শুভ জন্মদিন লেখার অভ্যাস কখনো কি ছিল আমার?
– নাহ।
আমার কল্পিত হিমালয়নগরে বিভিন্ন রোলে বসবাস করা ৭৯ জন ভ্যালুয়েবল মানুষের জন্মদিনেও কি নিস্পৃহ থাকতে পারি?
-নাহ।
৮০ এর দশকে ঢাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া ফিরোজা সময়ের ত্রিমাত্রিক ঘূর্ননে অন্তিম ত্রিশে পৌঁছে আমেরিকায় অভিবাসী হলে তাতে সোশ্যাল ডায়নামিক্স এ হেরফের ঘটে না, বাংলাদেশের কয়েক লক্ষ অভিবাসীর মধ্যে সে একটা সংখ্যা মাত্র!
ফিরোজার ১৪ মাস উত্তরে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় জন্ম নেয়া হিমালয়ও তার শুভাকাংক্ষী হতেই পারে, কারণ সময় হলো এক জ্বলন্ত উনুন, সে মানুষকে ক্রমাগত মোবিলিটির উপরে রাখে, নইলে উনুনের উত্তাপে ভস্মীভূত হওয়াই নিয়তি। উত্তপ্ত উনুনের ধাওয়ার প্রভাবে সময়ের কোনো এক উপাংশে ফিরোজার সঙ্গে হিমালয় একটা কমন পয়েন্ট শেয়ার করেছিল সাময়িক, শুভাকাংখীতার জন্মও তারই ধারাবাহিকতায়।
তবে শুভাকাংখীতা যে আমৃত্যু আয়তক্ষেত্র হয়ে থাকবার অনিবার্যতা হয়ে উঠবে ফিরোজার জানা ছিল না।
হিমালয় অবশ্য অনুধাবন করেছিল। তারই ফলশ্রুতে আয়তকে বানিয়ে নিয়েছিল সামান্তরিক!
হিমালয়নগরে হাজার হাজার মাইল ফাঁকা ভূখণ্ড, ৭ দিন ধরে তেজি ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলার পরে কালেভদ্রে দেখা মিলে জনমানবের।
ফিরোজাও যদি পায় ভূখণ্ডের মালিকানা এবং গঠন করে নিজস্ব রাজ্যশালা, হিমালয়নগর অধিপতির প্রতিটি দিনই রূপান্তরিত হবে জন্মদিনের সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিগত রিচুয়ালে।
তার পূর্বে মিমাংসা প্রয়োজন ফিরোজার ইউনিফর্মে ব্যবহৃত ব্যাজের নাম কী হবে? সম্ভাব্য অপশন দুটো- বন্ধু, শুভাকাংখী!
বন্ধু শব্দটাতে লুকিয়ে কানকো নাচায় কানাফলি মাছ, যা একদিন রূপ পায় চিতলে। এরূপ ইন্টারপ্রেটেশন তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে বাংলা সিনেমার দুটো গান ‘একটাই কথা আছে বাংলাতে/বুক আর মুখ বলে একসাথে/ সে হলো, বন্ধু, বন্ধু আমার’
এবং
‘বন্ধু আমরা দুজন/ হব না হব না দুশমন/ সে কালেও বন্ধু ছিল, এ কালেও বন্ধু আছে, সে কালেও বন্ধু রবে/ নইলে বাঁচার কী দাম আছে’
বিশেষত প্রথম গানে প্রয়াত দুই নায়ক ফারুক আর জাফর ইকবালের স্ক্রিন প্রেজেন্টেশন দেখার পরে বন্ধু শব্দটা কারো ক্ষেত্রে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলেও ব্যাক স্পেস চেপে মুছে দিই।
বন্ধুত্ব যদি হয় হেটারোসেক্সুয়াল, সেখানে প্রেমের গুঞ্জন আশপাশ থেকে উঠবেই, এবং মিডিয়াবাজ নায়ক-নায়িকার কল্যাণে ‘উই আর জাস্ট ফ্রেন্ড’ ফ্রেজিংটা ঠোঁটের কোণায় স্ট্যান্ডবাই হয়েই থাকে।
জনে জনে কৈফিয়ত দেয়া বা ক্লিয়ার থাকার গরিবী চিন্তায় মানুষ ৭৯ বছর আয়ুষ্কাল পেয়েও টিকটিকির জীবনচক্র অতিক্রমে ব্যর্থ হয়, তারা বেঁচে থাকে তটস্থ মহিষ হয়ে, কারণ সমুখে ভয়ালদর্শন ভাবমূর্তি রাক্ষস!
কিন্তু গ্যালাক্সিতে আছে সূর্যের চাইতে বড় নক্ষত্র!
তাই
হিমালয়নগরে ভাবমূর্তি থাকে জবুথবু শরণার্থী বেশে। ভাসমান এই ভাবমূর্তির প্রতি ইমপ্যাথিপূর্বক এক সন্ধ্যায় পরোটা, ডিমভাজি আর আনারসের চা খাওয়া শেষে একাকী পায়চারি করাকালে ঘিওরি হিমালয় সিদ্ধান্ত নিল ‘শুভাকাংখী’ নামের ৭ কোটি বৃক্ষরোপণের।
শুভাকাংখী বৃক্ষে নাই কাঁটা, অথবা প্রশস্ত কাণ্ড তাই ফার্নিচাররূপে ব্যবহার্য নয়। শুভাকাংখী বৃক্ষজুড়ে সারাবছর ফুটে থাকে সুগন্ধী পুষ্পরাজি, বাতাসে খেলে ঢেউ।
হিমালয়নগর উৎসবপ্রিয়। প্রতি মাসে ১ জন ভ্যালুয়েবল মানুষের জন্মদিন উদযাপন করা হয়। জুনে ঘটে বিপত্তি। জন্মদিন পড়ে গেছে ৩ জনের, নগরে একজনের ভূমিকা deception, ২য় জনের ফ্যান্টাসি। অপরজন মৈত্রী!
প্রায়োরিটি পাবে কোনজন, দ্বিধায় ভোগার পূর্বেই শুভাকাংখী বৃক্ষ থেকে ঝরতে আরম্ভ করলো পুষ্পবৃষ্টি, তাই মৈত্রীই নির্বাচিত হলো!
আমেরিকান ফিরোজার মন শিমুল তুলোর মতো, হালকা এবং উড্ডয়নশীল।
প্রায় সব বয়সী মানুষ ফিরোজার বৈঠকখানার কলসিগুলোতে নিশ্চিন্তে জমা রাখে গল্প, যেভাবে ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত থাকে আমানত।
ফিরোজা রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে নানারকম৷ শুভাকাংখী বৃক্ষতলে লাকড়ির চুলায় রন্ধনকৃত খাবার সাজিয়ে সে রিফ্লেক্সবশত বসে পড়ে রংতুলি আর ক্যানভাসের মধ্যে কথোপকথন নির্মাণে।
৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ৫ জুন জন্মদিন ফিরোজারও। নির্বিচারে বৃক্ষহত্যার দানবিকতার কুফল ভোগ করতে শুরু করেছে মানবপ্রজাতি। দাবদাহে ফুটো হয়ে গেছে বায়ুমন্ডলের প্লাস্টিক পাইপ, তাই সবেগে নির্গত হচ্ছে রোদরশ্মি! তুমি কোথায় লুকাবে হে উন্নয়নপাপী মানবসমাজ!
কিন্তু ফিরোজার রাজ্যশালায় তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রির উপরে উঠে না৷ পরিচর্যা ছাড়াই শুভাকাংখী বৃক্ষ যেভাবে টিকে আছে দিনের পর দিন, এই অত্যানুকূল তাপমাত্রা তাকে শেখায় কমফোর্টের পুনর্সংজ্ঞায়ন।
ফিরোজা হাঁটতে থাকে, এখানে সেখানে সান্ত্রীর ন্যায় দণ্ডায়মান শুভাকাংখী বৃক্ষের পাতার মর্মরে অনুরণিত হয়- ‘শুভ জন্মদিন’!
কিংকর্তব্যবিমূঢ় ফিরোজার হাসি অর্ধবৃত্ত হয়ে যায় চিরতরে!