পারফরমিং আর্টের মৌলিক ভিত্তি অনুভূতি, অথচ সবচাইতে অনুভূতিহীনতার জায়গাও এটি। যতক্ষণ যৌবন আছে আপনি মার্কেটে আছেন, আপনার জন্য কোটি মানুষের প্রত্যাশা-প্রার্থনা তৈরি, আপনার জন্য জীবন দিবে হাজারো মানুষ; যৌবন শেষ, আপনিও মার্কেট আউট। আপনার জন্য থাকা কোটি মানুষ তখন চলে গেছে মার্কেটে আসা নতুন কোনো জাদুকরের জাদু দেখতে।

মুহূর্তের মধ্যে মিনিংলেস হয়ে পড়বে আপনার অতীত, কতখানি আনন্দ দিয়েছেন সেই হিসাব তখন অস্তগত, ভবিষ্যতের ভার বইতে হবে একা আপনাকেই। পারফর্মিং আর্টের মানুষদের বিষন্নতায় ভোগা বা আত্নহত্যা প্রবণতার অন্যতম কারণও অতীতশূন্যতা আর ভবিষ্যত নিঃসঙ্গতার নিষ্ঠুর নিয়তিকে মেনে নিতে না পারা।

পারফরমিং আর্ট কি আদতেই অতীতহীন? অমিতাভ বচ্চন ৪০ বছর আগে যে সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, আরো ৫০ বছর পরেও সেই সিনেমায় তার বয়স একই থাকবে, কিন্তু সেলুলয়েডের বাইরে তার বয়স বেড়ে যাবে, আর মার্কেটে আসতে থাকবে নতুন জাদুকরেরা। তারপর একদিন তিনি মার্কেট আউট হয়ে যাবেন, এবং আজ ৭৫ বছর বয়সে চাইলেও আর ৩০ বছরের যুবকের চরিত্রে পরিচালক তাকে কাস্ট করবে না।

‘যে মানুষটি অতীতে এত আনন্দ দিয়েছে, অকৃতজ্ঞ জাতি কীভাবে তাকে অসম্মান করে’— এই ক্রোধোক্তি তখন হাস্যকর হয়ে উঠবে।

আপনি তার স্কিলের প্রেমে পড়েছিলেন, তার সাথে আপনার যতটুকু মেন্টাল এটাচমেন্ট সেখানে বাহ্যিক গ্ল্যামারটাই মূখ্য, তাতে টান পড়া মানে এটাচমেন্ট আলগা হয়ে যাওয়া। আপনি আনন্দ পেয়েছেন, এজন্য টাকা খরচ করেছেন, জাদুকরের সংসার খরচ চলেছে, তিনি বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন অথবা হাওয়ায় আসা টাকা হাওয়াতেই উড়িয়ে ফূর্তির দিন কাটিয়েছেন। সম্পর্কটা যেহেতু গিভ এন্ড টেক এর, এখানে মুগ্ধতা তৈরি হতে পারে, আকর্ষণ থাকতে পারে, কিন্তু কৃতজ্ঞতার প্রশ্নই আসে না।

বরং কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত সেই জাদুকরের, যেহেতু তার পারফরম্যান্স আপনি বা আপনারা গ্রহণ করেছেন।

ব্যান্ডশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু জীবনের শেষ দিকে কনসার্টে তেমন একটা পারফর্ম করতে পারতেন না শারীরিক অসুস্থতার কারণে। তার বহু পাড় ভক্তও তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করেছে সেসময়। হয়তোবা বিদ্রুপ করতে চায়নি, হতাশা থেকে আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, তবু মূল বার্তাটি কী? আপনার সময় শেষ, স্টেজে উঠবে নতুন কোনো রকস্টার।

ভক্তদেরও বয়স বাড়ে, ২০ বছর আগে যে ভক্ত গায়ক কিশোর কুমারের গান না শুনে ঘুমাতে পারতো না, ২০ বছর পরে জীবনের বিবিধ ব্যস্ততায় তার মাথায় গান কিংবা কিশোর কুমার- কারোরই স্থান নেই।

একারণেই পারফরমিং আর্টে অতীত বা ভবিষ্যতের কোনো স্থান হয় না।

তবু মানুষ পারফরমিং আর্টে ঝুঁকে কেন?

অল্প বয়সে দেশ-বিদেশজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এর চাইতে উপযোগী কোনো মাধ্যম নেই। যখনই আপনি জনপ্রিয় হবেন, আদতে আপনি এক গ্যাসবেলুনে চড়ে আকাশ উড্ডয়নে বেরিয়েছেন, এবং এটা নিশ্চিত বেলুনের গ্যাস ফুরিয়ে ভূপাতিত আপনি হবেনই।

জনপ্রিয়তার সাথে ভাগ্য জড়িত। চেষ্টা, শ্রম দেয়ার পরও জনপ্রিয় হবেন তা বলা যাচ্ছে না; জনপ্রিয় হয়ে গেছেন মানে আপনার হাতে আর নিজের কোনোকিছুর নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনি পরিণত হয়েছেন পাবলিক প্রোপার্টিতে, তারা আপনাকে গ্যাসবেলুনে উড়াবেই, আপনি আগ্রহী নাকি অনাগ্রহী তাতে কিছুই যায়-আসে না।

প্রিন্ট মিডিয়া আর সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ভারত এবং বাংলাদেশের বহু মানুষের কাছেই স্পোর্টস পারফর্মিং আর্টের চাইতেও দেশপ্রেমের চিহ্ন। স্পোর্টস না বলে সুনির্দিষ্টভাবে বলা উচিত, ‘ক্রিকেট’।

প্রত্যেক দেশেই কোনো না কোনো টিম গেম জনপ্রিয় যেটা তাদের ন্যাশনালিজমকে প্রমোট করতে কাজে লাগে। ন্যাশনালিজম কি জরুরী? রাষ্ট্রের বৈধতা এবং কার্যকারীতা নিশ্চিত করতে যে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হয়, জাতীয়তাবাদ তার মধ্যে ১ নম্বর; একক বা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমানুষের জন্য জাতীয়তাবাদ জরুরী না হলেও সমাজ বা রাষ্ট্রে বসবাস করতে এটা লাগবে। সে না চাইলেও সিস্টেম তাকে এর মধ্যে ফিট করে নিবে।

কিন্তু জাতীয়তাবাদ আর স্বদেশিকতা বোধ সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। জার্মানি বা অস্ট্রেলিয়ার সমর্থকেরাও খেলাধুলার মধ্যে জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে, কিন্তু এর সাথে দেশপ্রেমকে গুলিয়ে ফেলে না।

ভারত আর বাংলাদেশে ক্রিকেটকে দেশপ্রেমের সাথে গুলিয়ে ফেলে না, মিলিয়ে ফেলে এবং সম্ভবত এর সাথে বৃহৎ কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে।

বেসামরিক মানুষ যেহেতু এত পরিকল্পনা- মহাপরিকল্পনার ধার ধারে না, চায়ের দোকানে বসে সমালোচনা করতে পারলেই খাবার হজম হয়ে যায়, তাই দেশপ্রেম কোনো গভীর দায়িত্ববোধ না হয়ে চায়ের দোকানে প্রতি কাপ ৫টাকা দরে কিনতে পাওয়া যায়।

কোনোদিন ক্রিকেট খেলা দেখে না, ক্রিকেটের বেসিক নিয়ম-কানুন জানে না এমন অজস্র মানুষ বাংলাদেশ দলের খেলা থাকলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় এবং ২-১ জন খেলোয়ারের পিণ্ডি চটকায়, এর মূল কারণ সস্তাদরে কেনা দেশপ্রেম নামের ‘চা’ পানীয়। ঈদের নতুন পোশাক অন্যদের না দেখালে একটা বাচ্চার যেমন ঈদ পালন হয় না, ক্রিকেট বিষয়ে কিছু না বললে একটা উল্লেখযোগ্য অংশের দেশপ্রেম অপ্রকাশিত রয়ে যায়।

যেহেতু পুরো ব্যাপারটাই আরোপিত, মানুষ নিজের অজান্তেই প্রমাণ করে দেয় ক্রিকেট নিছক পারফরমিং আর্টের বাইরে কিছুই নয়।

কীভাবে?

মাশরাফিকে নিজের পায়ের লিগামেন্ট দিয়ে দিবে, প্রকাশ্যে এমন ঘোষণা দিয়েছে এরকম মানুষের সংখ্যা ১০০০ এর বেশি হবে না? কিংবা মাশরাফিকে আজীবন বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে দেখতে চাই এরকম কথা অন্তত ১ লক্ষ মানুষ বলেছে, তাই তো?

মাশরাফি ৭ বার সার্জারির পরও মাঠে নেমেছে, এটাকে দেশপ্রেম হিসেবে দেখেছে এমন মানুষের সংখ্যাও ১ লাখের কম না।

সেই একই মাশরাফি, একই সব অতীত কীর্তি রয়ে গেছে, তবু মাশরাফিকে দল থেকে বাদ দিতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা এখন কয়েক লক্ষ হয়ে গেছে। এর কারণ কী? সে পারফর্ম করতে পারছে না। খেলার প্রতি ডেডিকেশন তো তার একই রকম রয়ে গেছে, তবে কি দেশপ্রেম কমে গেছে?

কিংবা এর মধ্যেও কয়েক হাজার মানুষ মাশরাফিকে ডিফেন্ড করে যাচ্ছে। তাদের বক্তব্যের ভিত্তি, যে লোক দেশের ক্রিকেটকে এত কিছু দিল, যার কারণে আজ বাংলাদেশ সমীহ জাগানিয়া দল হয়ে উঠেছে, মাত্র একটা টুর্নামেন্ট দেখেই তাকে ছুড়ে ফেলতে বলছে। এই জাতির মতো অকৃতজ্ঞ জাতি আর ২য়টি নেই। কিংবা মেলোড্রামাটিক টোনে কেউ লিখছে ‘আর মাত্র ২টা ম্যাচ এই লোকটাকে সহ্য করেন, সে আর কখনো জ্বালাতে আসবে না’

স্টেটমেন্টগুলো কৌতূহলোদ্দীপক। এর মানে প্রকারান্তরে মেনে নেয়া হচ্ছে মাশরাফি পারফর্ম করতে পারছে না, তবে সাথে এও বলা হচ্ছে তার অতীত পারফরম্যান্সের কথা স্মরণে রেখে তাকে যেন তখনো সমর্থন জানানো হয়। এটা পারফরমিং আর্টের ইতিহাসের সাথেই পুরোপুরি সাংঘর্ষিক এক প্রত্যাশা, যা পৃথিবীতে কোনোদিন কোনো দেশে পূরণ হয়নি, বাংলাদেশেও তা না হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়ে গেছে, যতোই দেশপ্রেমের চা-মদিরা নামে চালানো হোক, ক্রিকেট এমনকি বাংলাদেশেও শেষ পর্যন্ত একটি পারফর্মিং আর্টই।

শাকিব খান বাংলা সিনেমার সুপারস্টার, হলগুলোতেও তার সিনেমার কদর। তার ভক্তরা অন্য স্টারের ভক্তের সাথে ঝগড়া-ঝাটি করে যৌবন বিসর্জন দিচ্ছে, এই শাকিব খানেরই যদি একনাগাড়ে ৭-৮টা সিনেমা ফ্লপ করে, ৯ নম্বর সিনেমা প্রদর্শনের জন্য কোনো হল পাওয়া যাবে না, তার ডাই-হার্ড ফ্যানেরাও তখন নতুন স্টারকে বরণ করে নেবে।
কিংবা তার সিনেমা ফ্লপ করলো না, তবু বয়স বাড়বে, ফিটনেস কমবে, এবং তার ভক্তরা অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে নতুন জেনারেশনের কাছে সে নিছকই এক প্রাক্তন সুপারস্টার, যার মার্কেট ডাউন হয়ে গেছে। এই পরিণতি কারো পক্ষেই আটকানো সম্ভব হয়নি। এজন্য কেউ বলবে না, অকৃতজ্ঞ জাতি, সুপার স্টারের কন্ট্রিবিউশন ভুলে গেল।

মাশরাফি, সাকিব, তামিম এরাও সিনেমাতেই এক্টিং করে। পার্থক্য হলো শাকিব খানের সিনেমায় কোথাও বাংলাদেশ শব্দটি পরিচিতি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না, কিন্তু মাশরাফি বা সাকিবের প্রতিটি সিনেমার প্রযোজক হিসেবেই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি মহাসমারোহে ব্যবহৃত হয় এবং শোভা পায়। কেবলমাত্র বাংলাদেশ শব্দের জোরে মাশরাফি-সাকিবেরা শাকিব খান বা ফেরদৌসের কলিগ না হয়ে পৃথক কমিউনিটিতে বিলং করে।

সেই কমিউনিটির মাটি এতোই উর্বর, একটু বৃষ্টি হলে সেখানে বিনা বীজেই ফসল ফলে, আবার সামান্য বন্যায় ফসল তো ভাসেই, নদী ভাঙনে উদ্বাস্তু হওয়ারও আশংকা থাকে সবসময়। বাংলাদেশে পারফরমিং আর্টিস্টদের মধ্যে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাই তাই সবচাইতে অনিশ্চিত এক মঞ্চে ঝুঁকিপূর্ণ সব জাদু দেখায়।

ক্রিকেট দুনিয়ায় অস্ট্রেলিয়ানদের আমরা বলি আবেগশূন্য জাতি, এবং প্রফেশনাল। পক্ষান্তরে নিজেদের দাবি করি আবেগী দর্শক বা ক্রিকেটার হিসেবে।

আবেগ আর অনুভূতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। আবেগ হলো কোনো কিছুর প্রতি সুতীব্র আকর্ষণ বোধ করে তার জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দেয়ার প্রস্তুতি ও সাহস রাখা, কোনো আগ-পিছ চিন্তা না করা।

অনুভূতি হলো, কোনো কিছুর প্রতি অন্ধভাবে সুতীব্র আকর্ষণ বোধ করা, এবং সর্বক্ষণ সেটি হারানোর ভয়ে তার প্রতি আরো কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে সেটিকে আরো বাক্সবন্দী করে ফেলা।

আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে আবেগ তৈরি হয়ই না বলতে গেলে, কিন্তু অনুভূতিতে একেকজন প্রশান্ত মহাসাগর।

আমার পর্যবেক্ষণ মতে, অস্ট্রেলিয়াই হলো আবেগীতম ক্রিকেট জাতি। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ট্রফি জেতা, এবং এটার জন্য কোনোরকম স্যাক্রিফাইস করতেই কুণ্ঠিত হয় না তারা।

মার্ক টেলর অধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও তাকে ওয়ানডে থেকে বাদ দিয়ে স্টিভ ওয়াহকে অধিনায়ক বানাতে তাদের ভাবতে হয়নি, টেলর অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে খেলে গেছে। ১৯৯৯ তে স্টিভ ওয়াহ বিশ্বকাপ জেতানো সত্ত্বেও ২০০৩ বিশ্বকাপে তাদের ২ ভাইকে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি, ২০১৫ বিশ্বকাপ চলাকালেই মাইকেল ক্লার্ক জানতো ফলাফল যা-ই হোক, বিশ্বকাপের পরে তাকে আর ওয়ানডেতে রাখা হবে না।

আপনার মনে হতে পারে, কেমন আবেগশূন্য অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট। কিন্তু আমি বলি, খেলাটার প্রতি তাদের আবেগ এতোটাই বেশি কে স্টিভ, কে ক্লার্ক তাতে কিচ্ছু ম্যাটার করে না, শিরোপা জেতার জন্য যা করতে হয় তা- ই করতে হবে। এজন্যই বিশ্বকাপ মানেই অস্ট্রেলিয়া, ৫ বার ট্রফি নিয়েছে, ৬ষ্ঠ বার এবারই না হওয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।

বাংলাদেশ এবারের বিশ্বকাপে যাদের হারিয়েছে প্রত্যকে পয়েন্ট টেবিলে তাদের চাইতে নিচে। অন্যদিকে আফগানিস্তান বাদে অন্য দলগুলো পয়েন্ট টেবিলের উপরে থাকা কোনো একটি দলকে হারিয়েছে। এখান থেকেই উপলব্ধি করা যায় খেলাটির প্রতি আমরা কোনো আবেগ তৈরি করতে পারিনি, অনুভূতি নিয়ে কাঁদাপানিতে হাবুডুবু খেয়েছি মাত্র। আগামীকাল যদি পাকিস্তানকে হারায় তাহলে ৪ জয়ের বিপরীতে সমান ৪ পরাজয় নিয়ে ফিরে আসবো, কিন্তু পাকিস্তানকে হারানোর কারণে সব ব্যর্থতা সোনায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে। আমাদের ক্রিকেটে পাকিস্তান এমনই এক পরশপাথর। গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য স্ট্যাটাস পড়লাম, বাংলাদেশ প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়েছে এটা নিয়ে যতজন হতাশ, পাকিস্তান সেমিতে উঠতে পারেনি এতে আনন্দিত তার চাইতে অন্তত ৩ গুণ বেশি। কিংবা নিজেরা জিতেছি মাত্র ৩ ম্যাচ তাতে বিমর্ষ না হয়ে ভারত আর আফগানিস্তান কেন যথাক্রমে ইংল্যান্ড আর পাকিস্তানের কাছে হেরে গেল তার মধ্যে ম্যাচ ফিক্সিং খুঁজছে, যেন বাংলাদেশকে সেমিতে তোলার দায়িত্ব নিয়েই অন্য দলের খেলতে হবে।

এগুলো স্বার্থান্ধতা, কোনোভাবেই আবেগ হতে পারে না। এরকম আবেগহীন জঙ্গি অনুভূতিবিদদের দিয়ে ক্রিকেট কখনোই পজিটিভ ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারবে না।

মাশরাফির সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল ২০১৭ এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পরপরই। মধ্যবর্তী সময়গুলোতে ক্রমাগত এশিয়ান কন্ডিশনে নিচের টায়ারের দলগুলোর সাথে খেলার দরুণ তার মার্কেট আউট হওয়ার বিষয়টি চোখে পড়েনি। কিন্ত এর মধ্যে যখনই এশিয়ার বাইরে কদাচিত খেলা হয়েছে টায়ারের উপরে থাকা দলের বিপক্ষে, বোঝা গেছে মাশরাফিকে দিয়ে হবে না। তবু গত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের সময় ফিটনেসের ব্যাপক উন্নতি করেছিলেন, এরপরই খেলা থেকে ফোকাস সরিয়ে রাজনীতিতে বেশি সক্রিয় হওয়ায় ফিটনেসের মারাত্মক অবনতি ঘটে তার। এমনিতেই এশিয়ার বাইরে তিনি অচল, তার উপর এরকম ফিটনেসহীনতা- দুয়ের সম্মিলনে বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্সের বেহাল দশা।

মানুষ ভেবেছিল মাশরাফির যেরকম মহামানব ইমেজ, তাতে তিনি কেমন পারফর্ম করছেন এটা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়বে না, তিনি মাঠে থাকলেই মানুষ তার লড়াকু ইমেজের কারণে সবকিছু ওভারলুক করে যাবে। কিন্তু প্রথম ৩ ম্যাচের ২টাতেই যখন তিনি বোলিং কোটা পূরণ করেননি, মানুষ হঠাৎই আবিষ্কার করেছে নিজের অজান্তেই তার মধ্য থেকে প্রতিক্রিয়া চলে আসছে, সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না নিজেকে। এমন নয় মাশরাফির প্রতি তার রাগ ( কিছু ডাক্তার আর আওয়ামিলীগ বিরোধী মানুষ ব্যতীত), তবু সে মাশরাফিকে মানতে পারছে না। কারণ সে পারফরমিং আর্ট দেখতে বসেছে, কিন্তু সেটা বুঝে পাচ্ছে না, নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে।

তবু দীর্ঘদিনের অনুরক্তি থেকে সে অপেক্ষায় ছিল হয়তোবা মাশরাফি ফিরে আসবে, দেখাবে ঝলক, কিন্তু পরের ২ ম্যাচের অবস্থাও যখন তথৈবচ, মানুষ বিস্ফোরিত হলো। পারফরমিং আর্টের নিষ্ঠুর নিয়তি মাশরাফির বেলায়ও অভিন্ন চেহারাতেই আবির্ভূত হলো।

পক্ষান্তরে, মাশরাফি স্বয়ংও হয়তো বুঝতে পারেনি নিজের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এভাবে অতর্কিতে প্রকাশিত হয়ে পড়বে। বিশ্বকাপের প্রথম ৩ ম্যাচই উপরের টায়ারের দলের বিপক্ষে পড়ায় মোরাল বুস্ট আপের সুযোগ আর আসেনি, উপরন্তু ৩ ম্যাচে পাওয়া বিপর্যস্ততায় সেই যে মোরালি ডাউন হয়ে গেলেন, তার মতো কঠিন ব্যক্তিত্ব আর মানসিক দৃঢ়তার মানুষও পরবর্তীতে নিচের টায়ারের দলের বিপক্ষেও সেখান থেকে উদ্ধার হলেন না৷ ক্রিকেটপ্রিয় মানুষের এখন একটাই প্রত্যাশা আর প্রতীক্ষা, কবে কোন মুহূর্তে তিনি অবসর নিবেন আর তার কীর্তিগাঁথা স্মরণ করে মানুষ তাকে নিয়ে স্তুতিকাব্য লিখবে, তার লেখায় শত শত লাইক, কমেন্ট পড়বে, শেয়ার হবে শত শত।

এটা কি হিপোক্রেসি?

একেবারেই নয়। আমরা উত্তম কুমারের নায়কোচিত চেহারা দেখতে চাই, ৫৫ বছরের বিগতযৌবনের কোনো প্রৌঢ় মানুষকে নয়।

আদতে পারফরমিং আর্ট সাময়িক আনন্দের বাইরে আমাদের জীবনে সামান্যতম কোনো অর্থ বহন করে না। অনেক মানুষ মনের আনন্দে বাইজি পুষে, জুয়া খেলে, যারা তা পারে না তারা বিভিন্ন পারফরমিং আর্টের দিকে ঝুঁকে। শিল্পকলাকে মহিমান্বিত করা হয় না, কারণ সেগুলো অনুধাবন করতে উচ্চবুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা লাগে, ক্রিকেট-ফুটবল জাতীয় আর্ট বুঝতে তেমন কিছু লাগে না; যে দল বেশি গোল দিবে অথবা যারা বেশি রান করবে তারাই জিতবে। জালে বল ঢুকলে গোল, বল যদি মাটি কামড়িয়ে দড়ির বাইরে যায় চার- হাওয়ায় ভেসে বাইরে গেলে ছক্কা, তিন স্ট্যাম্পের কোনো একটায় বল লাগলে আউট— এটুকু বুঝেই নির্বিঘ্নে খেলা দেখা চালিয়ে নেয়া যায়।

আজ কালের কণ্ঠ অনলাইনে পড়লাম অবসর বিষয়ে দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের সাথে কথা বলেছেন মাশরাফি। কারো মতামত তিনি আগামীকাল ঐতিহাসিক লর্ডস এই অবসর নিন, কারো মতামত দেশের মাটিতে বিসিবি একটি বিদায়ী সিরিজ আয়োজন করুক, কোনো দল পাওয়া না গেলে জিম্বাবুইয়ে তো আছেই।

কালের কণ্ঠের খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান থাকি। তবে এবারের বিশ্বকাপে অনেকগুলো ইস্যু থেকে আশ্বস্ত হয়েছি, তারা আদতে হিটম্যানের ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের অন্যান্য মূলধারার মিডিয়াগুলো যেখানে তারকা তোষণ আর দর্শক মনোরঞ্জন নীতিতে চলে, কালের কন্ঠের স্ট্যান্স অনেকটাই আনপপুলার ঘরানার। একটা সংবাদ যখন মূল ধারার মিডিয়ায় আসে তখন প্রতিবেদক তার বিপরীতে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ সাথে রেখেই লিখে, নচেৎ মানহানি মামলার আশংকা থাকে৷

কিন্তু মাশরাফির অবসর সংবাদ দেখার পরই কেন কালের কন্ঠকে ভিন্ন পারসপেক্টিভ থেকে দেখছি, আগে কেন দেখিনি, মাশরাফিকে মাঠে দেখতে দেখতে আমিও কি ক্লান্ত আর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছি?

এই বিকট সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়েই মন চলে যাচ্ছে ২০০১ এর সেই টেস্টে যেখানে জিম্বাবুইয়েকে মাত্র ১০ রানের টার্গেট দিয়েও পরপর ২ বলে ডিয়ন ইব্রাহীম আর স্টুয়ার্ট কার্লাইলকে আউট করে দিয়েছিল ৬ ফুট ১ ইঞ্চির সেই কলার উচু করে দৌড়ানো বোলার, ২০০৪ আর ২০০৭ এ উন্মত্ত শেওয়াগকে বোল্ড করা বোলার, আগ্রাসী গিলক্রিস্ট প্রথম ওভারেই এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরে যাচ্ছে, টেস্টের প্রথম বলেই ওয়াসিম জাফর বোল্ড, টেন্ডুলকার তার শততম সেঞ্চুরি করে কিপারকে ক্যাচ দিচ্ছে, বেন স্টোকস বিভ্রান্ত হয়ে মিডল স্ট্যাম্প হারিয়ে ফেলছে—- কিন্তু বোলারের কলার আর নামছে না।

ইউটিউবে এগুলো সবই দেখা যায়, আরো ১৭ বছর পরেও যাবে, কিন্তু ২০০১ এ ক্লাস নাইনে পড়া কিশোর আমি এখন ৩২ বছরের ছা-পোষা মধ্যবিত্ত, কোন ফাঁকে ২০১৯ চলে এসেছি বুঝে উঠতে পারিনি, সেই কলার উচানো বোলারেরও যে বয়স বেড়েছে, কলার জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গেছে, সেই বাস্তবতা ইউটিউবকে বোঝাবে সাধ্য কার! আমি বড়ো হলেও মাশরাফি যে বুড়ো হচ্ছে না, ইউটিউবে একইরকম ক্ষিপ্র লাগে।

এবং তখনই আমার বয়স্ক চোখ টিভিতে খুঁজে পায় ক্লান্ত-বিধ্বস্ত এক খেলোয়াড়কে যিনি বোলিং-ব্যাটিং কোনোটাতেই বিন্দুমাত্র অবদান না রেখে মাঠের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। আমি একবার ইউটিউবে যাই, একিবার টিভিতে ফিরে আসি, অবিরাম যাওয়া-আসার মধ্যেই অনুভব করতে থাকি খালেদ, ইবাদত ছেলেগুলো আসলে কতটা তরতাজা তা দেখা উচিত, অমিতাভের বয়স ৭৫ হয়ে গেছে, এবং

হ্যা, it’s time to say good-bye Mash!

২০০১ এর নিউজিল্যান্ড সফরে যে বোলারের ইনজুরির সংবাদে ব্যাকুল-ব্যথিত হয়েছিলাম, ১৮ বছর পরে তার খেলে যাওয়াতে উলটো বিরক্ত হচ্ছি।

এবং তখনই নিজের দিকে ফিরি। এখন বয়স কম, ৬ টা বই লিখেছি, আরো হয়তো কয়েক বছর দাপিয়ে বেড়াবো লেখালিখি নিয়ে, ৩০-৩৫ টা বই লিখে ফেলবো, তারপর আমিও ধরা পড়ে যাবো জরাগ্রস্ততা আর পুনরাবৃত্তির দূরারোগ্য ব্যাধিতে, আমি কি উপলব্ধি করতে পারবো, এইবার দোকান বন্ধ করা উচিত?

মাশরাফির অবসর মুহূর্ত নিদারুণ এক কঠোর আত্মোপলব্ধির সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো আমায়।

অতীত যেখানে অর্থহীন, ভবিষ্যত অনিশ্চিত, কেবল স্রোতে ভাসতে থাকায় যার নিয়ম, সেই আত্মসংহারি প্রলোভনে মানুষ জড়ায় কেন তবে!

ব্রায়ান লারাই অবসর মুহূর্তে তার উত্তর দিয়েছেন- ‘Did I entertain you?’

শেষ পর্যন্ত ‘আনন্দ’ দেয়া-নেয়াই সকল কিছুর উৎস এবং মাশরাফি যদি একই প্রশ্ন করে আমি বরং পাল্টা প্রশ্নে বলবো- ‘ any doubt’?