বাংলাদেশে যারা সাহিত্য সমালোচক এবং পাঠক তাদের কলমের কালিতে এবং মুখের ভাষায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একজন কালোত্তীর্ণ লেখক, কেউ কেউ মনে করেন তিনি ইউরোপে জন্ম নিলে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হতেন।

৫৪ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে তিনি ২টি উপন্যাস, ২৮টি গল্প, একটি প্রবন্ধ সংকলন এবং বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কবিতা লিখেছেন। অনেক সমালোচক তাকে বিশ্লেষণকালে ‘২৪ ঘন্টার লেখক’ বিশেষণে বিশেষায়িত করেন।

কবিতা বাদে ইলিয়াসের যা রচনাসম্ভার সবকটিই পড়ার সুযোগ ঘটেছে আমার, পাঠশেষে আমার উপলব্ধি হলো ইলিয়াস একজন আটপৌরে চিন্তাচেতনার লেখক, সমকালীন অধিকাংশ লেখকের মতোই তার পর্যবেক্ষণ এবং চিন্তাপ্রক্রিয়া। ‘মনোরম মনোটোনাস’ শব্দবন্ধের ব্যবহার বাদে ইলিয়াসকে লেখালিখির কোনো পর্যায়েই স্মরণে রাখার কারণ বোধ করিনি।

আমার ইলিয়াস দর্শন তাই বিপজ্জনক এবং সাহিত্যবিশারদদের দৃষ্টিতে অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী রোগের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

আমার নামহীন বই কিছুদূর পড়ার পরই ছুঁড়ে ফেলেছেন এমন পাঠকেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, দুজন বিদগ্ধ পাঠক মন্তব্য করেছেন আমার সাহিত্যরুচিতে যথেষ্ট ঘাটতি আছে বা তৈরি হয়নি, সাফির আব্দুল্লাহ নামের এক প্রাক্তন বুয়েটিয়ানের ভাষ্যমতে আমার ভাষাশৈলী এমেচার লেখকদের মতো, এবং আমার এক্সপেরিমেন্টাল গল্পগ্রন্থ ‘বীক্ষণ প্রান্ত’ পাঠশেষে সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের মন্তব্য ছিল আমার গল্পগুলো আদতে গল্প হয়ে উঠে না, এগুলো যে বানিয়ে লেখা বোঝা যায়।

উপরোক্ত অনুচ্ছেদটি লিখবার মূল কারণ, প্রথাগত সাহিত্যপ্রেমিরা যাতে আমার চিন্তাধারাকে নির্বিঘ্নে খারিজ করে দেয়ার পর্যাপ্ত উপকরণ পেয়ে যান। যেহেতু আমি সাহিত্য-প্রতিবন্ধী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে ধারণ এবং অনুধাবনের যোগ্যতাই তৈরি হয়নি আমার; এটাই সহজ এবং সন্তোষজনক সিদ্ধান্ত।

ইলিয়াসের লেখালিখি প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৭-১৮ বছর বয়সে, তবু তার লেখার পরিমাণ এতো কম কেন? বিদগ্ধজনেরা তাকে ‘স্বল্পপ্রজ’ লেখক অভিধায় ভূষিত করে মহিমাণ্বিত করতে চান, আবার তারাই বলেন তিনি ২৪ ঘণ্টার লেখক; দুটো বক্তব্যকে যদি সাংঘর্ষিক বলি তারা হয়তোবা বলবেন ‘আদতে তিনি লেখকের জীবন যাপন করেছেন প্রতি সেকেন্ডে, সকল অবস্থায় লেখার উপকরণ খুঁজেছেন, এটাই তার জীবনপ্রক্রিয়া। সকল উপকরণকে লেখায় তুলে আনতে হবে এই বিধান কে দিলো; কী লিখবো এর চাইতে কী একদমই লিখবো না এই নির্বাচন অধিকতর জরুরী। একারণেই এতো কম লিখে ইলিয়াস মনিমুক্তাসম রচনা যুক্ত করেছেন সাহিত্যভাণ্ডারে’। তাদের বক্তব্য আরো মজবুত হয় ইলিয়াসের ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ প্রবন্ধগ্রন্থের এক বক্তব্যে। তিনি বলেছেন- ‘ একজন লেখকের বলবার বা লিখবার খুব বেশি কিছু তো থাকতে পারে না’।

ইলিয়াস তার খোয়াবনামা উপন্যাস লিখবার জন্য বহু জায়গা চষে বেড়িয়েছেন, বিভিন্নজনের লেখাসূত্রে তা আমরা জানতে পারি। ফিল্ডওয়ার্ক বা রিসার্চ হিসেবে এটিকে মহিমাণ্বিত করা হয়। আমরা যদি, চলতি মতানুসারে, অমেধাবী কোনো লেখক, যেমন কাশেম বিন আবুবাকার, কিংবা তথাকথিত বাজারী লেখক, যেমন ইমদাদুল হক মিলনকে স্যাম্পল হিসেবে নিই, লিখবার সময় তারা কি ফিল্ডওয়ার্ক বা রিসার্চ করেন না? পৃথিবীতে এমন কোনো লেখক আছেন যার লিখতে কোনোরকম রিসার্চের প্রয়োজন পড়ে না? নাকি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুসরণে পদ্মান্দীর মাঝি লিখতে জেলেপাড়ায় গিয়ে বসবাস না করলে তাকে রিসার্চ বলা যাবে না?

আমার একটি প্রবল হাইপোথিসিস হলো, লেখালিখির জন্য বিপুল পরিমাণ স্যাক্রিফাইস না থাকলে লেখক হিসেবে আত্মশুদ্ধি আসে না।

আত্মশুদ্ধি কি খুব জরুরী বা আত্মশুদ্ধি ধারণার সংজ্ঞা কী?

যখন আপনি প্রশ্ন ভয় পাবেন না এবং হীনম্মন্যতাবোধ থেকে ক্রমাগত নিজেকে ডিফেন্ড করতে হবে না সেখান থেকেই আত্মশুদ্ধি ধারণা বিকশিত হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক যে কোনো শাখায় যারা কাজ করেন আত্মশুদ্ধি প্রশ্নে তারা কিছুটা ব্যাকফুটে থাকেন।

ইলিয়াস নিরাপদ পেশায় নিযুক্ত ছিলেন, সংসার খরচের টাকা কীভাবে কোত্থেকে আসবে— প্রায় প্রত্যেক লেখককে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যে পীড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার থেকে তিনি অনেকটাই মুক্ত ছিলেন।

পক্ষান্তরে পা হারিয়ে দীর্ঘদিন জীবনযাপনের যে মানসিক যন্ত্রণা তার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। এটাও স্যাক্রিফাইস, কিন্তু পা হারানোর সাথে লেখালিখির যেহেতু সম্পর্ক নেই, লেখার জন্য স্যাক্রিফাইস সেই অর্থে বলা যায় না।
সামাজিকতা, পারিবারিক আনন্দ প্রভৃতি স্যাক্রিফাইস করে সময়গুলো লেখালিখির পেছনে দিয়েছেন এটাও ধোপে টিকবে না, কারণ অন্য যে কোনো পেশার মানুষই গ্রোথের প্রয়োজনে এবং প্রায়োরিটি অনুসারে সময়গুলো স্যাক্রিফাইস করে থাকেন।

ইলিয়াস রাজনীতি এবং সাংগঠনিক কাজের পেছনেও প্রচুর সময় ব্যয় করেছেন। যদি ধরে নিই সেগুলোও লেখালিখির কাঁচামাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে, কাঁচামালগুলো চূড়ান্ত প্রোডাক্ট হিসেবে বাইরে এলো কই!

ইলিয়াসকে একজন এলিট মধ্যবিত্ত এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের শৌখিন বা খণ্ডকালীন লেখক বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো। তার একাডেমিক পড়াশোনা বাংলা সাহিত্য নিয়ে, ফলে একাডেমিক উদ্দেশ্যেই তাকে দেশ-বিদেশের সাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান রাখতে হয়েছে।

ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই আর খোয়াবনামা উপন্যাস, কিংবা ২৮ টি গল্পকে যদি পর্যালোচনা করি, সেখানেও প্রচুর পুনরাবৃত্তি এবং একঘেয়েমিতায় পূর্ণ। তার সাহিত্যদর্শন অতিমাত্রায় রিয়েলিস্ট ঘরানার।

নান্দনিকতা বোধ তাড়িত সমালোচকেরা তার ভাষাভঙ্গিকে বিশেষভাবে মূল্যায়িত করে থাকেন।

রিয়েলিস্ট এবং ডিটেইল ওরিয়েন্টেড সাহিত্যকে আমার রিফ্লেক্টিভ এবং রিপ্রোডাক্টিভ লাগে, ভাষাকে যোগাযোগ মাধ্যমের বাইরে অলংকার হিসেবে মানতে ঘোরতর আপত্তি রয়েছে।

সাহিত্যের ভূমিকা বা দায়িত্ব কী?

এই প্রশ্নের সার্বজনীন উত্তর হয় না, ব্যক্তিগত প্রেফারেন্সভেদে মানুষের জীবনে সাহিত্যের আবেদন বা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে সাহিত্যের চাইতে চালের দাম কতো সেই জিজ্ঞাসার আবেদন অনেক বেশি।

তবু,
আমার কাছে সাহিত্যের ভূমিকা একই বিষয় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করার প্রবণতা তৈরি এবং স্টেরিওটাইপ ভাবনার উৎস খোঁজার কৌতূহলী মানসিকতা তৈরি করায়, যাতে মানুষ খুব সহজে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়ার প্রলোভনে না পড়ে অনুসিদ্ধান্ত স্তরে পরিভ্রমণ করে। একবাক্যে বললে, সাহিত্যের ভূমিকা বিশ্বাসী নয়, সংশয়ী মানুষ তৈরি করায়। বিশ্বাস মানে জড়তা, সংশয় থেকেই উদ্ভাবন এবং ইনোভেশনের জন্ম হয়।

ইলিয়াসের ডিটেইলনির্ভর সাহিত্যে আমি কোনো সংশয় পাই না, প্রশ্ন পাই না, কেবল উত্তর আর উত্তরের ইঙ্গিত। একজন মানুষ কীভাবে জীবন কাটায়, পুরান ঢাকার বিশেষত্ব এসব তথ্যভিত্তিক লেখালিখিকে অনেকটাই প্রতিবেদন কিংবা ডকুমেন্টারির মতো লাগে, কিন্তু কেন তার জীবন এমন বা পুরান ঢাকা কেন গুরুত্বপূর্ণ তার কোনো নিশানা নেই।

বাঙালির সাহিত্য সংক্রান্ত গড় ধারণা হলো অনুভূতিকে স্পর্শ করতে হবে, প্রতিদিনকার চেনা বা দেখা ঘটনাকে কতটা নিখুঁত বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে, এবং চরিত্রের সাথে সে নিজেকে কতটা সুচারুরূপে কোরিলেট করতে পারছে সেইসকল প্যারামিটারের ব্যবহার। কিংবা ভাষা কতটা মুগ্ধতা জাগাচ্ছে তাও বিরাট প্রাধান্য পায়। বাঙালির পোশাক কেনাকাটা পর্যবেক্ষণ করলে ভাষাবিষয়ক আদিখ্যেতার উৎস অনুমান করে নেয়া যায়। আপনি যখন শার্ট বা শাড়ি কিনতে যাচ্ছেন, সেটি কতটা আরামদায়ক সেই চিন্তার পরিবর্তে পোশাকের নকশা কেমন, কোন রঙের এসবই প্রাধান্য পায়। সাহিত্যপাঠের ক্ষেত্রেও ভাষা পোশাককে প্রতিস্থাপন করে। কিংবা কোনো একটি বাক্য পড়তে ভালো লাগলে তার অর্থ হৃদয়াঙ্গম করতে না পারলেও উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করতে দ্বিধাণ্বিত হন না।

রিফ্লেক্টিভ আর রিপ্রোডাক্টিভ সাহিত্যের বাজারে ইলিয়াসও একই ধরনের সাহিত্য রচনা করে অতুলনীয় গ্রহণযোগ্যতা পেলেন কীভাবে?

এর চাইতেও জরুরী প্রশ্ন হলো, ইলিয়াসের লেখার সংখ্যা অপ্রতুল কেন?

আমার অনুসিদ্ধান্ত হলো, ইলিয়াসের আত্মপোলব্ধি ঘটেছিল, তিনি যথেষ্ট কল্পনাপ্রবণ এবং কৌতূহলী মানুষ নন, তিনি মূলত একজন ননফিকশন জনরার গবেষক, কিন্তু বাংলাদেশের মার্কেটে ননফিকশনের কদর নেই বিধায় ফিকশন চর্চা করছেন, এবং সেটা করতে গিয়েই উপলব্ধি করেছেন লিখতে পারছেন না, বা যা বলবার প্রায় সবই বলা হয়ে গেছে অন্য ভাষাভঙ্গিতে।

কম লিখলেই কোয়ালিটি সম্পন্ন লেখা এটা একধরনের বুজরুকি। নাচ বা গানের মতো লেখালিখিও একধরনের বিশেষ যোগ্যতা। বেশি নাচলে বা গাইলে কি কারো কোয়ালিটি নিম্নমুখী হয়, নাকি অনুশীলনের জন্য হলেও নাচ-গানের মধ্যে থাকতে হয়?

যিনি লিখতে পারেন তিনি যে কোনো মুহূর্তকেও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে জানেন, খুব তুচ্ছ ঘটনাকেও আকর্ষণীয় করতে জানেন, যার সে ক্ষমতা নেই আদতে লেখালিখির প্রতিভাযোগ ঘটেনি তার, হয়তোবা পড়াশোনাসূত্রে ভাষাজ্ঞান এবং সৌন্দর্যবোধ তৈরি হয়েছে।

ধরা যাক, ইলিয়াস নিজের মনমতো গল্প বা উপন্যাস লিখতে পারেননি বলে প্রকাশিত লেখার সংখ্যা কম, কিন্তু অপ্রকাশিত লেখা বা অসংখ্য ডায়েরি থাকার কথা তার লেখালিখির অনুশীলনের নিদর্শনস্বরূপ৷ এখনো পর্যন্ত তার মাত্র একটি ডায়েরি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে, এবং অপ্রকাশিত লেখাও সংখ্যায় আহামরি কিছু নয়।

সুতরাং ইলিয়াসের লেখালিখির অসাধারণ প্রতিভা ছিল তা বলা যাচ্ছে না, কিংবা চিন্তক-পর্যবেক্ষক বা দার্শনিক হিসেবে তাকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও প্রশংসনীয় কোনো অবস্থানে রাখতে পারি না, বরং একজন আত্মসচেতন মানুষ হিসেবে নিজের সীমাবদ্ধতা অনুধাবনের জন্য তাকে সাধুবাদ জানানো যায়।

চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামার পরে আরো একটি উপন্যাস লিখবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু দুরারোগ্য ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় আর পাননি।

জেমস জয়েস তার প্রিয় লেখক ছিলেন, মার্কেজও। কিছু সমালোচক তার চিলেকোঠার সেপাইকে জয়েসের ইউলিসিসের সাথে তুলনা করেন। জয়েসের ইউলিসিস বা পোরট্রেইট অব দ্য আর্টিস্ট এজ এন ইয়াং ম্যান এর মধ্যে দার্শনিকতার যে ব্যাপ্তি, বিস্তৃতি এবং গভীরতা, তার পাশে ইলিয়াসের উপন্যাসগুলোকে দুপুরের ভাতঘুমে দেখা রোমান্টিক স্বপ্নের মতো লাগে।

তবে,
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, এতো কম লিখেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এস্টাব্লিশমেন্টের স্বীকৃতি হিসেবে যে সমস্ত পুরস্কারকে মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়, তার প্রায় সবকয়টি বা অধিকাংশই পেয়ে গেছেন ইলিয়াস। স্বল্পপ্রজ প্রতিভাবান লেখকদের সাধারণ নিয়তি হলো মৃত্যুর পরে কোনো গবেষক বা সমালোচকের হাত ধরে তিনি প্রতিষ্ঠা পাবেন। ইলিয়াস নিজেকে একজন শক্তিমান লেখক জেনেই জগতান্তরিত হয়েছেন।

এটাকে তার সৌভাগ্য না বলে যোগাযোগ দক্ষতার পুরস্কার হিসেবে দেখি আমি। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়েও বাংলা ভাষার সাহিত্য মার্কেট খুবই ক্ষুদ্র। এখানকার সাহিত্য চলে লেখক কোরাম- সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদকদের মিথস্ক্রিয়া বা সিন্ডিকেট এ। সাহিত্য রাজনীতিতে প্রতিভার চাইতে যোগাযোগ দক্ষতারই কদর বেশি।

ইলিয়াসের সমসাময়িক সাহিত্যকারীদের বেশিরভাগই হয় তার বন্ধুস্থানীয়, অথবা একাডেমিকসূত্রে ছাত্র ছিলেন। লেখক শিবির নামে যে সংগঠন তিনি তার সভাপতি ছিলেন। ফলে ইলিয়াস লেখক হিসেবে কত বড়ো তা আমরা তার বই পড়ে যতোটা উপলব্ধি করেছি, তার চাইতে কৃত্রিম উপলব্ধি তৈরি করে দেয়া হয়েছে অন্যান্য লেখকদের লেখা রিভিউসূত্রে।

আপনার হয়তোবা খোয়াবনামা বা চিলেকোঠার সেপাইকে একেবারেই অর্ডিনারি উপন্যাস মনে হয়েছে, কিন্তু আপনি তা প্রকাশের সাহস পাবেন না, হীনম্মন্যতা বোধ কাজ করবে, কারণ সাহিত্য পরিমণ্ডলের দিকপালেরা এই উপন্যাস দুটিকে নোবেল পাওয়ার দাবিদার হিসেবে রায় দিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ডিসকোর্সের বিপরীতে যেতে চাইলে আপনার পড়াশোনা এবং জ্ঞানের লেভেল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হতে পারে। এর চাইতে ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান পটভূমিতে লেখা অসাধারণ উপন্যাস হিসেবে চিলেকোঠার সেপাইকে উচ্চকণ্ঠে স্বীকৃতি দেয়া, দু-চার লাইন স্তুতিবাক্য লেখা সাহিত্যসমাজে বিচরণের বৈধ ভিসা এনে দিবে।

আমাদের সাহিত্যরচনার অন্যতম ত্রুটি মনে হয় ভিন্ন এন্টারপ্রেটেশনের সুযোগ কম থাকা। অনেক বেশি তথ্য আর বর্ণনানির্ভরতার কারণে একটা বই পড়ে ১০০ জন মানুষের এন্টারপ্রেটেশন প্রায় কাছাকাছি থাকে। একটা বই ভালো লাগা এবং ভালো না লাগার কারণগুলো প্রায় কাছাকাছিই থাকে। যে কারণে লেখককে চ্যালেঞ্জ জানানোর সুযোগ থাকেই না বলতে গেলে, লেখক নিজেকে ঈশ্বরের পর্যায়ে নিয়ে যান, এবং তিনি গুরু, পাঠক ভক্ত এরকম এক নিঃশর্ত সমর্পণের আত্মিক এবং মানসিক আনুগত্যের চুক্তি তৈরি হয়। একারণেই ২০০০ বই পড়া সত্ত্বেও বহু মানুষের মধ্যেই পর্যবেক্ষণ আর পর্যালোচনা প্রবণতা গড়ে উঠে না।

ইমদাদুল হক মিলনের এক লেখাসূত্রে জানতে পারি, ইলিয়াস তার বন্ধুস্থানীয় কারো লেখা পছন্দ না হলে তার লেখালিখি বিষয়ে কথা বলতেন না। একবার মিলনের এক বন্ধু হেলাল ইলিয়াসকে জিজ্ঞেস করেন অমুকের লেখা সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী। তার উত্তর ছিল ‘ উনি ভালো মানুষ’। আরো ২ বার একই প্রশ্ন করার পরও ইলিয়াসের উত্তর ‘বললাম তো উনি ভালো মানুষ’

লেখক হিসেবে ইলিয়াসের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তার ‘ভালো মানুষ’ পরিচয়টাই নিয়ামক হয়ে থাকতে পারে। তার শুভানুধায়ীদের যত স্মৃতিচারণমূলক লেখা পাই প্রতিটিতেই তাকে একজন আড্ডাপ্রিয়, মিশুক এবং প্রচণ্ড মানসিক শক্তির মানুষ হিসেবেই দেখি। কলামিস্ট ফারুক ওয়াসিফ তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন- বগুড়ায় যখন ইলিয়াসের সাথে তার দেখা হয়, ততদিনে তার ২-১টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে; ইলিয়াস তার লেখা পড়তে চাইলে তিনি কিছুটা দাম্ভিকতা দেখিয়ে বলেন- ‘আমরা আপনার লেখা খুঁজে খুঁজে পড়ি, আপনিও আমার লেখা খুঁজে নিয়েন’। কৈশোরোত্তীর্ণ ফারুককে ইলিয়াস আত্মশ্লাঘা অনুভবের সুযোগ দিয়েছেন, এটা তার মনে রেখাপাত করেছে।

কিংবা ২০১২ তে দুইদিন ধরে লেখক শাহাদুজ্জামানের যে দীর্ঘ ইন্টারভিউ করেছিলাম তখনো তিনি ইলিয়াসের ইন্টারেস্টিং ব্যক্তিত্ব আর প্রজ্ঞার প্রশংসা করেছিলেন।

এই মিথস্ক্রিয়াগুলোতে লেখক ইলিয়াসের চাইতে ব্যক্তি ইলিয়াসই প্রাধান্য পেয়েছেন, ব্যক্তিত্বের সম্মোহন লেখা পাঠের সময় বায়াসনেস তৈরি করে থাকতে পারে। এবং বায়াসড হওয়া মানুষগুলো নিজেরাও যেহেতু লেখালিখির সাথে জড়িত তাদের প্রভাবে আনকোড়া কোনো পাঠক বা পাঠিকা আগে থেকেই চিলেকোঠার সেপাই বা খোয়াবনামাকে আন্তর্জাতিক মানের উপন্যাস মেনে নিয়ে পড়তে বসে। পড়ার সময় খটমট লাগলে সেটাকে নিজের মেধার দীনতা বলেই চালিয়ে দেয়।

খোয়াবনামা উপন্যাসের মূল ভিত্তি বিভিন্ন সামাজিক মিথ, কিন্তু স্বয়ং লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও যে একটি মিথিকাল চরিত্র হয়ে উঠবেন, সেই নিয়তির জন্য আমাদের সাহিত্য সমাজের প্রস্তুতি না থাকলেও আমি মিথটাকে আমলে নিয়েই ইলিয়াসকে মূল্যায়ন করি।

তবে
যেহেতু আমার সাহিত্যরুচি তৈরি হয়নি, ইলিয়াসকে মিথ বা ইলিউশন বলার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত কোন আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হই সেটাই দেখার প্রতীক্ষায় রয়েছি।