আমার বাড়ন্ত শৈশবে এবং পড়ন্ত কৈশোরে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল ১২-১৫ জন বাস্তব মানুষ, যাদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট ৪-৫ জনকে হয়তো বার্ধক্যকালেও বয়ে বেড়াতে হবে ফ্যাসিনেশন কিংবা অবসেসন আকারে কাল্পনিক চরিত্র হিসেবে।

জিয়া ভাই সেই সুনির্দিষ্ট ৪-৫ জন আজীবন চুক্তির অলিখিত মানুষের অন্যতম।

আমি কেন বই লিখি দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর ছিল না। বাংলাদেশের পাঠকরুচি এবং সাহিত্যসমাজের সাথে আমার বোধ আজীবনেও মিলবে না, লেখক হিসেবে ন্যুনতম গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের আশাও দুরাশার শ্রেষ্ঠত্ব। তবু বই লিখি মূলত ব্যক্তিজীবনে অবসেসন গড়ে উঠা বেশ কয়েকজন মানুষের প্রত্যেককে একটি করে বই উৎসর্গ করার সংকল্পে।

জিয়া ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় এসএসসি পরীক্ষার পরে। বয়সে আমার চাইতে ৮ বছরের বড়ো, মূলত নিজ আগ্রহেই তার সাথে আলাপ শুরু করেছিলাম ২০০৩ এ, পরবর্তীতে বয়সের বিভেদ তুলে তার সাথে প্রশ্নাতীত সখ্য গড়ে উঠেছিল, বুয়েটে ভর্তির পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত যোগাযোগ জারি রেখেছিলাম, এরপর সংযোগে বাহ্যিক ছেদ পড়ে।

কেন জিয়া ভাই?

জিয়া ভাইয়ের ব্যাপারে আগ্রহ জন্মে তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিভিন্ন গল্পের কারণে। নটরডেম কলেজে পড়তো, ইন্টার পরীক্ষা চলাকালে অপ্রকাশযোগ্য এক কারণে মানসিক বিপর্যয় ঘটে তার। রাস্তায় তাকে হাঁটতে দেখলেই খেয়াল করতাম নিজে নিজে কী যেন বলে, আর হাসে। নিজের সেলফ কনভারসেশনের অভ্যাস ছিল বিধায় ধরে নিয়েছিলাম স্বভাবের দিক থেকে আমরা কাছাকাছি।

জিয়া ভাইরা মোট ৪ ভাই। একই এলাকায় থাকাসূত্রে প্রত্যেককেই চিনতাম, তবে তার দুই অনুজ, পাভেল ভাই আর আপেল ভাইয়ের সাথে ক্রিকেট খেলাসূত্রে ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রথম থেকেই। নটরডেমে পড়ার কারণে জিয়া ভাইকে খুব একটা দেখিনি মানিকগঞ্জে, ইত্যবসরে আমরা বাসা বদল করে অন্য এলাকায় চলে যাই।

কয়েক বছর পর, তার মানসিক ভারসাম্য হারানোর ঘটনাটি ছোট্ট মানিকগঞ্জ শহরে যখন আলোড়ন তুলে, সেসময়ে আমি মূলত অন্য মানুষদের গল্প শোনাতেই সময় দিচ্ছিলাম, এলাকা আলাদা হওয়ায় তাকে সাময়িক বিস্মৃত হই। ভাড়া বাসা ছেড়ে নিজেরা বাড়ি করে যতদিনে পুরনো এলাকায় ফিরে এসেছি পাকাপাকিভাবে, ততদিনে ক্লাস টেনে পড়ি, এবং মহল্লার মানুষের কাছে জিয়া ভাইয়ের পরিচয় ‘পাগল’।

‘পাগল’ শব্দটার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলাম, কারণ বিচিত্র কাজ-কর্মের কারণে পরিচিত-অপরিচিত বহু মানুষই পাগল বলতো আমায়, এবং সংখ্যাটা গুনে রাখতাম। সেখান থেকে নৈকট্য বোধ করি তার প্রতি। শুধু জিয়া ভাই নয়, একই এলাকার বিপ্লব নামের এক বয়স্ক লোক, শোভা নামের এক উলঙ্গ বদ্ধ পাগল, কোর্ট প্রাঙ্গনে ঘোরা আরেক নারী পাগল যার কপালে সিদুর থাকতো সবসময়, এরশাদ নামের জনৈক মেকানিক– এরা প্রত্যেকেই ছিল আমার গবেষণার চরিত্র।

তবে জিয়া ভাইয়ের সাথে বাকিদের সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। তার চেতনা সম্পূর্ণরূপে কাজ করতো, কী বলছে, কাকে বলছে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ থাকতো, সুতরাং তাকে পাগল বলাটা যে অনর্থক সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। বরং প্রতিভাবানরা কিছুটা পাগল প্রকৃতির হয় এটাই ধরে নিয়েছিলাম।

এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে জিয়া ভাইয়ের সাথে নিয়মিত গল্প করা শুরু করি। পরীক্ষার কারণে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিয়েছি, পরীক্ষার পরও খেলা আর আগের মতো টানে না, বরং বিকালের সময়টা মানুষের গল্প শোনা আর ডায়রিতে পরিচিত-অপরিচিত মানুষের মন্তব্য সংগ্রহের কাজে বেশি মজা পেতে থাকি।

গল্পসূত্রে জানি, জিয়া ভাইয়ের সমস্যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে সিজোফ্রেনিয়া। কিন্তু তার দাবি সে সিজোফ্রেনিক নয়। তার সাথে গল্প করতে গেলে এমন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতাম যেটা সেসময়ে অন্যদের সাথে আলাপে একেবারেই হতো না। নিজের কল্পনাশক্তির প্রতি আস্থা ছিল, জিয়া ভাইয়ের কল্পনাশীলতায় বোকা হয়ে যেতাম।

কয়েকটা সুনির্দিষ্ট ঘটনা বলি।

ঘটনা১- শহরে অনেক দুর্গন্ধ আর আবর্জনা। সে একটা যন্ত্র আবিষ্কার করবে যেটা টয়লেটের লাইনের সাথে যুক্ত করে দিলে গোলাপের সুগন্ধ তৈরি হবে, এরপর সে নিজে একটা প্লেন ভাড়া নিয়ে সারা শহরে উপর থেকে পাইপ দিয়ে পারফিউম ছাড়বে বৃষ্টির মতো করে।

ঘটনা ২- তার বাসার সাথেই গার্লস স্কুল। রাস্তা দিয়ে ট্রাক চলে। সে রাস্তার মধ্যে একটা যন্ত্র বসাবে যেটা ট্রাকের হর্ন শোনামাত্র স্পাইকে রূপান্তরিত হয়ে টায়ার পাঞ্চার করে দেবে।

আমাদের কৈশোরে একটা বিশেষ ভিডিও গেম জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিল, একে মুস্তাফা নামেই চিনতো সবাই। ১ টাকায় ১ বার খেলার সুযোগ পাওয়া যেত, সাধারণত ১ম বা ২য় লেভেলেই এমেচার খেলোয়াড়রা কুপোকাত হয়ে যেত, দোকানীদের রমরমা ব্যবসা চলতো। জিয়া ভাই নিজেকে মুস্তাফা গেমস এ ইউনিভার্সের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় ঘোষণা করেছিল। সেই গেমসটাতে ৪ টি ক্যারেক্টার ছিল ( মুস্তাফা, জ্যাক, ম্যাস, হেনা), সাধারণত বেশিরভাগ ছেলেই মুস্তাফা নিয়ে খেলতো। কিন্তু জিয়া ভাই যে কোনো ক্যারেক্টার নিয়ে মাত্র প্রথমবারেই গেম ওভার করে দিত (আরো অনেকেই ছিল এমন, তবু সে নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলতো)৷ সে দোকানে যাওয়া মানে দোকানীদের বিরাট লোকসান, যে কারণে তাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে দোকানীরা সাধারণত খেলার সুযোগ দিতো না।

জিয়া ভাইয়ের সাথে গল্পের আগে আমার কাছে অঞ্জন দত্ত মানে ছিল শুধু ‘ বেলা বোস’, কিন্তু তার মুখে ‘মেরিয়েন’, ‘জেরিমির বেহালা’, ‘মালা’ সহ আরো অসংখ্য লিরিকে আবিষ্কার করি অঞ্জনকে। নিজেকে সে অঞ্জন দত্ত দাবি করতে থাকে, গিটার নিলে তাকে নাকি অঞ্জন দত্তের থেকে আলাদা করা যাবে না, তার কিছু ফ্যানও নাকি আছে। ইতোপূর্বে ইংরেজি গান শোনাই হয়নি, তার মুখে ব্রায়ান এডামসের নাম শুনি, কয়েকটা গানের সাথেও পরিচিত হই।

এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে তার ট্রিটমেন্ট চলতো, ডাক্তারের প্রতি অন্তহীন অভিযোগ তার। সে বলতো, ‘সে যেসব ওষুধ দেয় ওগুলো খেলে সুস্থ্য মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমার নিয়মিত হ্যালুসিনেশন হয়, কখনো জেসাস কখনো বুদ্ধ আমার পাশে এসে বসে থাকে’।

সে খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে গল্প বলতে পারতো। একদিন একটা শো-পিস দেখিয়ে বলে, ‘বুঝলা হিমেল, অপি করিম এসেছিল গাড়ি নিয়ে, এই গিফটটা দিয়ে গেল। আমি যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল’।

জিয়া ভাইয়ের সাথে ঘোরাঘুরির কারণে আমি নিজেও মাঝেমধ্যে নাজেহাল হয়েছি।

১. হাঁটতে হাঁটতে আমরা এক আংকেলের বাসার দরজায় গিয়ে থামি, তার ছেলে জিয়া ভাইয়ের বড়ো ভাইয়ের বন্ধু। সে আন্টিকে বলে সেমাই খাবে, আন্টি তাকে কাটানোর চেষ্টা করে। আন্টির মেয়ে আমার বড়ো আপার পরিচিত ছিল, আমাকে দেখে সে আৎকে উঠে বলে- ‘ভাইয়া তুমি উনার সাথে বেশি মিশো না, উনি কিন্তু ম্যাড’। কথাটা জিয়া ভাইয়ের খুব গায়ে লাগে, সে দ্রুত রাস্তায় নেমে পড়ে। সমস্ত দুনিয়ার প্রতি তার রাগ ঝারতে ঝারতে আন্টির উপর গিয়ে পড়ে- ‘ আজ আমি যদি নটরডেম থেকে পাশ করে বুয়েটে ভর্তি হতাম, আন্টি নিজেই আমারে দাওয়াত করে খাওয়াইতো, মেয়ের বিয়ে দিতে চাইতো। উনার নিজের ছেলে সারাদিন গাঁজা খেয়ে টাল হয়ে থাকে, উনার মেয়ে একটা ছেলের সাথে গোপনে সেক্স করে, অথচ উনি আমারে সেমাই খাইতে দিলো না। হিমেল তুমি কিন্তু বুয়েটে ঢুইকো, ২ লাখ টাকা স্যালারির চাকরি করবা, তারপর আমারে নিয়ে এই আন্টির বাসায় দাওয়াত খাইতে যাইবা’

২. জিয়া ভাইরা বাড়িতে গরু পালতো, মহল্লার অনেক বাসাতেই দিন চুক্তিতে দুধ দিত। রাখাল ছুটিতে থাকলে মাঝেমাঝে জিয়া ভাই নিজেই দুধ দিতে যেত বাড়িবাড়ি, কয়েকদিন আমিও গিয়েছি তার সাথে। একবার এক বাসায় গিয়ে দেখি সে বাসার আন্টি মাটির চুলায় রান্না করছে, জিয়া ভাই তার কাছে ডিম পোজ খাওয়ার আবদার ধরে, আন্টি বলে পাগলামি বাদ দাও। সে ক্ষিপ্ত হয়ে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করে- do you think i am a mere cow boy, who do think you are. You are nothing but a shitty housewife; আন্টি স্বল্পশিক্ষিত মানুষ, তার উপরে জিয়া ভাইয়ের আচরণে হতভম্ব হয়ে সে আমাকে বলে তাকে শান্ত করতে, এতে তার রাগ আরো বেড়ে যায়, সে আমাকে দেখিয়ে বলে – do you know how meritorious is this lad, you think him a cow boy also, shame on you’

৩. বর্ষার পানি এসেছে এলাকায়। জিয়া ভাইয়ের সাথে গল্প করছি, অদূরে মহল্লার এক আন্টি এক কিশোরকে নিয়ে নৌকায় করে পানি থেকে শাপলা তুলছিলেন। আন্টি ম্যাজিস্ট্রেট। জিয়া ভাই সেই কিশোরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে, আন্টি বিস্মিত হয়ে নৌকা নিয়ে আমাদের কাছে এসে বকাবকির কারণ জানতে চান। কিশোরের থেকে নজর সরিয়ে জিয়া ভাই সেই আন্টির প্রতি ক্ষিপ্ত হয়- you cant kill beauty; এরকম অদ্ভুত কথা আন্টি হয়তো কখনোই শুনেনি। সে নিজের পরিচয় দিলে জিয়া ভাই আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ে- আপনার মতো ম্যাজিস্ট্রেট পকেটে নিয়ে ঘুরি, ডু ইউ নো মি? আই এম স্ট্যানলি পিউস

জিয়া ভাইয়ের সাথে গল্প করতে করতে পরিসংখ্যান বিষয়টার প্রতি অদ্ভুত ভালো লাগা তৈরি হয়ে যায় আমার। মেন্টাল ডিসঅর্ডার চলছে, তবু সে তাস, লাল বল- নীল বল দিয়ে প্রোবাবিলিটিকে দারুণভাবে ব্যাখ্যা করতে থাকে, ক্রিকেট খেলায় জীবনভর কয়েন টস করতে দেখলেও হেড-টেইল এর মধ্যেও যে প্রোবাবিলিটি লুকিয়ে আছে তার আগে কেউ কখনো বলেইনি আমায়। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি ইন্টারে পরিসংখ্যান অবশ্যই নিতে হবে। আম্মু যে আমাকে মেডিকেলে পড়াতে চায় সেটা তার জানা ছিল, সে জানালো পরিসংখ্যান নিলে বায়োলজি বাদ দিতে হবে। বায়োলজি কখনোই পছন্দের বিষয় ছিল না; পরাগায়ন, নিষেক প্রভৃতি শব্দ পড়তে গেলেই রীতিমত লজ্জা পেতাম, তবু কেবলমাত্র আন্মুর চাপাচাপিতে বায়োলজি বাদ দেয়ার সাহস পেতাম না। কিন্তু জিয়া ভাইয়ের মুখে প্রোবাবিলিটির গল্প শুনে চরমতম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি মুহূর্তের মধ্যেই; ইন্টারে বায়োলজি বাদ দিবো। বড়ো আপা শুরুতে আপত্তি জানায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্নেহশক্তির কাছে হেরে গিয়ে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। কিন্তু আম্মু সেটা আজও মানতে পারেনি, এখন যখন আমি সুনির্দিষ্ট চাকরি-পেশা ছাড়া অনিশ্চিত জীবন কাটাই সেই সিদ্ধান্তের জন্য এখনো আমাকে তিরস্কার করে। জিয়া ভাইয়ের মুখে শোনা সেই প্রোবাবিলিটি নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করা হয়নি আর, কিন্তু ইচ্ছেটা এখনো সতেজ।

জিয়া ভাই কবিতা লেখার চেষ্টা করতো। মাঝে-মধ্যে নিজের লেখা ২-১টা লাইন পড়ে শোনাতো, তারপর বলতো মাইকেল মধুসূদন ছাড়া আর কারো পক্ষে এরকম লাইন লেখা সম্ভব না।

পরের ঘটনাটা আরো ভাবনাদার।

আমি সন্ধ্যার পরে খুব একটা বাসার বাইরে থাকতাম না। একদিন জিয়া ভাইয়ের সাথে গল্প করতে করতে রাত ৯টা বেজে গেছে, বাসায় টেনশন চলছে; বন্ধুদের যাদের বাসায় টেলিফোন ছিল প্রত্যেকের সাথে যোগাযোগ করেছে আম্মু আর রুমেল, কেউ খবর দিতে পারছে না। আমাকে কেউ কিডনাপ করলো কিনা সেই আশংকা পেয়ে বসে। আম্মু দিশেহারা হয়ে রুমেলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়, দেখে মাঠে বসে গল্প করছি জিয়া ভাইয়ের সাথে। আমার সমগ্র জীবনে মাত্র ২-৩ বার আম্মু কর্কশ ভাষায় শাসন করেছে, সেদিন বাসায় ফেরার পরের শাসন তার মধ্যে একটা। বড়ো আপা তখন ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে, থাকে হলে, সেও খুব বকেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না এতো ভয়ানক প্রতিক্রিয়ার কারণ কী, এবং এই বোঝার অক্ষমতার কারণে বকার পরিমাণ আরো বেড়েছিল৷

বুয়েটে পড়াকালে জিয়া ভাইয়ের সঙ্গে একদিন আচমকা দেখা হয়ে যায় বুয়েট শহীদ মিনারে। ভার্সিটির ৬ বছর প্রায় প্রতিটি বিকেলই আমি শহীদ মিনারে কাটিয়েছি। জিয়া ভাইয়ের এক বন্ধু প্রাক্তন বুয়েটিয়ান, দুজনে ঘুরতে এসেছে। কিন্তু আগের জিয়া ভাই অনেকটাই মিসিং, সম্ভবত সে মানসিক সুস্থিতি ফিরে পাচ্ছিল ধীরে ধীরে। ওই জিয়া ভাইয়ের মাঝে কৈশোরের সেই চার্ম পাচ্ছিলাম না মোটেই, যে কারণে আলোচনার দৈর্ঘ্য বাড়তে পারে না।

জিয়া ভাইয়ের প্রতি বহু কারণেই কৃতজ্ঞ আমি। কিন্তু একটি কারণকেও যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে সিদ্ধ করা সম্ভব হবে না।

তবে

১৬-১৭ বছর পরে এখন যখন হিউম্যান ল্যাব নিয়ে কাজ করি, মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়া পর্যালোচনা করতে যাই জিয়া ভাইয়ের সেইসব হ্যালুসিনেশনের প্রভাব টের পাই, কিংবা টানা ৭-৮ ঘন্টা যখন একই মানুষের ইন্টারভিউ নিই, সময়ের কাছে সম্মোহিত হয়ে পড়ি, তার পেছনেও জিয়া ভাইয়ের কল্পনাশীলতার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার কোনো প্রভাব থাকতে পারে। জানি না, জীবন আমাকে কোথায় ঠাঁই দিবে, বা আদৌ কোথাও টিকতে পারবো কিনা, তবু মানুষ নিয়ে গবেষণার যে দীর্ঘ জার্নি, তার একদম শুরুর দিকে জিয়া ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া সাহচর্য একই বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ৪-৫টি পারসপেক্টিভ তৈরির ক্ষমতা বিকশিত করতে সহায়তা করেছে আমায়।

এই অবদান অস্বীকার করা যায় কি আদৌ?

সর্বশেষ ৫-৬ বছরে জিয়া ভাইয়ের সাথে দেখা বা কথা হয়নি সেভাবে, যদিও তার ঠিকানা অপরিবর্তিতই রয়েছে এখনো। আমারই অভ্যাস বদলে গেছে। মানিকগঞ্জে গেলে ঘর থেকেই বের হওয়া পড়ে না৷

তবে

জিয়া ভাইয়ের সংবাদ জানি। শুনেছি সে সম্পূর্ণ সুস্থ্য এখন, সংসার করছে। এরকম মানুষ তো প্রতিনিয়তই দেখছি কত, ফলে বর্তমানের জিয়া ভাইয়ের প্রতি আগ্রহ ধরে রাখা কঠিন হবে হয়তো। তার সাথে দেখা করতে আগ্রহহীনতার এটাও একটা শক্ত কারণ হতে পারে। ১৬-১৭ বছর আগের যে ইমেজ মননে গেঁথে আছে, সেটাকে বর্তমান দিয়ে রিপ্লেস না- ই বা করলাম।

বরং ১২ তম বইটা তাকে উৎসর্গ করলে সেখানে কী লিখবো আর বইটা কীভাবে পাঠাবো সেইসব কল্পনাই অধিক মানসম্মত মনে হচ্ছে। কিন্তু জিয়া ভাইয়ের কথাও তো আমি রাখতে পারিনি। বুয়েটে পড়েছি, তবে তার কথামতো ২ লাখ টাকার চাকরি পাইনি, সেই আন্টিও চলে গেছেন প্যারালেল ইউনিভার্সে। জিয়া ভাই যদি এতোদিন পরে কৈফিয়ত চেয়ে বসতো!

তার চাইতে সে মনোযোগ দিয়ে সংসার সামলাতে থাকুক। আমি মাত্র ৭ নম্বর বইটা লিখছি, ১২ নম্বরটা আসতে আরো ৫ টা বই বাকি; ওদিকে ১৮ আর ১৯ তম বই কাকে উৎসর্গ করবো তাও চূড়ান্ত করা শেষ। এতো বই লিখবো কখন, জিয়া ভাই বলতে পারেন? আপনার প্রোবাবিলিট সূত্র কী বলছে, সময় পাবো তো, জীবিকাহীন জীবন আমাকে টিকতে দিবে তো?

আরে মিয়া কথা কন না ক্যান; who do you think you are?