বিশ্বকাপের পূর্বে ১১টি উপলব্ধি লিখেছিলাম, অপ্রত্যাশিতভাবে লেখাটি ভাইরাল হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ম্যাচের পরই পর্যবেক্ষণ লিখেছি। সেই পর্যবেক্ষণগুলো বিশ্লেষণ করলেই উপলব্ধি তৈরি হয়ে যেত। এই লেখাটি তাই বাহুল্য দোষে পরিপূর্ণ হবে যদি সেই পথে হাঁটি। ইতিমধ্যেই যা লিখে ফেলেছি সেইসব দৃষ্টিকোণকে পাশে রেখে ভিন্ন কোনো বক্তব্য দেয়ার চেষ্টা করি বরং; তাছাড়া পূর্ব আর পরবর্তী উপলব্ধিতে পরিবর্তন কেন ও কীভাবে এলো সে বিষয়েও কিছুটা অনুসন্ধিৎসু হওয়া উচিত।

উপলব্ধি১- কেমন গেল ২০১৯ বিশ্বকাপ? প্রচুর শব্দ খরচ না করে মাত্র ১টি শব্দে উপস্থাপন করতে বললে আমার নির্বাচিত শব্দটি হবে ‘ভরাডুবি’; শব্দখানি ওজনে ৫০০ হাতির সমান হওয়ায় এ ব্যাপারে কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের যা বয়স এবং দলীয় সামর্থ্য তাতে বিশ্বকাপে তাদের পারফরম্যান্স কেমন হওয়া কথা? র‍্যাংকিংয়ের নিচে থাকা সবগুলো দলের বিপক্ষে জয়, কাছাকাছি র‍্যাংকিংয়ের কোনো এক দলের বিপক্ষে জয়, এবং উপরের টায়ারের ৪ দলের ১টির বিরুদ্ধে নিশ্চিত জয়, এবং ভাগ্য খুবই ফেভার করলে আরো একটির বিপক্ষে জয়। তাতে বাংলাদেশের জয়অসংখ্যা হওয়ার কথা- ৩+১+১/২=৫/৬টি। এটা হলো পটেনশিয়ালিটি।তবে ক্রিকেট খেলা কাগজে-কলমে না হয়ে মাঠে হওয়া এবং প্রচণ্ড মেন্টাল স্ট্রেন্থের পরীক্ষা নেয়ায় বাস্তব সমীকরণ ২+১/২+১/২=৫টি। এখান থেকে নড়চড় হওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং প্রাথমিক অনুসন্ধানে ভরাডুবি না বলে ব্যর্থ বলা উচিত, যেহেতু প্রত্যাশিত ৫টি জয়ের বিপরীতে ৩টি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই ৩ এর মধ্যে ঘাপলা আছে। বাংলাদেশ উপরের টায়ারের কোনো দলের সাথেই জিততে পারেনি, নিচের টায়ারের ২টি দলের বিপক্ষে জিতেছে, এবং কাছাকাছি র‍্যাংকিংয়ে থাকা দলের বিপক্ষে ১টি জিতেছে। মূল অভিযোগ হলো, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে গেছেই আসলে সর্বোচ্চ ৪-৫টি ম্যাচ জয়ের টার্গেট নিয়ে। এটা নিন্দনীয়। তারা বিগথ্রি এর সাথে পারবেই না ধরে নিয়ে র‍্যাংকিংয়ের পেছনের ৩ দল, আর কাছাকাছি থাকা পাকিস্তান, সাউথ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডের মধ্যে ১টি বা ভাগ্যচক্রে ২টি জেতার টার্গেট। এই টার্গেটের ক্ষতিকর দিক হলো নিজের সামর্থ্যকে সীমাবদ্ধতা হিসেবে মেনে নেয়া। আপনি দেখবেন পেছনের দলগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশ ফিল্ডিংয়ে উজ্জীবিত, অন্য দলগুলোর বিপক্ষে দিশেহারা। এর কারণ আপনি বিলিভ করে নিয়েছেন আপনার সামর্থ্য ৪টা ম্যাচ জেতা পর্যন্তই। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হবে এই কথাটা কোনো একজন ক্রিকেটারও বিলিভ করতে পারেনি, বরং অতিমাত্রায় ভাগ্যনির্ভর হয়ে থেকে ক্যাজুয়াল এপ্রোচে খেলেছে।

ভরাডুবি কেন বলছি? ১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয়, সেটা পাওয়া গেছে। রানার আপ পাকিস্তানকে হারানো বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম বড়ো আপসেট এবং একই সাথে কন্ট্রোভার্সিয়াল ঘটনা। সেই এক জয় বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির জ্বালানী হয়েছিল। প্রথম আসরে বাংলাদেশ তাই ২০০% অর্জন করেছে। ২০০৩ এ টার্গেট ছিল কানাডা, কেনিয়াকে হারানো, সম্ভব হলে বড়ো কোনো দলকে হারানো। টার্গেটের দুই ম্যাচে হারার সাথে সাথে শ্রীলংকার বিপক্ষে প্রথম ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি। ২০০৭ এ সহজ প্রতিপক্ষ ছিল বারমুডা। কিন্তু ততদিনে ভারত, জিম্বাবুইয়ে, শ্রীলংকা, এমনকি মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর দরুণ একটু হলেও সাহস জন্মেছিল সুযোগ পেলে বড়ো দলকে হারানো সম্ভব। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেয়া রূপকথার অংশ হয়ে যায়, প্রত্যাশিত বারমুডার সাথে জয়ের পাশাপাশি নবাগত আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়ায় ১৫০% অর্জন যোগ-বিয়োগে ১০০% এর মতোই থাকে। পরের ৪ বছরে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করা হয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো হয়, তাছাড়া নিজের দেশে খেলা, সবমিলিয়ে বড়ো দলগুলোর জন্য বাংলাদেশ ডার্ক হর্স হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু দুর্বল নেদারল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয় বাদে আহামরি কিছু অর্জন নেই, উপরন্তু ৫৮ আর ৭৮ রানে অল আউট হয়ে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মিডিওকর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া জয়ই একমাত্র ব্যতিক্রমী ঘটনা। এরপরে এশিয়া কাপের ফাইনাল আর নিউজিল্যান্ডকে আরো একবার হোয়াইটওয়াশ করলেও মাঝের ২ বছর প্রচণ্ড বাজে কাটে, ভারতের ৩য় সারির দলের বিপক্ষে ৫৪ রানে অল আউট হওয়াকেও বিবেচনায় নিতে হবে। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ান কন্ডিশনে কতটুকু সাফল্য পাওয়া যাবে, এ নিয়েও সংশয় ছিল। আফগানিস্তান আর স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে প্রত্যাশিত জয়ের বাইরে আরো একবার ইংল্যান্ডকে হারানো; এটাকেও চলনসই পারফরম্যান্স বলা যেতে পারে। কিন্তু ২০১৫ এর পরে অনেকগুলো হোম সিরিজ জয় আর ১০ বছর পরে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার সুযোগ পেয়ে সেমিতে উঠে যাওয়া বাংলাদেশকে সত্যিকারের বিপজ্জনক দল হিসেবে পরিচিতি দেয় যাদের আর প্রকাশ্যে ‘মিনোস’ বলা যায় না। সেই মানদণ্ডে বিচার করলে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে কিছুই করতে পারেনি,বরং সময় আর সামর্থ্যের কনটেক্সট এ সবচাইতে সফল বিশ্বকাপ ১৯৯৯ আর ২০০৭ এর আসর। ২০০৩ কে যদি ফ্লপ বলি এবারের আসরকে নির্দ্বিধায় সুপারফ্লপ বলা উচিত।

উপলব্ধি ২- বিশ্বকাপের সাথে অন্যান্য যে কোনো টুর্নামেন্ট বা সিরিজের আসমান-জমিন ব্যবধান। দল হিসেবে, খেলোয়াড় হিসেবে আপনি কেমন সেই সার্টিফিকেটের অনেকটাই আসে বিশ্বকাপ মঞ্চে আপনি কী করেছেন সেই ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে। আপনি বিশ্বকাপের ৩০ জন গ্রেট খেলোয়াড়ের ডেটা নিয়ে দেখুন, অনেক গ্রেট খেলোয়াড় হয়তোবা দুর্ভাগ্যক্রমে নেই,কিন্তু যারা আছেন তাদের একজনও সাধারণ কোনো খেলোয়াড় নন। প্রতিটি দল ৪টি বছর ধরে প্রস্তুতি নেয় এখানে বড়ো কিছু করার, নতুন খেলোয়াড়ের মাথায় ঘুরে এখানে নিজের ক্লাস দেখাবে, অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের ইচ্ছা থাকে বিশ্বকাপ খেলে অবসরে যাবে। এই একটা জায়গা যেখানে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্কিলধারী দেশগুলো নিজেদের টেম্পারমেন্ট আর স্কিলের প্রদর্শনী দেখাতে আসে। এখানকার সাফল্যকে যতটা এপ্রিসিয়েট করা হয়, ব্যর্থতাকে দেখা হয় তার চাইতে বড়ো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে। পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সাউথ আফ্রিকা প্রতিটি দেশই নিজেদের মানদণ্ডে বিশ্বকাপে ব্যর্থ (শ্রীলংকাকে ব্যর্থ বলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছি না, তাদের টার্গেটের চাইতে বেশি এচিভ করে ফেলেছে) পাকিস্তান তাদের অধিনায়ককে অব্যাহতি দিবে, ব্যাটসম্যান-বোলার কয়েকজন বাদ পড়বে, অভিন্ন পরিণতি হওয়ার কথা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সাউথ আফ্রিকারও। ২-১দলের কোচকেও বরখাস্ত করা হতে পারে। মানে, দলে বড়ো রদবদল হবেই। বক্তব্যটা খুব সরল- যে সেট আপ থেকে আমার বিপর্যয় এসেছে, সেটা বদলে ফেলতে হবে, কারণ এটা কাজ করবে না প্রমাণিত হয়ে গেছে। এবার নতুন সেট আপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ব্যর্থতার বিপরীতে আদৌ কি কোনো শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া হবে? অধিনায়ক যেহেতু নিজ থেকেই অবসরে চলে যাবে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অন্য খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ, সিলেকশন কমিটি, তারা কি শাস্তি পাবে না? শাস্তিটা জরুরী এই কারণে, এতে সমগ্র ইকোসিস্টেম অনুভব করে কাজে গাফিলতি হয়েছে, এবং আরো অনেক বেশি এগ্রেসিভ না হলে চাকরি বাঁচানো যাবে না। মূর্খশ্রেণির মানুষের কাছে ক্রিকেট মানে দেশপ্রেম, সচেতন মানুষের কাছে বিনোদন হলেও, ক্রিকেটার বা ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে এটা নিছক চাকরি। চাকরিতে খারাপ পারফর্ম করলে আপনার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে, আবেগিয় চুদুরবুদুর চলবে না।

কিন্তু বিসিবির চিন্তা কী এ ব্যাপারে?

বিশ্বকাপ ব্যর্থতায় সবার আগে বাদ পড়া উচিত অধিনায়কের, তারপরে হেড কোচ, এরপরে ক্রমাণ্বয়ে ওপেনার, আর বোলার।

এই হিসাবে স্টিভ রোডসকে রাখার প্রশ্নই আসে না; তামিম-সৌম্য ২ জনকেই বাদ পড়তে হয়, সাথে মিঠুন ( মিডল অর্ডারে ব্যর্থ হওয়ার কারণে একজন জেনুইন ওপেনারকে মেকশিফট মিডল অর্ডার বানানো হয়েছে), রুবেল, রাহি ( নতুন বলের বোলার হিসেবে তারা এতোটাই অনির্ভরযোগ্য যে ম্যানেজমেন্ট তাদের নতুন বল দিতে পারেনি) এবং মিরাজ (স্পিনারের কাজ উইকেট নেয়া। সে ৭ ম্যাচ খেলে উইকেট পেয়েছে মাত্র ৪টি, যা মূল স্পিনারের সাথে যায় না কোনোভাবেই)

এরা যদি পারফর্ম করতে পারে ভবিষ্যতে আবারো ফেরত আসবে, কিন্তু এতো বড়ো ব্যর্থতার পরও যদি এরা বহাল তবিয়তে থাকে, তাদের মধ্যে বার্তা পৌঁছাবে বিশ্বকাপ অন্য ২-৫টা ওয়ানডে টুর্নামেন্টের বাইরে কিছুই না, আমি দলের অপরিহার্য অংশ। এর চাইতে বিধ্বংসী কোনো বার্তা হতে পারে না। স্মিথ, ওয়ার্নারের মতো ক্রিকেটারকে অস্ট্রেলিয়া বল টেম্পারিং ইস্যুতে ক্ষমা করেনি, ক্রমাগত সিরিজ হেরেছে তবু সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছে। বিসিবি যদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়, দেশের ক্রিকেট আগামী ১২ বছরেও একই জায়গায় থাকবে।

উপলব্ধি ৩- বাংলাদেশ ক্রিকেটার নিকৃষ্টতম মিথ্যা হলো, আমাদের পর্যাপ্ত খেলোয়াড় নেই। বরং আমার মতে চাহিদার চাইতে অনেক বেশি ক্রিকেটার আছে। সারা বাংলাদেশ বাদ দিলাম, কেবল ঢাকা শহরেই ক্রিকেট একাডেমির সংখ্যা কত? কিংবা বিকেএসপি, রাজশাহীর বাংলা ট্র‍্যাকে কত ক্রিকেটার আছে? থার্ড ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন, ফার্স্ট ডিভিশনে কতজন ক্রিকেটার খেলে? এটা গেলো ক্রিকেটার পাওয়ার পাইপলাইন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসর প্রিমিয়ার লীগে যারা খেলে তারা প্রত্যকে এতগুলো ধাপ পেরিয়েই আসে। প্রত্যেক ক্লাবে রেজিস্ট্রেশন করায় কতজন খেলোয়াড়কে?

তবু খেলোয়াড় নেই বলে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখাটা মূলত কোচ, কর্মকর্তা, ক্লাব রাজনীতি আর বিসিবি সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষের অবাধ দুর্নীতি, নেপোটিজম আর স্বার্থান্বেষীতার ঘৃণ্য চর্চা। প্রিমিয়ার লীগে যদি ৮ টা ক্লাব খেলে প্রতি দল কমপক্ষে ৩-৪ জন ওপেনার রেজিস্ট্রেশন করায়, তার মানে ৩০-৩২ জন ওপেনার, তাদের মাত্র ৩০% কিছুটা মানসম্পন্ন হলেও ১০ জন ওপেনার অবলীলায় পাওয়া যাবে, যাদের নিয়ে কাজ করা যাবে। তারা হয়তোবা প্রথম সিরিজেই সফল হবে না, কিন্তু তামিম বা সৌম্য যতটা খারাপ করেছে বিশ্বকাপে, তারা এর চাইতে কতটুকুই বা খারাপ খেলবে? সেই ১০ জনের পুল থেকে কি ৩ জন ফ্রেশ ব্লাড পাওয়া যাবে না যাদের সাহসের অভাব নেই এবং নার্ভাস হয়ে পড়ে না। সারা বছর তো খেলেন নিচের টায়ারের টিমের বিপক্ষে, এদের সাথেও যদি ফ্রেশ ব্লাড তৈরি করতে না পারেন, তবে কি আর্জেন্টিনা ক্রিকেট টিমকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে হবে খেলার জন্য। ফিল্ম এবং মিডিয়াতে ডার্টি পলিটিক্সের সংবাদ আমরা জানি; অমুক নায়ক, তমুক নায়িকা শাইন করতে পারেনি ফিল্ম পলিটিক্স বুঝতে না পেরে এরকম সংবাদ পড়ি হরহামেশাই, কিন্তু ক্রিকেটাঙ্গনেও যে ডার্টি পলিটিক্স চলে তা উপলব্ধি করতে না পেরে প্লেয়ার নেই, হাহাকার চলতে থাকে। এই জায়গায় আমাদের আরো বেশি ম্যাচিউর হওয়া প্রয়োজন।

উপলব্ধি ৪- টেকনিক-ফুটওয়ার্ক এগুলো ওভাররেটেড বিষয়। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের নিজস্ব এডজাস্টিং স্টাইল থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো ব্যাটসম্যান রান না পেলে বা ইনিংস বড়ো করতে না পারলে তার টেকনিক আর ফুটওয়ার্ক নিয়ে বেশি কাটাছেড়া করা হয়।।একজন ব্যাটসম্যান টিকবে নাকি হারিয়ে যাবে সেটা এসব ফুটওয়ার্ক আর টেকনিকনির্ভর নয়, এটা নির্ভর করে ৩ টি শর্তের উপর- ১. তার ফিটনেস ২. তার মেন্টাল স্ট্রেন্থ ৩. তার রিফ্লেক্স। তবে এসব জটিল শর্তকে সরলীকৃত করে একটি শর্তে নিয়ে আসা যায়- যে ব্যাটসম্যান অবলীলায় সিঙ্গেলস বের করতে পারে আর রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে দুরন্ত, সে ফর্ম নিয়ে স্ট্রাগল করলেও ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত হবেই। বাউন্ডারি মারা অবশ্যই বড়ো যোগ্যতা, কিন্তু সিঙ্গেলস এর শক্তি এর চাইতেও বেশি। যে ব্যাটসম্যান বাউন্ডারির বাইরে স্ট্রাগল করে সে উপরের টায়ারের বিপক্ষে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দলকে বিপদে ফেলবে।বাংলাদেশে সিঙ্গেলস সবচাইতে ভালো খেলে মুশফিক, এরপরই থাকবে সাকিব আর লিটন। মোসাদ্দেক মন্দের ভালো। একেবারেই পারে না সাব্বির, তামিম, সৌম্য, মিঠুন, মাহমুদুল্লাহ। আমাদের কোনো ব্যাটিং কোচ সিঙ্গেলস বের করার কৌশল নিয়ে কাজ করে কিনা জানা নেই, তবে করলেও যে সেটা কাজে লাগছে না তা দলের এতগুলো ব্যাটসম্যানের সিঙ্গেলস খেলতে পারার অক্ষমতা থেকেই প্রমাণিত। নির্বাচকরা যখন কোনো তরুণ ব্যাটসম্যানকে নির্বাচন করে তখন যেন কেবলমাত্র স্ট্রোক খেলার ক্ষমতায় মুগ্ধ না হয়, তার শট রেঞ্জ এবং সিংগেলস খেলার সামর্থ্যকেই অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত হবে।

উপলব্ধি৫- পেসার হান্ট, স্পিনার হান্ট এগুলো শর্টকাট তরিকা, এখান থেকে রেজাল্ট আসেনি পৃথিবীর কোনো দেশে। বাংলাদেশের মাটিই এমন, এখানে হয়তোবা চেষ্টা করেও ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মতো বাউন্সি পিচ দীর্ঘদিন বজায় রাখা সম্ভব হবে না। আপনি বিদেশ থেকে মাটি আনবেন, তবু কিছুদিন পর তা এখানকার বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে। তবুও স্পোর্টিং উইকেট বানানো সম্ভব। কিন্তু আমি উইকেটের চাইতে পলিসিতে বেশি জোরারোপ করবো। আমাদের লীগগুলোতে পেসাররা খুব বেশি বোলিং করারই সুযোগ পায় না। কিন্তু পলিসি যদি এমন হয় ৫০ ওভারের ম্যাচে ৫০% আর বড়ো দৈর্ঘ্যের ম্যাচে ৪০% ওভার পেস বোলার দিয়ে করাতেই হবে, তখন পেস বোলার বিকশিত হবার সুযোগ বাড়বে। পিচ যেমনই হোক, রান করা বা উইকেট পাওয়া অভ্যাসের ব্যাপার। আপনি ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ে অভ্যাস তৈরি করার জন্য আসেননি, বরং অভ্যাসের চর্চা করতে আসেন। আমাদের পেস বোলাররা এখানটাতেই খেই হারিয়ে ফেলে বারবার।

উপলব্ধি ৬- বাংলাদেশ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ৩টা ম্যাচ জিতবে এটা এতো কনফিডেন্টলি বলতে কারার কারণ কী ছিল? এক কথায় বললে, স্টিভ রোডস। গত নিউজিল্যান্ড সফরে সে যখন সাইফুদ্দিনকে নতুন বলে বোলিং করাচ্ছিল, এবং নাঈম হাসান স্কোয়াডে থাকা সত্ত্বেও তাকে ৩ ম্যাচেই বাইরে রেখে ক্রমাগত মিরাজকে খেলিয়ে গেল তখনই প্রকাশ্য হয়ে যায় তার অপরিপক্বতা। আয়ারল্যান্ড টুর্নামেন্টের ফাইনালে সাকিব না খেলা সত্ত্বেও টপ অর্ডারে লিটনকে না খেলিয়ে মিডলে মিঠুনকে খেলানো আরেকটি বড়ো শিশুতোষ ভুল। তখন থেকেই তার প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়ি। এবং বিশ্বকাপ চলাকালে তা অন্যরাও বুঝে ফেলে। নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড দুটো ম্যাচেই আমরা দুর্বল গেমপ্ল্যানের শিকার। প্রতি ম্যাচের বোলিং রোটেশনই ভয়াবহ। আপনার মনে হতে পারে বোলিং রোটেশন ক্যাপ্টেনের একক সিদ্ধান্ত, এটা আংশিক সত্য, পুরো নয়। ম্যাচের বিভিন্ন ক্ষণে প্রত্যেক দলের কোচই ড্রেসিংরুম থেকে স্ট্র‍্যাটেজি ঠিক করে ক্যাপ্টেনকে বার্তা পাঠায়। বাংলাদেশের বোলিং রিসোর্সে সমস্যা ছিল সেটা ভিন্ন আলাপ, কিন্তু বোলিং রোটেশন আর একাদশে বোলার সিলেকশন যে খাপছাড়া প্রকৃতির ছিল তা ৮ ম্যাচের বিভিন্ন পরিস্থিতির ডেটা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে। স্টিভ রোডস আদতে কোনো ক্লাব পর্যায়েরও কোচ হওয়ার যোগ্য নয়।

উপলব্ধি ৭- বিভিন্ন খেলোয়াড় দল থেকে বাদ পড়ে আর তার হারিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা অবিরাম বিসিবিকে দায়ী করি। এটি অত্যন্ত অযৌক্তিক সমালোচনা। আমাদের দেশের অধিকাংশ ক্রিকেটার উঠে আসে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। যে কারণে হুট করে পাওয়া টাকা তাদের অনেকেরই মাথা ঘুরিয়ে দেয়, আত্মতুষ্টি চলে আসে। তাছাড়া শৃংখলার অভাব তো থাকেই, কেউ কেউ মাদকাসক্তও থাকে। ক্যারিয়ার ক্রিকেটারের নিজের, বিসিবি তাকে গাইডলাইন দিতে পারে, মুখে তুলে খাইয়ে দিবে না। নিজের ক্যারিয়ার নিজেকেই গড়তে হয়। কিন্তু অতিরিক্ত ফেসবুক আসক্তি তাদের এক ফ্যান্টাসি জগতে নিয়ে যায়। উশৃংখলতার দায় বিসিবির হতে পারে না। খেলতে গিয়ে পাওয়া চোট ব্যতীত অন্যান্য ইনজুরিগুলোর বেশিরভাগেরই কারণ শৃংখলার অভাব।

উপলব্ধি৮- বাংলাদেশের কোচ হওয়া উচিত ডেভ হোয়াটমোরের মত রাগী, তবে হাথুরুসিংহের মতো কর্তৃত্বপরায়ণ নয়। খেলোয়াড়দের মন রক্ষা করে চলতে গেলে সেই কোচ কিছুদিনের মধ্যেই দলকে তলাবিহীন ঝুড়ি বানিয়ে ছাড়বে। বাংলাদেশের জন্য অস্ট্রেলিয়া অথবা ভারতের কোনো কোচ বেটার চয়েজ হবেন যিনি ফিটনেসকে ১ নম্বর প্রায়োরিটি দিবেন। সাথে সহকারী হিসেবে স্থানীয় কোনো কোচ যিনি লীগের খেলা দেখবেন নিয়মিত। কোচ কখনো লং টার্ম চিন্তা করে কাজ করবে না, তার লক্ষ্যই থাকবে শর্ট টার্ম সাফল্য এনে নিজের সিভি ভারি করা। একারণেই স্থানীয় কোচকে কোচিং প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যাতে ট্যালেন্ট পুল এর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থাকা যায়।

উপলব্ধি৯- অন্ধ সমর্থন অত্যন্ত ক্ষতিকর। ভালো করলে প্রশংসায় কার্পণ্য চলবে না, বাজে পারফর্ম করলে অবশ্যই সমালোচনা করতে হবে। বাযে পারফর্ম আর ম্যাচ হারা সবসময় সমার্থক নয়। হার-জিত খেলারই অংশ, কিন্তু পারফরম্যান্স ব্যক্তিগত স্কিলের ব্যাপার। বাংলাদেশের কোনো সেক্টরের মানুষই চাপে না থাকলে সোজা থাকে না। ভালো-খারাপ সবসময়ই পাশে থাকে কেবল বাবা-মা, ক্রিকেট দর্শক নিশ্চয়ই ক্রিকেটার বা ক্রিকেট দলের মা-বাপ হয়ে যায়নি। তবে সমস্যা হলো, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সমালোচনা করা মানে বিষোদগার আর ধ্বংসাত্মক মন্তব্য বুঝে থাকে। যে কারণে সমালোচনাকে এপ্রিসিয়েট করা ঝুঁকিপূর্ণ, তবু দুর্বল নার্ভের খেলোয়াড়দের মেন্টালি টাফ করার জন্য হলেও বিষোদগার বা ধ্বংসাত্মক সমালোচনার ইমপ্যাক্ট আছে। বরং অন্ধ সমর্থকেরাই ক্লীব প্রকৃতির, যারা কোনোই কাজে আসে না।

উপলব্ধি ১০- সাকিব এবারের বিশ্বকাপে যে অতিমানবীয় পারফরম্যান্স করেছে, বিশ্বকাপের ইতিহাসই তাকে মূল্যায়ন যা করার করবে ভবিষ্যতে। আমরাও এতে যারপরনাই আনন্দিত। কিন্তু আমার ১৩ বছর বয়সী ভাগ্নে জারিফ আজ সন্ধ্যায় কবি নির্মলেন্দু গুনের এক লেখা পড়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করেছে। সে বলে- ‘মামা নির্মলেন্দু গুণ এসব কী রাবিশ লিখে, সে বলেছে সাকিবই নাকি আমাদের বিশ্বকাপ। সাকিব ভালো খেলেছে, কিন্তু বাংলাদেশ তো মাত্র ৩টা ম্যাচ জিতেছে। সাকিবের কারণে কি তা মিথ্যা হয়ে যাবে!’ নির্মলেন্দু গুণ কী লিখেছে পড়িনি, কারণ নিয়মিত ক্রিকেট ফলো না করা মানুষ অন্য পরিচয়ের সুবিধা নিয়ে কলাম লিখলেই তাকে পাঠযোগ্য গণ্য করি না। তাই তিনি এক্সাক্টলি কী লিখেছেন বলতে পারছি না, তবে আমার কিশোর ভাগ্নে গভীর এক নিরেট সত্য বলেছে। ক্রিকেট শেষ পর্যন্ত দলীয় পারফরম্যান্সের খেলা। সাকিব ফ্যাসিনেশন যেন দলীয় ভরাডুবির কংকালের চাইতে বড়ো না হয়ে যায়।

উপলব্ধি ১১- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো ক্রিকেটার যদি ৭০ ম্যাচ খেলার পরও অন্তত ৪-৫ বার ম্যান অব দ্য ম্যাচ না হতে পারে অথবা দলে স্থায়ী হতে না পারে তার ক্যালিবারে সিরিয়াস পর্যায়ের সমস্যা আছে, এবং তার প্রতি আস্থা কমিয়ে বরং বিকল্প তৈরি করাতেই মনোনিবেশ করা উচিত। তাকে বাতিলের খাতায় ফেলার দরকার নেই, সে আসা-যাওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকতে পারে। সে কখনোই মূল খেলোয়াড়দের একজন হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন হবে না। ৭০ ম্যাচে ৫ বার ম্যান অব দ্য ম্যাচ মানে সে ১৪ মাচে ১টা জেতানোর যোগ্যতা রাখে। টেম্পারমেন্ট বাড়ালে সেটা হয়তোবা ১২-১৩ তে নামতে পারে। ওয়ানডেতে সবচাইতে বেশি ম্যান অব দ্য ম্যাচ টেন্ডুলকার ৬২ বার (৪৬৩ ম্যাচ), বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ভিরাট কোহলির স্ট্যাট- ২৩২ ম্যাচে ৩৩ বার। টেন্ডুলকারের অনুপাত ৭.৪, কোহলির ৭.০৩! বাংলাদেশের কেউ যদি অনুপাত ১২-১৩ রাখতে পারে সেটাই যথেষ্ট। কোনো ক্রিকেটারকে সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে এই ক্রাইটেরিয়াটা কঠোরভাবে অনুসরণ করলে ২০২৭ এর বিশ্বকাপ একাদশে অন্তত ৬-৭ জন ম্যাচ উইনার পাওয়া যাবে। আমাদের একাদশে ম্যাচ উইনারের অভাব থেকেই মিডিওক্রিটির জন্ম।