বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকা বা ভিলেনদের বিষয়ে কেন লিখি, এ প্রশ্ন পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ— উভয়গোষ্ঠীর কাছেই নিয়মিত শুনতে হয়। ক্রিকেটারদের মনোজগত নিয়ে যদি লিখতে পারি বাংলা সিনেমার অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে লিখতে সমস্যা কোথায়, এটাই প্রতিপ্রশ্ন হওয়া উচিত, কিন্তু কখনোই হয় না।

কারণ, তাদের মতো আমিও বাংলা সিনেমার অভিনয় আর্টিস্টদের বিষয়ে লেখার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ, কৌতুক এবং হাস্যরস বোধ করি। তবু নিজের কল্পনাশক্তি বিকাশে বাংলা সিনেমার প্রতি চিরঋণ অনুভব করি।

যেহেতু বাংলা সিনেমার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক, যারা প্রচণ্ড আবেগ এবং আগ্রহ সহকারে বাংলা সিনেমা দেখে, আমার লেখালিখিতে তাদের দর্শকানুভূতি আহত হয় অনেক সময়।

সেটা কতখানি শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে; যা পড়লে বাংলা সিনেমার পাড়ভক্তদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে এরকম লেখার দরকারটা কী?

প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বিষয়েই কিছু মানুষ আগ্রহ এবং কিছু মানুষ নিগ্রহ বোধ করে। কেউ অনাগ্রহের বিষয়ে লিখলে সেই বিষয়ের আগ্রহীরা আহত হতে পারে। এমনকি পর্ণ সিনেমার বিপক্ষে লিখলেও পর্ণাসক্তদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়, সামাজিক ইমেজের কারণে প্রকাশ থেকে বিরত থাকে।

সুতরাং আরেকজন আহত হতে পারে সেই ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকলে কারো পক্ষেই লেখালিখি সম্ভব হতো না, বরং এটা পাঠকের দায়িত্ব সে কী পড়ে হজম করতে পারবে, কোনটা পারবে না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া।

যে কোনো কমার্শিয়াল সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে হিউমার, উইট এবং কমেডির প্রতি বাড়তি ঝোঁক কাজ করে আমার৷ কিন্তু সিনেমার কমেডিগুলো দেখলেই বোঝা যায় হাসানোর চেষ্টা করছে, যে কারণে হাসি আসে কদাচিত।

যখনই হাসতে ইচ্ছা করে বিগত ১৭-১৮ বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট কাজই করে আসছি, খুঁজে খুঁজে জসিমের সিনেমা দেখি; প্রচণ্ড হাসতে থাকি, মাথা ফ্রেশ হয়ে যায়। যে কোনো দেশের/ভাষার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি মিলিয়ে আমার চোখে শ্রেষ্ঠতম কমেডিয়ান জসিম, যদিও বাংলা সিনেমার দর্শকেরা তাকে ভিলেন অথবা নায়ক হিসেবে মহিমাণ্বিত করে থাকে।

জসিম কারো মতো নয়, কেউ হতে পারেনি জসিমের মতো। এমনই অতুলনীয় তার কমেডি প্রতিভা। বাংলা সিনেমার পরিচালকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা কখনোই শেষ করা যাবে না একারণে যে, তারা জসিমকে নায়ক বা ভিলেন হিসেবে কাস্ট করেছেন সবসময়।

জসিমকে বিরল প্রতিভার কমেডিয়ান বলার বিপত্তিও এখানেই।সিনেমার রেসিপিতে নায়ক এবং ভিলেন মূখ্য উপকরণ, কমেডিয়ানের জায়গা ভাঁড়ামির জন্য নির্ধারিত এবং কমেডিয়ান বললে যেখানে দিলদার, আফজাল শরীফ, কাবিলা, হারুন কিসিঞ্জার, কালা আজিজদের নাম চলে আসে, সেখানে জসিম নামটা যুক্ত করা বাংলা সিনেমাপ্রেমিদের বিরক্তির এবং বিক্ষোভের উদ্রেক ঘটাবে।

দিলদার বা আফজাল শরীফ নিখাদ ভাড়, তাদের ভাড়ামো দেখে হলের সুনির্দিষ্ট শ্রেণির দর্শকরা শিটি বাজালেও আমি কখনো হাসতে পারিনি, বরং ডিভিডি বা ইউটিউবে সিনেমা দেখাকালে বরাবরই দিলদার- আফজাল শরীফদের অংশগুলো ফাস্ট ফরোয়ার্ড করেছি। সার্কাসের জোকার বা বামুনদের সাথে বাংলা সিনেমার ভাড়দের চরিত্র এবং প্রকৃতিগত সাদৃশ্য পাই খুব।

জসিমের কমেডির প্রধান শক্তিমত্তা সে কখনোই জেনে-বুঝে কমেডি করেনি, সিনেমার লিড রোলে অভিনয় করা হেতু সিরিয়াস দৃশ্যে অভিনয় করেছে, এবং একশন-রোমান্টিক-দুঃখাতুর যেরকম পরিস্থিতিই হোক, দেখে হেসেছি। একটা সিনেমায় জসিমকে যতবার স্ক্রিনে দেখায়, ততবারই কমেডি দেখতে পাই। কোনো কারণে মন বিক্ষিপ্ত, কিছুক্ষণ জসিমের সিনেমা দেখে নিই, তাজা চায়ের কাজ করে দেয়।

এটা সম্ভবত সিনেমার ইতিহাসেই অশ্রুতপূর্ব ঘটনা যে, একজন নায়ক সর্বক্ষেত্রে কমেডিয়ান হয়ে থাকছে।

‘জসিম কমেডি শো’এর ভোক্তা হয়ে উঠার ক্ষেত্রে ক্রোনোলজিকাল একটি ধারা মেনে চলেছি সম্ভবত।

প্রাথমিক ইমপ্রেসন আসে নায়কের নাম দিয়ে। রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ, আলমগীর, ফারুক, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল নামগুলো বিশেষ ইমপ্রেসন তৈরি করেনি, বৈশিষ্ট্যহীন নাম মনে হয়েছে।

পক্ষান্তরে ইলিয়াস কাঞ্চন, মাহমুদ কলি, ওয়াসিম, আলিরাজ, সোহেল রানা নামগুলোর মধ্যে কিছু একটা ছিল যা শৈশব-কৈশোরে ভাবাতো। নামগুলো শুনলে আলিফ লায়লার ক্যারেক্টার মনে হতো৷ একজন নায়কের নাম মাহমুদ কলি হয় কীভাবে, এটাই বুঝতে পারতাম না।

বর্ণমালা শেখার সময় ৪টা বর্ণের উচ্চারণ খুবই অদ্ভুত লাগতো। ঋ (হ্রস্ব রি), ঢ় ( ঢয় শূন্য র),ংং(অনুস্বার) এবং জ ( বর্গীয়- জ); এরকম উচ্চারণের কারণে এই ৪টি বর্ণ বরাবরই কানে ভিন্ন দ্যোতনা সৃষ্টি করতো। জসিম নামটা শোনার পর থেকেই সে ইলিয়াস কাঞ্চন জাতীয় নামের শ্রেণিতে ঢুকে পড়ে।

মাহমুদ কলি বা সোহেল রানা নামগুলো কৌতূহল জাগানিয়া হলেও তাদেরকে সেই অর্থে কমেডিয়ান লাগেনি, তাদের অভিনয় আগ্রহ কিংবা হাসি কোনোটাই জাগায়নি। কিন্তু জসিম যখনই তার ট্রেডমার্ক ভয়েস আর চুলের স্টাইল নিয়ে স্ক্রিনে এসেছে, হেসে উঠেছি ( বড়ো হয়ে অবশ্য বুঝেছি যে চুলের স্টাইলের কারণে তাকে আরো বেশি কমেডিয়ান মনে হতো, আদতে সেটা উইগ বা পরচুলা)

জসিমের দশাসই শরীরের বিপরীতে কণ্ঠটা বড্ড বেমানান লাগতো, সঙ্গে শরীর যতটা মেদবহুল পা-গুলো চিকন— এই বিন্যাস একজন কমেডিয়ানের জন্য আদর্শ গড়ন। ফাইট দৃশ্যে এক ধরনের আওয়াজ করতো মুখ দিয়ে, যে কারণে জসিমের ফাইটে কখনোই টেনশন অনুভব করিনি। নাচের দৃশ্যগুলো আরো ইন্টারেস্টিং, ইউনিক সব মুদ্রার সাথে ক্যামেরায় বিশেষ লুক।

তার পোশাক নির্বাচনও ইউনিক। মাথায় কাউবয় হ্যাট, পুরুষ্ট চুরুট, ঝিলমিলে পোশাক, অদ্ভুত রঙের প্যান্ট, জামার বোতাম খোলা— যদিওবা ভক্তরা একে রাফ এন্ড টাফ বলে থাকে, আমি নির্ভেজাল বিনোদনই পেয়েছি সবসময়।

জসিমকে নিয়ে অনলাইনে ট্রল হয় প্রচুর। আমার লেখাটাও কি ট্রলিংয়ের পর্যায়ভক্ত? যারা ট্রল করে তারা কেন করে? ঠাট্টা-মশকরা করাই থাকে উদ্দেশ্য, তার সামর্থ্যকে উপহাসের দৃষ্টিতে দেখে। নায়ক বা ভিলেন নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই, বাংলা সিনেমা দেখার একমাত্র কারণ স্ট্রেস রিলিজ।এই কারণ পরিপূরণে জসিমের চাইতে উত্তমরূপে কেউ কার্যকরী হয়নি, সুতরাং ট্রলিংয়ের প্রশ্ন আসছে না, বরং আমি জসিম সংক্রান্ত একটি বিকল্প এন্টারপ্রেটেশন দেয়ার চেষ্টা করছি।ট্রল মনে হলে সেটা ভক্তদের চিন্তার দুর্বলতা।

জসিমের অঙ্গভঙ্গি, দেহসৌষ্ঠব, চেহারা সবচাইতে মানানসই হয় তামিল এবং তেলেগু সিনেমার জন্য। তেলেগু কোনো পরিচালকের নজরে পড়লে জসিম ওই ইন্ডাস্ট্রির কিংবদন্তী হতে পারতেন।

বাংলা সিনেমাতেও তাকে কিংবদন্তী বলে থাকে অনেকে, বিশেষত একশন হিরো হিসেবে তাকে পায়োনিয়ার ধরা হয়।

তবু জসিমকে দেখলেই হাসি আসার আরেকটা গুরুতর কারণ তার রূপায়িত চরিত্রের নাম। গোঁফওয়ালা নাদুসনুদুস চেহারার একজন মানুষের নাম রাজু হলে বেখাপ্পা লাগে। মিনা কার্টুনে রাজু চরিত্রটি যে ইমেজ তৈরি করেছিল শিশুমনে, তার সাথে রাজু হিসেবে জসিমের যে ইমেজ তা সরাসরি সাংঘর্ষিক। জসিম আর কার্টুনচরিত্র— রাজু হিসেবে কাকে যথার্থ মনে হচ্ছে সেই প্রশ্নে কখনোই জসিমের অনুকূলে মত দিতে পারেনি।

তবু একজন ব্যক্তিকে দেখলেই হেসে ফেলা, এটা নিশ্চয়ই তার জন্য অস্বস্তিকর।

স্ক্রিনে দেখা আর সামনাসামনি দেখার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য বিস্তর।আমরা যখন কাউকে নাগালের মধ্যে দেখি সেটা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার অংশ, পরস্পরের মধ্যে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ অনেক কিছুর বিনিময় হয়। সেই ক্ষণে কাউকে দেখে বিনা কারণে হাসা অভদ্রতা।

যখন কাউকে দেখার উদ্দেশ্যে স্ক্রিনের সামনে বসি সে একজন পেশাদার এন্টারটেইনার, যার প্রধান কাজ দর্শককে আনন্দ দেয়া। দর্শক যদি প্রতি ফ্রেমে তাকে দেখে হেসে উঠে এটা তার সার্থকতা, যদিও হাসিটা যদি উফাসার্থে হয় সেটা তাকে কিছুটা বিব্রতও করতে পারে।

বলিউডের গোবিন্দের সিনেমা দেখলেও কিছুদিন জসিম ধর্মী বিনোদন পেতাম। সেই জায়গাটা সে ধরে রাখতে পারেনি, কিছুদিনের মধ্যেই একঘেয়ে লেগেছে। কারণ হিসেবে আবিষ্কার করি, সে ডেলিবারেটলি কমেডি করার চেষ্টা করছে।

মানুষকে হাসানোটা খুবই কঠিন। হাসানোর ক্ষেত্রে কিছু প্রচলিত টেকনিক ব্যবহার করে কমেডিয়ানরা। ফেসিয়াল এক্সপ্রেসন,ননসেন্স বিহেভিয়ার, কথার উত্তরে ননসেন্স জবাব; অতি ব্যবহারে টেকনিকগুলো এতো বেশি প্রেডিক্টেবল হয়ে গেছে কমেডি ব্যাপারটার প্রতিই আগ্রহ হারিয়ে ফেলি একসময়। জসিম যেহেতু কোনো টেকনিক অনুসরণ করে না, তার সবকিছুই ন্যাচারাল কমেডি হয়ে উঠে।

কিন্তু জসিমকে নায়ক বানানো উচিত, সেই ভাবনাটা পরিচালকের মনে কেন এসেছিল, তার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আজও তৈরি করতে পারিনি।

হতে পারে নায়ক বলতে মনোজগতে যেসব বৈশিষ্ট্য কল্পনায় আসে সেই স্টেরিওটাইপ ভাঙ্গার চিন্তা থেকে জসিমকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা, কিংবা ভিলেন হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়ায় সেই জনপ্রিয়তাকে পজিটিভলি ব্যবহারের উদ্যোগ৷

কারণ যা-ই হোক, বাংলা সিনেমায় যদি একজন জসিম না আসতো, হয়তোবা কখনোই কমেডি ব্যাপারটার প্রতি কৌতূহল তৈরি হতো না আমার, হিউমারচর্চাকেও তেমন একটা আমলে নেবার প্রয়োজন বোধ করতাম না। বিশেষ করে জসিমের ফোক-ফ্যান্টাসি ধরনের সিনেমা ( যেখানে সে সাপের চরিত্রে অভিনয় করেছে) যতবার দেখি ততবারই একইরকম উদ্দীপ্ত হই।

ইরেশনাল থিংকিং বিষয়ক বই লেখা শেষ করে বর্তমানে ক্রিটিকাল থিংকিং বিষয়ে লিখবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। মধ্যবর্তী সময়টা কাটছে প্রচুর পরিমাণে তেলেগু-তামিল আর বাংলা সিনেমা দেখে। কনসেপ্ট এখান থেকেই তৈরি হবে। জসিমের একটা সিনেমা দেখলে মাথায় যে পরিমাণ চিন্তা তৈরি হয়, ১০ টা বই পড়া বা ৫ জন মানুষের ইন্টারভিউ নেয়া শেষেও তা হয়ে উঠে না।

ফলে আমার প্রজ্ঞা আর দর্শনচর্চায় জসিমকে এড়িয়ে চলাটা হয়ে উঠে না আর।