউটগুলো দেখবেন, তারপর বুঝবেন ক্রাইসিস কেন জরুরী।

মুশফিক ২০১২ এর আগে কয়টা ছক্কা মেরেছে? কিংবা বাংলাদেশে স্কুপ শট বেশি খেলতো আশরাফুল, সাকিবও খেলেছে দীর্ঘদিন; কিন্তু এই শটে দুজনের একুইরেসিই যথেষ্ট কম। কিন্তু মুশফিক স্কুপ করতে গিয়ে বোল্ড বা ক্যাচ আউট হয়েছে, এরকম দৃষ্টান্ত কয়টা দিতে পারবেন? কিংবা স্ট্রাইক রোটেট করা, ইমপ্রোভাইজিং শট খেলায় তার সমকক্ষ ব্যাটসম্যান কে ছিলো বা আছে? নতুন বল এ সমস্যা হতো, বিশেষত ইনকামিং ইনসুইঙ্গিং ডেলিভারিতে বোল্ড বা লেগবিফোর অবধারিত ছিলো বলে ৬ নম্বরের আগে ব্যাটিংয়ে নামতে চাইতো না। ২০১৬ এর পরে কয়টা ম্যাচে মুশফিককে ওভাবে আউট হতে দেখেছেন? অথচ তার অভিষেক তো ২০১৬ তে। ২০১২এর এশিয়া কাপে ভারতকে চেজ করে হারানো ম্যাচে সাকিব আউট হওয়ার পর যখন মুশফিক নামে গ্যালারিতে দর্শকরা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো (ম্যাচটা মাঠে বসে দেখেছিলাম), কারণ ওই সময় স্লগিংয়ের প্রয়োজন ছিলো; বল আর রানের ব্যবধান অনেক; মুশফিক নেমে বল নষ্ট করবে এটাই ছিলো অভিযোগ। সেই মুশফিক ইরফান পাঠানের একই ওভারে দুটো, প্রভিন কুমারকে ১টা সহ মোট ৩টা ছক্কা মেরে ম্যাচটা বের করে এনেছিলো। এখন যদি স্লগ ওভারে মুশফিক থাকে, যে কোনো স্লগারের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে পারবে। এই অবস্থানে আসতে তাকে খেলতে হয়েছে ১২ বছর। আজ প্রথম আলোতে তার একটা স্টেটমেন্ট পড়ে অভিভূত হলাম। ‘আমরা যারা ২০০ এর মতো ম্যাচ খেলে ফেলেছি তাদের প্রতি ৩ ম্যাচের ২টাতেই রান করা উচিত’। এই স্টেটমেন্টেই বোঝা যায়, গ্রোথের ক্ষুধা তার কতখানি তীব্র। অথচ অভিষেকের আগেই মুশফিক সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যান। ২০০৬ এর ইংল্যান্ড সফরে টেস্টে তার অভিষেক হয়েছিলো জেনুইন ব্যাটসম্যান হিসেবে, পাইলট ছিলো কিপার। প্র্যাকটিস ম্যাচে ওইটুকু শরীর নিয়ে ইংলিশ বোলারদের ছক্কা মেরে ব্রিটিশ মিডিয়ার প্রশংসা আর আগ্রহ আদায় করে নিয়েছিলো। শরীরের প্রসঙ্গ বললাম, কারণ তার আর শাহাদাত হোসেন রাজিবের অভিষেক হয়েছিলো একই সাথে (তার উচ্চতা ৬ফুট ৩ইঞ্চি), প্রথম আলোতে ২জনকে নিয়ে ফিচার করেছিলো, সেখানে শারীরিক বেসাদৃশ্যের প্রসঙ্গটা এসেছিলো। এছাড়া আয়ারল্যান্ডের পেসার রেনকিন এর উচ্চতা ৬ফুট৯ উচ্চতা; তার পাশে দাঁড়ানো ৫ফুট ৩ ইঞ্চি মুশফিকের ছবি নিয়েও বহু হাসাহাসি হয়েছে একসময়। সেই মুশফিক ব্যাটিংয়ে আস্থার প্রতিদান দিতে না পেরে ধীমান ঘোষের মতো লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানের কাছেও জায়গা হারিয়েছে।

সত্যি করে বলুন তো, ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে মাহমুদুল্লাহ সম্পর্কে কারো কোনো পজিটিভ ইমপ্রেসন ছিলো? অথচ তার তো অভিষেক হয়ে গেছে ২০০৮ এ। ৭ বছরে সে ক্রমাগত ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে গেছে।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট কালচারটা বড়োই অদ্ভুত। মেহরাব হোসেন অপি, আলশাহরিয়ার রোকন এরা টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগেই তারকা। রোকন বাংলাদেশের প্রথম ফার্স্টক্লাস সেঞ্চুরিয়ান তাও নিউজিল্যান্ডের কোনো প্রাদেশিক দলের বিপক্ষে। ফলে তারা হয়তো ধরেই নিয়েছিলো, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রান করা যাবে। আশরাফুল যদি অভিষেকেই সেঞ্চুরি করে না বসতো, গল্পটা হয়তোবা অন্যরকম হতে পারতো। এনামুল হক বিজয় অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে রানের ফুলঝুরি ফুটিয়ে নিজের সম্বন্ধে উচ্চধারণা তৈরি করে ফেলেছিলো। দলে ঢোকার পরপরই অল্প সময়ের ব্যবধানে ৩টা সেঞ্চুরি করে ফেলে। সৌম্য সরকার বিশ্বকাপ দলে চান্স পেয়েছিলো ৭ নম্বরে ব্যাট করবে পাওয়ার হিটার হিসেবে, প্লাস মিডিয়াম পেস বোলিং করবে এই ভাবনা থেকে। মানে, পেস বোলিং অলরাউন্ডার। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে মমিনুলের খেলার কথা ৩ এ, তার ৭এ। কিন্তু হয়ে গেলো উল্টো। সৌম্য সেই ম্যাচে ফ্রি ফ্লোয়িং ব্যাটিং করলো, সবগুলো ম্যাচেই মাহমুদুল্লাহ এর সাথে পার্টনারশিপ দিচ্ছিলো, স্কটল্যান্ড ম্যাচে ফিল্ডিং করার সময় বিজয় ইনজুরিতে পড়ায় তাকে ওপেন করতে হলো, সেই ম্যাচে ব্যর্থ হলেও পরের সিরিজ ৩টিতে (পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা) বিস্ফোরক কয়েকটা ইনিংস খেলে ফেললো। প্রায় প্রতিটি ইনিংসেই কিপার আর স্লিপের মাঝখান দিয়ে চার হয়েছে, লফটেড শট নো ম্যানস ল্যান্ডে পড়েছে, কিংবা ফিল্ডার ক্যাচ মিস করেছে, মানে ভাগ্যের সরাসরি ছোঁয়া ছিলো। সেটা সে অনুধাবন করেনি। তার শট যে খুবই লিমিটেড, ভারতের বিপক্ষে আশ্বিন-জাদেজার স্পিন খেলতে গিয়ে যে ধুঁকতে হয়েছে, এইসব ফাটলকে আমলে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। ফলে ফাটল একসময় ধ্বস নামিয়েছে।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্ট্যান্ডার্ড হঠাৎ করেই উপরে উঠে গেছে দলের ৫০% ক্রিকেটার প্রায় একযুগ ধরে একসাথে খেলার দরুণ। আগে যেটা হতো, কোনো উদাহরণ ছিলো না দেয়ার মতো। আশরাফুল আসার আগে আহামরি পারফরম্যান্স ছিলো না কারো, শাহরিয়ার নাফিস যখন এসেছে তখনও ওয়ানডেতে পারফরমার বলতে ইনকনসিসটেন্ট আশরাফুল, টেস্টে হাবিবুল বাশার। মুশফিক-সাকিব-তামিমরা যখন এসেছে তখনো সেরকম পারফরমার না থাকায় তারা খারাপ খেলেও সুযোগ পেয়ে গেছে বিকল্প প্লেযার না থাকায়। বিকল্প যারা হতে পারতো, যেমন শামসুর রহমান শুভ, নাজিমউদ্দিন, জহুরুল, জুনায়েদ সিদ্দিকী তারাও খুব চোখে পড়ার মতো কিছু করতে পারেনি। একই সময়ে খেলা ইমরুল কায়েস বাকিদের তুলনায় মন্দের ভালো পারফরম্যান্স প্রদর্শন করায়, এতোদিন পরও সে থিতু হতে পারেনি, বরং যে কেউ ব্যর্থ হলেই স্ট্যান্ডবাই কোটায় সর্বপ্রথম ডাক পড়ে তারই। আমার ধারণা, বাংলাদেশের যে কোনো ট্যুরেই তার লাগেজ একটা গোছানোই থাকে; এই বুঝি কেউ ইনজুরিতে পড়লো, অথবা ফর্ম হারিয়ে ফেললো; আর আমাকে উড়াল দিতে হবে। যেহেতু তার অন্তর্ভুক্তিগুলো জোড়াতালি দিতে বেশিরভাগ সময়ই, যে কারণে ফিটনেস, ফিল্ডিং, ব্যাটিং কোনোকিছু নিয়েই পর্যাপ্ত আন্তরিক বা সচেতন হওয়ার কোনো প্রবণতা তৈরি হয়নি তার মধ্যে। একটা যোগ্যতাই দারুণভাবে রপ্ত করেছে- চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করা।

লিটনের কেইসটা এদিক থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। পাইলট ২০১৫এর বিশ্বকাপগামী দলেই তাকে দেখতে চেয়েছিলো। ক্রিকেটপাড়ায় লিটন দাস অনেকদিন ধরেই এক্সেপশনাল ট্যালেন্ট হিসেবে পরিচিত এবং কিছুটা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হয়েই বুঝতে পারলো, প্রতিভা ধুইয়ে পানি খাওয়া যাবে না। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজেও অবস্থা তথৈবচ। কিন্তু অলক্ষ্যে তার এক মহা উপকার করে দিয়েছিলো ক্রীড়া সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রনী। দীর্ঘদিন থেকেই সে সাঙ্গাকারার উদাহরণ দিয়ে একটা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছিলো, টেস্টে মুশফিকের কিপিং ছেড়ে দেয়া উচিত, তাতে তার ব্যাটিং পারফরম্যান্স বাড়বে, দলের জন্যও উপকার হবে। মুশফিক খুব বেশি আমলে না নিলেও আমলে নিয়েছিলো তার ইনজুরড আঙুল, যে কারণে টেস্টে কিপিং করার মতো যথেষ্ট ফিটনেস সম্ভবত ছিলো না। উইকেটকিপার হিসেবে টেস্টে সুযোগ পেয়ে যায় লিটন, এবং বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়া টেস্টে দারুণ সম্ভাবনাময় ব্যাটিং করে, যেখানে ডেইল স্টেইনকে স্ট্রেট ড্রাইভ করে মারা বাউন্ডারিটাই মূলত বিদগ্ধ ক্রিকেট দর্শকদের মনে তার প্রতি অত্যন্ত পজিটিভ ইমপ্রেসন তৈরি করে। স্টেইনের মতো বোলারকে এতোটা এলিগ্যান্স নিয়ে স্ট্রেইট ড্রাইভ করা ব্যাটসম্যান কে আছে! চার তো কতজনেই মারে, লিটনের মতো দৃষ্টিনন্দন তো লাগে না কারোরটাই! ওই এক শট দিয়েই লিটন নিজের ক্লাস সম্বন্ধে ধারণা দিয়ে দেয়।

কিন্তু ২০১৫ এর বিপিএলটা কাটে দুঃস্বপ্নের মতো। এতোটাই শোচনীয় পারফরম্যান্স যে, একাদশেই জায়গা হারিয়ে ফেলে। ২০১৬ তে বাংলাদেশে টেস্ট আর ওয়ানডে তেমন খেলেইনি হাথরুসিংহের প্রেসক্রিপশন মেনে। টি২০ বিশ্বকাপের প্রস্তুতিস্বরূপ টি২০ ই বেশি খেলা হয়। রনী ভাইয়ের যুক্তিতে অন্যান্য অনলাইন ক্রিকেট লেখকও কনভিন্সড হয়ে পড়ে যে, মুশফিকের আসলেই কিপিং ছেড়ে দেয়া উচিত, এবং মানুষ আবিষ্কার করতে থাকে কিপার হিসেবে তার মান যাচ্ছেতাই, যদিও ততদিনে ৯ বছর হয়ে গেছে টেস্টকিপিংয়ের বয়স। এতো মানুষের লেখালিখির সুবাদে বোর্ডও কনভিন্সড হয়ে পড়ে, মুশফিককে কিপিং থেকে অব্যাহতি দেয়া উচিত। যে কারণে শ্রীলংকা সিরিজের টেস্ট দলে তাকে রাখা হয়। একটা ম্যাচ খেলার পর ইনজুরিতে পড়ার দরুণ ২য় টেস্টে সুযোগ হয় না। অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে সুযোগ পেয়েছিলো কিনা মনে নেই, তবে শ্রীলংকার সাথে হোম সিরিজে আবারো টেস্টে সুযোগ আসে। লাকমলের বল লিভ করে ক্লিন বোল্ড হয়ে দারুণ সমালোচিত হলেও পরের টেস্টে ৯৪ রান করে আবারো কিছু ক্লাসিকাল ক্রিকেট অনুরাগীর প্রশংসা কুড়ায়। ফলে টেস্টে লিটন মোটামুটি নিয়মিতই হয়ে পড়ে। তার ক্যালিবার আরো ভালোভাবে ধরা পড়ে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে ৭০ রানের ইনিংসটাতে। এতোদিন তার বিরোধীতা করা মানুষও বলতে বাধ্য হয়, দিস গাই ইজ রিয়েলি স্পেশাল, ট্রিট টু ওয়াচ। কিন্তু ওয়ানডে সিরিজে দৃষ্টিকটুভাবে আউট হয়ে আবারো পুরনো ট্রলগুলো জীবিত করে ফেলে।

সৌম্য-এনামুলে কাজ না হওয়ায় কোনো এক অজানা কারণে নিদহাস ট্রফিতে তাকে দলে রাখা হয়। শ্রীলংকা ২১৫ করে ফেলার পর ম্যাচ ওখানেই শেষ ধরে নেয় মানুষ, কিন্তু তামিমের সাথে ওপেনিং নেমে বোলারদের যেভাবে শাসন করে তাতে আবারো মানুষ ভাবতে শুরু করে এই ছেলেকে দিয়ে হতে পারে। ফাইনাল ম্যাচেও পয়েন্টের ওপর দিয়ে মারা ছক্কাটা স্মরণ করলে যে কেউ বুঝতে পারবে তার ক্যালিবার কোন পর্যায়ের। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তাকে হুট করেই টেস্ট ওপেনার বানিয়ে দেয়া হয়েছে, যেটা আমি কখনোই সমর্থন করি না। মাহমুদুল্লাহ টেস্ট খেলার যোগ্য নয়। সে হতে পারে পারফেক্ট নাম্বার সিক্স। অথচ সব ফরম্যাটে ওপেন করানোর যে অদ্ভুত অদূরদর্শীতা এ থেকে বোর্ডের মুক্তি মিলবে কবে কেউ বলতে পারে না। কারণ লিটন ওপেন করছে, মুশফিক ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছে; স্পেশালিস্ট কিপার হিসেবে নিতে হচ্ছে সোহানকে; এই বিলাসিতা কি সত্যিই মানায়? অথচ ৫ বা ৬ এ খেললে লিটন হতে পারে ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড। ওয়ানডে ওপেনার আর টেস্ট ওপেনার তো এক জিনিস না। মাহমুদুল্লাহ তখন ৭ এ ব্যাট করতে পারে, কারণ ৭-৮ নম্বরে তার টেস্ট ব্যাটিং যথেষ্ট কার্যকরী তার বহু দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি।

লিটনের ক্যারিয়ারে মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জেতা শেষ টি২০; প্রথমবারের মতো ম্যান অব দ্য ম্যাচ। তবে এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে, সে পুলশট ভালো খেলে, এবং এটা করতে গিয়ে অনেক সময়ই মিস টাইম করে ফেলে, ফ্লিক করতে গিয়ে প্রায় সময়ই লং লেগ এ ক্যাচ তুলে দেয়, ইনসুইঙ্গিং ডেলিভারিতে এক্রোস দ্য লাইন খেলতে গিয়ে লেগবিফোর বা বোল্ড হয়; অথচ চাইলেই সে এগুলোতে ভি-তে খেলে স্ট্রেইট চার মারতে পারে, সেটা টেস্টে দেখাও গেছে। সুইপ দুর্দান্ত খেলে, কিন্তু স্লগ সুইপ করতে গেলে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। পর্যবেক্ষণগুলো যোগ করলেই দাঁড়ায়, সে পর্যাপ্ত প্র্যাকটিস করে না, কেবলমাত্র প্রতিভার ওপর নির্ভর করে রুটিন প্র্যাকটিসটুকু করে হয়তোবা। যে কারণে তার মিডলিং হয় কম, এইজড হয় বেশি।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের টি২০ এর পর তার অনুরাগী এবং নিন্দুক দুটোই বেড়ে গেছে। একদল, সে কেন ট্যালেন্টের অপচয় করছে তা নিয়ে আফসোস করছে, আরেকদল যে কোনোভাবে প্রমাণে তৎপর লিটনের পারফরম্যান্স ফ্লুক, ১৩ ম্যাচ খেলেও ২০০ রান করতে পারেনি, সে কিসের ব্যাটসম্যান। এশিয়া কাপের প্রথম ৩ ম্যাচ নিন্দুকদের মুখে হাসি ফুটিয়ে সে শোচনীয়ভাবে আউট হয়েছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সুপার ফোরের ম্যাচে ৪১ রান করলেও রশিদ খানকে ইনসাইড আউট এ মারা চারটা টুর্নামেন্টের সেরা শট ছিলো নিঃসন্দেহে। পরের বলেই স্লগ সুইপ, এবং আউট। ওটাই ছিলো তার ক্যারিয়ার বেস্ট। পাকিস্তানের বিপক্ষে যেভাবে ইনসুইংগিং বল এ বোল্ড হয়, তাতে আবারো বোঝা যায় ব্যাটিং নিয়ে কত কাজ করা বাকি তার। কিন্তু দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে যে ক্রাইসিস, এটা তার জন্য উপকারী হয়েছে। সে বুঝতে পেরেছে কোথায় যাওয়ার সামর্থ্য আছে তার, এবং সে পড়ে রয়েছে কোথায়। ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ৫০ রান পুরোপুরি সলিড, এরপরই স্লগ সুইপের খেসারত দিতে হচ্ছিলো প্রায়, কিন্তু ক্রাইসিসে প্রায় ৩ বছর পার করে ফেলায় ভাগ্য এযাত্রায় তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে; এরপরে যে সেঞ্চুরিটা করলো, বিগত ১১ বছরে এত দৃষ্টিনন্দন ইনিংস বিশ্বক্রিকেটেই দেখেছি কিনা মনে করতে পারছি না। ৪ বছর বয়স থেকে জীবনের সব স্মৃতি মনে রাখি, ক্রিকেট নিয়ে এতো কিছু লিখি কোনোরকম স্ট্যাট না ঘেঁটে স্রেফ স্মৃতির উপর নির্ভর করে, অথচ সেই আমি এমন দৃষ্টিনন্দন ইনিংসের দৃষ্টান্ত খুঁজতে গিয়ে পেলাম সেই ১১৯৮ সালে শারজাতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফাইনালে টেন্ডুলকারের করা সেঞ্চুরিটা। এরপরেও তো টেন্ডুলকার কত সেঞ্চুরি করেছে, কোহলি সেঞ্চুরি জিনিসটাকেই খেলো বানিয়ে ফেলেছে, রুট-উইলিয়ামসনের কত সেঞ্চুরি দেখলাম, তবু লিটনের ১২১ এর সাথে নান্দনিকতায় কম্পিট করার মতো পেলাম না একটাও! এবং তার আউটটাও হয়েছে এমন, ম্যাচের সবকিছু ছাপিয়ে ওটাই প্রধান বিতর্কের বিষয়। সমস্ত আলোচনা লিটন নিজের ওপরে টেনে নিয়েছে এক আউটে; এভাবেই তারকার জন্ম হয়!

লিটন কি এখন থেকে নিয়মিতই রান করবে? নাহ, তবে ৩ বছরের ক্রাইসিস তাকে একটা বার্তা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া এখনো অনেক অনেক দূর (মানে লেভেল অব এক্সিলেন্স)। সে এখন চাইলেও সাব্বির বা সৌম্যের মতো পথ হারাতে পারবে না, কারণ পিচ্ছিল পথটা সে হেঁটে এসেছে। এবং মঞ্চও তার জন্য প্রস্তুত, কারণ ওপেনিং স্লট নিয়ে যাদের সাথে প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা (সৌম্য, এনামুল, শান্ত, ইমরুল। জিম্বাবুইয়ে সিরিজে হয়তোবা জাকির সুযোগ পাবে) একজনও এমন আহামরি কোনো ফর্মে নেই যে তার জন্য থ্রেট হতে পারে, যদিও দেশের ক্রিকেটের জন্য এটা ভালো বিজ্ঞাপন না। কিন্তু দেশের দর্শক, বিসিবি সবাই শর্ট টার্ম সাফল্যে বিশ্বাসী, ১যুগ ধরে সিনিয়রার স্ট্যান্ডার্ডের একটা বেঞ্চমার্ক তৈরি করে দিয়েছে। তামিমের আগে কোনো তামিম ছিলো না, শাহরিয়ার নাফিসের যা কীর্তি বেশিরভাগই জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে হওয়াতে দর্শকরাই তাকে সেরকম সমীহের জায়গায় রাখে না। কিন্তু লিটনদের এখন শুরু করতে হয় তামিমকে ছাড়িয়ে-ছাপিয়ে যাওয়ার টার্গেট নিয়ে। এই চ্যালেঞ্জ জিততে লং টার্ম ইনভেস্ট জরুরী। ফাইনালের ইনিংসটা সেই ব্রিদিং স্পেসটা দিয়েছে তাকে। মুশফিকের কথাতেই ফেরত যাই। তারা এখন ৩ ম্যাচের ২টাতেই রান করার টার্গেট করতে পারে, লিটনকে সময় দিলে সেও এখন থেকে প্রতি ৩ ম্যাচের ১টাতে ৩৭+ রান করবে। মার্ক মাই ওয়ার্ড। কারণ, ক্রিকেট পুরোপুরিই মানসিক খেলা। সে এতোদিন খুবই ক্ষুদ্র এক গণ্ডিতে চিন্তা করেছে। কালকের ইনিংসের ধারাবাহিকতায় পরের ৩টা সিরিজে ১টা করে ৫৩+ ইনিংস রাখতে পারলে আগামীবারের আইপিএল এও সে ডাক পেতে পারে। ধোনি কিপিং করা অবস্থায় তার ব্যাটিং দেখেছে, রোহিত দেখেছে, এবং বুঝতে পেরেছে কোনো একটা ব্যাটসম্যান তাকে সাপোর্ট দিলে সে ইনিংসটাকে কতো বড়ো করতে পারতো। পরের বছর ধোনি বা রোহিতের দলে যদি সে ডাক পায় অবাক হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। মুস্তাফিজের ঘটনা মনে আছে তো? আইপিএল খেলা বাংলাদেশীর তালিকা খুব বড়ো নয়- আশরাফুল, মাশরাফি, সাকিব, মুস্তাফিজ; তামিম দলের সাথে ছিলো, ম্যাচ পায়নি। এদের মধ্যে সাকিবের আইপিএল ক্যারিয়ারই সবচাইতে সমৃদ্ধ, মুস্তাফিজেরটা এভারেজ। লিটন ডাক পেলে সেটা হবে প্রথম কোনো ব্যাটসম্যানের নিয়মিত হওয়া। কারণ আশরাফুল খেলেছে মাত্র ২ ম্যাচ, এবং পারফরম্যান্স হাস্যকর পর্যায়ের। এভাবেই স্বপ্নের সীমানা বড়ো হয় মানুষের। ৩ম্যাচে ১টা ভালো খেলার নীতি জারি থাকলে বিশ্বকাপে অন্তত ৫টা ম্যাচে লিটন দুর্দান্ত খেলবে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, তবে এর সঙ্গে কিছু যদি-কিন্তু আছে।

বাংলাদেশে জন্ম নেয়া সবচাইতে দৃষ্টিন্দন ব্যাটিংশৈলীর ব্যাটসম্যান কে? আমার ধারণা, অপশন হিসেবে ৪জন শর্টলিস্টে থাকবে- আশরাফুল, তামীম ইকবাল, অলক কাপালী এবং লিটন দাস। আরো সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে তামিম আর অলক বাদ পড়ে যাবে। বাকি থাকবে কেবল আশরাফুল আর লিটন। আমি ভোট দেবো লিটনকে।

আশরাফুলের স্কোরিং শট খুব বেশি ছিলো না। সে পুলটা খুব ভালো খেলতো, ড্রাইভ খেলায় দক্ষ ছিলো, মুরালিধরনকে দারুণভাবে সামলাতে পারতো, স্কুপ খেলতো। কিন্তু স্ট্রাইক রোটেট করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা মারাত্মক; লেগ কাট এর বাইরে সিঙ্গেলস নেয়ার মতো স্কোরিং শট ছিলোই না বলতে গেলে। তার রিস্টেও পাওয়ার ছিলো না তেমন। অনেক ম্যাচেই স্পিন বলে ওভার দ্য টপ খেলতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ আউট হয়েছে টাইমিং হওয়া সত্ত্বেও। তাছাড়া ব্যাটিংয়েও সে ছিলো অনেকটা ওয়ান ডিরেকশনাল। যেদিন এটাকিং মোডে থাকতো, নির্বিচারে হিট করতো, যেদিন ডিফেন্সিভ মোডে থাকতো, ক্রমাগত ডট খেলতো। প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরি করে সেই যে স্পটলাইট নিয়ে এসেছে নিজের ওপর, তার প্রভাবে ব্যাটিংয়ের দুর্বলতাগুলো নিয়ে কাজ করার আগ্রহ-ইচ্ছা কোনোটাই তৈরি হয়নি নিজের মধ্যে, বরং হঠাৎ পাওয়া সাফল্যেই সে সন্তুষ্ট ছিলো। কিন্তু সাকিব অধিনায়ক হওয়ার পর যখন সে দলে জায়গা হারায়, এবং ২০১১ বিশ্বকাপেও অধিকাংশ ম্যাচ বাইরে বসে কাটায়, তারপর সে ব্যাটিং নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ করেছিলো, যেটা দেখা যায় শ্রীলংকা সিরিজে ১৯০ রান করা ইনিংস দেখে। সে সময়ের ইনিংসগুলো দেখলে বোঝা যায়, তার মধ্যে ধারাবাহিকতা আসতে শুরু করেছিলো, but it was too late!

লিটন এই জায়গাটাতে এডভান্টেজ পেয়েছে। সে ইতিমধ্যেই জেনে গেছে, তার দুর্বলতা কী, এবং দলে টিকে থাকার চাপ কতখানি হতে পারে। ফলে, একটুখানি আন্তরিক হলেই সে নিজেকে ধরে রাখতে পারবে। তাসকিন, নাসির বা সাব্বিররা পারেনি, কারণ সেই ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি তাদের। মোসাদ্দেককে বাদ দিয়ে দিক, ১ বছর পরে সে যখন ফিরে আসবে, অনেক পরিণত হয়ে আসবে। মমিনুল ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছে কোয়ালিটি স্পিন, কোয়ালিটি পেস দুটো সামলানোর ক্ষেত্রেই তার সীমাবদ্ধতা আছে। এটা নিয়ে কাজ করতে করতেই সে উতরে যাবে। কারণ, তার ক্রাইসিসের গল্পটাও দীর্ঘ যথেষ্ট। লিটন যখন খেলে মাঠটা অনেক ছোট লাগে, মনে হয় ফিল্ডার সংখ্যা আরো ৫জন বেশি হলে ভালো হতো। সে পুরোদস্তুর রিস্ট নির্ভর প্লেয়ার; ড্রাইভ-কাট-সুইপ এমন কোনো শট নেই যেখানে তার মুন্সিয়ানা চোখে পড়ে না। এরকম একজন ব্যাটসম্যান যদি বিশ্বক্রিকেটে ডমিনেট করতে না পারে, সেই দায় বিসিবির, লিটনের সামান্য। কেন বলছি এই কথা?

যে কোনো অর্গানাইজেশনের গ্রেটনেস আসে ট্যালেন্ট নারচারিং মোডিউলের মধ্য দিয়ে। বিসিবি একটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান; হয়তোবা ভোগ-দখলের বাইরে বিশেষ কোনো নীতিও নেই তাদের। কিন্তু বিজনেস গ্রোথ বা প্রফিট ম্যাক্সিমাইজ করার জন্যও বিশেষ কোনো স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং দেখি না তাদের। তারা গেম ডেভেলপমেন্ট নামে উইং খুলেছে, অথচ সেখানে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং নামে কোনো পোস্ট নেই। তারা আছে মনোবিদের ভূত নিয়ে। আরে ভাই, যে কোনো কিছুর গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই কান্ট্রি কালচারের উপর নির্ভর করে। এদেশের ৮৯% মানুষ মনোবিদ বলতে বোঝে পাগলের ডাক্তার; ক্রিকেটাররা তো সেই দলেরই প্রতিভু। তারাও মনোবিদ কনসেপ্টকে খুশিমনে গ্রহণ করতে পারবে না। তাছাড়া ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মনোবিদ তো বুঝতেই পারবে না ২০-২১ বয়সী একটা ছেলে রাতারাতি ৪৭ লাখ টাকা পেয়ে গেলে তার মনোজগতে কেমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে; সে তো বিচার করবে বুকিশ বিহেভিয়ার প্যাটার্নের আলোকে। বাংলাদেশের একজন মানুষ কিসে সবচাইতে প্রায়োরিটি দেয়, কিসে দেয় না- এইসব আর্থসামাজিক, মনোজাগতিক ইতিহাস-ভূগোল না জানলে তার পক্ষে ইফেক্টিভ সমাধান দেয়া ম্যারাডোনার এই বয়সে নতুন করে আর্জেন্টিনা টিমে খেলা শুরু করার মতো ব্যাপারে পরিণত হবে।

কিন্তু ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং অন্য জিনিস। নাজমুল আবেদিন ফাহিম স্যারের সাথে কথা বললে বোঝা যায় তার ক্রিকেট প্রজ্ঞা কত গভীর, কিংবা জালাল চৌধুরীর লেখা পড়লেও অনুমান করা যায়, ক্রিকেটটাকে তারা কেবল ফিজিকাল এক্টিভিটি হিসেবে দেখেন না; এটার একটা ফিলোসফিকাল এবং সাইকোলজিকাল এসেন্স আছে, সেটাই পার্থক্য গড়ে দেয়। বিরাট কোহলি এতোটা এগ্রেসিভ হয়েও কীভাবে পারফরম করে, এর ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই তাদের জানা আছে। কিন্তু আমাদের তথাকথিত ক্রিকেট এক্সপার্টরা বলবে ব্যাটিং টেকনিক, প্রচুর প্র্যাকটিস এসবের কথা; মনোজগতের মানচিত্র বুঝবার কোনো প্রসঙ্গই সেখানে থাকবে না। লিটনকে যদি বলা হয়, তোমার খেলা ১১ টা ম্যাচের ভিডিও দেখে বলবা, কোন্ কোন্ শট ঠিক খেলেছো, কোনটা খেলো নাই, এটা আমাকে বিস্তারিত বলবে, সে কিন্তু একটা প্রশিক্ষণের মধ্যে ঢুকে পড়লো। কিংবা বিরাট কোহলি আর জো রুটের ৫টা করে সেঞ্চুরির ভিডিও দেখে আমাকে বলবা, কীভাবে ইনিংস বড়ো করতে হয়, এবং তুমি কোন্ জায়গায় পিছিয়ে আছো- এইসব নিয়ে কাজ করতে করতেই ক্রিটিকাল এনালাইসিস এবিলিটি গড়ে উঠে মানুষের।

কিংবা বলা হলো, তামিমের সাথে ৫ ঘণ্টা সময় কাটাও ওর ব্যাটিং দর্শন বোঝার জন্য, এবং ওর সাথে তোমার মেন্টালিটি আর এপ্রোচের পার্থক্য বলবা আমারে; লিটন চিন্তা করে যাবে কোথায়! ফাহিম স্যার, জালাল স্যার, কিংবা আরো যারা ক্রিকেট প্রজ্ঞাসম্পন্ন প্রাক্তন ক্রিকেটার আছে বিসিবির উচিত তাদের চুক্তিভিত্তিক মেন্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়া, যারা কেবলমাত্র টেকনিকাল ইস্যু না, বরং ফিলোসফিকাল এবং মেন্টাল হেলথ বিষয়ে গাইড করবে ক্রিকেটারদের। মেন্টরশিপ কনসেপ্টটাই তো প্রচলিত না ক্রিকেট জগতে; এরা মেন্টরশিপ বলতে বোঝে ব্যাটিং-বোলিং স্কিল বিষয়ে গাইড করা। আরে ভাই ব্যাট-বলই যদি সব হতো, তাহলে মুশফিক ওইটুকু শরীরে এতো বড়ো ছক্কা হাঁকাতে পারতো কোনোদিন?

ক্রিকেটে ফিলোসফিকাল মেন্টরশিপ অন্তত বাংলাদেশের কালচারে খুবই জরুরী। ক্রিস গেইল, বেইন স্টোকসরা ম্যাচের্ আগের রাতেও নাইট ক্লাবে গিয়ে বিয়ার গিলে ম্যাচে ঠিকঠাক পারফরম করতে পারে, কিংবা সামাজিকভাবে বিয়ে না করেও অনেক প্লেয়ারই সন্তানের বাবা হতে পারে, কারণ তাদের সামাজিক কাঠামোতে এগুলোকে অনৈতিক হিসেবে দেখা হয় না, তারাও এটাকে লাইফস্টাইলের সাধারণ অংশ হিসেবে গণ্য করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের একজন প্লেয়ার ক্যাসিনোতে যাবে, এটাই সামাজিকভাবে গ্রহণীয় নয়। যে কোনো সামাজিক অনুশাসনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির ক্ষেত্রে নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস আছে। কাজেই ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াতে যা খুবই সাধারণ, আমাদের কালচারে সেটা ফিট নাও করতে পারে। বিপরীতক্রমে, আমরা যেমন যথেষ্ট অতিথিপরায়ণ, অপরিচিত মানুষকেও সহজে আপন করে নিতে পারি, তাদের কালচারে এগুলো উদ্ভট লাগতেই পারে। তাদের দেশে ৫৩ বছর বয়সেও মানুষ যথেষ্ট ফিট থাকে, আমরা খাদ্যাভ্যাস এবং অন্যান্য কারণে ৩১ পেরুলেই ফিটনেস হারাতে শুরু করি। কালচারাল, জিওগ্রাফিকাল ব্যারিয়ারকে জয় করা কি সম্ভব, কিংবা আদৌ দরকার?

বাংলাদেশে তাই মেন্টরশিপ বা গাইডেন্স অত্যাবশ্যকীয়। আমরা কারো না কারো উপর নির্ভর করতে চাই, তার কাছ থেকে পরামর্শ পেতে চাই, নিজের ভালো লাগা-মন্দ লাগা শেয়ার করতে চাই। মেন্টরশিপকে সিরিয়াসলি প্রমোট করা হলে তরুণ ক্রিকেটারদের যে উন্নতি হবে এটার জন্য মুশফিক, সাকিবদের ব্যাচটাকে স্যাম্পল হিসেবে রাখা যেতে পারে। তারা বিকেএসপির স্টুডেন্ট, ফাহিম স্যার তখন বিকেএসপি এর কোচ ছিলেন, রিচার্ড ম্যাকিন্স ছিলেন বয়সভিত্তিক দলের কোচ। আমি নিশ্চিত, তারা কেবল ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং নয়, তাদের মাথার ভেতরে একটা মাঠ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যেখানে সাহস, পেশাদারিত্ব, চ্যালেঞ্জ প্রভৃতি প্রবণতাগুলোও ছিলো ফিল্ডারের চেহারায়। একে বলে মেন্টাল টাফনেস; যতদিন তা নিশ্চিত করা যাবে, ফাইনালে উঠে শেষ ওভার পর্যন্ত ম্যাচ নিয়ে যাওয়ার খুশিতেই বাকবাকুম করতে হবে, চ্যাম্পিয়ন আর হওয়া হবে না।
আশরাফুলরা যা পারেনি, লিটন তা অবশ্যই পারবে, যদি মেন্টাল টাফনেস এবং মেন্টরশিপ এর গভীরতা-ব্যাপ্তি সম্বন্ধে সে নিজে বুঝে, কিংবা বিসিবি তার মতো সকল খেলোয়াড়কে বোঝানো জরুরী মনে করে। লিটন, নেট প্র্যাক্টিসের বাইরে সময় পেলে ফাহিম স্যার, জালাল স্যারদের সাথে সময় কাটিয়ো, তাহলে বুঝবে সীমানার দৈর্ঘ্য ৭০-৭৫মিটার নয়, ৭০০ হাজার মিটার। অত বড়ো সীমানার মাঠে খেলতে নামলে চার-ছক্কা কীভাবে মারতে হবে জানা আছে তো? তোমার মাঠের সীমানা যদি ৭০ থেকে বেড়ে ৯০ মিটার হয় তাহলে বড়োজোর ৩১ এভারেজ নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে পারবে, কিন্তু কোনোভাবে যদি ৭০০ হাজার মিটারের মাঠে খেলতে শিখে ফেলো, শত চেষ্টা করেও ব্যাটিং গড় ৫৯ এর নিচে নামাতে পারবে না। তুমি আশরাফুল হবে, নাকি লিটন নামের মহীরুহ হবে সেটা নির্ভর করছে কিন্তু সীমানার দৈর্ঘ্যের ওপরই।
সাহস আছে ৭০০ হাজার মিটার সীমানায় ব্যাট করার? না থাকলে বছরে ২-৩ টা ফ্লুক টাইপ ইনিংস খেলে অবসরে বাইক দাবড়াও, আর কোন্ মেয়ে তোমার দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই কল্পনায় সময় পার করে দিয়ো। ক্রিকেট অনেকেই খেলে, ক্রিকেটার হয় কেউ কেউ!