ফুটবল খেলাটা সারাজীবনে কখনোই ভালো লাগেনি, তবু এর ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করার মূল কারণ এটা বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলা। মানুষের মানসিক গঠন বুঝতে গেম এবং স্পোর্টস সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আমার ভালো লাগুক বা বিরক্ত লাগুক, তাতে জনপ্রিয়তম খেলা হিসেবে ফুটবলের স্বীকৃতিতে কোনোই প্রভাব পড়বে না।
স্পোর্টস বললে আমার মাথায় সবসময়ই চলে আসে ক্রিকেট; নেশাগ্রস্তের মতো ক্রিকেটেই চূড় হয়ে ছিলাম সবসময়, অন্য খেলায় আগ্রহই যায়নি। ক্রিকেটের বাইরে দাবায় প্রচণ্ড আসক্তি কাজ করে। দাবা তো স্পোর্টস নয়, গেম।

ফুটবল কেন ভালো লাগে না? ক্রিকেট অক্সিজেন হলে ফুটবলকে কার্বন ডাই অক্সাইড হতে হবে এমন চরম ইন্টারপ্রেটেশন নিশ্চয়ই কাম্য নয়। হকি, টেনিস, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল প্রভৃতি স্পোর্টস এ আগ্রহ কম, কিন্তু ভালো লাগে না বলার সুযোগ কম। যদি বোধ করি পর্যাপ্ত অলস সময় পড়ে আছে, এগুলোর কোনো একটা দেখে সময় কাটিয়ে দিতে পারি, কিন্তু ফুটবল খেলা দেখার সবরকম সুযোগ থাকলেও ৯০ মিনিট ধরে দেখবো সেই সম্ভাবনা খুবই কম। আমাদের বাল্যকালে বাংলাদেশ ছিলো ফুটবলনিয়ন্ত্রিত, ক্রিকেটের তেমন কোনো খবরই রাখতো না কেউ; সেই সময়েও আমার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলো টেন্ডুলকার, ওয়াকার ইউনিস, ওয়াসিম আকরাম, ম্যাকগ্রা, লারা, মার্ক ওয়াহ, সাঈদ আনোয়ার সহ অজস্র ক্রিকেটার; পেপার কেটে তাদের ছবি জমাতাম, স্টিকার কিনে রাখতাম।

মানিকগঞ্জে সেসময় নিয়মিত ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো। সেওতা উদয় সেনা আর ড্রাগন স্পোর্টিং ক্লাব নাম দুটো দল ছিলো যাদের খেলা থাকা মানে মারামারি অবধারিত। ১০ টাকা টিকিটের দাম; আমি আর রুমেল (আমার ভাই) খেলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে গেটের নিচের ছোট্ট ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকতাম। ফুটবল খেলা দেখার উদ্দেশ্যে নয়, আগত শত শত দর্শকের নানা ধরনের মন্তব্য শুনবার আকাঙ্ক্ষায়।
ফুটবল খেলাটা কেন ভালো লাগে না, অবশ্যই এর প্রধানতম কারণ খেলাটা আমি বুঝি না। কিন্তু বুঝতে চাইলেই তো বোঝা যেতো; চাইলাম না কেন? বিগত ২৫ বছরে বহুবার করেছি প্রশ্নটা নিজেকে, সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারিনি। অগভীর কিছু পর্যবেক্ষণ আছে যেগুলো আমার নিজের কাছেই হাস্যকর লাগে। প্রথমেই আসে বাল্যকালে শোনা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুক। ফুটবল প্রসঙ্গে সে বলেছিলো- ‘১টা বল নিয়া ২২ জন কাড়াকাড়ি করার দরকার কী; ২২ জনরে ২২টা বল দিয়া দিলেই তো হয়’। এই কথাটা মারাত্মকভাবে আচ্ছন্ন করেছিলো আমায়; একটা মাঠের ২২ জন খেলোয়াড়ের প্রত্যেকেই একটা করে বল নিয়ে দৌড়াচ্ছে গোল দিতে; কে কাকে ডিফেন্ড করবে, কে কার আগে গোল দিবে- একটা ম্যাজিক রিয়েলিজম আবহ তৈরি হতো, সেটা আর তখন খেলা থাকতো না।
তবে যৌক্তিক কারণ যদি বলা হয়, ট্যাকল করা জিনিসটা পছন্দ হয়নি ছোটবেলা থেকেই। একজন মিডফিল্ডার বা উইঙ্গার বল নিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, হুট করে তাকে একটা রাফ ট্যাকল করা হলো; এটা খুবই বিচ্ছিরি লাগে। এটাও খুব শক্ত কারণ নয়। খেলার ব্যাপ্তি মাত্র ৯০ মিনিট; এটা একটা বড়ো কারণ হতে পারে।

সম্প্রতি ‘89’ নামে কলকাতার একটা থ্রিলার ফিল্ম দেখলাম। সেখানে একজন সিরিয়াল কিলারের সংলাপ ছিলো ‘৯০ হচ্ছে একটা ইউনিটারি পারফেক্ট নাম্বার; ৯০ ডিগ্রিকে আমরা বলি রাইট এঙ্গেল’। সংলাপটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ইংরেজি মুভিগুলোর গড় ব্যাপ্তি যদি ধরা হয়, ৯০ মিনিটই পাওয়া যাবে। ৯০ মিনিট মানে দেড় ঘণ্টা! আমি খেলা দেখি বিনোদনের উদ্দেশ্যে কম, টেনশনমুক্ত থাকতে এবং এক্টিভিটি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে বেশি। যে কারণে ৯০ মিনিট সময়টা নিতান্তই অল্প মনে হয়, ক্রিকেটকে ভালো লাগবার ক্ষেত্রেও ব্যাপ্তি একটা বড়ো অনুষঙ্গ। তবে টি২০ খেলাটা যেভাবে এগ্রেসিভলি আগাচ্ছে, তাতে ক্রিকেট খেলাটাও দুটো ৯০ মিনিটের প্যাকেজ হয়ে যাবে হয়তোবা।

ফুটবলের দুটো ব্যাপার খুবই পছন্দ করি: ফ্রি কিক থেকে গোল এবং লেফট বা রাইট উইং থেকে লম্বা ক্রস। ড্রিবলিং বেশিরভাগ ফুটবল বোদ্ধার পছন্দ হলেও আমার কাছে অহেতুক কসরত প্রদর্শন মনে হয়। ফ্রি কিকে একটা গোল, নাকি দুর্দান্ত ইয়র্কারে মিডলস্ট্যাম্প উপড়ে ফেলা; কোনটা আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয় লাগে? নিশ্চিতভাবেই ওয়াকার ইউনিসের বিধ্বংসী ইয়র্কার।
আরেকটা অন্ত্যমিল নিয়ে ভেবেছি প্রায়ই, এখনো ভাবি। ফুটবল এবং ক্রিকেট, দুটো খেলাতেই খেলোয়াড়সংখ্যা ১১ হলো কেন? ১১ এর মাহাত্ম্য কী।
ইতিমধ্যেই বলেছি, ফুটবল ভালো না লাগলেও ফুটবলের সাথে আমি থাকি, মানুষের আলোচনা-পর্যালোচনা শুনি, এক দলের সমর্থক অন্য দলের সমর্থকের সাথে তর্ক করছে কার দল সেরা, এগুলো আমাকে টানে ভীষণ। ফ্যান্ডম ব্যাপারটা নিয়েও আমি কৌতূহলী। শাহরুখ খানের ফ্যান মানুষ কেন হয়, হুমায়ূন আহমেদের হিমু কেন হতে চায়, বা সালমান শাহের মৃত্যুর পর কেন ৭-১০ জন তরুণী আত্মহত্যা করেছিলো। ফ্যান্ডমের শক্তি এবং প্রভাবকে হালকাচালে দেখাটা বোকামি। এর শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। ফ্যান্ডমের উৎসে পৌঁছানোর জন্য হলেও ফুটবলকে বোঝার দরকার আছে। আমি সঠিক জানি না, সারবিশ্বে কত কোটি মানুষ হলিউডের ফিল্ম দেখে আর কতজন ফুটবল দেখে। তবে কমন সেন্স থেকে অনুমান করতে পারি, ফিল্মের চাইতে ফুটবলের দর্শকসংখ্যা বেশি, ফ্যান্ডমও বেশি।

ফুটবল ভালো না লাগলেও প্রতিটি বিশ্বকাপেই ৫-৬টা ম্যাচ দেখি, সেই ১৯৯৪ থেকে এই ধারা শুরু করেছি। একটা বিশ্বকাপ শুরু হয় আর হিসাব করি পরের বিশ্বকাপ আসার মধ্যবর্তী সময়টুকুতে জীবনে নতুন কী কী পরিবর্তন আসতে পারে, ভূমিকাতে নতুন কী যুক্ত হতে পারে, এবারের আসরে যারা তারকা পরেরবার এদের মধ্যে কতজন খেলবে, কতজন অবসরে চলে যাবে। মাঠের খেলার চাইতে এইসব বিষয়াদি আমাকে টানে বেশি। মাত্র ১০-১২টা দলের অংশগ্রহণে ক্রিকেট বিশ্বকাপকে একটা মাঝারি মানের টুর্নামেন্টের বাইরে কিছুই মনে হয় না; এটা কেন বিশ্বকাপ সেই প্রশ্নেরই তো উত্তর পাই না। পক্ষান্তরে, ৩২টা দল খেলবে, তারা কত কঠিন বাছাইপর্ব পেরিয়ে তবে একটা টুর্নামেন্টে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে; বিশ্বকাপ তো এমনই হওয়া উচিত।

যেহেতু বিশ্বকাপের ৫-৬টা ম্যাচের বাইরে ফুটবল আমার জগতের কোথাও অবস্থান করে না, সাপোর্ট করি কোন্ দল এটা খুব বড়ো বিষয় নয়। তবে সত্যি কথা হলো, মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখতে হলে কোনো একটা দলকে সাপোর্ট করতেই হয়, নইলে খেলার সাথে মানসিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া যায় না। যে দল সুন্দর খেলবে তার সাপোর্ট দেবো, এটা তত্ত্বকথা, মাঠের খেলা শুরু হয়ে গেলে কোনো একটা দলের প্রতি সাপোর্ট চলে যাবেই। বাল্যকালে যে এলাকায় থাকতাম, সেখানকার বড়ো ভাইরা বেশিরভাগই ছিলো আর্জেন্টিনার সমর্থক, বড়ো আপার মুখেও ম্যারাডোনার কথা শুনতে শুনতে ধারণা জন্মেছিলো আর্জেন্টিনা দারুণ একটা দল, তাদের জার্সিটাকেও অন্যরকম লাগতো। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের আগে প্রত্যেক দলের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে আলাদা ফিচার আসতো, প্রতিটা পড়তাম। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে নিয়ে ফিচারের শিরোনাম ছিলো আর্জেন্টিনার গোলমেশিন। আমাদের পাশের বাসার আন্টি ছিলো বাতিস্তুতার বিশাল ফ্যান, তার ঘরে বাতিস্তুতার পোস্টার টাঙানো থাকতো। আমার বড়ো হওয়াটাই আর্জেন্টিনা পরিমণ্ডলে, যে কারণে আর্জেন্টিনার প্রতি এক ধরনের সফট কর্নার কাজ করে, যে কোনো দলের সাথে খেলা পড়লে মন থেকে কে যেন বলে আর্জেন্টিনাই জিতুক। যদিও আমি যে ধরনের ফুটবল দেখে আনন্দ পাই সেটা সবচাইতে ভালো মিলে জার্মানি আর নেদারল্যান্ডের সাথে। দুই উইং দিয়ে দ্রুতগতিতে উপরে উঠে যাওয়া, লম্বা ক্রস, কাউন্টার এ্যাটাক- এসবের মধ্যে কম্প্যাক্টনেস পাই। আর্জেন্টিনার খেলায় কখনোই সেটা দেখিনি। বাতিস্তুতা,ওর্তেগা, এরপর তেভেজ, দিনো মারিয়া, এরপর মেসি; বাংলাদেশে ব্যান্ডগুলো যেমন বেশিরভাগ ভোকালসর্বস্ব, ব্যান্ড কনসেপ্ট কম, আর্জেন্টিনা দলটাও সেরকম ১-২ জন তারকানির্ভর ছিলো মনে হয়েছে। ক্রিকেটে ১জন ব্যাটসম্যান বা ১টা বোলারই ম্যাচ শেষ করে দিতে পারে, ফুটবলে এই সুযোগটা খুবই কম। তারকা খেলোয়াড়টিকে ২জন ডিফেন্ডার মিলে ব্লক করে দিলে ম্যাচ বের করা কঠিন।

ফেসবুকে লেখালিখির বড়ো সমস্যা খুব সহজেই ট্যাগিং পেয়ে যাওয়া। আমার উপরোক্ত প্যারাটি থেকে কোনো আর্জেন্টাইন সমর্থক ইন্টারপ্রেট করে নিলো আমি ব্রাজিল সমর্থক, ইনিয়ে-বিনিয়ে আর্জেন্টিনার নিন্দা করছি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের খেলা ভালো লেগেছিলো; রোমারিও, রবার্তো কার্লোস, বেবেতো এর খেলাতে গতি দেখেছিলাম। বিশেষত সুইডেনের বিপক্ষে ম্যাচে রবার্তো কার্লোস ফ্রি কিক থেকে দুর্দান্ত এক গোল করেছিলো। ১৯৯৮ এর আসরে রোনালদোকে নিয়ে ব্যাপক মাতামাতি হয়েছিলো, পুরো টুর্নামেন্টে সে ফ্লপই ছিলো বলতে গেলে; যদিও ব্রাজিল ফাইনালে উঠেছিলো, খুব একটা ভালো লাগেনি খেলা। ২০০২ এ রোনালদিনহো, কাকা এই দুজন খেলোয়াড়কে মনে ধরে। রোনালদো, রিভালদোও দুর্দান্ত খেলেছিলো। আমি ফুটবল বিশ্লেষক হিসেবে নবিস প্রকৃতির, তবু মনে হয়েছে ২০০৬ আসর থেকে ব্রাজিলের খেলার ধারা পাল্টে গেছে, কোয়ালিটি নিম্নমুখী। ৯৪,৯৮ বা ২০০২ তে যেরকম গতি ছিলো, সেটা আর চোখে পড়েনি সেভাবে।

লাতিন আমেরিকান প্রতিবেশী হওয়ায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতা থাকাটা সঙ্গত, কিন্তু বাংলাদেশে এই দুটো দলের বিপুল জনপ্রিয়তার উৎস কী এটা একটা বড়ো জিজ্ঞাসার জায়গা আমার। কেবলমাত্র ম্যারাডোনা ফ্যাক্ট দিয়েই এতো ফ্যান যোগাড় হয়ে গেছে, কিংবা পেলে-জিকো-সক্রেটিস বা ৫ বারের বিশ্বকাপ ট্রফি পাওয়াটাই কারণ? আরো গভীর কোনো কারণ আছে সম্ভবত। জার্মানিও তো বোধহয় ৪ বার ট্রফি পেয়েছে, ইতালিও ৪ বার। এই দলগুলোর সাপোর্টার কম হওয়ার কারণ কী? জার্মানি আর নেদারল্যান্ডকে যথেষ্ট আন্ডাররেটেড দল মনে হয়, শুনেছি নেদারল্যান্ড এবার জায়গা পায়নি।
সবচাইতে বাজে লাগে স্পেনের খেলা। সারাক্ষণ বল নিজেদের কাছে রাখবে, আক্রমণও করবে না, গোল দিবে না, খাবেও না। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার প্রভাবেই সম্ভবত স্পেনের সাপোর্টার গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। ৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে জিদানের সেই অতর্কিত ২ গোলের সুবাদে ফ্রান্স দলটা নিয়েও কিছুদিন শোরগোল শুনেছিলাম; এখন বোধহয় নেই আর আগের মতো।
২০০৬ বা ২০১০ এর আসরে আর্জেন্টিনাকে বড়ো ব্যবধানে হারিয়েছিলো জার্মানি; মুখে বলছি জার্মানির খেলা ভালো লাগে, কিন্তু আর্জেন্টিনার জন্য মায়া হচ্ছিলো। ২০১৪ তে ব্রাজিলকে যখন ৭ গোল দিলো, তখনো খারাপ লাগছিলো। জার্মানির সাপোর্টার কম হওয়ার কারণটা বোঝার ক্ষেত্রে এটাও একটা ইঙ্গিত হতে পারে পরবর্তীতে। সম্ভবত সবচাইতে বেশিবার ফাইনালে উঠেছে জার্মানি, তবুও ফ্যান্ডম কম তাদের। শ্রেয়তর দল কেন সাপোর্টার কম পাবে; এটা আমার ভবিষ্যৎ জীবনের একটা বৃহৎ অনুসন্ধানের ক্ষেত্র হতে পারে। যোগ্য মানুষ যে সবসময় যোগ্যতম স্থানে থাকবে না, এই প্রাকৃতিক সিদ্ধান্তটা অনুধাবনের ক্ষেত্রেও জার্মানি একটা উৎকৃষ্ট কেস স্টাডি হতে পারে।

এখনো পর্যন্ত যতগুলো বিশ্বকাপ দেখেছি তার একটা শো-রিল বানাচ্ছি শব্দ দিয়ে।
১৯৯৪: ক্লাস টু তে পড়ি। খেলা হতো গভীর রাতে। ঘুমিয়ে পড়তাম, কোনো কোনো রাতে ঘুম থেকে উঠে ম্যাচ দেখতাম। এক্সক্লুসিভ কিছু স্মৃতি লিখে রাখি:
১.বুলগেরিয়ার রিস্টো স্টয়চকভ নামের একটা খেলোয়াড়ের খেলা ভালো লেগেছিলো
২. কলম্বিয়ার অধিনায়কের চুলের স্টাইলটা পছন্দ হয়েছিলো
৩. রুমানিয়ার সাথে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনা গ্যালারিতে ছিলো সম্ভবত।
৪. বেবেতোর অদ্ভুত স্টাইলে গোল উদযাপন। কার্লোসের ফ্রি কিক
৫. ফাইনালে পেনাল্টি শুট আউটে ব্যাজ্জেওর বল গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেয়া

১৯৯৮: সিক্সে উঠে গেছি। পাশের বাসার আন্টি প্রেগন্যান্ট, তবু রাত জেগে আর্জেন্টিনার ম্যাচ দেখা চাই। আমি তার সহচর
১.চিলির জা-সা জুটি
২. নেদারল্যান্ডের বার্গক্যাম্প, ডেভিস, ক্লাইভার্ট খেলোয়াড় ৩জনকে আলাদাভাবে ভালো লাগে।
৩. ডেনমার্কের জমজ ভাইদের ভালো লাগে।
৪. আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ডেভিড বেকহ্যামের লালকার্ড পাওয়া। টাইব্রেকারে ম্যাচের ফলাফল।
৫. নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে বাতিস্তুতার দূরপাল্লার শট গোলবারে লেগে ফেরত আসা।
৬. ফাইনালে শুরুতেই পাওয়া কর্নার কাজে লাগিয়ে হেড দিয়ে জিদানের গোল

২০০২: প্রথমবারের মতো দিনের বেলা বিশ্বকাপ। নিজেরা বাড়ি করেছি। বাসার সামনে আর্জেন্টিনা, আর ক্যামেরুনের পতাকা টাঙ্গিয়েছি। এলাকাজুড়ে উৎসবের আমেজ।
১.প্রথম ম্যাচেই নবাগত সেনেগাল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে দিলো।
২. ডেভিড বেকহ্যামের নেয়া পেনাল্টিতে আর্জেন্টিনার হার। বেকহ্যামের বুনো উল্লাস। আর্জেন্টিনা প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ।
৩. অলিভার কান, মিরাস্লোভ ক্লোসা টুর্নামেন্টজুড়ে আলোচনায়।
৪. সহ আয়োজক দক্ষিণ কোরিয়া বহুদূর গিয়েছিলো।
৫. রিয়াল মাদ্রিদসূত্রে রাউল গঞ্জালেস বড়ো নাম
৬. রোনালদোর নতুন হেয়ার স্টাইল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রোনালদিনহোর রংধনু গোল। কাকার খেলা আলাদাভাবে ভালো লাগে। ডেনিলসনের ড্রিবলিং নজর কাড়ে
৭. পর্তুগালের লুই ফিগোদের সোনালি প্রজন্ম নিয়ে মাতামাতি।
৮. ইতালির ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরিকে ভালো লাগে।

২০০৬: বুয়েটের হলে উঠেছি। বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে পরীক্ষা পেছানো আন্দোলন। ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষে হল ভ্যাকেন্ট। তবে হলেই বেশিরভাগ ম্যাচ দেখা হয়েছে
১.মেসির অভিষেক।
২. ফাইনালে জিদানের লাল কার্ড পাওয়া

২০১০: বুয়েটের মোস্ট সিনিয়র ব্যাচ। পরীক্ষা পেছানো ইস্যুতে সিনিয়র-জুনিয়র মারামারি, হল ভ্যাকেন্ট। বেশিরভাগ ম্যাচই দেখা হয়নি।
১.ফাইনাল ম্যাচ দেখা হয়েছিলো ঢাকা ভার্সিটি সূর্যসেন হলে। নেদারল্যান্ড ভালো খেলেও স্পেনের বিশ্রি ফুটবলের কাছে হেরে গেলো।

২০১৪: পিঁপড়া টিম, ক্রিকেট টিম নিয়ে অন্যরকম গ্রুপে দারুণ ব্যস্ত সময় পার করছি। প্রথম ম্যাচের দিন মানিকগঞ্জে ছিলাম ক্রিকেট টিমের ট্যুর উপলক্ষ্যে।
১.হামাস রদ্রিগেজ নামের তারকার আবির্ভাব
২. জার্মানির সাথে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের পূর্বে ব্রাজিলের জাতীয় সঙ্গীত পর্বে নেইমারের ছবি নিয়ে খেলোয়াড়দের বাড়তি আবেগ প্রকাশ
৩. ইরানের বিপক্ষে মেসির অদ্ভুত গোল
৪. ফাইনালে হিগুইয়েনের গোল অফসাইডের কারণে বাতিল।

২০১৮: মাত্র ৬২৫ পৃষ্ঠার দীর্ঘ বই লেখা সমাপ্ত। উনিশ- তেইশের ১০ মাস পূর্ণ। অন্যরকম গ্রুপের সাথে ৯ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের উদ্যোক্তাজীবন শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কবে বিশ্বকাপ শুরু সেটাই জানি না। ৫-৬টা ম্যাচ দেখার ইচ্ছা, বিশেষত জার্মানি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, পর্তুগালের ম্যাচগুলো লিস্টে রেখেছি। বোনাস হিসেবে আরো কয়েকটা ম্যাচ ঢুকে যেতে পারে। কে চ্যাম্পিয়ন হবে জানি না, তবে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা হবে না এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। বাংলাদেশে বিশ্বকাপ উৎসব বজায় রাখার জন্য হলেও এই দুটো দলের অন্তত কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যাওয়া উচিত। দুই দলের সমর্থকরা একে অপরের বিপক্ষে যেসব হিউমারাস মন্তব্য করে, সত্যি বলছি, অতুলনীয়। একেই বলে ফ্যান্ডম…

শূন্য, ইংরেজি o, বৃত্ত, পৃথিবী- সবগুলোর আকৃতিতে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়; এটা কি নিতান্তই কাকতালীয়? ফুটবলকে শূন্যের সাথে তুলনা করলে অত্যুক্তি হবে? আকৃতি তো একইরকমই লাগে।
এবার তাহলে আবারো ভাবি, খেলোয়াড় সংখ্যা ১১ জন কেন।
ফুটবল খেলাটা ভালো লাগে না। ফুটবল খেলাটার পেছনে আরো সময় দিতে হবে। ফুটবল খেলাটা ভালো লাগে না। ক্রিকেট, ফুটবলে ১১ জন প্লেয়ার কেন? ফুটবল খেলাটা ভালো লাগে না। ভাঙ্গা রেকর্ড বন্ধ, ইঁদুর পঁচা গন্ধ….