আপনি ইন্ট্রোভার্ট, নাকি এক্সট্রোভার্ট? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয় মানুষ। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণকে সীমায়িত করা যায় এভাবে- যে চুপচাপ থাকে সে ইন্ট্রোভার্ট, কথা যে বেশি বলে বা স্বতঃস্ফূর্ত থাকে সে এক্সট্রোভার্ট। এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিশক্তি কতখানি তা নিরূপণের পূর্বে ব্যক্তিত্ব বা পারসোনালিটি সংক্রান্ত পপুলার ধারণাকে একটু নাড়াচাড়া করে দেখা যাক।

মেপে মেপে কথা বলা, হাসতে গেলে শব্দ করা বা দাঁত বের করা থেকে বিরত থাকা এবং মানুষের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে রিজার্ভ থাকা- এই বৈশিষ্ট্যাবলী আমাদের এখানে পারসোনালিটির বহিঃপ্রকাশ। পক্ষান্তরে হিউমার চর্চা করা, আগ বাড়িয়ে কথা বলা কিংবা কাউকে প্রায়োরিটি দেয়া মানে ছেচড়া/লেইম/সস্তা/ ব্যক্তিত্বহীনতার লক্ষণ। আমাদের বৃহত্তর অংশের মনোজগতে তাই রাশভারিতাকে প্রমোট করে, হিউমারকে হালকা ধাঁচের নিম্নবুদ্ধিসম্পন্ন গণ্য করে, যদিও রাশভারি প্রকৃতির মানুষকে অহংকারী বা মুডি হিসেবেও ধরে নিই আমরা। দুটো প্রবণতাকে একত্রিত করলে পারসোনালিটির কল্পিত চেহারাটি আদতে অহংকারী মানুষের।

উপরোক্ত প্যারাটি বহুলচর্চিত, ইতিপূর্বে বহুমানুষ তাদের লেখনীতে পারসোনালিটি সংক্রান্ত ভুলধারণাকে প্রকাশ করতে গিয়ে এগুলো লিখে কথাগুলোকে ক্লিশে বানিয়ে ফেলেছে। তবু ক্লিশে চর্চাটা করতে হচ্ছে আরেকটি ক্লিশেকে টেনে আনতে গিয়ে। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব কমফোর্ট জোন থাকে, সেই জোনের বাইরে কে কীরকম আচরণ করে মূলত তার ভিত্তিতেই ইন্ট্রোভার্ট-এক্সট্রোভার্ট নির্ধারিত হয়। নিজের গণ্ডিতে একজন মানুষ চরম প্রগলভ হতেই পারে, তাতে তাকে যেমন এক্সট্রোভার্ট বলা যায় না, অনুরূপভাবে নিজের গণ্ডিতে চুপচাপ থেকেও কেউ ইন্ট্রোভার্ট নাও হতে পারে। হয়তোবা সে চাইলেই কমিউনিকেট করতে পারে, ইচ্ছার অভাবে কথা বলা থেকে বিরত রেখেছে নিজেকে। কমফোর্ট জোনের বাইরে কে কত সহজে মানিয়ে নিতে পারে, সোজা কথা, কার অভিযোজন ক্ষমতা কীরূপ তার নিরিখেই ইন্ট্রোভার্ট- এক্সট্রোভার্ট যাচাই করা হয়।

তবে ইন্টারেস্টিং তথ্য হলো, অভিযোজন ক্ষমতাকে মানদণ্ড ধরলেও ইন্ট্রোভার্ট বা এক্সট্রোভার্ট সম্বন্ধে পুরো নিশ্চিত হওয়া যায় না। একারণে ‘এম্বিভার্ট’ নামে ৩য় একটি ধরনের কথা শোনা যায়, কিছুক্ষণ আগে গুগলে এক আর্টিকেল পড়ার সময় দেখলাম পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই নাকি ‘এম্বিভার্ট’ প্রকৃতির।

আমি এম্বিভার্ট প্রকৃতিকে দেখি সুবিধাবাদী এবং সুযোগসন্ধানী মানসিকতা হিসেবে। এরা যতখানি অভিযোজিত হয়, তার চাইতে বেশি ভান করে। সবখানেই কিছু কিছু দক্ষতা থাকায় এরা জগতের জটিল সমীকরণে উতরে যায়, কিন্তু নিজস্বতার জায়গা কতটুকু থাকে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে থাকে। উৎপল নামের এক মানুষকে এক্ষেত্রে স্যাম্পল হিসেবে দাঁড় করাতে পারি। সে ছবি আঁকতে পারে, সে বিজনেস প্ল্যান ভালো বানায়, সে একজন দক্ষ অর্গানাইজার, এবং মাঝেমধ্যে গান-বাজনাও করে। এই বৈশিষ্ট্য শুনে তাকে বহুমুখী প্রতিভা বলবেন যে কেউই। কিন্তু ছবি আঁকিয়ের জায়গা থেকে দেখলে সে কি উৎকৃষ্ট? না, মধ্যম বা গড়পড়তা মানের। স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিংয়ে ১১ জন দক্ষ মানুষের নাম বললে সেখানে কি উৎপল থাকবে? নাতো। কিন্তু জগতের ডিমান্ড আসলে ওরকম মানুষই। দাবা খেলা দিয়ে জগতের মানুষ বিষয়ক ভাবনাটা আরো চমৎকরারভাবে বোঝা যায়।

তবে সেই দিকে যাওয়ার পূর্বে লেখচিত্র বা গ্রাফ বিষয়ে দু-চারটে বাক্য লিখি। আমরা যখন গ্রাফ আঁকি, X-axis এবং Y-axis ধরে তারপর কোনো একটা বিন্দুর স্থানাংক বসাই। মানুষকে যদি বিন্দু ধরি, তাহলে হরিজন্টাল অক্ষকে ব্যাপ্তি এবং ভার্টিকাল অক্ষকে গভীরতা হিসেবে চিন্তা করতে সমস্যা হয় না মোটেই। ধরা যাক, কারো স্থানাংক (১৯,৩) অর্থাৎ তার ব্যাপ্তি এবং বিস্তৃতি যথেষ্ট হলেও গভীরতা তুলনামূলক কম। বিপরীতক্রমে (৩,২৩) স্থানাংক মানে গণ্ডি খুব সুবিস্তৃত নয়, কিন্তু গভীরতা অনেক বেশি। অপরপক্ষে কারো স্থানাংক (১৩,১১) হওয়া মানে সে ব্যালেন্সড বা সুষম প্রকৃতির মানুষ; ব্যাপ্তি আর গভীরতার মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে; নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া যেরকম (১৩,১১) স্থানাংকের মানুষগুলোও সেরকম।

প্রশ্ন হলো, হরিজন্টাল- ভার্টিকাল দুটোই বেশি হওয়া সম্ভব কিনা, যেমন (৬৭,৭১) কিংবা (১০৯,১০৭)। মানুষের সময়, শক্তি, রিসোর্স, ট্যালেন্টের মোট পরিমাণ নির্দিষ্ট। ফলে দুইদিকে সমানতাল রক্ষা করতে গেলে এক্সিলেন্স কি আসতে পারে? একে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আপনার কাছে মোট ১৭ লক্ষ টাকা আছে। আপনি চাইলে পুরো টাকাটা ১-২টা খাতে খরচ করতে পারেন, কিংবা বেশ কয়েকটি খাতে বণ্টন করে দিতে পারেন।

ইন্ট্রোভার্ট-এক্সট্রোভার্ট বোঝার ক্ষেত্রে গ্রাফ ধারণাটাই সবচাইতে যৌক্তিক লাগে আমার। হরিজন্টালে বেশি মানপ্রাপ্ত মানুষেরা এক্সট্রোভার্ট, ভার্টিকালি ডোমিন্যান্ট মানুষেরা ইন্ট্রোভার্ট। দুদিকেই ভারসাম্য রাখা মানুষেরা এম্বিভার্ট।

তবে এই লাইনটাকে ব্যাখ্যা করতে চাই মানুষের মৌলিক প্রবণতার মাধ্যমে। ৩ধরনের মানুষ হতে পারে- থিংকিং বেইসড, একশন বেইসড, ব্যালেন্সড। মানুষের এই প্রবণতাকে সবচাইতে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যায় দাবা খেলার পিসগুলোর মধ্য দিয়ে।

দাবা খেলা পছন্দ করুন বা না করুন, এটা হয়তোবা বেশিরভাগ মানুষই জানেন দাবা খেলায় ১৬টি পিস থাকে; আবার MBTI টেস্ট সম্বন্ধে যাদের ধারণা আছে তারা বোধকরি অবগত আছেন, পারসোনালিটি ট্রেইট অনুসারে পৃথিবীর মানুষকে ১৬টি ট্রেইটে বিভক্ত করা হয়। ১৬ কেন? 2^4=16 ই তো হয়।

দাবা খেলার পিসগুলোর দিকে লক্ষ্য করা যাক, ৮টি থাকবে সৈন্য বা পন, যারা কেবলমাত্র ১ ঘর এগুতে পারবে, বা প্রারম্ভিক অবস্থান থেকে ২ঘর যেতে পারবে, কোনো অবস্থাতেই পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। শুনলেই কেমন লিনিয়ার বা একরৈখিক জীবনপ্রণালী মনে হচ্ছে না? অথচ এই সৈন্য যদি বিপক্ষের সর্বশেষ ঘরে পৌঁছে যেতে পারে সে হয়ে যায় কুইন(মন্ত্রী)বা যে কোনো শক্তিশালী পিস। তাহলে দাবা খেলার অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে? তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫০%); জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, এই বক্তর্বের ইমপ্লিকেশন কি এবার বোঝা গেলো? এদের বলা যেতে পারে এম্বিভার্ট, কিংবা ব্যালেন্সড মানুষ।

রুক (নৌকা) ২টি, বিশপ (হাতি) ২টি, নাইট (ঘোড়া)২টি। প্রশ্ন হলো এই পিসগুলো ২টি করে কেন? কারণ, আপনাকে শতাংশের হিসাব মিলাতে হবে তো। ৫০% বা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ইতিমধ্যেই একটি গোষ্ঠী নিয়ে রেখেছে। এই পিসগুলোর
প্রত্যেকটিই সুনির্দিষ্ট বিশেষত্ব সম্পন্ন। রুক অবশ্য সক্ষমতায় বিশপ আর নাইট এর তুলনায় কিছুটা এগিয়ে; এটাও খুবই স্বাভাবিক। যে কোনো শ্রেণিতে বিভাজন থাকবেই; হোক সেটা বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা অর্থনৈতিক সক্ষমতার ভিত্তিতে। ৩টি পিস মিলে ৬টি সংখ্যা অধিগ্রহণ করে। ১৬ এর সাপেক্ষে ৬ হলো ৩৭.৫%; একে হিসাবের সুবিধার্থে ৪০% লিখা যেতে পারে। এদের বলতে পারি একশন বেইসড মানুষ, বা এক্সট্রোভার্ট। এরা সমাজের ক্ষমতাধর গোষ্ঠী; মূলত এরাই নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতি। আবার এরাই শিল্প-সাহিত্য-নৃতত্ত্ব-দর্শনের পৃষ্ঠপোষক, ধারক ও সঞ্চালক।

কুইন(মন্ত্রী) সংখ্যায় মাত্র ১টি, অথচ সে একাই মাস্টারপ্ল্যানারের ভূমিকা পালন করে। তার নকশাতেই নাচে ৪০% আর ৫০% এ বিলং করা জনগোষ্ঠী। ১৬ এর সাপেক্ষে ১কে ৬.২৫% বলা যায়, যা হিসেবের সুবিধার্থে ৫% লিখছি। এরা পলিসি মেকার, গভীর পর্যবেক্ষক; বলতে গেলে এরা মাফিয়া ধরনের মানুষ, যাদের বাইরে থেকে বোঝা যায় না, বরাবরই তারা পর্দার আড়ালে থেকে নেপথ্য চরিত্র হিসেবে কাজ করে। এরা পুরোপুরি থিংকিং বেইসড মানুষ; এদেরই ইন্ট্রোভার্ট বলা যায়।

বাকি রইলো রাজা, যে একজন উন্নত বৈশিষ্ট্যের সৈন্যের বাইরে কিছুই নয়, সামনে-পিছনে-ডানে-বামে মাত্র ১ঘর যেতে পারে, অথচ তাকে সুরক্ষিত রাখতেই সকল আয়োজন। রাজা আক্রান্ত হলেই খেলার গতি বদলে যাবে, ধরাশায়ী হলে কিস্তিমাত বা চেকমেট। ৬.২৫% বা ৫%- এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় পীরামিডের সর্বোচ্চ স্তরে আসীন হওয়াটা একটা ভাগ্য বা কিছুটা রেন্ডম সিলেকশন। রাজার ছেলের তেমন কোনো যোগ্যতা না থাকলেও ভবিষ্যতে সে রাজাই হবে, আর তাকে অবিসংবাদী করতে সর্বস্ব উজাড় করে দেবে মন্ত্রী। এই ৫% কে তাই পাওয়ার হাউজ বলা যায়, যারা মেধা বা যোগ্যতায় ৫০% এর প্রতিচ্ছবি বলেই তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারে। আপনি যদি কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা আর গড় মানুষের জীবনযাপনকেন্দ্রিক মানসিকতা পর্যালোচনা করেন, বিস্মিত হয়ে দেখবেন রাষ্ট্র বা সুপ্রিম অথরিটির বৈশিষ্ট্য সেই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ইন্টালনাল ফ্যান্টাসিরই বাস্তবায়ন। এই ৫% কে হিসেবের বাইরে রেখেই ৯৫% এর হিসাব মেলাতে হবে আপনাকে।

এই হিসাবের গোঁজামিল খুঁজে বের করতে আপনি ইতিমধ্যেই তৎপর হয়ে উঠেছেন হয়তোবা। পৃথিবীতে মাত্র৫% মানুষ ইন্ট্রোভার্ট, এটা তো গাঁজাখুরি গল্প, ইন্ট্রোভার্টনেসকে মহিমাণ্বিত করার হীনপ্রয়াস। ইন্ট্রোভার্ট হওয়াই কি আরাধ্য হবে মানুষের?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে অপ্রিয় এক সত্যের মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে; সেই সত্য হয়তোবা হজম করা দুঃসাধ্য হতে পারে। সত্যটা হলো, ইন্ট্রোভার্টনেস কোনো বৈশিষ্ট্য নয়, যোগ্যতা। অন্যদিকে এক্সট্রোভার্টনেস কোনো যোগ্যতা নয়, প্রায়োগিক বহিঃপ্রকাশ। আর এম্বিভার্টনেস যোগ্যতা-বহিঃপ্রকাশ কোনোটাই ঠিকঠাক রপ্ত করতে না পেরে টিকে থাকার প্রয়োজনে অভিযোজিত হওয়ার দক্ষতা।

তাহলে যেসব মানুষ বিচ্ছিন্ন থাকতে পছন্দ করে, পারতপক্ষে কথাই বলে না, নিজের কাজ নিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন থাকে সেইসকল মানুষকে কি ইন্ট্রোভার্ট বলবো না; তারা কি তবে এম্বিভার্ট?

আমি বিভিন্ন বয়সের, মেধার, শ্রেণির উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের ১১২৯+ মানুষের ইন্টারভিউ করেছি বিগত ২২ বছরে। কয়েক বিলিয়ন মানুষের পৃথিবীতে এটা খুবই ক্ষুদ্র স্যাম্পল; এই যুক্তিতে আমার অনুসিদ্ধান্তকে শুরুতেই উড়িয়ে দেয়া যায়। কিন্তু Mob Wisdom বিষয়ে যদি এক্সপেরিমেন্ট করেন বা পড়াশোনা থাকে, দেখবেন ১০০০+ হলেই সেই স্যাম্পল থেকে আপনি যে অনুসিদ্ধান্ত পাবেন, ১০০০০০০+ স্যাম্পল সাইজ থেকে প্রাপ্ত অনুসিদ্ধান্তে তারতম্য হবে খুব সামান্যই। মুদ্রা টস করার ক্ষেত্রে হেড আর টেল পড়ার ক্ষেত্রেও স্যাম্পলিং করে দেখতে পারেন।

কান্ট্রি কালচার নামক ক্যাচি এক ফ্যাক্টর দিয়েও অনুসিদ্ধান্তকে খারিজ করে দিতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষকে দিয়ে ফিনল্যান্ড বা হাঙ্গেরির মানুষকে বিচার করলে হবে নাকি? এই প্রশ্ন শুনলে আপনি বাহবা দিতে পারেন, কিন্তু আমি এটাকে গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তুর সূত্রের বাস্তব প্রয়োগ হিসেবে দেখি। একই উচ্চতা থেকে ভিন্ন ভরের দুটো বস্তু ফেলা হলে হালকা বস্তুটি দেরিতে পড়ার কথা ভারিটার তুলনায়, কিন্তু পড়ন্ত বস্তুর সূত্র মোতাবেক দুটোর পড়তে একই সময় লাগবে যদি এক্সটারনাল ফ্যাক্টরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দেশ-সীমানা যা-ই হোক পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের মানুষই শরীরে বসবাস করে, এবং রোগ-শোক-বার্ধক্য-কাম-ক্রোধ-প্রশংসার নিগড় থেকে সেই শরীরের রেহাই মিলবে না কখনো। হাঙ্গেরি বা ফিনল্যান্ডের মানুষ কি শরীরের এই সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছে, নাকি হবে কোনোদিন?

১১২৯+ মুখচোরা মানুষের সাথে গড়ে ২ঘণ্টা ১১মিনিট (আড়াই ঘণ্টা লিখতে পারতাম, কিন্তু মৌলিক সংখ্যার প্রতি অবসেসনটা বিরক্তিকর জায়গায় চলে যাওয়ায় শিশুতোষ পাগলামি করতে হয় সংখ্যা বা সময় উল্লেখের ক্ষেত্রে। আশা করি, বক্তব্যের এসেন্স তাতে বদলে যাবে না) আলাপ করে আমি যে অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে তার আলোকে বলতে পারি, এই মানুষগুলো আদতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কোনোকিছু নিয়েই সন্তুষ্ট নয়, তারা অভিযোগপ্রবণ, ওভার কনফিডেন্সের খোলসে প্রচণ্ড কনফিডেন্সহীনতায় ভোগে, নিজেদের আন্ডাররেটেড গণ্য করে একই সাথে ইনফেরিওরিটি এবং সুপেরিওরিটি কমপ্লেক্সে চলাচল করে। এরা আদতে এনিহিলেটের বা ধ্বংসকামী। এদের মৌখিক বা লৈখিক উভয়প্রকার যোগাযোগেই চরম অনীহা কাজ করে, কৌতূহলের চাইতে জাজ করতে চাওয়ার ইচ্ছা বেশি, এবং সেটাও খুবই বিপজ্জনক ধারায়। কোনো একটি বক্তব্যের খণ্ডিত অংশকে রেফারেন্স হিসেবে ধরে সেটাকে সমর্থন অথবা অসমর্থন করে গোঁয়াড়-গোবিন্দ সেজে বসে থাকে। তাদের জীবনে প্রশ্ন আছে প্রচুর, কিন্তু সেইসব প্রশ্ন ‘কী এবং কীভাবে’ সর্বস্ব, ‘কেন’ এর খুব বেশি প্রাধান্য নেই। এই বৈশিষ্ট্যের মানুষগুলোকে দাবা কোর্টের b2 এবং g2 পজিশনের সৈন্য বলা যায়।

এরা মানুষের সংস্পর্শ/সাহচর্য কেন অপছন্দ করে, কিংবা ভিন্ন মতাবলম্বীদের কেন স্পেস দিতে কুণ্ঠা বোধ করে, এই প্রশ্নটি বিভিন্ন সময়ই মাথায় এসেছে আমার, সদুত্তর পাইনি। তাদের বক্তব্য থেকেও সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য(Individualism), প্রাইভেসি (privacy), আত্মসম্মান (self respect)- (সংক্ষেপে IPS)- এই ত্রিমুখী ফাঁদের প্রলোভন জয় করতে যতটুকু মানসিক দৃঢ়তা এবং ক্রাইসিস সহনশীলতা থাকা উচিত, তার ধারেকাছেও থাকা হয় না এদের। এবং আগামীর পৃথিবীতে IPS হবে সর্বোৎকৃষ্ট প্রোডাক্ট ডিজাইন।

বক্তব্যের সপক্ষে কিছু প্রবণতা দেখাই। ই-কমার্স বিজনেস, অনলাইন স্কুলিং, প্রিস্কুলিং- প্রভৃতি ট্রেন্ডের তো জয়জয়াকার। একটু কি গভীরভাবে চিন্তা করেছেন এই ট্রেন্ডগুলো আসলে কোন্ মেসেজটি বহন করছে? আপনি বাজারে যাবেন না, বাজারই আপনার ঘরে চলে আসবে, আপনার পেমেন্ট করতে কাগজের নোট লাগছে না; কার্ডের মাধ্যমেই পেমেন্ট হয়ে যাচ্ছে। কেবল কিছু ডিজিটের আদান-প্রদান হচ্ছে। আপনি সমবয়সীদের সাথে একত্রে বসে ক্লাশ করবেন, তার প্রয়োজন নেই, অনলাইন থেকেই শিখে ফেলুন আর দুর্দান্ত জ্ঞানী হয়ে যান। আপনাকে বারবার বলা হবে সময় বাঁচান, কিন্তু সেই সময় বাঁচিয়ে কোন্ রাষ্ট্রোদ্ধার করবেন তা হয়তোবা আপনারও জানা নেই। গতকাল কলকাতা বাংলা সিনেমার নায়ক প্রসেনজিতের একটা ইন্টারভিউ পড়লাম। সেখানে সে খুবই শক্তিশালী বিবৃতি দিয়েছে একটা যার সারমর্ম হলো- এককালে সিনেমা শুধু হল আর টেলিভিশনে দেখার জিনিস ছিলো। কিন্তু এখন আরো বিভিন্ন মাধ্যমে সিনেমা দেখা যায়; নিজেদের তাই আর্টিস্ট বা ডিরেক্টর ভাবার চাইতে কনটেন্ট প্রোভাইডার ভাবাটাই নিরাপদ অপশন। পৃথিবীটা ছোট হতে হতে এখন আর ড্রইংরুমে রাখা বোকাবাক্সতে বন্দী নেই, সেটা এখন পকেটে রাখা ছোট্টস্ক্রিনে বন্দী। – তার এই উপলব্ধির মধ্যেও নিষ্ঠুর এক সত্য নিহিত রয়েছে।

দলবেঁধে হলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আড্ডাবাজি করে বখাটেরা, হিউম্যান ইন্টারেকশন যত কম থাকবে ততোই জীবন সহজ ও সুনিশ্চিত। একজন মানুষ দোকানে গিয়ে পোশাক বা বই কিনবে, এটাকে বিবেচনা করা হচ্ছে আনপ্রোডাক্টিভ কাজ হিসেবে। প্রোডাক্টিভিটির সংজ্ঞাতে কোথাও মেন্টাল রিফ্রেশমেন্ট ফ্যাক্টরটা নেই, থাকলেও সেগুলো মোটিভেশনাল স্পিস শোনা, মুভি দেখা, গান শোনা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে। IPS এর মাস্টারপ্ল্যানিং কি অনুধাবন করা যাচ্ছে?

ফলে ইন্ট্রোভার্টের আদলে বিপুলসংখ্যক মানুষ আদতে এম্বিভার্ট জীবনযাপন করে, এবং গুগলের বদৌলতে ‘ইন্ট্রোভার্ট’ সংক্রান্ত প্রচুর সংখ্যক পজিটিভ আর্টিকেল পড়ে স্থির সিদ্ধান্তে এসেছে- পৃথিবী আসলে এক্সট্রোভার্টদের জন্য, কিন্তু পৃথিবীতে যারা আবিষ্কার, জ্ঞান, আর দর্শনের মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন তারা প্রত্যেকেই ইন্ট্রোভার্ট। তারপর ইন্ট্রোভার্টনেস এর কিছু লক্ষণ পড়ে নিজেদের সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে গর্বিত ইন্ট্রোভার্ট হয়ে পৃথিবী উল্টানোর স্বপ্ন নিয়ে শেষতক খাট উল্টে মেঝেতে পড়ে বিব্রত হয়।

ইন্ট্রোভার্টনেস এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার সাংঘর্ষিক এবং মৈত্রীয়পূর্ণ বিপ্রতীপ সহাবস্থান। পর্যবেক্ষণ মানে কিন্তু খেয়াল করা নয়; এটা অনেকেই করতে পারে। পর্যবেক্ষণের মানে সবাই যা দেখছে কিন্তু গুরুত্ব দিচ্ছে না, সেই গুরুত্বহীন জিনিস বা ঘটনাতে যৌক্তিক গুরুত্বারোপের অভিপ্রায়ে অবিরাম মানসিক যোগ-বিয়োগ চালনা করা। তার ভিত্তিতে একটি ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো দাঁড় করিয়ে সেটাকে নির্দযভাবে ব্যবচ্ছেদ করা। কাঠামোটির অদ্ভুত সম্মোহনী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন; যদি এর কলকব্জাতে ঘুণ থাকে তবে ব্যবচ্ছেদের পর সেটি চৌচির হয়ে যাবে, আর যদি মাকড়সা থাকে তবে ব্যবচ্ছেদ সত্ত্বেও ফ্রেমওয়ার্কটি পরিপুষ্ট থাকবে। একেই আমি পর্যালোচনা প্রক্রিয়া বলি।

ইন্ট্রোভার্ট, এক্সট্রোভার্ট কি জন্মগত, নাকি অর্জনীয়? এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারবো আরো ১৭ বছর পরে যখন আমার জমজ কন্যা উনিশ আর তেইশ ১৮ তে পদার্পণ করবে। জন্মগতভাবেই ওদের চালচলন, শারীরিক গড়ন, খাদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ বিপরীত ঘরানার। ১৫ মাস বয়স, অথচ উনিশ এখনই গানের তালে নাচে, বাসায় আমার কাছে কেউ এলে নিজ থেকেই আমার কোলে এসে বসে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করে, হাসি বিনিময় করে। কেউ তাকে বলে দেয়নি লোকগুলো কেন এসেছে, কিন্তু সে আসবে, এবং নিজের সাংকেতিক ভাষায় তাদের সাথে যোগাযোগ করে। অর্থাৎ এক্সট্রোভার্টনেস এখনই তার মধ্যে দৃশ্যমান।

পক্ষান্তরে, তেইশের চোখের দিকে তাকালে আপনি অপ্রস্তুত হবেন; মনে হবে, আপনাকে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, কিন্তু মুখে একটা কথাও বলছে না। কেউ এলে সে দূর থেকে দেখে, কখনোই আমার কাছে আসে না। আমি যখনই টেবিলে লিখতে থাকি, সে চেয়ার ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু উনিশ লেখার সময় সচরাচর আমার কাছে আসেই না। উনিশ বরং সেলফে রাখা বইগুলো নামিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখার চেষ্টা করে। উনিশ-তেইশ দুজন একই সময়ে, একই পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠছে; তবু এই বৈপরীত্যের হেতু কী, এটাই আমার আগামী ১৭ বছরের প্রধান আগ্রহ ও কৌতূহলের বিষয়।

কিন্তু আমি এও জানি বয়স বাড়ার সাথে উনিশ এক্সট্রোভার্ট আর তেইশ ইন্ট্রোভাটনেস হারিয়ে এম্বিভার্ট হয়ে যাবে।

কমিউনিকেশন স্কিল, টিমওয়ার্ক প্রভৃতি যোগ্যতার উপর যে এতো জোরারোপ করা হয় এগুলো তবে কেন? দাবা খেলাসূত্রেই তো নিয়তি দেখেছেন- জনগোষ্ঠীর ৯০% ভরাট করতে হবে এম্বিভার্ট-এক্সট্রোভার্ট দিয়ে। এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়া যতগুলো আছে প্রায় সবকয়টিই আপনাকে ইন্ট্রোভার্ট হতে বাধা দেবে অথবা সাধনাকে বিলম্বিত করবে। আপনাকে সেলফ কনভারসেশনে নিরুৎসাহিত করবে। যেকারণে পৃথিবীর ইতিহাসে সেলিব্রিটি মাত্রই নায়ক, গায়ক, খেলোয়াড়, মডেল, কিংবা বড়ো ব্যবসায়ী। অন্যদিকে গবেষক, বিজ্ঞানী মানেই তার পূর্বে বাই ডিফল্ট ‘নিভৃতচারী’ বিশেষণ জুড়ে বসবে। খ্যাতি-পরিচিতির মোহ জয় করা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি চিরন্তন আকর্ষণকে অতিক্রম করার চাইতেও কষ্টকর। ফলে ইচ্ছায় হোক, কিংবা সিস্টেমের বাই প্রোডাক্ট হিসেবেই হোক, আপনি-আমি ৯০% এর কোটায় ঢুকে পড়বোই। সর্বোচ্চ চেষ্টা আর সাধনা করলে হয়তোবা দাবা বোর্ডের d2, e2 পজিশনের সৈন্য হতে পারি, কিংবা স্যাক্রিফাইস, হিউমিলিয়েশন, রিজেকশন, অপেক্ষা আর যন্ত্রণার পঞ্চতন্ত্রে ঘোড়া বা বিশপ হতে পারি বড়োজোর, কিন্তু কুইন (মন্ত্রী) হয়ে ৫% এর দুর্গম কোটায় প্রবেশযোগ্যতা পাওয়া আর হবে না।

তাহলে বেঁচে থেকে লাভ কী? সেই তো এভারেজ এর দলভারি করা। কিন্তু মরেও তো ফায়দা কিছু নাই। ব্যাঙ, দাঁড়কাক, কচ্ছপ, পিঁপড়া, বাঘডাসা প্রভৃতি প্রাণীর সাথে আড্ডা মেরেও তো পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা উন্নত করা যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা- এই ৪টি চাহিদাতে টান না পড়া পর্যন্ত ষৎকো নামের সেই হেলানো দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে থাকা পিঁপড়ার গতিবিধি পর্যবেক্ষণেও আনন্দ কম কিছু না কিন্তু!

কে বা কারা থাকবে সেই ৫% এ? You cant choose, but will be chosen somehow; মাকড়সা আর ঘুণপোকা প্রাণী দুটির উল্লেখ করেছি ইতিপূর্বে। সিম্বলিজম বা মেটাফোরিকাল ইন্টারপ্রেটেশনে আগ্রহ কাজ করে যাদের, তারা নিশ্চয়ই মাকড়সা রহস্য উদ্ধার করতে পারবেন। না পারলে সৈন্য হয়ে পাশাপাশি বসে চা, সিগারেট খাই আর নিম্নমানের রসিকতা করি চলুন। যেমন, ডিপজলের ডায়ালোগ, এরশাদের রাজনৈতিক অবস্থান, বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের মন্তব্য, তেলেগু সিনেমার নায়িকার গ্ল্যামার; টপিকের অভাব আছে নাকি! কিংবা ক্রিকেটার ইমরুল কায়েস ১১ বছর ধরে দলে যাওয়া-আসার মধ্যে থেকেও কীভাবে সাকিব আল হাসানের সাথে পার্টনারশিপে রেস্টুরেন্ট দিয়ে ফেললো; লিটন দাসের স্ট্যাম্পিংটা আসলে হয় নাই, ইন্ডিয়া জোচ্চুরি করেছে, কিংবা সিনেমার গ্রুপগুলোতে দেবী সিনেমা নিয়ে যেসব লেখা আসছে বেশিরভাগই পেইড পোস্ট, চঞ্চল চৌধুরী একটা ক্ষ্যাত অভিনেতা, মিসির আলি চরিত্রে খুবই হাস্যকর লাগছে দেখতে, এটা ফ্লপ করবে নিশ্চিত। বমির মতো করে উগড়ে আসতে চাইছে টপিক। পরচর্চায় যে শান্তি, তার সাথে তুলনীয় আর হতে পারে কিছু?

এভারেজ থেকে এভারেস্টের চূড়ায় উঠে সেলফি একটা তুলবোই।

ধ্যাত্তেরি বিদ্যুৎ চলে গেলো। কিহে, উনিশ-তেইশের মা, IPS(!) চালু করো তো দেখি