আজ ঘুম ভেঙ্গেছে শব্দতাড়নায়; চোখ খোলামাত্র প্রথম যে শব্দটা মাথায় এসেছে তা হলো মীর জাফর। পুরোপুরি ঘুমমুক্ত হওয়ার পর অনুধাবন করি, মীর জাফর একজন ঐতিহাসিক চরিত্র, এটা শব্দ হয় কোন্ যুক্তিতে। পরক্ষণেই নিজের যুক্তি খণ্ডিত হয়, মীর জাফর কে ছিলেন এ নিয়ে অনেকের সংশয় থাকলেও প্রতারক/বিশ্বাসঘাতক বলতে গেলেই যে ‘মীর জাফর’ নামটা চলে আসে, তাতে তো এটা ব্যক্তির নাম থাকে না কেবল, নিন্দার্থক বিশেষণও হয়।

ব্রুটাস, জুডাস, বিভীষণ, শকুনি প্রমুখ ব্যক্তি বা চরিত্রের পাশাপাশি মীরজাফরও একটি অবস্থান অর্জন করে নিয়েছে। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে এই নামটাই প্রথমে মাথায় এলো কেন, এ নিয়েই ভেবে পার করে ফেলেছি কয়েক ঘণ্টা; অতঃপর সিদ্ধান্ত নিই তাকে শব্দায়িত করবো। সিরাজ উদ দৌলা, পলাশীর যুদ্ধ, লর্ড ক্লাইভ, বিশ্বাসঘাতকতা প্রভৃতি কী-ওয়ার্ডগুলো তাকে উপজীব্য করে লেখা যে কোনো নিবন্ধে আসবেই। আমিও যদি সেসব নিয়েই নাড়াচাড়া করতে চাই শব্দ আর সময়ের অপচয় বৈ অন্যথা হবে না।

এসব কী-ওয়ার্ড বাদ দিলে তাকে নিয়ে বাকিই বা থাকে কী যা তাকে নিয়ে লেখার জন্য উপযুক্ত হতে পারে। এ সংক্রান্ত দ্বিধা-দ্বৈরথে কিছুটা আনমনা ছিলাম যখন, তখন ব্যাক ক্যালকুলেশন করে সকালের পরিস্থিতিটার নেপথ্য পট আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু করি। প্রায় প্রতিরাতে ঘুমানোর সময়ই প্রস্তুতি নিয়ে রাখি এটাই শেষ ঘুম, যে কারণে প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গার মুহূর্তেই একদম আনকোড়া কোনো ভাবনা বা শব্দের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় হয় আমার। কিন্তু এতো বছরেও কখনো মীরজাফর শব্দটার অভিজ্ঞতায় ঘুম ভাঙ্গেনি।

মীরজাফরকে আমরা চিনি মূলত পলাশীর যুদ্ধে বেঈমানী করা, ক্লাইভের পুতুল নবাব হয়ে থাকা, জামাতা মীর কাশিমের কাছে ক্ষমতা হারানো, মীর কাশিম ক্লাইভের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করায় পুনরায় স্থলাভিষিক্ত হওয়া এবং সর্বশেষ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত করুণভাবে মৃত্যুবরণ করার কাহিনীগুলোসূত্রে। কিন্তু তার পূর্বের ইতিহাস সম্বন্ধে জানা ছিলো না কিছুই। সিনেমাতেও মীর জাফরকে যখন দেখি তখনও সে বয়োঃবৃদ্ধ মানুষ; তার কৈশোর-যৌবনের ঘটনাগুলো সম্বন্ধে কিছুই জানা ছিলো না, যার ভিত্তিতে তার বিশুদ্ধ বেঈমানীর ব্যাকরণ বোঝা যায়। আজ ঘুম ভাঙ্গার পর গুগলে মীর জাফরকে নিয়ে কিছু পড়াশোনার চেষ্টা করি, পেয়েও যাই অনেক কিছুই; তন্মধ্যে কয়েকটি তথ্য আলাদা করেছি যা এই লেখার বাকি অংশে সাপোর্টিভ ডাটা হিসেবে কাজ করতে পারে।

প্রথমত, বাংলার ইতিহাসে ঘৃণিত হলেও সে আদতে বাংলার কেউ ছিলো না। তার আদিনিবাস ইরানের পারস্যে; সেখানে ভাগ্যবিড়ম্বিত অবস্থায় বাংলায় আসে মূলত ভাগ্যাণ্বেষণে। তখন নায়েব আলিবর্দি খানের অধীনে ১০০ টাকা মাইনের চাকরি নেয়।

দ্বিতীয়ত, আলিবর্দি খানের নায়েব থেকে নবাব হওয়ার ক্ষেত্রে তার প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। নবাব সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার বীরত্ব প্রকাশ পায়, তার পদোন্নতি হয়, এবং আলিবর্দী খান নিজের বোনকে তার সাথে বিয়ে দেয়।

তৃতীয়ত, ১৭৪০-৪৮ এই সময়সীমায় মারাঠা বিদ্রোহীদের দমনে তার প্রবল বিক্রম দেখা যায়। কিন্তু এরপর থেকেই সে উচ্চভিলাষী ও ক্ষমতালোভী হয়ে উঠে। অন্য সেনাপতিদের সাহায্যে আলিবর্দী খানকে হত্যা করে ক্ষমতাদখলের চেষ্টা করে, যদিও অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়, এবং নবাব তাকে সাময়িক পদচ্যুত করে। কিছুদিন পর স্বপদে পুনর্ববহাল করা হয়।

৪র্থত, ২০ বা ২২ বছরের অর্বাচীন সিরাজকে নবাব হিসেবে সে প্রথম থেকেই মানতে পারেনি। সিরাজও সে ব্যাপারে অবগত ছিলো, এবং তাকে একবার পদচ্যুতও করেছিলো। কিন্তু কুরআনের কসম দিয়ে সে নবাবের বিশ্বাস অর্জনে সমর্থ হয়।

১৭৫৬ সালে মীরজাফরের বয়স ছিলো ৬৪ বছর; তার মানে কর্মজীবনের সেরা সময়গুলো ততদিনে বিগত হয়েছে। একজন কপর্দকহীন মানুষ হঠাৎ করে বিপুল ক্ষমতার অধিপতি হলে ক্ষমতালিপ্সা তার বাড়বেই; তাছাড়া প্রাসাদ ষড়যন্ত্র যে কোনো রাজা-সম্রাটের বেলায়ই সত্য। আওরঙ্গজেবকে অনেকেই উদার শাসক বলে প্রশংসা করে, তার প্রজ্ঞার বহু গল্প শোনা যায়। কিন্তু তার ক্ষমতা দখলের পেছনে যে বাপ-ভাইয়ের রক্ত ঝরানোর গল্প সেই নিষ্ঠুরতাও তো প্রাসাদ ষড়যন্ত্রেরই ফলাফল। মীরজাফর যেখানে স্বয়ং আলিবর্দী খানকেই হত্যার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিলো, সেতুলনায় সিরাজ উদদৌলার মতো বিলাসী প্রকৃতির এবং রাজনীতি অনভিজ্ঞ নবাবকে সে সরাবে এটাই খুবই সহজ অনুমান।

মীরজাফর যদি অযোধ্যার নবাবের সহায়তায় কিংবা অন্য কোনো উপায়ে সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করতো, সেও একজন গড়পড়তা নবাব বা শাসক হিসেবেই ইতিহাসে স্থান পেতো, কিন্তু সে সহায়তা নিয়েছে বহিঃস্থ মিত্র ক্লাইভের, মূলত এটাই তার নিকৃষ্টতার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা।

তবে শৈশবে বেঈমান বলতে আমি বুঝতাম মীর সাদিক নামের এক সেনাপতিকে। ৯০ দশকের শুরুতে বিটিভিতে ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’ নামে এক সিরিজ দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। তখন স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়েছে কি হয়নি, খুব বেশি মনে নেই, কিন্তু মীর সাদিক নামটা মনে রেখাপাত করেছিলো। তার কয়েক বছর পরে যখন সিরাজ উদ দৌলা সিনেমা দেখি এবং মীর জাফরের সাথে পরিচয় হয়, প্রথম প্রশ্নটাই মাথায় আসে- মীর জাফরের কথা বলে সবাই, মীর সাদিক কেন নয়? বড়ো হয়ে দুটো কারণ আবিষ্কার করি। মহীশূরের টিপু সুলতানকে নিয়ে বাংলাদেশে কারো আগ্রহই জন্ম নিতো না হয়তোবা যদি ডিডি বাংলার ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’ সিরিয়ালটি বিটিভিতে প্রচারিত না হতো। তাছাড়া, মীর সাদিক যুদ্ধকালেই নিহত হওয়ায় তার প্রতিপত্তি বা পরিণতি কোনোটাই দেখার সুযোগ পায়নি ইতিহাস।

কিন্তু মূল মিলটা ‘মীর’ এ; মীর জাফর- মীর সাদিক। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তখন যেভাবে অবিভক্ত ভারতের রাজ্যগুলো দখল করে নিচ্ছিলো তাতে মীর জাফর বেঈমানী না করলেও বাংলার স্বাধীনতা অক্ষূণ্ন থাকার সম্ভাবনা দেখি না। কী হলে কী হতো, এটা চিরকালই ফ্যান্টাসি, কী হয়েছে এটাই বাস্তবতা। এবং এই বাস্তবতার কারণেই মীর জাফর নামে কোনো বাঙালি পুরুষের নামকরণ হয় না, এবং মৃত্যুর এতো বছর পরও তার প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের সামনে লেখা- ‘নিমকহারামের দেউড়ি’!

মীরজাফরের নিমকহারামির কিংবা লোভের আরেকটা দৃষ্টান্ত আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়, যদিও সেটা খুব বেশি হাইলাইটেড হয় না। সিরাজকে হত্যার পর মীরজাফর নবাব হয়ে ক্লাইভকে বিপুল অংকের উপঢৌকন দেয় পূর্বপ্রতিশ্রুতি মোতাবেক, কিন্তু সিরাজের হেরেমের ভেতরে ৮ কোটি টাকা পাওয়া যার সন্ধান ক্লাইভ জানতো না; মীর জাফর সেই টাকা নিজের পুত্র মিরন আর কয়েক অনুচর মিলে লোপাট করে দেয়। বড়োলোকের বা ক্ষমতাবানদের বখে যাওয়া পুত্রদের যা আচরণ মিরন ছিলো তারই প্রতিচ্ছবি, এমনকি প্রভু ইংরেজদের সাথেও সে ঔদ্ধত্য দেখানো শুরু করে, যে কারণে ইংরেজরাই তাকে হত্যা করে, যদিও বহু বইতেই তার মৃত্যুকে বজ্রপাতজনিত দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।

মীরজাফরের ক্যারেক্টারে ঢুকতে হলে সিরাজের ঘাতক মোহাম্মদী বেগের সম্বন্ধেও ছোট্ট পাদটীকা দেয়া উচিত। সিরাজের মা আমেনা বেগম সিরাজের জন্মের পূর্বেই মোহাম্মদী বেগকে পুত্রস্নেহে প্রতিপালন করেছিলো, তার বিয়েতে প্রাসাদে ধুমধামও হয়েছিলো। সেই মোহাম্মদী বেগ মিরনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকার প্রস্তাবে সিরাজকে হত্যা করে। তখনকার সময়ে ১০ হাজার বিশাল অংকের টাকা অবশ্যই, কিন্তু সমগ্র জীবনের কৃতজ্ঞতার দাম কি ১০ হাজার টাকা মাত্র?

এবার একটা প্রশ্ন করতে চাই, শুধু প্রশ্নই করবো, এরপর অন্য কেইসে চলে যাবো। মীরজাফরের জীবনের যে পট-পরিক্রমা সেই স্থানে আপনি বা আমি হলে কী করতাম? মীর মদন, মোহনলাল এর বীরত্বের গল্প শোনা যায়, কিন্তু তাদের জীবনচিত্র খুব বিশদভাবে পাওয়া যায় না।। এখানে স্মর্তব্য, মীরজাফর বেঈমান হওয়ার আগে ৫৬ বছর বিশ্বস্ত এবং মূল্যবান মানুষ ছিলো রাজ্যের জন্য, এবং চূড়ান্ত বেঈমান হয়েছে ৬৪ বছর বয়সে। মোহনলাল বা মীর মদনের বয়স কতো ছিল যুদ্ধের সময়?

ক্ষমতা মানুষকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ক্ষমতার উত্তাপ একবার যে পেয়েছে সেখান থেকে তার মনোজগত কীভাবে কাজ করে, এটা বিচার করতে হলে নিজে অনুরূপ পরিস্থিতি পার করতে হয়। নইলে ‘সুযোগের অভাবে সৎ’ হয়েই জীবন পার করে দিতে হয়। নায়ক বা গায়কদের আমরা প্রায় সময়ই চরিত্রহীন ট্যাগ দিই, তাদের কৃতকর্মের কারণেই ট্যাগটা জোটে তাদের। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার, আপনি-আমি প্রতিনিয়ত শত-সহস্র নারী ভক্ত বা অনুরাগীর সান্নিধ্য পাওয়ার অপার সুযোগ পেলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতাম কিনা। সেলিব্রিটি বা এন্টারটেইনারদের রেসপনসিবিলিটি যেমন বেশি, তেমনি নিজেদের ১১ ইঞ্চি স্কেল দিয়ে ১১০০০০ ইঞ্চিকে মাপতে চাওয়ার ক্ষেত্রেও সংবেদনশীলতা জরুরী।

মীর জাফর বা মীর সাদিক, যা-ই বলি, তারা একটি রাজ্যের ক্ষমতা দখলের আশ্বাসে পেছন থেকে ছুরি মেরেছিলো; আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাই সেখানে একমাত্র প্রধান বিচার্য ছিলো। রাজ্য বা রাষ্ট্রকে আমরা যদি একটি কোম্পানী কিংবা সংগঠন হিসেবে চিন্তা করে সেই আলোকে বিশ্লেষণ করতে যাই, অবাক হয়ে দেখবো মীর জাফরেরা কেমন কিলবিল করছে কৃমির মতো। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন- যেটাই হোক- সেখানে আপনি একটা বিশেষ গোষ্ঠীকে আবিষ্কার করবেনই যারা নিজেরা একটা দুর্ভেদ্য সিন্ডিকেট গঠন করে রেখেছে, তারা টপ ম্যানেজমেন্টের নৈকট্য বা আনুকূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতে দেবে না, সময়ে-অসময়ে বস বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করবে, প্রয়োজনে তার/তাদের বাসার বাজার করে দেবে, বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। সিন্ডিকেটের এই সদস্যরা অচিরেই মালিকপক্ষের আনুকূল্য বা কৃপা লাভ করে, তারা স্বীকৃতি পায় ডান হাত- বাম হাত হিসেবে। কারণ, প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের মধ্যেও এক ধরনের সামন্তপ্রভু সত্তা বিকশিত হতে হতে স্থায়ী রূপ লাভ করে। এক্ষেত্রে কর্ণধারদেরও দোষ দেয়া যায় কিনা সেটাও তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার।

২০১৭ এর শুরুর দিকে ২ মাসব্যাপী একটা এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিলাম নিজের উপর। ১৩ জনের একটা স্যাম্পল গ্রুপ বাছাই করি মনে মনে, যাদের ১১জন কারণে-অকারণে আমার প্রশংসা করে, ২ জন আমার কাজ-কর্মের বিরোধীতা করে। যে ২জন বিরোধীতা করে তারাও ঘনিষ্ঠ, যে ১১ জন প্রশংসা করে তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা তুলনামূলক কম, এবং আমি বুঝতে পারছিলাম তাদের প্রশংসাগুলো উদ্দেশ্যমূলক। আমি ২ মাস ধরে নিজের আচরণ এবং মনোভাব পর্যবেক্ষণ করতে থাকি, এবং এক্সপেরিমেন্ট শেষে শতভাগ নিশ্চিত হই, বিরোধীতাকারী ২জন আমার ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও যে ১১জন উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশংসা করছে তাদের কথা শুনতে ইচ্ছা করছে বেশি, বিরোধীতাগুলো বরং ডিফেন্ড করতে ইচ্ছা করছে।

মাত্র ১৩ জন মানুষের মনোভাবকে ফিল্টার করার যোগ্যতাই যদি না থাকে মানুষের, সংখ্যাটা ১০৭ পেরিয়ে গেলে সেই মানুষের অবস্থা কী হতে পারে এটা বোঝার জন্য আমি স্যাম্পল হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম সোহাগ ভাইকে, যার সাথে কাজ করে ১০০০+ মানুষ। এবং সোহাগ ভাই পেরিয়ে আমি বড়ো নেতা, গ্রুপ অব কোম্পানীর এমডি, রাষ্ট্রনায়কদের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করি, এবং নিশ্চিত হই মানুষ প্রত্যুত্তর চায় না, প্রতিধ্বনি শুনতে চায়, প্রতিচ্ছবি দেখবার প্রত্যাশা করে। এটা মানুষের প্রোডাক্ট ডিজাইনজনিত ত্রুটি!

বুয়েটে পড়াকালে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো আরিফুল হোসেন তুহিনের সাথে। নিজে পড়ুয়া মানুষ না হওয়ায় আমি বরাবরই পড়ুয়া মানুষদের সাথে মেলামেশা করি, তাদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের মনোযোগী ছাত্র হই। জ্ঞান বিতরণ করা যায়, প্রজ্ঞা নিজের চেষ্টায় রপ্ত করতে হয়। কয়েক মাস আগে তুহিন এলো আমার বাসায় নামহীন বইটি সংগ্রহের উদ্দেশে। ওকে পেলেই নানা বিষয়ে ওর বিদগ্ধ মতামত শুনি। হিউম্যানল্যাব৭৭৭ নামে নিজে কোম্পানী খুলছি যেখানে বিজনেস ফিলোসফি এবং হিউম্যান পটেনশিয়ালিটি ম্যাক্সিমাইজ সংক্রান্ত সার্ভিস নিয়ে কাজ করবো জানাই। ও তখন একটা বইয়ের নাম বলে ‘Bullshit Jobs’, যেটা লিখেছে David Graeber নামের জনৈক নৃতাত্ত্বিক। গুগল থেকে বইয়ের সামারি পড়ে লেখকের বক্তব্য পাই এরকম- একটা প্রতিষ্ঠানে যেসব পদে লোকজন কাজ করে অধিকাংশ কাজেরই আসলে কোনো ইমপ্যাক্ট নেই, তবু এই শ্রেণীটি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কাজগুলোকে অতিগুরুত্বপূর্ণ ভাবার ভান করে এবং বস তোষণ নীতি অনুসরণ করে। অফিসের বসও এই শ্রেণিটিকে টিকিয়ে রাখে মূলত নিজেকে অবিসংবাদী বানানোর অভিপ্রায়ে; মোসাহেব পোষা তাদের একটি স্বভাব বা অভ্যাসে পরিণত হয়।

বইটা না পড়েও এই হাইপোথিসিস বহুদিন আগে থেকেই নিজের মধ্যে ধারণ করতাম; ১৩২৭ জন আলাদা মানুষের চাকরির ইন্টারভিউ নেয়াসূত্রে পর্যাপ্ত ডাটা তো আগে থেকেই ছিলো মাথায়। বইটা পড়ে, এর ক্যানভাসটা বৃহত্তর হয়েছে বলা যায়। আগে ধারণা ছিলো, প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়তবো বাংলাদেশের কোম্পানীগুলোর জন্য সত্য, কিন্তু বইয়ের সারমর্ম পড়ে বুঝলাম এটা গ্লোবাল ইস্যু। তবে পার্থক্য হলো, তাদের সিন্ডিকেটে চাটুকারিতার বাইরে মেধা-মনন থাকে, বাংলাদেশে পুরোটাই চাটুকারিতার উপরে চলে।

বাংলাদেশে যারা কোম্পানী চালায় এবং কোম্পানীতে চাকরি করে দুইয়ের মধ্যেই দূরদর্শীতার অভাব সাংঘাতিক পর্যায়ের। চাকরিদাতা জানে না চাকরিপ্রার্থীর মনোজগত কীভাবে কাজ করে, ট্যালেন্ট কীভাবে নারচার করা যায়; সে মনে করে বেতন দিচ্ছি, ইনক্রিমেন্ট হচ্ছে- এটাই তো যথেষ্ট; আর কী চাই? চাকরিজীবী মনে করে, এখানে টাইম-স্কিল বিক্রি করছি, যে বেশি দাম দিবে তার কাছেই বিকিয়ে দেবো, এই কোম্পানী অন্য যে কোনো কোম্পানীর চাইতে আলাদা কিসে, সেই প্রশ্নেরই উত্তর জানা নেই দুই পক্ষের কারোরই। যে কারণে ৫০০-১০০০ টাকা বেশি বেতনের অফার এলেই পাততাড়ি গুটিয়ে নেয়। চাকরিদাতা-চাকরিজীবী উভয়গোষ্ঠীই প্রফেশনালিজম বলতে কোনোকিছুর সাথে ন্যূনতম যোগাযোগ রাখে না।

একসময় পেপার-পত্রিকায় শিরোনাম দেখতাম ‘ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি’; সেই ‘ব্যাঙের ছাতা’ এখনো আছে, কেবল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পরিবর্তে সেস্থলে বসবে ‘স্টার্ট আপ কিংবা কোম্পানী’। হিউম্যানল্যাব৭৭৭ সূত্রে স্মল, মিডিয়াম বহু কোম্পানীর মালিক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথেই যোগাযোগ হয় টুকটাক। তারা যখন ট্যালেন্ট নারচারিং, পটেনশিয়ালিটি ম্যাক্সিমাইজিং বা বিজনেস ফিলোসফি সংক্রান্ত কনসেপ্টগুলো শোনে, প্রথম কথাই হলো- এইসব কাজে নষ্ট করার মতো টাকা আমাদের নেই; আপনার কোম্পানীর কোনো ওয়েবসাইট নাই, অফিস নাই, ব্রোশিউর নাই, এমনকি ভিজিটিং কার্ডও নাই, আপনি কীভাবে বুঝবেন বিজনেস চালানোর যন্ত্রণা কেমন! এই মাসে ব্যস্ত আছি, পরে আসেন। কিংবা এইসব সার্ভিস নিয়ে আমার লাভ কী?

এই কারণেই বাংলাদেশের কোম্পানীগুলো কখনোই খুব ব্যতিক্রমী হতে পারে না, এবং হুট করে কলাপস করে। সাসটেইনেবিলিটি বলতে কিছু নাই। বরং ক্যারিয়ার সেমিনার, ইয়ুথ প্রোগ্রাম প্রভৃতিতে বক্তব্য দেয়া, পত্রিকায় নিজেদের ছবি দেখানো এগুলোতেই বড়ো তৃপ্তির জায়গা খুঁজে নেয়। বহু তরুণ এসবে অংশও নেয় নেটওয়ার্কিংয়ের উদ্দেশ্যে। আপনি যে কোনো প্রোগ্রামেই যান ঘুরেফিরে কিছু তরুণ-তরুণীর চেহারা কমন পাবেনই; ‘নেটওয়ার্কিং’ নামের ম্যাজিকাল ওয়ার্ডের খপ্পরে পড়ে না হয় চিন্তাশক্তির বিকাশ, না হয় ডিসিসন মেকিং ম্যাচিউরিটি। নেটওয়ার্কিং আর কানেক্টিভিটি যে এক না, এই মৌলিক পার্থক্যই তো অজানা। নেটওয়ার্কিং হলো কোনো স্বার্থ বা উদ্দেশ্য পূরণের উদ্দেশ্যে কারো সাথে পরিচিত হওয়া এবং সেই পরিচিতিকে কাজে লাগানোর কৌশল খোঁজা; সমগ্র ধারণাটাই ‘প্রয়োজন’ ফ্যাক্টরকে মাথায় রেখে ইমিডিয়েট বা শর্ট টার্ম সাকসেস এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে, কানেক্টিভিটি হলো কারো প্রতি সুনির্দিষ্ট কারণে আগ্রহ বা কৌতূহল বোধ করা এবং সেই আগ্রহের কারণে তার সাথে সহজ-সতেজ এক যোগাযোগের ধারা জারি রাখা। এটা কোনো কাজে লাগতেও পারে, নাও পারে।

কিন্তু কানেক্টিভিটির উদ্দেশ্যে কারো সাথে মিশতে থাকলে কোনো একদিন তার ফলাফল মিলবেই। কিন্তু ‘কোনো একদিন’ শব্দবন্ধটাই যত অনিষ্টের মূল। সেই ‘কোনো একদিন’ এর অপেক্ষায় থাকার অভিরুচি আছে কম মানুষেরই। একারণে নেটওয়ার্কিংয়ের জয়জয়কার, অথচ মিনিংফুল পরিবর্তন সে তুলনায় কত নগণ্য। রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (ROI) যদি সিরিয়াসলি কেউ হিসাব করতো, নেটওয়ার্কিংয়ে হুজুগ-হাইপ কবেই ছুটে যেতো!

প্রশ্ন হলো, মীর জাফর সংক্রান্ত কথা-বার্তায় এসব আলোচনা তো ধান ভানতে শিবের গীত লাগার কথা। আদতে আমি এই প্রবাদটিরই সমর্থক না; ধান ভানা একটি ক্লান্তিকর একঘেয়ে কাজ; শিবের গীত গাইতে থাকলে ধান ভানার ক্লান্তিটা টের কম পাওয়া যাবে। তবে রসিকতা বাদ দিলেও মীর জাফর প্রশ্নে এইসকল প্রসঙ্গ মাকড়সার জালের মতো জড়িত।

মীর জাফর কোনো ব্যক্তি নয়, এটি একটি প্রবণতা-প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। কথার সাথে কাজের মিল সামান্য, কমিটমেন্ট করাই হয় ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে, মিছরির ছুরি দিয়ে প্রতিনিয়ত হত্যা করা হয় বিশ্বাসকে। নিজে যখন আয়নার সামনে দাঁড়াই বা কন্যা তেইশ মাহফুজের সাথে গল্প করি, প্রতিবার আবিষ্কার করি কতখানি প্রতারণা আর কতখানি অরিজিনালিটি ধারণ করি; অনুপাত করতে গেলে তেইশের সামনে লজ্জায় পড়ে যাই। আশপাশের মানুষও তো আমারই মতো; কিছুটা কম বা বেশি। মীরজাফরের প্রভাবকে তাহলে এড়াতে পারলাম কই!

যে কোনো অফিসের সিনিয়র গ্রুপ তরুণ গ্রুপকে নিয়ে অজানা আতঙ্কে ভোগে, এই বুঝি তরুণটি তার পজিশন দখল করে তার ক্ষমতা খর্ব করে। আমার চাইতে ১১ বছরের ছোট কেউ যদি এখন আমার রিপোর্টিং বস হয়ে পড়ে সেটা কি মানতে পারবো মন থেকে? যতোই স্পোর্টিং মানসিকতার হই। ২১ বছরের গ্রায়েম স্মিথকে সাউথ আফ্রিকা যখন অধিনায়ক নির্বাচিত করলো, এ নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কিংবা ১৩ বছরের নাবালক আকবর যখন সম্রাট নিযুক্ত হয়, বৈরাম খান তাকে অভিভাবকত্ব দিচ্ছিলো; গোলযোগটা তখনই বাঁধে যখন ১৭তে পৌঁছে আকবর নামমাত্র সম্রাট থাকতে না চেয়ে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চাইলো এবং বৈরাম খাঁ কে অবসরে পাঠালো। বৈরাম খান আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত করে, যদিও পরাজিত হয়, এবং আকবর তাকে হজ্জ করতে পাঠায়। পথিমধ্যে আততায়ী কর্তুক নিহত হয় বৈরাম (অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ড আকবরের ইন্ধনেই হয়েছে)। মীর জাফরের ক্ষেত্রেও একই মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে। তাতে জাতি স্বাধীনতা হারাবে, ব্রিটিশরা স্থায়ীভাবে জেঁকে বসবে- এই সমস্ত হিসাব-নিকাশের প্রজ্ঞা তার ছিলো, কোনোভাবেই তা বলার সুযোগ দেখি না।

মীরজাফরই কি তবে জাতিগতভাবে পূর্বপুরুষ আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের? এ প্রসঙ্গে একটা কেইস মনে পড়লো। বিবিসি যখন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপ চালাচ্ছিলো, আমরা তখন স্কুল বা কলেজে পড়ি। ঢাকা ভার্সিটির এক ভাইয়ার সাথে আলাপ হয়েছিলো। তিনি বলেছিলেন, তাদের হলের অনেক ছেলেই নাকি ফান করে মীর জাফরকে ভোট দিয়েছিলো। তাদের যুক্তি ছিলো, যেহেতু যুগে যুগে বাঙালি বেঈমান/বিশ্বাসঘাতক, এবং এটা ঐতিহ্যেই পরিণত হয়েছে, এর প্রবাদপুরুষ হিসেবে সমস্ত কৃতিত্ব মীরজাফরের প্রাপ্য। বাঙালির প্রকৃত চরিত্র তার চাইতে সুনিপুণভাবে কেউ বুঝতে বা ধারণ করতে পারেনি। সুতরাং মীরজাফরই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে বাঙালি জাতীয়তার প্রতীক হওয়া উচিত! রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিত বা বঙ্গবন্ধু আসলে বাঙালিত্বের আশ্চর্য ব্যতিক্রম এবং বেমানান।

সেসময় ভাইয়ের কথায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম; ভার্সিটিতে পড়া তরুণরা যদি এভাবে চিন্তা করে, চিন্তাধারার অবক্ষয়ের জন্য আর কী লাগে! কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে উপলব্ধি করেছি, দুষ্টুমি করে বললেও এই স্টেটমেন্টের মেরিট ফেলনা নয়। তাই বলে মীর জাফরকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে মেনে নেয়াও চরম লজ্জাজনক দৃষ্টান্তই হতো। ভাগ্যিস জরিপটা, ফেসবুক জমানার আগে হয়েছিলো, নইলে ট্রলপ্রিয় প্রজন্ম যেভাবে মাহফুজুর রহমানকে গায়ক বানিয়েছে, হিরো আলমকে পাবলিক ফিগারে পরিণত করেছে, তারা ট্রল করতে করতে ২০ জনের সংক্ষিপ্ত লিস্টে মীর জাফরকে ঢুকিয়ে ফেললে বিস্ময়কর লাগতো না একদমই।

পরশ্রীকাতরতা শব্দটার উপযুক্ত ইংরেজি নেই সম্ভবত। হিংসা বা ঈর্ষার সাথে পরশ্রীকাতরতার প্রভেদ আছে বেশ খানিকটা। পরশ্রীকাতর, অভিমান, পরচর্চা প্রভৃতি শব্দ বিশ্লেষণ করলেই আমাদের গড় চরিত্র সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। মেঘনাদবধ কাব্যে বিভীষণকে ভীরু এবং বেঈমান হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন মাইকেল মধুসূদন; ‘ধর্মযুদ্ধ’ শর্তটা উহ্য রেখে দিলে বিভীষণ আর মীরজাফরের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য পাওয়া যাবে না। প্যারিসের লালসার বলি হলো ট্রয় নগরী, রাবণের জন্য লংকাবাসী। বেসামরিক মানুষের কাছে ধর্মযুদ্ধ শর্তটা আদৌ কি কোনো অর্থ বহন করেছিলো? গ্রীক-ট্রয় যুদ্ধে অবশ্য ধর্মযুদ্ধ শর্তটাই ছিলো না; এটা পুরোটাই ব্যক্তিগত ক্রোধ (ক্রোধটা দেবীর, নাকি আগামেননের তা নিশ্চিত নই), তবু যদি থাকতোই সাধারণ মানুষ কিন্তু তার অ,আ,বিসর্গ কিছুই জানতো না, অথচ ভয়াল পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে তাদেরই সবচাইতে বেশি।

মহাভারতের চরিত্র নিয়ে বলতে গেলে কৃষ্ণ, কর্ণ, ভীস্ম, যুধিষ্ঠির, দ্রৌপদী, অর্জুন এরাই সবচাইতে বেশি বাক্য বরাদ্দ পায়, ক্ষেত্রবিশেষে অভিমন্যু, ঘটোৎকচও থাকে আলোচনায়, তবে আমার বিবেচনায় মহাভারতের ইউনিকতম চরিত্র আসলে অশ্বত্থামা। এই এক অশ্বত্থামা ইস্যুতে সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা বলতে হয়েছে, এবং উপপাণ্ডবদের হত্যা করার কারণে সে অমরত্বের অভিশাপ পেয়েছে। যুগের পর যুগ চলে যাবে, অশ্বত্থামা মরবে না; এর চাইতে বড়ো শাস্তি আর কী হতে পারে! মীরজাফরকেও মহাভারতের অশ্বত্থামা লাগে আমার। শারীরিকভাবে মৃত্যু হয়েছে তার, কিন্তু যতদিন বাংলা ভাষাভাষি একজন মানুষও অবশিষ্ট থাকবে, মীর জাফর নামটা শুনলেই তার ফেসিয়াল এক্সপ্রেসন বদলে যাবে; অশ্বত্থামার চাইতেও তো তার শাস্তি নির্মম!

কিন্তু যার প্রতি ঘৃণায় গা শিরশির করে, চরিত্রগত দিক থেকে তার সাথেই সাদৃশ্য সর্বাধিক; এটা কেমন হিপোক্রেসি বা প্যারাডক্সিকাল হয়ে গেলো না? ১০ টাকার লটারি কিনে ৩০ লক্ষ টাকা পুরস্কার জেতার গল্পটা তো বেশিদিন আগের নয়। আমি নিজেও কৈশোরে ৫-৭টা টিকিট কিনেছি, ড্র হওয়ার পর টিকিট হাতে পেপারের উপর হামলে পড়তে দেখিনি এমন মানুষ কমই ছিলো; সিনেমাতে রিকশাচালক নায়ক হঠাৎ গার্মেন্টসের মালিক হয় কীভাবে? লটারি জিতে! এইবার একটা টাইম মেশিন যোগাড় করুন, এবং টিকিটটা নিয়ে ১৭৫৬-৫৭ তে ফেরত যান, এবং মীর জাফরকে একই মেশিনে চড়িয়ে ২০০০-০১ এ পাঠিয়ে দিন। এখনো কি প্যারাডক্সিকাল লাগছে?

হ-তে হিউমার, হ-তে হিপোক্রেসি; এমনকি হিমালয় লিখতেও ‘হ’ লাগে। এবার পরিষ্কার হলো, কেন আজ ঘুম ভাঙ্গার পরই মীরজাফর শব্দটা চেতনায় এসেছিলো। ব্রুটাস আর মীরজাফরের মধ্যে পত্রমিতালি পাতিয়ে একটা আর্টিকেল লেখার ইচ্ছা হয়েছে। ব্রুটাস কীভাবে নিজেকে ডিফেন্ড করে, মীরজাফর কীভাবে নিজের দোষ স্বীকার করে এবং অশ্বত্থামার সাথে দেখা করতে যায়।

হিউম্যানল্যাব নামে এখন যে বইটা লিখছি সেখানে ‘ব্যাঙ উপপাদ্য’ শীর্ষক অধ্যায় আছে একটা । এক্সপেরিমেন্টটা সেখানে চেষ্টা করবো কিনা ভাবছি।

ইতিহাস ধারণাটা সবসময়ই পলিটিক্যাল, যে কারণে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর প্রতি ঢালাওভাবে মুগ্ধতা-ক্ষুব্ধতা তৈরি করতে পারি না। রক্তচাপের মতো ইমপ্রেসনগুলোও অহর্নিশি উঠা-নামা করে। আলিবর্দি খান, সিরাজউদদৌলা ২ জন নবাব যাকে বরখাস্ত করেও স্বপদে পুনর্বহাল করতে পারে তার ব্যক্তিত্বে নিশ্চিতভাবেই ক্যারিশমাটিক উপাদানে ভরপুর ছিলো। এখনকার সময়ে জন্ম নিলে সে হয়তোবা সিলিকনভ্যালির কোনো কোম্পানীর সিইও হিসেবে সফল ক্যারিয়ার গড়তো, আর নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার বই লিখতো সেলফ-হেল্প বিষয়ে!

think and grow rich, never eat alone, rich dad poor dad, 7 habits of highly effective people, five temptations of a ceo প্রভৃতি চটকদার কনটেন্টের বই দেখি আর খুব মনোযোগ সহকারে লেখকের নাম ও প্রোফাইল বিশ্লেষণ করতে থাকি; প্রতিবারই প্রকাশক আর মুদ্রণযন্ত্রের প্রতি বিরাগ জন্মে; আরে ব্যাটা, লেখকের নাম ভুল দিতেছিস ক্যান!