অতনুর সঙ্গে ৭ মিনিট আলাপ হতে পারত ২১ বছর আগেই, নটরডেম কলেজের ৩১৭ নম্বর রুমে। ৫ বছর সময়ের ডালি নিয়ে তৈরি ছিল বুয়েট ক্যাম্পাসও।
হয়নি।
একটা গল্প যার ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে যাবে ৭ মিনিট, তা ঘটলো অবশেষে গত ডিসেম্বরে, বনানীর যাত্রাবিরতি রেস্টুরেন্টে।
অতনু জানতে চায় আমার অর্থ উৎপাদনের প্রক্রিয়া কী, যেহেতু এনার্জির ৯০ শতাংশ বই লেখায় ব্যয়িত হলেও বিক্রির অবস্থা নায়িকা মাহিয়া মাহির নির্বাচনে পাওয়া ভোটের চাইতে রুগ্ন।
বহুবছর পূর্বে অতনুর তোলা একটা ছবি খুব প্রেস্টিজিয়াস একটা পুরস্কার জিতেছিল। আর্টিস্ট, আর্কিটেক্ট, মিউজিশিয়ান, ফিল্ম মেকার, ফটোগ্রাফার প্রভৃতি ক্যাপাসিটির মানুষের অভ্যন্তরীণ লেন্স কীভাবে কাজ করে, পছন্দের কৌতূহল আমার। তাই অনেক বছর আগেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম, কথা বলতে চাই। আমাদের মাঝ দিয়ে প্রবহমান আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগর ভেদ করে বার্তা পৌঁছুতে কুয়াশা রোদ রূপ পেল মিঠাই রোদে।
অতনুর জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে জানালাম- ‘আমি লোকাল কিছু স্টার্ট আপ সিইওদের সঙ্গে গল্প করি। গল্প থেকে তারা হয়ত কোনো ভ্যালুয়েবল ইনসাইট পায়। গল্প শেষে আমাকে পে করে। কেউ কেউ ১২ মাসের জন্য বুকিং দিয়ে রাখে, প্রতি মাসে ১ বার গল্প হয়’
শোনার পরে তার মন্তব্য ছিল আমেরিকায় এটা খুবই জনপ্রিয় পেশা, এই সার্ভিসের নাম CEO Whispering
শব্দটা মনে দাগ কাটে। ইউনিক হওয়ার যন্ত্রণা বিস্তর। নিজের মতো কাউকে খুঁজে না পেলে অন্যদের বোঝানো দু:সাধ্য হয়ে পড়ে নিজের ঠিকুজি আর কুষ্টি। তখন অস্তিত্বই পড়ে গভীর সংকটে। বিলুপ্তিই অবধারিত নিয়তি। নীলগাই কিংবা বাঘডাস বিলুপ্তির বদলে আজও বিরাজ করত যদি তাদের প্রজাতির অন্যরা টিকে যেত। আমি পর্যাপ্ত কল পাই না, কারণ আমার কর্ম এবং পদ্ধতি স্কেলেবল নয়, তাই বলামাত্র বোঝাতেও পারি না।
বই লেখার ঘোরে বিস্মৃত হই অতনু এবং তার বলা কথা। তাদের ফিরিয়ে আনলো সেই বই ই। একটা নিবন্ধ লিখছিলাম যেখানে মূল বক্তব্য ছিল ভ্রমণে যেসব মানুষের সাথে দেখা বা কথা হয়, জানি এটাই একমাত্র আলাপের ঘটনা হয়ে থাকবে জীবনে, কিন্তু তাদের চোখেই চিনি তার শহর-সমাজ-লাইফস্টাইল, এই মানুষগুলোর সাথে সম্পর্কের নাম কী! নাম রাখি ‘কালচারাল হুইসপারার’
শব্দটা কোত্থেকে পেলাম চিন্তা করতে করতে ফিরে আসে অতনু। মেসেজ পাঠাই CEO Whisperer পেশাটা সম্বন্ধে জানার জন্য রিসোর্স পাব কোথায়। সহায়তা পাই।
গুগল থেকে জানলাম এটা আদতে CEO এবং এক্সিকিউটিভদের কোচিং করানো। পড়াশোনা শেষে নি:সঙ্গতা বোধ জাগ্রত হলো পুনরায়। ধর্মশালায় দেখা হওয়া আমেরিকান তরুণী লিলি এবং তার বাবাকে যখন বলেছিলাম কীভাবে আয় করি তাদের মন্তব্য ছিল তার মানে তুমি কাউন্সেলর বা সাইকো থেরাপিস্ট? অস্বীকার করি।
Whisperer এর প্রচলিত যে রীতি, যতটুকু বুঝলাম তার সঙ্গে ফিলোসফিকালি মিসএলাইনমেন্ট আমার।
প্রতিষ্ঠান চালায় মানুষ, তবে মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয় কালচার, ক্রাইসিস এবং মার্কেট দ্বারা। একটা আইটি কোম্পানির সাথে মিলবে না ম্যানুফ্যাকচারিং, কনস্ট্রাকশন বা গার্মেন্টস কোম্পানির ধরণ-ধারণা, প্রত্যেকে স্বতন্ত্র পৃথিবী। এমনকি দুটো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি যদিও তাদের মার্কেট এক কিন্তু ভিন্ন হতে পারে তাদের কালচার, অবজেক্টিভ বা ক্রাইসিস।
একজন মাত্র মানুষের পক্ষে সব ধরনের সিইও বা এক্সিকিউটিভদের কোচিং বা টিচিং দেয়া সম্ভব হতেও পারে, যেহেতু মানুষের সামর্থ্য এবং সীমাবদ্ধতা দুটোই অসীম, তবে ব্যক্তিগতভাবে এই আইডিয়াতে বিশ্বাস করি না।
সমাধান বাতলে দেয়া আমার কাছে সমস্যাজনক এপ্রোচ মনে হয়। কেউ যখন কোনো একটা কোম্পানির সিইও বা টপ লেভেল এ কাজ করে, তার মানে ওই সুনির্দিষ্ট বিজনেস এবং সেই গন্ডির মানুষ সম্বন্ধে তার বোঝাপড়া শার্প। কিন্তু কর্মীরা যেহেতু প্রজা মানসিকতার, তারা তাই বলে বা করে, যাতে রাজা খুশি হয়। এতে রাজার জীবন থেকে নির্মোহ আলাপের মানুষ হারাতে শুরু করে, যারা হতে পারত তার দর্পণ বা মিরর!
আমার গল্প মূলত ক্রিটিকাল এবং অজনপ্রিয় প্রশ্ন করে উত্তর শোনা। এতে যার সাথে গল্প হচ্ছে তার কনসেপ্ট সুদৃঢ় হয় অথবা বাতিল। গল্প করতে করতেই তাকে পৌঁছে দেই তার পেইন পয়েন্টে অথবা সমস্যার রুট কজ এ। এবং সম্ভাব্য সমাধানগুলোও তার থেকেই আসে। আমার একমাত্র চ্যালেঞ্জ গল্প চালিয়ে নিতে যথার্থ প্রশ্ন করা।
গত সপ্তাহে এক এক্সিকিউটিভের সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। গল্পের শেষ পরিণতি হলো, সে তার এমডির কাছ থেকে ১ ঘন্টা সময় চেয়ে নিবে। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির চিফ টেকনোলজিকাল অফিসার (CTO) হওয়ার জন্য তার মধ্যে কী কী রিসোর্স আছে, এবং ঘাটতিগুলো কোথায়, এখনকার স্টাইলে কাজ করলে লক্ষ্য পূরণে কতদিন লাগতে পারে, এবং কোম্পানি এখনো অব্দি তাকে কেন ধরে রেখেছে— সে বিষয়ে এমডির সঙ্গে খোলামেলা আলাপ।
অথচ গল্পের শুরুতে আমাদের কারোরই জানা ছিল না এই গল্পের শেষ কোথায়, কীভাবে!
আমার কোন ফরমুলা নেই, পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড বা অন্যকিছু। চিঠি লেখার কাগজ-কলমের বাইরে সবটাই আমি নি:সম্বল, কারণ আয়না হতে স্বচ্ছতাই একমাত্র ক্যাপিটাল।
আমার সার্ভিসটা হাই ডিমান্ডিং নয়, খুব গুরুতর কোনো সমস্যার সমাধানও আমার দ্বারা হচ্ছে না, সঙ্গত কারণেই সম্মানি তাই অনেক বেশি নয়। আমি হয়ত কমফোর্ট দিতে পারি।
তখনই বোধ করলাম CEO Whispering এর বদলে ‘CEO Mirroring’ শব্দটা আমার সাথে অধিক মানানসই!
আজ সকালে গায়ত্রি মিত্রকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি ২০২৪ এ ১৭ জন নতুন সিইও এর দর্পণ হিসেবে কাজ করব। লক্ষ্যের কতটা কাছাকাছি যাওয়া হলো, সুস্থ্যতা সাপেক্ষে মিলিয়ে দেখব বছর শেষে।
অতনুর সঙ্গের আলাপটা ওই একটা শব্দের গুণেই ভ্যালুয়েবল। নইলে আমার ১৪ বছর ধরে করা কাজটাকে দেয়া হত না উপযুক্ত শিরোনাম।
অতনুর ভাষ্যমতে আমার প্রতি সে আগ্রহী হয়েছিল একটামাত্র কারণে। আমাদের মধ্যে সুয়েজ খাল হয়েছিল বন্ধু Fahim Rahman ইমু। ২০১০ এ বুয়েটে আমাদের র্যাগ প্রোগ্রামে টেলিফিল্ম নির্মাণ করেছিলাম, বুয়েট অডিটরিয়ামে হয় প্রদর্শনী। ইমুর থেকেই সে জেনেছিল আমার ফিল্মে আগ্রহের ব্যাপারে। আমার বই, ফেসবুক লেখালিখি, বাবল রেশিও পডকাস্ট কোনোকিছুই তাকে ট্রিগার করেনি, তার ভাবনায় বেঁচেছিলাম ১৪ বছর আগেকার আমি, যে আর পরবর্তী জীবনে ফিল্মে গেলই না (যাবে যদিও)!
জীবন এজন্যই ফ্যাক্টের চাইতে ফিকশন বেশি, কখনোবা সবটাই ফিউশনাল!