বই পড়া আমার জন্য লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছাত্রজীবনে একটা মোটা ফিকশনের বই নিয়ে পড়তে পড়তে ফজরের আজান শোনার অভিজ্ঞতা আজ প্রায় অবিশ্বাস্য লাগে। মাঝে সাঝে চেষ্টা যে করা হয়না তা নয়, কিন্তু গল্প উপন্যাসের বইয়ের ক্ষেত্রেও কিছুদুর পড়ার পরে খুবই প্রেডিক্টেবল একটা সমাপ্তির আশংকায় পাতা উল্টে দেখে নেই শেষটুকু। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মিলে যায়, তাই পড়ার বাকি এক্সারসাইজ ক্লান্তিকর লাগে।
হুমায়ুন আহমেদ পেলে পড়ে ফেলি আজও।
কর্মক্ষেত্রের সাথে সম্পর্কিত বই পড়া হয় খুবই কম। ক্বচিৎ কদাচিত দু’ একটা বইয়ের শিরোনাম রকমারীতে দেখে কয়েক পাতা পড়ে ইন্টারেস্টিং মনে হলে অর্ডার করি। অভিজ্ঞতা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই খুব সুখকর নয়।
এই প্রেক্ষাপটেই ঠিক কিভাবে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়ের ঢাউস দুই দুই খানা বই পড়ে ফেললাম, তাও গল্প উপন্যাস নয়, বরং বায়োফিকশন আর বিজনেস ফিকশনের মত অশ্রুতপূর্ব জনরার- সেটা নিজের কাছে একটা রহস্যের মতই লাগে!

একটু পেছন থেকে আসি।
ঠিক কিভাবে আমি চমক হাসানের রিভিউটা খুঁজে পেয়েছিলাম আজ আর মনে নেই। একেবারেই উদ্দেশ্যহীন ফেসবুক স্ক্রলিং করতে করতে, চমৎকার রিভিউটা পড়লাম। বইটা নামহীন, দাম পাঠকের বিবেচনা নির্ভর, কোন বুকশপ বা অনলাইনে পাওয়া যাবে না, পেতে হলে লেখককে ইমেইল করে জানাতে হবে- কেন বইটা পড়তে চাই!
রিভিউ আর বই হাতে পাওয়ার এতসব বেড়াজাল মিলিয়ে, বেশ আগ্রহ জাগানিয়া একটা প্যাকেজ। চট করে ছোট্ট একটা ইমেইল পাঠিয়ে দিলাম, উত্তরও চলে আসলো বেশ দ্রুতই। বই পাঠাতে হলে বিবেচনামত কিছু টাকা বিকাশ করে দিতে হবে একটা বিশেষ ঠিকানায়- আর সে ইন্টারভিউ নিতে চায়! আমার ইন্টারভিউ? এটা কি বই পাওয়ার শর্ত নাকি? না, ঠিক শর্ত নয়, তবে ইন্টারভিউ নেয়াটা তার হবি, তাই…
হিমালয়ের সাথে পরিচয়ের সেই শুরু।

ঢাউস নামহীন বই যেদিন হাতে পেলাম, সেদিন নিজের বিবেচনাবোধের সীমাবদ্ধতায় লজ্জায় পড়ে গেলাম। বইয়ের যে সাইজ, তাতে নিছক ছাপানোর খরচটুকুও আমার পাঠানো টাকায় কভার করবে না। যা হোক, লাজ লজ্জা একপাশে রেখে পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে প্রায় পুরোটা পড়েই ফেললাম। আমার মত গড়পরতা মানের পাঠকের জন্য একেবারেই নতুন ধরণের বই। জীবনে এমন বই কখনো পড়িনি এবং কখনো পড়ার সম্ভাবনাও খুব একটা দেখিনা।
ইন্টারভিউটা তখনও হয়নি- কিন্তু প্রবল আগ্রহ তৈরী হলো হিমালয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার।
বায়োফিকশন- যেমনটা বইয়ের সম্পর্কে বলা হয়েছিলো, তা একরকম লেখকের আত্নজীবনীই বলা যায়, তার সাথে কল্পনার মিশেল। চরিত্ররা সব বাস্তব জীবনে ঘুরে বেড়ানো তার চেনাজন, এটা মাথায় রাখলে কল্পনার একটা নতুন মাত্রা তৈরী হয়, এবং প্রবল কৌতুহল- আ্চ্ছা, এর পরে কী?
একেবারেই অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
তারপর তার সাথে পরিচয়, তার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আমাদের বিজনেস এবং এইচ আর এর উপরে একটা কম্প্রিহেনসিভ রিপোর্ট- সে আরেক লম্বা আখ্যান। পরিচয়, এবং কাজের মাঝে দরকারী অদরকারী কথোপকথনের সুত্রে জেনেছিলাম সে আরেকটা বই লিখছে, যেটাকে বিজনেস ফিকশন বলা যায়। প্রচলিত বিজনেস সংক্রান্ত বইয়ের কাঠামো প্রায়শই কেসস্টাডি আর তার থেকে তুলে নিয়ে আসা সফল বিজনেসের ৭টি দাওয়াই – এ ঘরানার। তার বইয়ের যেটুকু শুনলাম, তাতে মনের মাঝে প্রত্যাশা তৈরী হয়েছিলো যে এটা ঠিক তেমনটি হবে না!
নামহীন বইয়ের আর্থিক মূল্য (ছাপানোর খরচটুকু) পরে একরকম শোধ করা গেলেও, আত্নিকমূল্য আজও অপরিশোধিত রয়ে গেছে, সম্ভবত আজীবনই সেভাবে থাকবে।
সুতরাং রকমারী থেকে “হিউম্যান ল্যাব (মৌন মানুষ মানসে)” নামে বইটা যখন হাতে পেলাম, মোটামুটি খাওয়া নাওয়া পাশে রেখে পড়তে শুরু করেছিলাম!

বই শেষ করে, বা শেষের দিকে আসতে আসতে আরেকবার সেই চেনা অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা- এমন বই আগে কখনও পড়িনি। ভালো বা মন্দ- সেটা রিলেটিভ টার্ম, কিন্তু “হিউমারমিশ্রিত বিজনেস ফিকশন”- এটা বাংলা ভাষায় সোনারপাথরবাটির মত দূর্লভ, অন্ততঃ আমি দেখিনি বা জানিনা।
—-
এবার বইটা নিয়ে কিছু অবজার্ভেশন, অবশ্যই নির্মোহ নয় বরং প্রবলভাবে বায়াসড।
বায়াসড আমার চিন্তা-চেতনা-পেশা-অভিজ্ঞতা দিয়ে, বায়াসড, যেহেতু লেখক আমার চেনা এবং আমি তার মৌলিকত্বে মুগ্ধ এবং প্রভাবিত, এবং বইটা আমাকে একটা চিন্তার ঘুর্ণিপাকে ফেলে নাকানি চুবানি খাইয়েছে।
বইটার প্রচ্ছদ, অংগসজ্জা, ছাপা এবং সামগ্রিক উপস্হাপনা আকর্ষণীয়। গাঢ় হলুদ ব্যাকগ্রাউন্ডে সিলু্য়েট একটা পাখি শেকল মুখে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে- চাইলে চিন্তা করার অবকাশ আছে, ভাবনার খোরাক আছে। নামের ব্যাপারে আপত্তি আগে থেকেই ছিলো, এখনো আছে- তা হলো শুধু নাম শুনে বোঝার উপায় নেই ঠিক কি বিষয় নিয়ে বইটা। তবে সম্ভবতঃ এটাই আজকালকার চল, নাম শুনে যদি বুঝে ফেলা যায় অনেকটুকু, তাহলে হয়ত কিছুটা আকর্ষণ হারায় বৈকি!
বইয়ের ভেতরের কনটেন্ট নিয়ে কিছু বলাটা কঠিন, আসলেই কঠিন। এই বই কোন ম্যাজিক বুলেট সলিউশন দেয় না, কোন কেসস্টাডি থেকে সফলতার সরল সুত্র উপস্হাপন করে না, বরং সফলতা বলতে কি বোঝায় তা নিয়ে তুমুল তর্ক জুড়ে দেয় বইয়ের চরিত্ররা (সফলতা মিথ)- এমন বই পড়ে আর যাই হোক আরাম নেই।
তবে, কেউ যদি আগ্রহী হয় ব্যবসায় চিন্তার বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে, বিজনেস ফিলোসফি নামক আপাত অবোধ্য শব্দের আড়ালে একটা গভীরতর চিন্তাসূত্রের নাগাল বই্য়ে পাওয়া সম্ভব, হয়তো ছিলোও- যার খানিকটা একজন চল্লিশোর্ধ গড়পরতা মেধার বাইচান্স ব্যবসায়ী কাম প্রফেশনালের মাথার প্রচলিত চিন্তাসুত্রগুলো সাফল্যের সাথে এলোমেলো করে দিতে পেরেছে।
—–
বইয়ের “পাসপোর্ট-ভিসা” থেকে খানিকটা উদ্ধৃতি দেয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা…
“জাগতিক পৃথিবীতে অনিশ্চয়তাকে ভয় পায় মানুষ, আমার কাছে অনিশ্চয়তাই অস্তিত্বের সৌন্দর্যময়তা। বর্তমান বইটাকে বলা চলে নামহীন বইয়ের পরবর্তী গন্তব্য বা সিক্যুয়েল। তবে পার্থক্য হলো নামহীন বই ছিল আমার বায়োফিকশন, যেখানকার প্রতিটি ঘটনাই বাস্তব জীবন থেকে উৎসারিত, সিক্যুয়েল বইয়ের সমগ্রটাই কল্পনাশ্রিত।…..চরিত্র নির্মাণ, বিকাশ কিংবা মোচড়ে অনাবশ্যক বাক্য খরচের বাহুল্য পরিহার করে এই বইয়ের প্রধান প্রতিপাদ্য কিংবা কুশীলব তাই ‘দৃষ্টিভঙ্গি’।”
চিন্তার জট খোলার চাইতে যে বই আরো পাকিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আগায়, প্রচলিত প্রায় তর্কাতীত ভাবনাগুলোকেও প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়- অগণিত ফেসবুক এডিক্ট চিন্তা-হেটার্সদের ভীড়ে এ বইয়ের ব্যবসা-সম্ভাবনা শুন্যের কোঠায়, অজনপ্রিয় হওয়াই তার নিশ্চিত গন্তব্য।
তবে, সে অজনপ্রিয়তা বোধকরি খানিকটা গৌরবেরই!