মিডিয়ার সাকিবকে দরকার। তাই যেভাবেই হোক আমাকে ক্রিকেটে রাখেন’।— শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্ট না খেলে আইপিএল এ অংশ নেয়াহেতু সৃষ্ট বিতর্কের প্রেক্ষিতে উৎপল শুভ্রের ওয়েবসাইটে সাকিবের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল, সাকিব স্বয়ং এই বক্তব্যটি দিয়েছিল।
বক্তব্যটা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এমন অনেক কিছুই ভাবনাগোচর হবে যা ক্যাজুয়াল মুডে উপলব্ধি বহির্ভূত থাকবে।
গতকাল সাকিবের ঘটনার পরে প্রায় সকল ক্রিকেট কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ৩-৪টি বড় ক্রিকেটগ্রুপ এবং অন্তত ৫০ জন ব্যক্তির স্ট্যাটাস পর্যালোচনা করলাম।
আতংকের বিষয় হলো ‘সাকিব এপোলজিস্ট’ হিসেবে একটা অদ্ভুত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে। এদের ইনটেনশন এবং মোটিভ বোঝার প্রয়াস চালালে ক্রিটিকাল থিংকিংয়ে মূল্যবান এন্টারপ্রেটেশন পাওয়া যেতে পারে।
এন্টারটেইনারের নিয়তি বড়ো বেদনার। মার্কেট যতদিন থাকে সবাই তার গোলাম, মার্কেট পড়ে গেলে রাস্তার হকারও তাকিয়ে দেখে না। চিন্তা-দর্শন-আইডিওলজির অনুশীলনে এন্টারটেনাররা চিরপরিত্যাজ্য; তাদের সঙ্গে সম্বন্ধটাই সাময়িক লেনদেনের। একারণে এন্টারটেইনারের অন্ধভক্তদের বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি সারাজীবনে। এদের প্রায় ৯৫% এরই বয়স ১২ থেকে ৩০ এর মধ্যে, সিরিয়াস উপার্জন শুরু করেনি বা করলেও গ্রোথ ভাবনা কম; ব্যস্ততা বা এনগেজমেন্ট বাড়লে অন্ধভক্তি আপনাআপনিই ছুটে যাবে। এদের অন্ধভক্তিকে অকর্মণ্যতা বা আলস্য ইস্যুতে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা যায়। এরা নিজেরা কনটেন্ট ক্রিয়েট করে কদাচিৎ; বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা কনটেন্ট সাবস্ক্রাইব করে সেগুলো প্রোপাগেট করার চেষ্টা চালায়। গুরুর জন্য এরা জীবন দিতে পারে, নিতেও পারে।
কিন্তু ত্রিশোর্ধ একটি শ্রেণি লক্ষ্য করছি যারা সাকিব ঘটনা/অঘটন ঘটানোমাত্র ইন্টারেস্টিং/এক্সাইটিং সব ডিসকোর্স তৈরি করে, বজ্রের গতিতে সেসব থিওরি/ডিসকোর্স ভাইরাল হয়।
অনুমিতভাবেই একটি কাউন্টার ফোর্স তৈরি হয়েছে যারা থিওরি প্রস্তাব না করলেও সামাজিক অনুশাসন, ডিসিপ্লিন, ক্রিকেটিয় স্পিরিট, এথিকাল বাউন্ডারি প্রভৃতি গ্রাউন্ডের ধোয়া তুলে সাকিবের সমালোচনা করে, এবং সমমনরা সমন্বিত হয়ে সাকিব কতটা খারাপ কালচার তৈরি করছে সে তর্কে-বিতর্কে প্রশান্তি লাভ করে।
হুমায়ূন আহমেদ পরবর্তী যুগে সাকিব ব্যতীত ২য় কোনো এন্টারটেইনার পেলাম না যার কার্যাবলীকে ডিফেন্ড করতে দ্রুততম সময়ে থিওরি তৈরি হয়ে মগজান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এবং ইন্টারেস্টিংলি, পরবর্তীতে সেসব থিওরির মধ্যে পছন্দসইটা সাকিবের সাথে মিলেও যায়, যা পরবর্তীতে কোনো প্রমোশনাল ফেসবুক লাইভসূত্রে জানতে পারি।
ইতোমধ্যেই সাকিবের স্ট্যাম্পে লাথি মারার কার্টুন/পোরট্রেইট এ সয়লাব হয়েছে ভার্চুয়াল ক্রিকেট পাড়া। ফাটাকেস্ট মিঠুন চক্রবর্তীর ন্যায় সাকিব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, এটা নাকি বিসিবির দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের মুখে লাথি।
কিন্তু খটকাটা অন্যত্র!
দুর্ব্যবহার প্রশ্নে সাকিবের কিংবদন্তীতুল্য ইমেজের ব্যাখ্যা কী?
যেমন,
ইতোপূর্বে বিপিএল এর আসরে আম্পায়ার তানভীরকে বাইনচোত গালি দেয়া বা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহারের সময় সাকিব ঠিক কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল? তখন তো কোনো দুর্নীতি হয়নি। কিংবা গত সপ্তাহেই সংবাদ এসেছে সাকিবসহ মোহামেডান টিম বায়ো-বাবল ভেঙ্গেছে; সাকিবের জায়গায় যদি শামসুর রহমান শুভ কিংবা মোহাম্মদ মিঠুন বায়োবাবল ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হতো, সাকিব যেভাবে পার পেয়েছে তাদেরও সেই সৌভাগ্য হতো কিনা?
গত ২-৩ বছরে প্রথম আলো আর বিডিনিউজে ২য় আর ৩য় বিভাগ লীগে পাতানো ম্যাচ নিয়ে প্রচুর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, টিভি চ্যানেলেও ছিল রিপোর্ট, কিংবা শেষ ৮-৯ বছরে প্রিমিয়ার লীগে যে আবাহনী মাফিয়াগিরি করছে এটা নিয়ে কম করে হলেও ৭০টা রিপোর্ট ছাপা হয়েছে; সোস্যাল মিডিয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পোস্ট শেয়ারের বাইরে উত্তেজনার পারদ তৈরি হয়নি।
সাকিব স্ট্যাম্পে লাথি মারা আর উপড়ে ফেলার পরে থিওরি এলো আবাহনীর অন্যায় সুবিধার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
আপনি কি মনে করেন এর মাধ্যমে পাতানো খেলা বন্ধ হবে? এই প্রতিবাদের ব্যাপ্তি কতক্ষণ?
আজ শনিবার; আসন্ন বুধবারে এ সংক্রান্ত একটা নিউজ বা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখবার সম্ভাবনা কতখানি? সর্বোচ্চ যেটা হতে পারে, লোকলজ্জার কারণে আবাহনীকে ফাইনালে উঠানো হবে না, ৩য় বা ৪র্থ পজিশন দিয়ে ধামাচাপা দেয়া হবে। সাকিব নিজে অতীতে আবাহনীতে খেলে অন্যায্য সুবিধা নিয়েছে, আগামী বছর আবাহনীতে খেললে আবারো নিবে—- এটা কি খুব দুর্কল্পনা?
তাহলে সাকিব কেন করে থাকতে পারে কাজটা? সে রগচটা সহজভাবে এটাই হয়ত কারণ মনে হবে। ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগে স্যামুয়েলস, পোলার্ড রা মেজাজ হারানোর বেশ কিছু নিদর্শন দেখিয়েছে। সাকিব গত এক দশকে অসংখ্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগে অংশগ্রহণ করেছে, মেজাজ হারানোর দৃষ্টান্ত কয়টা? আন্তর্জাতিক ম্যাচে কয়েকবার এরকম দেখেছি; ২০১৬ এশিয়া কাপ টি২০ তে পাকিস্তানের বিপক্ষে চেজিংয়ে ক্রুশিয়াল মুহূর্তে মোহাম্মদ আমিরের বলে বোল্ড হয়ে ব্যাট দিয়ে স্ট্যাম্পে আঘাত করেছে হতাশামিশ্রিত ক্ষোভ থেকে, যদিও পরক্ষণেই দুঃখ প্রকাশ করেছে। ঘরোয়া লীগকে সে গোনায় ধরে না, বহুবার বলেছে। মূলত এটাই তার এটিচুড নির্ধারণ করে হয়ত। কিংবা চলতি লীগেই প্রতিপক্ষ দলের তরুণ খেলোয়াড়রা তাকে মাঠে পেয়ে প্রায় পাল্লা দিয়ে সেলফি তুলেছে, এমন প্রতিবেদনও চোখে পড়েছে। সেলিব্রিটি ইজম ক্রিকেটার সত্তাকে অতিক্রম করে যাওয়াতেই বারবার সমস্যাগুলো ঘটে অনুমান করছি। একজন আম্পায়ারের সোস্যাল স্ট্যাটাস কতটুকু? সে কি আইসিসির এলিট প্যানেলভুক্ত; তার সর্বোচ্চ অর্জন হয়তবা হোম সিরিজের ২-১ টা ম্যাচে আম্পায়ারিং, আইসিসির কোনো ইভেন্টে সে ডাক পায়? ধারে-ভারে এতটা পিছিয়ে থাকা আম্পায়ার যখন তাকে গুরুত্ব দেয় না, বা আপাত ন্যায্য দাবিকে অগ্রাহ্য করে— তখনই খ্যাতি-ক্ষমতার প্রশ্নটা সামনে আসে। ক্ষমতাবানেরা চাটুকারিতা আর নিঃশর্ত আনুগত্য অপরিসীম পছন্দ করে। আবাহনী আওয়ামিলীগের আনুকূল্যপুষ্ট দল, সাকিব নিজেও কি তা নয়? তাহলে আম্পায়ার তাকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছে কেন!— ক্ষমতাবানেরা ব্যক্তিগত ইগোরক্ষায় জীবন বিসর্জন দিতেও পিছপা হয় না, প্রয়োজনে অন্যের জীবন নিতেও কুণ্ঠাবোধ করে কদাচিৎ; ক্ষমতার সামাজিক মনস্তত্ব এভাবেই কাজ করে।
সাকিব জানে এধরনের ঔদ্ধত্যের শাস্তি কী হতে পারে; কয়েক ম্যাচ সাসপেন্ড, কিছু আর্থিক জরিমানা; এর বেশি কী হতে পারে? তার এপোলজিস্টরা হাজারে-বিজারে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন প্রান্তে, তার হয়ে তারাই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই শুরু করবে, সেগুলো প্রবাহিত করতে ডাই হার্ড অন্ধ ভক্তরা তো বসেই থাকে। সুতরাং হেডম দেখাতে সমস্যাটা কোথায়। তাছাড়া নিষিদ্ধ অবস্থা থেকে ফেরার পর পারফরম্যান্সের অবস্থা শোচনীয়; ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো বোলিংয়ের উপর নির্ভর করে দলে থাকার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হচ্ছে, ব্যাটিংয়ের রিফ্লেক্সের শোচনীয় অবস্থা।ডেটা বলছে আনকনভেনশনাল ব্যাটিং এপ্রোচের প্লেয়াররা একবার ব্যাডপ্যাচে পড়লে রিকভার করতে দীর্ঘ সময় লাগে, কেউ কেউ পারেও না৷ এটাও মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত রাখতে পারে। তবে সেজন্য যে সে এমন হেডমগিরি দেখায়নি, তা থিওরি তৈরি না করেও বলা যায়।
সাকিবের কেইসটা নিয়ে তাই বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই৷ বরং আমি কৌতূহলী এপোলজিস্টদের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্বের ব্যাপারে। এদের ডেমোগ্রাফিক অবস্থান, অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস,আদর্শিক এফিলিয়েশন/ইন্টারেস্ট প্রভৃতি ফ্যাক্টর বিশ্লেষণ করলে একটি প্যাটার্ন পাওয়া অবধারিত। ইন্টারেস্টিংলি এদের অনেকেই ক্রিকেট অনুরাগী নয়, কিন্তু সাকিব প্রসঙ্গে দেশের ক্রিকেট কালচার, প্রশাসন বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ তাত্ত্বিক আলোচনায় প্লাবিত হয় নিজেরাই। এর সম্ভাব্য কারণ কী, সাকিবের এত প্রভাবের উৎসটাই বা কোথায় নিহিত, প্রশ্ন সেটাই।বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে বরাবরই হাঁস-মুরগির খামার মনে হয়, যারা জিম্বাবুইয়ে আর পতিত উইন্ডিজের কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। হাস-মুরগির খামারে সাকিব আকৃতিতে সামান্য বড়ো একটা হাঁস অথবা মোরগ; কিন্তু এপোলজিস্ট গ্রুপ যেরকম ওভার-প্রটেক্টিভ তার ব্যাপারে, এটা মোরাল ক্রাইসিস তৈরি করার কথা। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার বাঁশির সুরে প্রথমে ইদুর ঘরছাড়া হয়, পরে শহরের শিশুরা। সামষ্টিক হিপনোটাইজেশন কীভাবে তৈরি হলো; এটা স্বতঃস্ফূর্ত, নাকি কৌশলগতভাবে তৈরিকৃত— এপোলজিস্টদের নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করলে হয়তবা কিছু হাইপোথিসিস তৈরি করা যাবে। কিন্তু সময় আর ইচ্ছার স্বল্পতায় ভাবনাটা থেমে আছে। ইয়াং ব্লাডদের কেউ আগ্রহ পেলে ভ্যালুয়েবল ইনসাইট পাওয়ার সুযোগ যথেষ্ট!
সাকিবকে সমর্থন-অসমর্থনের চাইতে নির্মোহভাবে ক্ষমতার দলীয় এবং ব্যক্তিগত দুর্বৃত্তপনার সার্থক নমুনা হিসেবে তাকে নিরীক্ষণ আর পরীক্ষণ করুন; দিনশেষে সুজন-সাকিব কিন্তু বুক মিলিয়ে কোলাকুলিই করে!