যে কোনো বই পড়ার পূর্বে আমি কিছু অনুমান করে রাখি। এটা নিজের ইনটিউশনকে আরো প্রখর করার এক পরীক্ষা বলা যায়। শিবলী ভাই যখন থেকে আসমান উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন এবং ফেসবুকে তার ওয়ালে বইয়ের নির্বাচিত লাইন কিংবা সারমর্ম পোস্ট করতে থাকেন, এবং সবশেষে বইয়ের প্রচ্ছদ দেখতে পাই, বইটি সম্পর্কে আমার দুটো ইমপ্রেসন তৈরি হয়- ‘মেলোড্রামাটিক’ অথবা ‘সিনেমাটিক’।

গত ২৪শে মার্চ বিকাল ৫:৩০ থেকে রাত ৯:৪৫ পর্যন্ত ৪ঘণ্টা ১৫ মিনিট ব্যয় করে বইটা সমাপ্ত করেছি, এবং তারপর থেকেই চিন্তা করছি অনুমান কি মিললো আদৌ?

বইয়ের পূর্বে ভালো, মন্দ, গতানুগতিক প্রভৃতি বিশেষণ বসানো বিশেষ পছন্দ করি না।একটা বই পড়বার সময় কতবার মনে হয়েছে এটা শেষ করি, অথবা পরে পড়বো, অথবা এটা শেষ না করলেও চলে- মোটামুটি এই তিনটি ট্যাগ দিয়েই আমার পাঠধারা চালিয়ে নিই। তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘শেষ না করলেও চলে’ ট্যাগটি ব্যবহৃত হয়।

তবে ‘আসমান’ এ সেই বোধ-বিবেচনার সুযোগ ছিলো না।
প্রথমত, এলআরবি এর ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’ গান দিয়েই ব্যান্ড শোনার শুরু আমার। জেমসকে প্রথম চিনি ‘জেল থেকে বলছি’ গানের মাধ্যমে। দুটো গানই শিবলী ভাইয়ের লেখা। যে কারণে তার প্রতি সম্মান কাজ করে।
দ্বিতীয়ত, আমার পরিচিত ৩ জন পড়ুয়া মানুষ বইটি পড়ে নিজেদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। মুগ্ধতা এবং বিরক্তি দুটোই কৌতূহল জাগায়, তার উৎস অনুসন্ধানের জন্য হলেও নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

***
আসমানকে আমি বলবো পলিটিক্যাল থ্রিলার।বাংলাদেশের উপন্যাসগুলো বড্ড স্থানিক, বৈশ্বিক ক্যানভাসে প্লট বাছাইয়ের নজির তেমন একটা চোখেই পড়ে না। আসমান আন্তর্জাতিক ক্যানভাসকে ধারণ করে স্ফীত হয়ে উঠেছে, এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়।

২০০১ এর ১১ই সেপ্টম্বরে টুইন-টাইওয়ার হামলা বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তনে অত্যন্ত শক্তিশালী এক উপকরণ। যদিও এর সাথে বাংলাদেশের কোনোরকম সংস্রব ছিলো না, কিন্তু ঘটনাক্রমে কোনো বাংলাদেশী এই রাজনীতির বেল্টে ঢুকে পড়তেই পারে। সেই পরিক্রমাটা সাজানোই লেখকের চিন্তার মুন্সিয়ানা।

এই মুন্সিয়ানা প্রদর্শনে মূখ্যচরিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন ওমার রিজওয়ান নামের একজনকে। তার প্রতিবেশ নির্মাণে চরিত্র হিসেবে এসেছে মসজিদের ইমাম, রকস্টার হওযার স্বপ্ন দেখা রুশো, তাবলিগী আনোয়ার, তালিবানী খালিদ, জাপানী শিমুজি। নারী চরিত্র হিসেবে পাই ওমারের মা, প্রথম প্রেমিকা লামিয়া, খালিদের দুই মা, এবং যার নাম থেকে আসমান রূপকের আবির্ভাব সেই আসমাকে। উপন্যাসের ব্যাপ্তিকাল ১৬ বছর, যার সূচনা১৯৯৬, আপাত সমাপ্তি২০১২।

আমরা যারা তামিল-তেলেগু সিনেমা দেখি তাদের এই ইন্ডাস্ট্রির প্রতি আগ্রহের অন্যতম নিয়ামক এর স্টোরিলাইন। চরিত্রগুলোকে যদি ভিজুয়ালাইজ করি এবং সেই অনুসারে পাত্র-পাত্রী বাছাই করি, আসমান খুব সহজেই কমার্শিয়ালি হিট এক তেলেগু সিনেমা হিসেবে আখ্যা পেতে পারে, যেখানে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নায়ক বেঁচে থাকে, এবং দুজন নায়িকার প্রথমজন চলে যায়, ২য় জন টিকে যায়। মাঝখানে কাহিনীতে ক্রমাগত টুইস্ট আসতেই থাকে।
টুইস্ট যদি বুদ্ধিবৃ্ত্তিক হয় সেটা মুগ্ধতা বাড়ায়, আরোপিত হলে একটা শব্দই ঘুরেফিরে আসে- ‘সিনেমাটিক’। আসমানের টু্ইস্টগুলোকে সিনেমাটিক বললে একটুও অত্যুক্ত হয় না বোধকরি। প্রথম টুইস্টের সাথে পরিচয় ঘটে যখন আমরা জানতে পারি ওমারের দীর্ঘদিনের প্রেমিকা লামিয়া ভার্সিটিতে ওঠার পর এক প্রভাবশালী নেতার সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। তার আগে লামিয়াকে যেভাবে দেখানো হচ্ছিলো তার এমন স্খলনের কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ড না পেলে আমরা ধরে নিতে বাধ্য হই লেখক চেয়েছেন তাই লামিয়া এনায়েতের সাথে তার ফ্ল্যাটে গিয়ে অন্তরঙ্গ সময় কাটাচ্ছে।

পরবর্তী টুইস্ট পাই জাপানী শিমুজি যিনি ওমারদের সাথে পাকিস্তানে তাবলীগে গিয়েছিলেন, খালিদের তেজোদ্দীপ্ত ভাষণে আফগানিস্তানে জিহাদে শরিক হন, তিনি আদতে আমেরিকান গোয়েন্দা। অত্যন্ত চমৎকার এক টুইস্ট, এবং এটা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ধারণা যে মুসলিম সংগঠনগুলোর মধ্যে ছদ্মেবেশে আমেরিকান এজেন্ট মজুদ থাকে। এই টুইস্টের তাই সুনির্দিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ড লাগে না এবং পড়ার উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়।

কিন্তু এই টুইস্টই মেলোড্রামাটিক হয়ে যায় যখন সেই শিমুজি মুসলিমদের সাথে মিশতে মিশতে তাদের দৃঢ়তা আর ঈমানদারিতে অভিভূত হয়ে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে এবং চাকরি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। হিংস্র প্রকৃতির জেলার এন্ড্রু যে ওমারকে নির্যাতনস্বরূপ শুকরের মাংস খেতে দিয়েছিলো সেও যাওয়ার আগে বলে যায় ‘যদি কখনো শোনো আমি মুসলমান হয়ে গেছি তার একমাত্র কারণ কয়েদি নম্বর ১১০’

এ ধরনের টুইস্ট লেখকের সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তাকেও একজন এজেন্ডাবাহী এজেন্ট হিসেবে উপস্থাপন করে। একজন সৎ লেখকের প্রধান যোগ্যতা হবে নির্মোহতা, সেটাই যখন হারিয়ে যায় লেখকের লেখা তখন কম্যুনিস্টদের লাল বই কিংবা জঙ্গীদের জিহাদী বইয়ের ইশতেহারের চাইতে আলাদা কিছু হয় না।

একজন খ্রিস্টান বা হিন্দু মুসলিম হয়ে গেলে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি; উল্টোভাবে দেখলে একজন মুসলিম যদি খ্রিস্টান বা হিন্দুতে পরিবর্তিত হয় তাকে আমরা বিনাবাক্যে কাফের বলে দিই। আমার ধর্মই সেরা, অন্যগুলো মিথ্যা, বাকিরা বিধর্মী- এরকম মনোভঙ্গিই তো যতো যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণ। শিমুজি যখন বলে ‘আমি মুসলিম হতে চাই’ তখন মনে হয় বইটা যদি ইংল্যান্ড বা আমেরিকান কোনো লেখক লিখতেন তিনি হয়তোবা ওমারের মুখ দিয়ে বলাতেন ‘আমি ক্যাথলিক খ্রিস্টান হতে চাই’, কারণ তার কৃতকর্মের কারণে নিজ দেশ তাকে নিবে না, তিনি একজন দেশহীন মানুষ, সেই অবস্থায় রেডক্রস তাকে আশ্রয় দিয়েছে, কৃতজ্ঞতাবশত তিনি একথা বললে আমরা সেটাকেও বাড়াবাড়ি বলতাম না নিশ্চয়ই।

গুগলসূত্রে আমরা জানি আফগানিস্তান যুদ্ধে যাওয়া আমেরিকান সৈন্যদের ক্ষুদ্র একটা অংশ বিবেকের দংশনে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছে, কিংবা আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু তারা আমেরিকান সৈন্যদের গড় মনস্তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে না, বিচ্ছিন্ন স্যাম্পলমাত্র। যেহেতু এদেশে প্যারাডক্সিকাল সাজিদ লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয় সেখানে একজন ভিন্ন ধর্মালম্বীর ‘আমি মুসলমান হতে চাই’ লাইনটা বইয়ের বিক্রিতে বৃহৎ এক সূচকে পরিণত হতে পারে এবং আবিষ্কার করি পাঠকের মুগ্ধতা তৈরির ক্ষেত্রেও এই লাইনের সুগভীর প্রভাব রয়েছে।

সর্বশেষ টুইস্ট পাই ১২ বছর পরে আসমার সাথে ওমারের দেখা হওয়ার মধ্য দিয়েছে। শিমুজি তাকে আফগানিস্তান থেকে নিয়ে এসেছে। এটা মোটেও টুইস্ট নয়, যখন আমরা দেখি আসমার সাথে ১২ বছরের এক বালক এবং ওমারের কাছে আসমা তাকে উপস্থাপন করছে ‘আপনার ছেলে’- তখন আবারো সিনেমাটিক আখ্যানের সাথে পরিচিত হই আমরা। আসমা আর ওমারের বিয়েটাকে প্রতিবেশীরা দেখেছে কারবালার কঠিন যুদ্ধকালে ইমাম হোসেনের মেয়ে সখিনার সাথে ইমাম হাসানপুত্র কাশেমের বিয়ের মতো ঘটনা হিসেবে।

প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু ঝুঁকি, পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া- এরকম এক দাম্পত্য জীবনে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায় কেবলমাত্র বাংলা সিনেমায়। এ প্রেক্ষিতে মনে পড়ে যায় রুবেল-সাবরিনা অভিনীত ‘বেয়াদব’ সিনেমার কথা। বিয়ের পরদিনই সংসার ভেঙ্গে যায় রুবেল-সাবরিনার, এবং পরিচালক কাহিনীতে টুইস্ট আনার জন্য দেখান রুবেল বাসরঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছে, তার আগ পর্যন্ত স্ত্রীর মুখ ঢাকা, যে কারণে অন্ধকারের মধ্যে তাদের মধ্যে শারীরিক সংসর্গ হয়েছে অথচ কেউ কাউকে দেখতে পায়নি। সিনেমার অন্তিম মুহূর্তে আবারো টুইস্ট হিসেবে দেখতে পাই, নায়িকা গর্ভবতী। আসমানে ১২ বছর বাদে ১২ বছর বয়সী পুত্রসন্তানকে নিয়ে আসাটা সেরকম ‘পিপলস চয়েজ ধরনের নাটকীয়তা’।

বরং এন্ডিংটা হতে পারতো এরকম- বিয়ের ১২ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর দেশহীন দুজন মানুষ পেছনের সমস্ত ঘটনাকে শিফট-ডিলিট চেপে মুছে ফেলে নতুন করে সংসার শুরু করেছে, তাদের দায়িত্ব নিয়েছে এক অনুতপ্ত জাপানী। বাংলাদেশী, আফগানিস্তানী,আর জাপানীর ঊর্ধ্বে তারা মানবিকতার বার্তা নিয়ে সমুদ্রতীরবর্তী দ্বীপে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছে।এর মধ্যে জাতীয়তাবাদের নোংরা বাষ্পকে উপেক্ষা করে বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণের প্রত্যয় লক্ষ্য করা যেতো। কিন্তু ১২ বছরের বালকপুত্রের আবির্ভাবে সমস্ত ব্যাপারটাই চিরাচরিত সিনেমার অন্তিম দৃশ্যের রূপায়ণ হয়ে উঠে।

শিবলী ভাই একজন কবি, জনপ্রিয় গীতিকার, তরুণ বয়সে তিনি নাটকও লিখেছেন। যে কারণে বইয়ের মধ্যেও নাটকীয়তাকে এড়াতে পারেননি। বইয়ের সাথে সিনেমার সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে এটা কারো অজানা নয়। যে কারণে বই থেকে সিনেমা নির্মাণ করলে দেখতে ভালো লাগে না, কিংবা সিনেমার অবলম্বনে বই লিখলে পড়তে ভালো লাগে না। সিনেমা আর বই এতোটাই স্বতন্ত্র দুটো মাধ্যম যে একটি দিয়ে অপরটিকে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা সিংহভাগ ক্ষেত্রেই অসফল হয়। আসমান যদি সিনেমা হয় কখনো, নিঃসন্দেহে দর্শক তার সাথে কানেক্টেড বোধ করবে, কিন্তু চিন্তাশীল পাঠকমাত্রই এটা পড়তে গিয়ে ওই সিনেমাটিক বৈশিষ্ট্যের কারণে অস্বস্তি বোধ করবে।

আবার আমরা যারা কাশেম বিন আবু বাকারের প্রেমের উপন্যাসগুলো পড়ি/পড়েছি, আসমানের প্রেমময় অংশগুলো যেন সেই অভিজ্ঞতা স্মরণ করিয়ে দেয়। যদি ভুল না জানি, বাংলাদেশের সর্বাধিক বিক্রিত বই কাশেম বিন আবুবাকারের ‘ফুটন্ত গোলাপ’, এখনো পর্যন্ত ৩০ বারের অধিক প্রিন্ট করা হয়েছে। এই পাঠকেরা কারা? আমি, আপনি, আমরাই।

ফুটন্ত গোলাপের প্রসঙ্গ টানার কারণ হিসেবে যুৎসই এক রেফারেন্স ব্যবহার করা উচিত। লামিয়া আমাদের সেই ঝামেলা থেকে মুক্তি দেয়। আমরা দেখতে পাই লামিয়ার আই লাভ ইউ য়ের প্রত্যুত্তরে ওসমান বলছে আই রেসপেক্ট ইউ। এই পর্যন্ত সহনীয়, কিন্তু আমরা দেখতে পাই সেই স্কুলজীবন থেকে সম্পর্ক গড়ে উঠে ভার্সিটি সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত যা চলমান ছিলো, এই সুদীর্ঘ সময়ে ওমার কখনো স্পর্শই করেনি লামিয়াকে। স্পর্শ করার ব্যাপারটাকে অগুরুত্বপূর্ণ ধরে বই পড়া চালিয়ে নেয়া যেতো, কিন্তু লেখক তা দিলেন কই! এনায়েতের সাথে সম্পর্কটা যখন ‘লিটনের ফ্ল্যাট’ পর্যায়ের তখন ওমারকে এনায়েত ধন্যবাদ জানায় লামিয়াকে কখনো স্পর্শ করেনি বলে! ফুটন্ত গোলাপ তখন যেন বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে আসমানকে কেন্দ্র করে।

তর্কটা হতে পারে বিবাহবহির্ভূত প্রেমকে সমর্থন করি নাকি করি না সেই সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে। কিন্তু প্রেম করছি অথচ প্রেয়সীকে স্পর্শ করছি কিনা এই শিশুতোষ পয়েন্টে আদৌ কি বিতর্ক হওয়ার মতো? তবে কি ব্যাপারটা এমন, বিয়ের আগে প্রেম করা যাবে, একসাথে ঘোরাঘুরি করা যাবে, কিন্তু স্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে হবে। যদি ভুল না করি ফুটন্ত গোলাপেও এরকম কোনো বক্তব্য আছে যেখানে বলা হচ্ছে পরপুরুষের সাথে বাইরে যাওয়া যাবে না, তবে বোরখা পরা থাকলে যাওয়া যাবে। কারো প্রতি মানসিকভাবে আকৃষ্ট হলেই সেটা আসক্তির পর্যায়ে পড়ে; নইলে পৃথিবীর যে কোন পুরুষ এবং যে কোনো নারীর মধ্যেই আকর্ষণ তৈরি হতো। তা তো হয় না। সুনির্দিষ্ট কারো প্রতিই তৈরি হয়, এবং তার থেকেই আসক্তি। আসক্তি যদি মানসিক হয়, সেটা শারীরিক পর্যায়ে গেছে নাকি যায়নি তা কি আদৌ ম্যাটার করে? মূল ব্যাপার তো ‘কলব’ পরিষ্কার রাখা।

‘কলব’ পরিচ্ছন্ন রাখার বৃহত্তম চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে স্পর্শ নিয়ে ট্যাবু দেখানোটা আবারো বাংলা সিনেমার কাহিনী মনে করিয়ে দেয়। ইলিয়াস কাঞ্চন, শাহনাজ, ওমর সানী অভিনীত ‘মহৎ’ সিনেমাটি টানতে পারি। শাহনাজের সাথে ওমর সানীর প্রেমের সম্পর্ক, কিন্তু বিয়ে হয় ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে। তারা সমাজের চোখে স্বামী-স্ত্রী, ধর্ম মোতাবেক বিয়ে হয়েছে, কিন্তু দুজনের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর একান্ত সম্পর্কটা স্থাপিত হয়নি কখনো। বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে এরকম অন্তত ১৯টা সিনেমার রেফারেন্স পাওয়া যাবে যেখানে এরকমটি ঘটেছে। কেউ যদি প্রশ্ন করে, এর মাধ্যমে আসলে কোন্ বক্তব্যটি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন তখনই বিপাকে পড়ে যাবেন পরিচালকরা।

তবে ফুটন্ত গোলাপের প্রেমময়তার সাথে আসমানের প্রেমের সাদৃশ্য টানাটা অবশ্যই আসমানকে অবমূল্যায়ন করা হয়, এবং বইয়ের দার্শনিকতাকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে ভুল বার্তা দিতে পারে।

সিনেমাটিকতার অংশগুলো বইয়ের কনটেন্ট মেরিটে কোনোই প্রভাব রাখেনি, এগুলো থাকায় বরং মেরিট কমে গেছে, কিন্তু সিনেমাটুকু যদি ফ্লুইড দিয়ে মুছে দিই তবে আসমান অসংখ্য চিন্তার খোরাক রেখেছে আপনার-আমার জন্য। মার্কেট ধরতে লেখক যতটুকু আপোষ করেছেন সেটুকু পাশ কাটালে বইয়ের প্লট এবং প্রেক্ষাপট আপনাকে ধাক্কা দিতে পারে।

আমরা তখন আবিষ্কার করবো এই বইটি স্টেরিওটাইপের বিরুদ্ধে এক শৈল্পিক জিহাদ।বইয়ের মূল চরিত্র ওমার এক লুথা এবং কনফিডেন্সশূন্য মানুষ যে পদে পদে ব্রেইনওয়াশড হয়। সেই ব্রেইনওয়াশের অংশ হিসেবে সে রুশোর সাথে নেশা ভাঙ করে, জিম মরিসনকে নিয়ে তর্ক করে, আবার ব্রেইনওয়াশ হয়ে পুরোপুরি ইসলামী জীবনধারায় চলে যায়, ব্রেইনওয়াশ হয়ে আফগানিস্তানে যায় তালিবানদের পক্ষে যুদ্ধ করতে। তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা বলতে কিছুই নেই, এমনকি লামিয়ার সাথে তার সম্পর্কটাকেও মোটাদাগে লামিয়ার দ্বারা তার ব্রেইনওয়াশ হওয়াই বলবো। সমাজের লক্ষ মানুষেরই প্রতিচ্ছবি এই ওমার,কারণ মানুষও কারণে-অকারণে ব্রেইনওয়াশ হয়। এরা কবে জন্ম নেয়, কবে মারা যায় পৃথিবী তার খবর রাখে না। এখানেই লেখকের কৃতিত্ব তিনি ব্রেইনওয়াশ কমিউনিটির এক প্রতিনিধিকে শেষ পর্যন্ত জিতিয়ে দিয়েছেন, যে মর্টার শেল বিস্ফোরণে মরে না, বাসের ভেতরে থাকা সহযোদ্ধাদের প্রায় সবাই যুদ্ধে নিহত হলেও আহত অবস্থায় বেঁচে থাকে, এবং ওসামা বিন লাদেনের সাথে কানেকশন আছে অনুমান করে তাকে দামী বন্দী গণ্য করে আমেরিকান সৈন্যরা। ব্রেইনওয়াশ কমিউনিটির ভাগ্যে এসব ট্রিটমেন্ট জুটে না, তারা ওই প্রথমবার মর্টার শেল বিস্ফোরণেই মারা যায়, এবং ইতিহাস থেকে চিরতরে বিদায় নেয়।

স্টেরিওটাইপ ভাঙ্গার আরেক দৃষ্টান্ত পাই বইয়ের সবচাইতে বলিষ্ঠ চরিত্র মসজিদের ইমাম আর রকস্টার রুশোর মধ্যে। সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে মসজিদের ইমাম মাত্রই ধরাবাঁধা কিছু বিশ্বাস ধারণ করে। কিন্তু এই বইয়ের ইমাম এমনই প্রগতিশীল যিনি ইসলামকে দর্শনের জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করেন, ডারউনের বিবর্তনবাদ নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন, ক্যাপিটালিজম-কম্যুনিজম নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিতে পারেন; এরকম ইমাম চরিত্র সৃষ্টি করাটা এক বড়ো সাহসিকতার নিদর্শন।

রুশো যতোই জিম মরিসনের অন্ধ অনুসরণ করে নেশায় চূড় হয়ে থাকুক, নিজেকে গুরু বানাতে মরিয়া থাকুক সে ধর্মপালনকারীদের প্রতি অত্যন্ত সমীহপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে। ওমারের চাইতেও তার চরিত্রে দার্শনিকতা আর বৈচিত্র্য অনেক বেশি, কিন্তু লেখক যেহেতু ওমারকেই বেছে নিয়েছেন প্রোটাগনিস্ট হিসেবে তাই তাকে স্পেস ছেড়ে দিতে হয়েছে ওমারের জন্য। রুশো আর মসজিদের ইমাম, পৃথিবীর দুই বিপরীত মেরুর চরিত্র তারা, অথচ চিন্তাশীল পাঠকমাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন আদতে তারা একই মানুষ, মুদ্রার উল্টোপিঠমাত্র।

জঙ্গীদের আমরা সেভাবেই চিনি-জানি যেভাবে মিডিয়া তাদের উপস্থাপন করে। জঙ্গীর পয়েন্ট অব ভিউ থেকে জগত দেখার-বোঝার জায়গাটা কেমন, এটা যে কোনো কৌতূহলী মানুষেরই আগ্রহ জাগাতে পারে। লেখক সেই কাজটিই করেছেন। তালিবানদের প্রতি পৃথিবীবাসীদের যে ধারণা তার কাউন্টারে একজন তালিবান কীভাবে দেখে সমগ্র ব্যাপারটাকে, কিংবা টেলিভিশনে আমরা যখন আমেরিকান আক্রমণে তালিবানদের অনবরত বিধ্বস্ত হওয়ার সংবাদ দেখছিলাম সেই সময়ে তালিবানদের মনোচিত্রটা কেমন, লেখক সেই জায়গা থেকে বিষয়টা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এটাকে অবশ্যই কাউন্টার ন্যারেটিভ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাতে কখনো মনে হতে পারে লেখক জঙ্গিবাদের পক্ষালম্বন করেছেন, কিন্তু কেউ যদি হিটলারের ডায়েরি নিয়ে কাজ করতে যায় সে সবকিছুকে হিটলারের পয়েন্ট অব ভিউ থেকেই দেখবে, এটাই নিয়ম। সুতরাং পয়েন্ট অব ভিউ বোঝার ম্যাচিউরিটি পাঠকের আছে ধরে নেয়া যেতে পারে।

তাবলীগ জামাআত সম্বন্ধে লেখক যে দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেছেন সেটা সাহসী এবং প্রশংসনীয়। কোনো সাহিত্যে তাবলীগ জামাআতের এমন চমৎকার ক্রিটিকাল এনালাইসিস পাইনি আমি। এটা নিঃসন্দেহে আলোড়িত হওয়ার মতো।

সিনেমাটিকতাটুকু বাদ দিয়ে পলিটিক্যাল ধারাপ্রবাহতে আরো বেশি ফোকাস করলে বইটা হয়তোবা আন্তর্জাতিক পাঠকমহলের জন্য অবশ্যপাঠ্য কিছু হতে পারতো, কিন্তু বিক্রির অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতা থাকায় আইটেম সং এর মতো কিছু উপকরণ ঢুকে পড়েছে, যা বইয়ের দার্শনিকতা খর্বিত করলেও সামগ্রীকভাবে মূল এসেন্সটা বোধগম্য রয়ে গেছে বলা যায়। শিল্প শেষ পর্যন্ত মার্কেটের চাহিদা পূরণ করে এটাই বারেবারে প্রমাণিত হয়। বইতেও রুশো তাই এবস্ট্রাক্ট লিরিক ছেড়ে সহজবোধ্য লিরিকের গান লিখে সাফল্য পায়। অথচ জীবনের প্রথম ফ্লপ কনসার্ট থেকে দর্শকের দুয়োধ্বনি শুনে তাকে নেমে আসতে হয়, সেই কনসার্টে দেশের প্রথমসারির ব্যান্ডগুলোও পারফরম করে। সেই কনসার্টের কয়েকটা গানের উল্লেখ পাই বইতে। ফিলিংস ‘মান্নান মিয়ার তিতাস মলম’, এলআরবি ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, মাইলস ‘হ্যালো ঢাকা’। প্রতিটি গানের গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী স্বয়ং; অবচেতনভাবে লেখক নিজেই এবস্ট্রাক্ট বনাম কংক্রিটের দ্বন্দ্বে ঢুকে পড়েছেন। জিম মরিসন, সাইক্যাডেলিক জনরার গানের মধ্যে রুশোকে তখন মনে হয় শিবলী ভাইয়ের তরুণবয়সের চরিত্র, যার কোনো সন্ধান আমরা আর পাই না, শুধু বইয়ের শেষের দিকে দেখি সে দেশের নামকরা রকস্টারে পরিণত হয়েছে, ওমারকে মনে রেখে এখনো মাঝেমধ্যে সেই ইমামের সাথে দেখা করতে যায়। কিন্তু কীভাবে সাইক্যাডেলিকের ভক্ত রুশো তারকাখ্যাতি পেলো সেই পরিক্রমাটা জানা হলো না, অবশ্য বইয়ের কনটেক্সট এ সেটা খুব তাৎপর্যবাহীও নয়।

শেষ পর্যন্ত আমরা সেই লাইনেই ফেরত যাবো- মানুষ জন্মগতভাবেই এক পলিটিক্যাল প্রাণী, সে যেখানেই বসবাস করুক বৈশ্বিক রাজনীতির সুবিশাল চেইনে তারও আছে সুনির্দিষ্ট অবস্থান, যে চেইনের কোথাও টান পড়লে তাকেও নড়েচড়ে উঠতে হবে। মানুষ যেন রেলের বগি, আসমান পড়তে গিয়ে সেই দার্শনিকতাই জ্বলে আর নিভে ট্রাফিক বাতির মতো করে…