সম্প্রতি এক ভার্সিটি সিনিয়রের সঙ্গে তুমুল তর্কাতর্কি হয়েছে আমার, যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যেতে পারে তার রেশবশত। এ নিয়ে দুর্ভাবনা নেই, কিছু মানুষকে আমি অত্যন্ত ভ্যালুয়েবল গণ্য করি, তারাও জানে সে ব্যাপারে। এর বাইরে সকল মানুষই ফরমালিটি।

বিরোধের পয়েন্ট বাচ্চাদের মডেলিং, তার ৭ বয়সী কন্যাকে মডেল হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে একটি বিখ্যাত ব্রান্ড। ফেসবুকে ফ্যামিলি ছবি দেখে পছন্দ হওয়ায় কোনোভাবে নজরে পড়েছে হয়ত।

সে রাজি, ভাবী অরাজি, এ নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, এক পর্যায়ে আমার কাছে আসেন এনালিটিকাল আলোচনার উদ্দেশ্যে। কারণ বয়সের ব্যবধানকে এক পাশে রেখে আমরা আড্ডায় মাতি হুটহাট৷

তার বক্তব্য ছিল ভাবী যেহেতু হিজাব পরিধান করেন, মেয়েটাকেও সেই লাইনে নেয়ার পায়তারা চলতেছে। অথচ ভার্সিটি পড়াকালে সে কালচারাল প্রোগ্রাম এংকরিং করেছে, নাচ-গানেও পারফর্ম করেছে। মাঝবয়সে ধর্মের দিকে ঝুঁকে এখন নিজের আইডিওলজি বাচ্চাটার উপর চাপিয়ে দিয়ে ওর শৈশব আর সমগ্র জীবনটা নষ্ট করতে চাইছে।

বললাম ভাবীকে ফেসবুকে দেখি, নানারকম ছবি দেন, স্টার মেকার এপস এ এখনো গান করেন তো। হিজাব পরার কারণে পোশাকে পরিবর্তন এসেছে, ফিলোসফিকালি আগের অবস্থানেই আছেন মনে হলো। ভুলও হতে পারে আমার।

-‘মানুষ অডিশন দিয়ে চান্স পায় না, আমার মেয়েকে নিজেরা অফার দিয়েছে– এটা কেন করতে দেবে না? একটা বাচ্চার প্রতিভা হত্যা করার অধিকার কে দিয়েছে আমাদের; জাস্ট বিকজ আমরা ওর প্যারেন্ট’?

-‘ ভাবী কোন পয়েন্টে চাচ্ছে না কথা বলা ব্যতীত বুঝতে পারব না, তবে উনিশ-তেইশ তো আপনার মেয়ের সমবয়সী। ওদেরও এরকম মডেলিং অফার এলে কঠোরভাবে মানা করে দিতাম। তবে নাচ-গান-অভিনয় বা ছবি আঁকা সংক্রান্ত কোনো অফার এলে যদি ওদের ন্যাচারাল ট্যালেন্ট আছে বুঝতে পারি, অবশ্যই এপ্রিসিয়েট করতাম’!

-‘নাচে-গানে সমস্যা নেই, মডেলিংয়ে আপত্তি’—এই নীতির মানে কী? তুমিও দেখি পজেসিভ ফাদার, আমি তোমাকে আরো উদারমনা ভেবে এসেছি এতদিন’

– আমাকে কী ভেবেছেন, আপনার ভাবনার দায় আমার না৷ একটা সিম্পল থিসিস বলি। আপনি হয়ত খেয়াল করেছেন আমি চাইল্ড প্রডিজি একদমই আমলে নিই না, কিংবা বাচ্চারা যে বিভিন্ন রিয়েলিটি শো তে পারফর্ম করে– এটাও এপ্রিসিয়েট করি না। বাচ্চাদের সবার আগে ‘বাচ্চা’ থাকা নিশ্চিত করতে হবে। ৮ বছরের একটা বাচ্চা টিভিতে কিশোর কুমার বা লতা মুঙ্গেশকরের গান গাইলো, আমরা প্রশংসা করলাম, কারণ এত বিচারক-দর্শক আর ক্যামেরার সামনে পারফর্ম করছে– এটা ওর সাধ্যাতীত অর্জন। কিন্তু ১৮ বয়সের একটা ছেলে বা মেয়ে যদি গায় তখন কিন্তু সেই এপ্রিসিয়েশনটা পাবে না।বাচ্চারা এমনিতেই প্রচণ্ড এটেনশন সিকার, উৎসাহ আর প্রশংসার পার্থক্য বোঝার ম্যাচিউরিটি থাকে না। ফলে কিশোর কুমার বা লতা মঙ্গেশকর আইডেন্টিটির ব্যাপকতাই ধরতে পারবে না; নিজেকে আরো শাণিত করার প্রয়োজনীয়তাই ধরতে পারবে না। আপনি ১০ বছর আগে রিয়েলিটি শো করা বাচ্চাদের স্যাম্পল নিয়ে দেখেন, এতদিনে তারা বড় হয়ে গেছে। কয়জন লাইনে আছে? নেই কেন, কারণ সে হাঁটতে শিখেনি। প্রডিজিরা বেশিরভাগই পরিণত বয়সে ধাক্কা কেন খায়, কারণ তাদের স্কিল পরবর্তীতে বয়সের সাথে সাথে হালনাগাদ হয় না। খ্যাতি বা জনপ্রিয়তা অবশ্যই লটারির মতো ভাগ্যের খেলা, তবে সেই লটারি কেনার প্রধানতম শর্ত কোয়ালিটি থাকা৷ কোয়ালিটি নেই অথচ ২০-২৫ বছর পরেও খ্যাতিমান এমন মানুষ দেখান, সাময়িক হাইপ আর সাসটেইনেবল খ্যাতি এক নয়। এখন আবার কুতর্ক শুরু করিয়েন না, ‘কোয়ালিটি সাবজেক্টিভ ম্যাটার, তোমার কাছে যেটা কোয়ালিটি আমার কাছে তা নাও হতে পারে’৷ এরকম ফ্যালাসি দিলে অবশ্য কথা বলা নিরর্থক। আপনি আর ভাবী দিনভর ঝগড়া করে শেষ পর্যন্ত যে টিকে থাকে তার মত জয়ী করে নিয়েন’

– ‘তোমার এই এপ্রোচকে বলে ভিক্টোরিয়ান মোরালিটি। এখনকার পৃথিবীতে এই দৃষ্টিভঙ্গি অপ্রাসঙ্গিক এবং অপাঙক্তেয়। তুমি ইউটিউবে ঢুকলে অন্তত ৫০ জন ইউটিউবার পাবে বাইরের দেশের যাদের বয়স ১০ এর নিচে, কিন্তু ওদের চ্যানেলে হিউজ সাবস্ক্রাইবার, ভিউও অগণিত৷ এই জেনারেশন অনেক বেশি স্মার্ট। ২০ এ গিয়ে তো আর্ন করতেই হবে, সেটা ৮ এ শুরু হলে, বরং ১২ বছর এগিয়ে গেল! একবার ভাব আমার মেয়ে যদি এখন বাচ্চাদের প্রোডাক্টে মডেল হয়, ক্যামেরা ভীতি কেটে যাবে, ওর কনফিডেন্স লেভেলই তো তোমার-আমার চাইতে বহুগুণ বেশি। যুগের ডিমান্ড বুঝতে না পেরে নোকিয়ার মতো জায়ান্টও মার্কেট আউট হয়ে গেছে, মুহূর্তের মধ্যে। তুমি-আমি সেখানে জাস্ট নাথিং; আমি বলতে চাই ডিরেক্টরের চোখ অন্যদের চাইতে আলাদা, আমার মেয়ের মধ্যে সে এমন কিছু দেখেছে যা অন্যদের মধ্যে পায়নি, তার মানে ও কিছুটা হলেও স্পেশাল। হতেই পারে একবার মডেলিং করে ওর ভালো লাগলো না। এটাই জীবনের একমাত্র মডেলিং; এক্সপেরিয়েন্স নেয়ার সুযোগটা কেন দিব না? বড় হয়ে যদি বলে আমার সম্ভাবনা ছিল মডেল হওয়ার, মায়ের কারণে পারিনি; কী জবাব দেব তখন?’

– আপনার মেয়ে জন্মের পরে নিজে অন্তত ২০ টা কাজ করতে চেয়েছে বা আবদার করেছে যেটা আপনি/আপনারা নিষেধ করেছেন। সেই অথরিটি কোথায় পেলেন প্রশ্ন আসেনি, এক্ষেত্রে আসছে কারণ মডেলিংটা কন্যার চাইতে আপনার ব্যক্তিগত এনডোর্সমেন্টের জন্য জরুরী।।আপনি বলবেন আমার মেয়ে অত বড় ব্রান্ডের মডেল হয়েছে, সমবয়সী অন্য বাচ্চারা তো পারেনি। এটা আপনাকে কলিগ-বন্ধুদের চাইতে একটু বেশি এক্সপোজার দিচ্ছে ভেবে মানসিক প্রশান্তি পাবেন। ফেসবুকে সুবর্ন আইজ্যাক বারী নামের এক বাচ্চাকে নিয়ে তার সাইকোপ্যাথ বাবার এক্টিভিটির যে অবজেক্টিভ, আপনার মোটিভও কাছাকাছিই মনে হচ্ছে, সরি। আমাকে আগে বলুন আপনার মেয়ে কোনোরকম পারফর্মিং আর্টের সাথে যুক্ত? ওকে অভিনয় শেখান বা গানের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন, বেইসটা তৈরি হোক। সারা জীবনই তো পড়ে আছে মডেলিং করার জন্য, আসলেই প্রতিভা থাকলে বিকশিত হবেই। তবে আমার লিটমাস টেস্ট আলাদা। ২৯ এর পরেও কেউ পছন্দের কাজে যুক্ত থাকলে, একমাত্র তখনই সে আমার মধ্যে আগ্রহ সঞ্চারিত করে। ১০ এর আগে ১ লক্ষ ইউটিউবার থাকলেও আমি সেটাকে প্রবলেমেটিকই বলবো। জীবনে শৈশব মোস্ট ভ্যালুয়েবল, সেটা ভিউ আর ডলার কাউন্টিংয়ের কমপ্লেক্সে নষ্ট করাটা মোরাল ক্রাইম। যুগের চাহিদা একটা বোগাস ধারণা; গারবেজ প্রোডাকশনই যদি চাহিদা হয়ে থাকে আমি সেই যুগকে সজ্ঞানে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করলাম। তবে আমাকে ১৭ জন ওরকম শিশু ইউটিউবারের লিংক দিয়েন, আমি ১০ বছর পরে এদের লাইফস্টাইল দেখতে চাই। ৩০ বয়সে যারা সামাজিক মানদন্ডে অনেক বেশি সাফল্যবান হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, তাদের মধ্যে ওই ইউটিউবারদের কতজন থাকবে দেখার আগ্রহ রইলো। এরা কিছুটা প্রেজেন্টেশন স্কিল শিখবে। কিন্তু যারা চেঞ্জমেকার হবে তারা কিশোর-তরুণ বয়সে নিজেদের প্রস্তুত করছে, কোর-আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি করছে। আপনি পারসিভ করেন কম ডেলিভার করেন বেশি— এই সমীকরণ ব্যক্তি এবং সমাজ উভয় পয়েন্টেই অবক্ষয়ের সূচক’

-‘তোমার চিন্তা অনেক বেশি জাজমেন্টাল। প্রথমত চেঞ্জমেকার হয় অতি অল্পজনে, সেটা তুমি প্ল্যান করে হতে পারবে না। যত আগে বুঝতে পারবে তুমি এভারেজ, তোমার টিকে থাকার সম্ভাবনা এবং সমৃদ্ধি বাড়বে। আমি নিশ্চিত আমার মেয়ে এভারেজ। জীবন দিয়ে বুঝেছি এভারেজ মানুষদের অপরচুনিস্ট হতেই হবে যাতে সে এভারজদের মধ্যেও এলিট এভারেজ হয়। ধরা যাক আমি ওকে নাচের স্কুলে ভর্তি করে দিলাম, পরের বছর ওকে কেউ ডাকবে তার গ্যারান্টি কী। তার চাইতে শুটিং করুক, শেখার সুযোগ তো চলে যাচ্ছে না। একদিনেরই তো ব্যাপার। ফ্লেক্সিবল হতে হবে সব ক্ষেত্রেই৷

-‘আপনার এই চিন্তাকে বলে উপযোগবাদীতার ট্র‍্যাপ। আপনি ট্র‍্যাপগ্রস্ত। শুটিং কয়েক ঘন্টার ব্যাপার মাত্র, কিন্তু আপনি যে ফিলোসফি থেকে মডেলিংয়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলছেন আমি ক্রিটিক করছি সেই ফিলোসফিকে। ‘আমি নিজেকে গ্রো করতে অনুশীলন করে পারফর্ম করবো, নাকি আগে পারফর্ম করে আসি, ভালো লাগলে তখন গ্রোথের চিন্তা করা যাবে– এই ডিলেমায় বরাবরই ২য় অপশনটা নেয় উপযোগবাদী সমাজ, এবং এখান থেকেই অন্ত:সারশূন্যতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়, ব্যক্তি নিপতিত হয় অর্থহীনতার নিরেট ভ্যাকুয়ামে। এটা খুবই দু:খজনক যে, ক্রমশ আপনাদের মতো ভ্যাকুয়াম ফেরিওয়ালাদের সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

-‘তুমি ওভারথিংকিং কর। এজন্যই তোমার ভাই-বন্ধু-বউ কারো সাথে বনে না। সিম্পল জিনিসকে মহা জটিল বানাও। তোমার সাথে আলাপ কমিয়ে দিতে হবে।

-let it be, you are free to fly

এই দীর্ঘ বিতর্কে আমি কোনো স্টেকহোল্ডার ছিলাম না, দিনশেষে তারা স্বামী-স্ত্রী হয়ত কেউ একজন ছাড় দিবে বা করে নিবে সমঝোতা। আমি নিরীহ আউটসাইডার হয়েও পেলাম কালো তালিকাভুক্তির সংবাদ।

তবু বাচ্চাদের মডেলিং সংক্রান্ত আমার ফিলোসফি অপরিবর্তিতই থাকবে। তাতে যদি পৃথিবীর সর্বশেষ মানুষটিও আমার বিপক্ষে চলে যায়, যাবে!