যদি সুস্থভাবে বেঁচে থাকি, ২০২৯ এ বয়স হবে৪৩, যুবসীমা শেষ করে মধ্যবয়সে পদার্পণ করবো। আগামী ১০ বছর কোনোরকমে মাটি কামড়ে টিকে থাকাটাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত; যদি লক্ষ্য পূরণ হয়ে যায় ২০৩০ থেকে কাঙ্ক্ষিত এক জীবন উদযাপন করতে পারবো আশা রাখি।

এখন আমার মাস চলাই দুরূহ; কোনো মাসে হিউম্যান ল্যাব থেকে কাজ পাই, অনেক মাসেই পাই না। তবু এই আর্থিক সংগ্রামকে বৃহত্তর উদ্দেশ্যপূরণের পথে ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে দেখতে চাই।

কাঙ্ক্ষিত জীবনের স্বরূপ সম্বন্ধে ধারণা না থাকলে কীভাবে বুঝবো কেমন আছি।

আন-অর্থোডক্স চিন্তা এবং জীবনপ্রণালীর প্রতি আগ্রহী মানুষের সংখ্যা কত হতে পারে আনুমানিক? দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি হলে এর ৫% ধরলেও ৮৫ লাখ হয়; অন্যান্য যোজন-বিয়োজন করে ৫০ লাখে নামা যায়। ৫০ লাখের মধ্যে এলাকাভিত্তিক বিভাজন করলে ঢাকার ভাগে ১৫-২০% পড়বে (৭-১০ লাখ), বাকি ৮০% থাকবে দেশের বিভিন্ন জেলার অধীনে।

তো এই ৫০ লাখ মানুষের কত পারসেন্টের সাথে আমার যোগাযোগ আছে? প্রচলিত জীবনযাপনে আনফিট এবং কিছুক্ষেত্রে মিসফিট যে বিশাল কমিউনিটি তাদের মধ্যে কানেক্টিভিটি গড়ে তোলার উপায় কী? বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র একটি মাধ্যম হতে পারতো, কিন্তু পারেনি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্থবির হয়ে পড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কেইস স্টাডি হতে পারে। তো এই ৫০ লাখ মানুষের মধ্যে যদি একটি কানেক্টিভিটি প্লাটফরম তৈরির উদ্যোগ নিতে পারি সেটাকে কাঙ্ক্ষিত জীবন বলা যায়।

কানেক্টিভিটি প্লাটফরম কী; কোনো রাজনৈতিক সংগঠন, অথবা এনজিও?
ভারতীয় উপমহাদেশের কনটেক্সট এ রাজনৈতিক সংগঠন একটি আণবিক বোমার মতো উদ্যোগ; ক্ষমতালিপ্সা অথবা ক্ষমতার প্রতি ঔদাসীন্য, দুটোই এত বেশি একমুখী প্রবণতা যে, এটা উপমহাদেশের কালচারে ফিট করবে না। তাছাড়া রাজনীতির যে প্রশাসনীকরণ এবং পেশীকরণ তার মধ্যে দমবন্ধতা প্রকট। যারা আন-অর্থোডক্স চিন্তার বাবলে বসবাস করে তারা এর মধ্যে কানেক্টিভিটি বোধ করবে না।

এনজিও শব্দটার মধ্যেই চিন্তাজীবী গোষ্ঠী অস্বস্তি বোধ করে।

বাকি থাকলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।এটাও চলবে না।

বস্তুত সংগঠন (সেটা যেমনই হোক) আর বাঙালি একে অপরের সাপেক্ষে মিসম্যাচ।

তবু ব্যবসায়িক সংগঠন করলে তার ইমপ্যাক্ট তুলনামূলক বেটার হতে পারে।

২০২০ এর দশকে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে নতুন কিছু প্যারামিটার যুক্ত হবে অনুমান করে ২০২৯ সাল নাগাদ আমি একটি লেখক কোম্পানী খুলতে চাই, বলা যায় ওটা আমার একটা ড্রিম প্রজেক্ট।

লেখক কোম্পানী মানে যেখান থেকে লেখক তৈরি হবে, এবং গবেষণার মূল বিষয়বস্তু থাকবে লেখালিখি। যেমন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর হারম্যান হেস এর সাহিত্যে সেল্ফ এনলাইটেনমেন্ট কীভাবে এসেছে এ সংক্রান্ত গবেষণার মধ্য দিয়ে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের মধ্যে একটি তুলনামূলক গবেষণা করা হলো।

দার্শনিকতা আর চিন্তাবৃত্তিক ডেভেলপমেন্টের জন্য লেখক কোম্পানী প্রচলিত অন্যান্য মূলধারার কোম্পানীর আদলেই কাজ করবে। কোম্পানীর ত্রৈমাসিক এবং বাৎসরিক টার্গেট থাকবে, গ্রোথ প্যারামিটার থাকবে, এমনকি থাকবে সেলস টার্গেটও৷

লেখক কোম্পানীর আয়ের মূল উৎস হবে বিভিন্ন রিসার্চ পেপার, বই, স্ক্রিপ্ট প্রভৃতি থেকে বিক্রির অর্থ। এছাড়া লেখক হওয়া সংক্রান্ত দেড় বছরের ডিপ্লোমা কোর্স। লেখালিখিকে যদিও জন্মগত প্রতিভা বলা হয়ে থাকে, তবু লেখক তৈরির ইকোসিস্টেম গঠন করা সম্ভব।

যে কোনো কনটেন্ট প্রোভাইডিং কোম্পানীর সাথে লেখক কোম্পানীর পার্থক্যটা কোথায়, যে জন্য এটাকে ড্রিম প্রজেক্ট বলছি, বা এখনই শুরু করছি না কেন?

প্রথম পার্থক্য, আর্জেন্ট এবং ইমার্জেন্সি, বা বিজ্ঞাপন ধরনের কনটেন্ট লেখক কোম্পানী তৈরি করবে না। যেমন, অন্য কোম্পানীর প্রোডাক্ট বা সার্ভিস নিয়ে লেখালিখির কোনো পরিকল্পনাই নেই, মানে ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি হওয়ার ইচ্ছা শূন্য পারসেন্ট।

লেখক কোম্পানী থেকে প্রচুর পরিমাণে পডকাস্ট তৈরি করা হবে, মানুষের ক্যারেক্টারাইজেশন নিয়ে কাজ করবে, এবং ননফিকশন বিভিন্ন বই লিখবে, ভাষা হবে বাংলা এবং ইংরেজি উভয়ই।

বাংলাদেশ নিয়ে আমি কি আশাবাদী? দেশ অর্থনৈতিক মন্দা কবলিত হলে এসব চিন্তাকে এপ্রিসিয়েট করার মতো পরিস্থিতি কি থাকবে?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর, তেমন একটা আশাবাদী নই। তবে আমার হাতে বিকল্প কোনো অপশনও নেই। যদি ইন্টারের পরপরই বা গ্রাজুয়েশন শেষ করে কানাডায় বা অন্য কোনো দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য চেষ্টা করতাম, কোথাও না কোথাও একটা ব্যবস্থা হতো। কিংবা চাকরি নিয়ে যদি মাইগ্রেট করার চেষ্টা করতাম, লাইফস্টাইল অন্যরকম হতো৷ একাডেমিক পড়াশোনা এক ধরনের ফরমাল এস্টাব্লিশমেন্ট; এর প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করি না। চাকরি তো একাডেমিক পড়াশোনার চাইতেও জঘন্য লাগে।

ফলে বাইরের কোনো দেশে যাওয়ার সুযোগ এবং যোগ্যতা দুটোতেই ঘাটতি রয়েছে। ইংরেজি স্কিল আরেকটু ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করছি, নিকট ভবিষ্যতে ইংরেজিতে লেখালিখি করতে পারি গ্লোবাল পাঠকের সাথে কানেক্টেড হতে।

আগামী ১০ বছরে আমার টিকে থাকার শর্তটা সরল- দেড়লাখ মানুষের একটি এক্টিভ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, এবং সেই নেটওয়ার্কের মাত্র ২% মানুষের জন্য প্রোডাক্ট বা সার্ভিস ডিজাইন করা। এখনো পর্যন্ত ফেসবুক আর লিংকডইন মিলিয়ে আমার নেটওয়ার্কে প্রায় ১৭০০০ মানুষ যুক্ত থাকলেও ইফেক্টিভ নেটওয়ার্ক বড়োজোর ৪০০০, এর কমও হতে পারে, কারণ আমার কোনো বই অদ্যাবধি ৪০০ এর বেশি বিক্রি হয়নি ( বইয়ের ক্ষেত্রে ১% কে ১০% উঠানোর টার্গেট)

এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে ১.৫ লাখ ইফেক্টিভ নেটওয়ার্ক কতটা অসম্ভব এক মিশন। তবে যা সহজেই প্রশংসিত হয়, সহজেই অর্জন করা যায় এ ধরনের কাজে অনাগ্রহই বেশি কাজ করে। ১.৫ লাখ ইফেক্টিভ নেটওয়ার্ক আগামী ১০ বছরে হয়েও যেতে পারে যদি কাজের ক্ষেত্রে 7D ( desire, depth, determination, dedication, desperateness, direction, deliver) নীতিতে অটল থাকি, এবং আলস্য আর দীর্ঘসূত্রীতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারি। চ্যালেঞ্জটা মজাদার।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর, ক্রাইসিস মানুষকে বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করে, ১০০০ টাকার কাজ কীভাবে ১০০ টাকায় করা যাবে সেই বুদ্ধি খরচ করতে জোরাজুরি করে, সেখান থেকেই আসে ইনোভেশন। আমাদের দেশে ইনোভেশনহীনতার দুটো গুরুতর কারণ হতে পারে, কষ্টসহিষ্ণুতার অভাব আর অতিরিক্ত ঘুমকাতরতা।

লেখক কোম্পানীর দর্শন এবং কার্যপ্রকারণ ব্যাখ্যা করে এই নামে একটি বই লেখার ইচ্ছা রয়েছে আগামী বছরের কোন এক সময়ে।

লেখক কোম্পানী নিয়ে লিখছি মূলত ব্যক্তিগত কারণে যাতে জীবনের অন্যান্য প্রায়োরিটির চাপে এটি তালিকা থেকে হারিয়ে না যায়।