কয়েক বছর আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা গান ভাইরাল হয় অতর্কিত
‘বাদাম বাদাম দাদা কাঁচা বাদাম, আমার কাছে আছে শুধু কাঁচা বাদাম’
এই গানটাকে প্যারোডি করে বাদামকে যদি ‘সিভি’ দ্বারা রিপ্লেস করি
সিভি সিভি ভাইয়া ভেজাল সিভি, আমার কাছে আছে শুধু ভেজাল সিভি—- অনায়াসে তা বিডিজবসের বিজ্ঞাপনী জিঙ্গেল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। যদি আমার দুষ্ট বন্ধু জাহাঙ্গীর এই জিঙ্গেল তৈরির কাজ পায় সে ‘ভেজাল’ শব্দের পরিবর্তে ‘বালের’ ব্যবহার করবে।
বিডিজবস কে নিয়ে মন্তব্যের পূর্বে একটি মৌল জিজ্ঞাসা:
বিডি জবস ২০১১ তে যে অবস্থায় ছিল পরের ১৩ বছরে আদৌ কি কোনো সিগনিফিক্যান্ট ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পেরেছে?
আমার গত ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা বলে ইমপ্যাক্ট সর্বোচ্চ ৭%
ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, ইউনিলিভার, ব্র্যাক, টেলকো কিংবা ব্যাংকগুলো ওয়ার্কফোর্সের জন্য বিডিজবস এর উপর নির্ভরতা নেই, নিজেদের ব্রান্ড আর ফাইনান্সিয়াল স্ট্রেন্থ দিয়েই তারা আকৃষ্ট করে নেয় ক্যান্ডিডেট।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনবলের চাহিদা কতজন?
বিপরীতে যদি হাজার হাজার লোকাল SME গুলোর দিকে নজরপাত করি, তাদের কাছে বিডিজবস এর চাইতে বেটার প্লাটফরম কি আছে?
লোকাল এসব SME এর অনেকগুলোর রিক্রুটমেন্টেই এক্সটার্নাল কনসালট্যান্ট হিসেবে উপস্থিত থাকার দরুণ দুটো পরিস্থিতিতে নিয়মিত পড়তে হয়
প্রথমত, কোম্পানি যেমনই হোক (পরিচিত অথবা অপরিচিত) যে কোনো সার্কুলারে আবেদন পড়ে দেড়-দুই হাজার। শর্টলিস্ট করে যদি ৪০-৫০ জনে নামিয়ে ইন্টারভিউ কল করা হয়, উপস্থিত হয় সর্বোচ্চ ৪-৫জন
দ্বিতীয়ত কোম্পানিটি যদি অপেক্ষাকৃত পরিচিত হয় ইন্টারভিউতে উপস্থিতি ২০-২৫ বা তারও বেশি, কিন্তু ২ দিন ধরে ইন্টারভিউ নেয়ার পরেও ২ জন প্রার্থী বাছাই করা দুষ্কর হয়ে পড়ে যারা কমিটেড কর্মী হতে পারে।
বিডি জবস এর রেভিনিউ মডেল সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা নেই। যেসব কোম্পানির রিক্রুটমেন্টে থাকা হয় তাদের অথরিটির থেকে পাওয়া তথ্যমতে বিডিজবস আয় করে কয়েকটা মাধ্যম থেকে
১. বিডিজবস এ কোম্পানির একাউন্ট খুলতে হয়। ৬ মাস বা ১ বছরের জন্য বিডিজবসকে সার্ভিস চার্জ দিতে হয়।
২. বিডিজবস এর স্পেশাল প্যাকেজ আছে কয়েকটা। সেগুলো নিলে প্রার্থীর সিভি বাছাইয়ের কাজ করে দেয় তারা।
৩. নানা ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিংয়ের আয়োজন করে। এসব ট্রেনিংয়ের ইমপ্যাক্ট বা ইউটিলিটি নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে কিনা, ট্রেনিং করা ৭৯ জনের সাথে কথা বলে হয়তবা বোঝা সম্ভব।
৪..বিজ্ঞাপন
আরো থাকতে পারে। আমি এটুকুই জেনেছি৷
যদি আরেকটু ক্রিটিকালি দেখি, বিডিজবস ইনকাম করতে পারছে কেন?
কারণ তাদের সাইটে রয়েছে লক্ষ লক্ষ সিভি৷ এটাই তাদের শক্তি, আবার মহাদুর্বলতাও৷
ইন্টারভিউতে আসা প্রার্থীদের বড় অংশই জানে না কোন পোস্ট, কোম্পানি কী, কেন আবেদন করেছিল। এক মাসে একজন প্রার্থী ৭৫টা আবেদন করতে পারে। ৭৫ সংখ্যাটা অনেক বড়।
গত সপ্তাহ কাটলো এক লোকাল কোম্পানির রিক্রুটমেন্টে। ৪৩+ ইন্টারভিউ নিলাম।
কয়েকজন প্রার্থীকে দুটো প্রশ্ন করলাম
প্রথমত, আপনার চাকরি দরকার, কোম্পানির দরকার লোক। তবু কোম্পানিগুলো কাংখিত লোক কেন পায় না?
দ্বিতীয়ত, যদি বিডিজিবস এ প্রতিটি আবেদনের জন্য ৫০ টাকা খরচ করতে হত আপনি কি এই কোম্পানিতে আবেদন করতেন?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে দুটো পয়েন্ট এলো- কোম্পানিগুলো ইন্টারভিউ নেয় লোক দেখানো, ভেতরে ভেতরে ক্যান্ডিডেট সিলেক্ট করে রাখে। এবং খুব কম বেতন দিতে চায়।
দ্বিতীয় পয়েন্টের সাথে আমি আংশিক একমত। স্যালারি স্ট্রাকচার বেশিরভাগ কোম্পানিতেই প্রশংসনীয় স্কেলে থাকে না। তবে এটা সমগ্র চিত্র নয়।
আমাদের দেশ কি ব্যবসা বান্ধব? আমি সংশয় প্রকাশ করি
‘স্পিড মানি’ তথা ঘুষ কালচারের মহাপ্রলয়ের মধ্য দিয়ে কাজ করার পরে SME গুলো আদতেই কি প্রফিট করতে পারে, যার মাধ্যমে বেতন-ভাতা ঠিকঠাক দিতে পারবে? অনেক SME বেতন দিতে দিতে ২০ তারিখ পাড় করে ফেলে, কেউবা ২ মাস পরে ১ মাসেরটা।
কিছু কোম্পানি প্রফিট করা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃত এক্সপ্লোয়েটিং বেতন দেয়। তারা বাংলাদেশের SMEগুলোর প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করে না হয়ত৷
লোকদেখানো ইন্টারভিউয়ের পয়েন্টটা অবশ্য অবান্তর। তাদের বললাম একটা বোর্ডে ৪ জন মানুষ থাকে, ইন্টারভিউ না নিলে সেই সময়টাতে অন্য কাজ করত তারা। এতগুলো এক্সপেনসিভ রিসোর্স বসে থেকে লোকদেখানো ইন্টারভিউ নিবে, তাতে কোম্পানির লাভটা কী?
দ্বিতীয় প্রশ্নে ফিরি। আবেদন করতে ৫০ টাকা খরচ হলে এই কোম্পানিতে সিভি দিত কিনা। উত্তর এলো- যদি ইন্টারভিউতে ডাকার নিশ্চয়তা পাই তাহলে করতাম খরচ।
তার মানে বিডি জবস এ একজন ক্যান্ডিডেট যখন এক নাগাড়ে আবেদন করে সে বহুলাংশে নিশ্চিত থাকে ইন্টারভিউতে ডাক পাবে না, কারণ একেকজন ২৯ জায়গায় আবেদন করলে ইন্টারভিউ কল পায় মাত্র ২-১ জায়গায়।
বিডিজবস এর গারবেজখানা হওয়ার প্রক্রিয়ার শুরুও এখান থেকেই।
আমরা যদি রাইড শেয়ারিং এপস (উবার, পাঠাও) কে রেফারেন্স ধরি, তারা যাত্রী এবং বাহনের মধ্যে কানেকশন স্থাপন করে দেয়, বিনিময়ে কমিশন নেয়।
বিডিজবসও তো ফিলোসফিকালি উবার বা পাঠাও আদতে।
কিন্তু তারা কতটুকু টেকনোলজিকালি স্মার্ট সল্যুশন দিতে পারছে?
আমি কয়েকটা সুনির্দিষ্ট গ্যাপ বা ত্রুটি পাই, যেগুলো সমাধান করা উচিত।
প্রথমত, অধিকাংশ জব সার্কুলারে স্যালারি বিষয়ক স্পষ্টতা নেই। মিনিমাম এবং ম্যাক্সিমাম রেঞ্জ অপশন থাকলেও কোম্পানিগুলো বাছাই করে ‘নেগোশিয়েবল’ অপশন। ব্যাপারটা তখন গরুর হাটের মতো হয়ে যায়। যে যেভাবে পারে কিনে নেয়। কোম্পানির স্বচ্ছতার অভাব, ক্যান্ডিডেটেরও আস্থার অভাব। অতি অবশ্যই ‘নেগোশিয়েবল’ অপশনটা সিস্টেম থেকে গায়েব করে দিতে হবে, এবং মিনিমাম ও ম্যাক্সিমাম স্যালারি রেঞ্জ এ ভারসাম্য থাকতে হবে। একটা পজিশনে মিনিমাম স্যালারি ১৯ হাজার ম্যাক্সিমাম ৫৯ হাজার হয়ে গেলে সেটাও ধোঁকাবাজি।
দ্বিতীয়ত, কোম্পানির সিনোপসিস এবং ফাউন্ডিং মেম্বার (এমডি, চেয়ারম্যান, ডিরেক্টর) দের প্রোফাইল/স্টোরি যুক্ত রাখা উচিত। বাংলাদেশে বিজনেস চলে মূলত ফেসভ্যালু এবং ফাউন্ডারদের ব্যাকগ্রাউন্ডের ভিত্তিতে। ফাউন্ডারদের সম্বন্ধে জানা থাকলে আস্থা অথবা অনাস্থা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়।
তৃতীয়ত, লোকের চাহিদা হয়তবা ২-৩ জন, সর্বোচ্চ ৫ জন, আবেদন জমা পড়ে ২ হাজার। এটা কোনো ইফিশিয়েন্ট সিস্টেম হতে পারে না। বিডিজবস এ জব পোস্টিংয়ের একটা ধরাবাঁধা টেম্পলেট আছে। সিভির ক্ষেত্রেও তাই। দুটো টেম্পলেটেই পরিবর্তন আনতে হবে। ধরা যাক সিভিতে চাইলো ট্রেনিং করা আছে কিনা। থাকলে ৫ পয়েন্ট। প্রার্থী ট্রেনিং উল্লেখ করলো, প্রমাণস্বরূপ ডকুমেন্ট আপলোড করলো। একটা পূর্ণাঙ্গ সিভিতে ১০০ পয়েন্ট থাকতে হবে, কোম্পানিগুলো তাদের সার্কুলারে উল্লেখ করবে কাট অফ পয়েন্ট কত। এবং প্রতিবারে একটা কোম্পানি ৫০ জনের বেশি সিভি নিতে পারবে না। বিপরীতক্রমে একজন ক্যান্ডিডেট মাসে আবেদন করতে পারবে সর্বোচ্চ ৭ কোম্পানিতে। প্রতিবার আবেদনে ৫০টাকা পেমেন্ট৷
কোম্পানি সার্কুলার দেয়ার সময়ও অনেকগুলো ফিল্টার পূরণ করে দিবে, অটোমেটেড সিস্টেমে সেই ফিল্টারের সাথে ম্যাচ করা ক্যান্ডিডেটদের কাছে জব রিকুয়েস্ট চলে যাবে। একসেপ্ট করলে নির্ধারিত কোটা থেকে ১ কমে যাবে, ডিক্লাইন করলে অন্য কেউ একসেপ্ট করবে। ৫০ জন হয়ে গেলে, সার্কুলার নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। কোম্পানি বাধ্যতামূলকভাবে ৫০ জনকে ইন্টারভিউতে কল করবে, চাইলে সে লিমিট কমিয়ে ৩০ এ আনতে পারে। কিন্ত নির্ধারিত লিমিটের প্রত্যককে সে ডাকতে বাধ্য৷ নইলে তার রেটিং কমে যাবে। পক্ষান্তরে ক্যান্ডিডেট ইন্টারভিউতে অংশ নিতে বাধ্য। মাসে ২টার বেশি ইন্টারভিউতে অনুপস্থিত থাকলে তার সিভি থেকে পয়েন্ট মাইনাস করা হবে, এবং জব রিকুয়েস্ট কম পাবে।
এই যে আর্গুমেন্টটা বললাম, এটা যে বাস্তবায়নযোগ্য, আমরা সকলেই জানি। বিডিজবসও। কিন্তু তারা নিজেদের আপডেট করবে না। বলবে কোম্পানি ঝামেলা নিবে না, কর্মীরা রাজি না।
আপনার সিস্টেম যদি নিশ্চিত করতে পারে কমিটেড রিসোর্স যোগান দিবে, কোন সে কোম্পানি যারা এই সুযোগ নিবে না? আপনার সিস্টেম বলছে আবেদন করতে পারলে ইন্টারভিউতে কল পাওয়া নিশ্চিত, ক্যান্ডিডেট অরাজি কেন হবে?
মূল কথা হলো, তেমন কিছু না করেই টাকা আসছে, এত ঝামেলার কী দরকার।
বাঙালি প্রতিযোগিতা ভয় পায়। মাসে ৪০-৫০টা চাকরির আবেদন করছি মাসের পর মাস, কিন্তু মামা-চাচা না থাকায় চাকরি হচ্ছে না—- বলতে পারাও বহু তরুণ বা তরুণীর নিজেদের অযোগ্যতাকে আড়ালের প্রলেপ হয়ে আছে। যখন স্কিলভিত্তিক তীব্র প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থান উন্মোচিত হয়ে পড়বে, লুকানোর জায়গাটা থাকবে কোথায়?
কিংবা কোম্পানিগুলো যখন বেশুমার বেকারত্বের মিসইউজ করে ‘নেগোশিয়েবল’ এর আড়ালে ইচ্ছামতো একটা স্যালারি সেট করার সুযোগ হারাবে, তাদেরও মনোপীড়া বাড়বে বৈ কমবে না।
ফলে আমরা কোয়ালিটি এবং কম্পিটিশন প্রশ্নে ট্রমাগ্রস্ত হয়ে জায়েদ খান আর নিপুণ আক্তারের কাছে সামাজিক আশ্রয় খুঁজে গান গাই- ‘আমার কাছে আছে শুধু কাঁচা বাদাম’!
আমি বলছি না আমার প্রস্তাবিত মডেলই সমাধান। গভীর চিন্তা করলে এর চাইতেও ইফিশিয়েন্ট সমাধান অবশ্যই আসবে। আমি যা বলতে চাই, বর্তমান মডেল পুরোপুরি অকেজো এবং অকার্যকর, এভাবে চলা উচিত নয়।