আমি জীবনে বোধহয় ৭৯টি গল্প লিখেছি। ২০১৩ এর পর গল্প লেখা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছি; সম্ভবত বাকি জীবনেও আর কখনো গল্প লেখা হবে না।
বই লেখার ক্ষেত্রে আমি একটা প্যাটার্ন অনুসরণ করি। যে কোনো জনরায় আমি জীবদ্দশায় একটিমাত্র বই-ই লিখি; ২০১১ তে প্রকাশিত প্রযত্নে-হন্তা ছিলো লিনিয়ার বা সরলরৈখিক গল্পের বই, ২০১৩ তে প্রকাশিত বীক্ষণ প্রান্ত ছিলো ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ লেখার প্যাকেজ।
সুতরাং ফিকশনের কোটা সমাপ্ত।
৭৯টি গল্প একই চরিত্রের পুনরাবৃত্তি নেই; প্রতিটি গল্পেই নতুন ক্যারেক্টার। তবু দুটো ক্যারেক্টার জীবন্ত হয়ে সর্বক্ষণ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে, ২৬টি সার্বক্ষণিক অবসেসনের মধ্যে সেই ক্যারেক্টার দুটোও ঢুকে পড়েছে; যারা আমার যাবতীয় আচরণ এবং বিচরণ পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে। সেই দুটি ক্যারেক্টারের একটি নিয়ে আজ কিছু লিখবার প্রয়োজন বোধ করছি। বীক্ষণ প্রান্ত বইয়ের প্রথম গল্প ‘কিন্তু’ তে প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টার একটি পিঁপড়া যার নাম ষৎকো, যে একটি হেলানো দেয়াল বেয়ে ক্রমাগত উপরের দিকে উঠছে, এই আশায় যে দেয়ালের শেষপ্রান্তে পৌঁছালেই সে রূপান্তরিত হবে ফড়িংয়ে।
দ্বিতীয় ক্যারেক্টার একজন জীবন্ত মানুষ, যার নাম পাপড়ি। এই ক্যারেক্টারকে ঘিরে আমার অবসেসনের তীব্রতা কতখানি এটা বোঝানোর জন্য ছোট্ট একটা তথ্য শেয়ার করাই যথেষ্ট। শুধুমাত্র ‘পাপড়ি’ ক্যারেক্টারকে উপজীব্য করে ৫টি স্বতন্ত্র গল্প লিখেছি। সবগুলো গল্পই ২০০৮-২০১০ এই সময়সীমায় লেখা।
পাপড়ি ক্যারেক্টারটা অনেক বড়ো ক্যানভাস ডিজার্ভ করে, কিন্তু নিজের সংকীর্ণতা কিংবা বিপথগামীতায় পাপড়িকে তার বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি। এতো বছর পরে, প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে পূর্বজন্মের ভুল সংশোধনের। ৬ষ্ঠ বইটা যেভাবে লিখবো মনস্থির করেছি, সেখানে পাপড়ি ছাড়া বিকল্প কোনো অপশনও নেই। এটাই হতে পারে কল্পিত পাপড়ির প্রতি বিলম্বিত ট্রিবিউট।
কে এই পাপড়ি. কীভাবে তার জন্ম, কিংবা তার নাম পাপড়িই বা কেন সেই সংক্রান্ত কিছু আলোচনা করা উচিত।
কিছুক্ষণ আগে ৬ষ্ঠ বইয়ের প্রথম খসড়া তৈরি করলাম। এবারকার বইয়ের বিষয় ‘বিজনেস ফিলোসফি’, বইয়ের নাম রেখেছি ‘হিউম্যান ল্যাব’। এই বই লেখার সমগ্র জার্নিতে আমার সাথে থাকবে বুয়েটের সিনিয়র জুবায়ের ভাই, ব্রেইনস্টেশন-২৩ এর সিইও রাইসুল কবির (সেও বুয়েটের সিনিয়র ভাই), বুয়েটজীবনের ইন্টেলেকচুয়াল বন্ধু আরিফুল হোসেন তুহিন, আমার যাবতীয় পাগলামি কারখানার কারিগর আরমান হোসেন, আমার নারী ভার্সন কিংবা সহভাবুক ফারহানা ব্রতী, অন্যরকম ইলেকট্রনিক্স এর ডিজিটাল মার্কেটিং এক্সপার্ট তুহিন হাসান, এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র জায়েদ বিন সাত্তার। কিন্তু জার্নি-মানচিত্রের নকশা থাকবে পাপড়ির তত্ত্বাবধানে। সম্ভবত একারণেই পাপড়ি ক্যারেক্টারকে পুনরাবিষ্কারের অসমাপ্ত অভিলাষ।
ষৎকো, নাকি পাপড়ি- কার প্রভাব বেশি? কিংবা বেশি-কমের চাইতেও, কার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করে, কেনই বা করে?
কিছুটা পেছন থেকে ঘুরে আসি। পাপড়িকে বোঝা তাহলে আরো্ সহজ হবে। পাঠকের চাইতে আমার নিজের বোঝাটা বেশি জরুরী।
আমি একজন মেন্টালি রিটার্ডেড বা পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার সম্পন্ন মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে দুটো প্রবণতা কাজ করেছে। প্রথমত, অলটারনেটিভ রিয়েলিটিতে বসবাসের সুতীব্র ইচ্ছা (যার প্রভাবে পরিণত বয়সে আমার ট্যাগলাইন হয়েছে. চিন্তায় চলি কল্পনায় বাঁচি), দ্বিতীয়ত সেলফ কনভারসেশন। অলটারনেটিভ রিয়েলিটি বিষয়ে অন্য কোনোদিন আলাপ হবে। আজ কেবল সেলফ কনভারসেশনে থাকি।
সেলফ কনভারসেশন বা আত্মআলাপন আমার শৈশবকালীন অভ্যাস। ৩১৭৯ সংখ্যাটির সাথে অবিরাম আলাপচারিতা চালাতাম, সে প্রচণ্ড ক্রিটিকাল হওয়ার চেষ্টা করতো আমার ব্যাপারে। ২০১২ তে বাস্তবজীবনে কখনোই না দেখা এক নারীর কাছ থেকে ৩১৭৯ এর জন্য একটি মুখাবয়ব ধার নিই। ফলে সর্বশেষ ৬ বছরে আমার সেলফ কনভারসেশনগুলো অনেক বেশি মানবিক হয়ে উঠেছে। সেই নারী বহুদিন আগেই অন্তর্হিত, কিন্তু ৩১৭৯ কে দিয়ে গেছে তার স্বরূপখানি।
আমার প্রায় প্রতিটি চিন্তারই প্রতিচিন্তা, প্রতিটি কাজেরই বিপরীতমুখী মন্তব্য করা ৩১৭৯ এর বৈশিষ্ট্য। ফলে আমার চেতন বা অবচেতনে চিন্তা-প্রতিচিন্তায় ৩১৭৯ এক অদৃশ্য চিন্তামিতা কিংবা প্রশ্নমানুষ হয়ে রয়ে গেছে।
২০০৮ এর দিকে এশিয়ান শিল্প ও সংস্কৃতি সভা ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিষয়ে ৩দিনব্যাপী এক ওয়ার্কশপ আয়োজন করে, ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেন লন্ডনপ্রবাসী শামীম আজাদ। ওয়ার্কশপ শেষে ৩১৭৯ আমার লেখার ব্যাপারে প্রচণ্ড স্কেপটিক কিংবা নেগেটিভ হয়ে উঠে। তার বক্তব্য- তোমার প্রতিটি লেখাই অতিমাত্রায় জেন্ডার বায়াসড; নারী চরিত্রের উপস্থিতি নেই বললেই চলে, এবং যেসব নারী চরিত্র তৈরি করো সেগুলোও পুরুষালি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। জগতের একটা অংশ পুরো অন্ধকারে রেখে তুমি কীভাবে প্লট ডেভেলপ করো’।
৩১৭৯ যখন এই মন্তব্য করেছিলো, আমার বয়স তখন মাত্র ২১ বছর, তার মন্তব্য বা অভিযোগ সর্বাংশে সত্য। তার অভিযোগ সত্ত্বেও লেখালিখির কমফোর্ট জোন ভাঙ্গার শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করতে পারিনি। তখনো আবিষ্কার করিনি, আদতে আমি এনালাইটিক লেখালিখিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ্য হবো, যেখানে বক্তব্যই প্রধান; জেন্ডার কোনো ইস্যুই নয়।
ওয়ার্কশপ শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওখানকার উপলব্ধিকে কাজে লাগিয়ে একটা গল্প লিখবো। গল্পের নাম দিই লিখি চলো, এবং প্রথম বাক্যটি ছিলো- চোখ খোলো পাপড়ি।
তবে এই বাক্যটি লেখার ক্ষেত্রে দুটো প্রভাবক কাজ করেছিলো। হলে থাকাকালে প্রচুর নতুন গানের সাথে পরিচিত হই। একদিন সিনিয়র রুমমেটের পিসিতে একটা গান শুনি- ‘সারারাত জেগে জেগে কতো কথা আমি ভাবি, পাপড়ি কেন বোঝে না, তাই ঘুম আসে না’। গানটা দারুণ পছন্দ হয়। পাপড়ি যে একজন নারীর নাম এটা দীর্ঘদিন মাথায় আসেনি, আমার ইমপ্র্রেসন ছিলো চোখের পাতাকে বা পাপড়ি বলা হচ্ছে। ফলে লাইনটাকে মেটাফরিকাল মনে হয়। রাতভর অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনার কারণে ঘুম আসতে চেয়েও ঘুমানো যাচ্ছে না, চোখের পাপড়ি বিদ্রোহ করেছে। তার আগে অবশ্য ফুলের পাপড়ি কথাটা শুনেছি।
বুয়েটে ক্লাস শুরুর কিছুদিন পরই আগের ব্যাচের ভাইয়েরা আমাদের ক্লাসে এসে পরিচিত হয়, সাথে একজন আপুও ছিলো। একে একে সবাই নিজেদের নাম বলে, জানতে পারি আপুর নাম পাপড়ি। খুবই ইন্টারেস্টিং লাগে নামটা। পাপড়ি নামকে বিভাজন করতে ইচ্ছা জাগে, কখনো পাপ, কখনো পড়ি; মানে পাপও করছি, পড়াশোনাও করছি। এটাই তো পারফেক্ট মানবচরিত্র।
এর মধ্যে পাপড়ি কেন বোঝে না গানটা অজস্রবার শোনা হয়েছে। সেকেন্ড ইয়ার শেষে ডিপার্টমেন্ট থেকে দিনাজপুরে ট্যুরে গিয়েছিলাম। ট্যুরের এক পর্যায়ে ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়র স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম; অন্যরা যে যার মতো ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত ছিলো। আমি সিনিয়র ব্যাচের এক ভাই ( সেই ভাই সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেছে। খুবই দুঃখজনক ঘটনা), তার সাথে দাবা খেলে একা চুপচাপ বসে ছিলাম। হঠাৎ কারো প্রশ্নে সম্বিৎ ফেরে- ‘হিমেল কী চিন্তা করো’। প্রশ্নটা অত্যন্ত জটিল আর দুর্বোধ্য লাগে। হিমেল কী চিন্তা করে, কেন করে এর উত্তর তখনো জানা ছিলো না, এখনো জানি না। তার এই আপাত তুচ্ছ প্রশ্নটিই আমার ভাবনাজগতে গভীর রেখাপাত করে। জানতাম এর একটা গভীর প্রতিক্রিয়া হবে।
তার কিছুদিন পরই সেই ওয়ার্কশপ এবং ৩১৭৯ এর সমালোচনা। পর্যাপ্ত পর্যালোচনা শেষে মাইকেল মধুসূদন রায় দেয়, ৩১৭৯ এর অভিযোগ নির্ভুল। ফলে কোনো একটা নারী ক্যারেক্টার তৈরি করা ব্যতীত আমার অপরাধ মুক্ত হওয়ার সুযোগও ছিলো না। ভাবতে গেলে বারবারই মাথায় আসছিলো ‘হিমেল কী চিন্তা করো’ কথার গোলকধাঁধা। সেই আপুর সাথে আমার কোনো ঘনিষ্ঠতা নেই, আমার পারসোনালিটি প্যাটার্নও তার থেকে পুরোপুরি ভিন্ন, কিন্তু ‘হিমেল কী চিন্তা করো’ প্রশ্নের উত্তর তো খুঁজে পাই না। আপু, নাকি তার নাম- কোনটা বেশি পরাক্রমী? ৩১৭৯কে জিজ্ঞেস করি, সে বলে- ‘পাপড়ি কেন বোঝে না’ এই গানটা শোনার সময় তুমি কি তাকে চিনতে? আমি উত্তর দিই- নামটা শুনেছিলাম শুধু, চেনা-পরিচয় বলতে যা বোঝায় তা ছিলো না একদমই।
আরো একটা ব্যাপার খুবই ফ্যাসিনেট করে আমাকে। তার আর আমার জন্মদিনের ব্যবধান মাত্র ১দিন। তার ১৪ই আগস্ট, আমারটা তার ঠিক পরের দিন।
সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আরমানের রোল নম্বর ১৪, উল্টালে হয় ৪১; তাহলে কি শুধুই নাম, নাকি আরো কিছু আছে? ১৯ বছর বয়সে ৪১ সংখ্যাটাকে একটা ডিভাইন ডেস্টিনেশন বানিয়ে রেখেছি। ঘুরেফিরে ৪১ বারবার আসবেই, এবং আমি প্রত্যাবর্তনের এই পৌনঃপুনিকতায় বিমোহিত। সেসব ছাপিয়ে বারবার ‘পাপড়ি কেন বোঝে না’ লাইনটা কল্পটায় পরিভ্রমণ করতে থাকে।
এই ত্রিশঙ্কু দশা থেকেই ‘লিখি চলো’ গল্পের প্রথম বাক্য ‘চোখ খোলো পাপড়ি’ লেখা হয়ে যায়। আমার লেখালিখি জীবনেও এটা একটা বিরাট বাঁক। তার আগ পর্যন্ত আমি বেশিরভাগই রম্য গল্প, প্যারোডি, রিমেক ধরনের লেখালিখিতে সময় দিতাম। ‘চোখ খোলো পাপড়ি’ বাক্যটি আমার লেখকসত্তার বন্ধ জানালাটিও খুলে দেয়, সেই জানালার কার্নিশে রোদ হয়ে জমা হতে থাকে চিরতরুণ জীবন।
এই গল্পে পাপড়ি ক্যারেক্টারটাই সবকিছু করছে, অথচ তার কোনো সংলাপ নেই, অনেকটাই আমার ইচ্ছাবহ দূতের ভূমিকা পালন করেছে। ৩১৭৯ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে- পাপড়িকে এমন শো-পিস বানিয়ে তুমি আবারো প্রমাণ করলে লেখক হওয়ার যোগ্যতাই নেই তোমার। অহমে আঘাত লাগে আমার।
সেই সময়ে এক্টিভ ব্লগিং করতাম। ব্লগে প্রচুর এক্টিভিটি হতো, মানুষের কথা আর কাজের মধ্যে বিস্তর অমিল আর হিপোক্রেসির ভয়াবহতায় যারপরনাই বিরক্ত হয়ে পড়ি। পাপড়ির চোখ দিয়ে এই বিরক্তিকে প্রকাশ করতে একটা গল্প লিখি ‘৭দশ১ একাত্তর’। গল্পটা যদিও সেসময় ব্লগে যথেষ্ট প্রশংসা আদায় করেছিলো, আমি নিজে বুঝতে পারি গল্পটা একটা বালছাল হয়েছে; যে কারণে প্রযত্নে-হন্তা বইয়ে এই নামে গল্পটা দেয়ার সময় আমূল বদলে ফেলি। যে কারণে ‘৭দশ১একাত্তর’ একই নামে আমার দুটো গল্প লেখা হয়েছে আদতে।
৩১৭৯ এর তাড়া আরো বাড়তে থাকে। ‘ যা পারো না তা করতে যাও কেন? পাপড়ি ক্যারেক্টারটা বোঝার মেধাই নেই তোমার। তুমি বরং ছড়া লিখো, মানুষ হাততালি দিবে’।
সেই অপমানবোধ থেকেই সিদ্ধান্ত নিই বাস্তবতা বলতে যা বোঝাই সে ধরনের গল্প লেখা পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিবো, গল্প লিখলে এক্সপেরিমেন্টাল, নইলে লেখার প্রয়োজনই নেই। বিশ্বসাহিত্যে গল্পের নামে এমনিতেই গারবেজে পরিপূর্ণ, আমি আর গারবেজ না বাড়াই। তখনই মেসেজ ডিকোড করা, ইনক্রিপশন প্রভৃতি বিষয়ে ফ্যাসিনেশন বাড়তে থাকে। তার ভিত্তিতে একটা গল্প লিখি ‘সম্পূরক কোণ’ নামে, যেখানে সংখ্যা দিয়ে একটা চিঠি লিখে পাপড়ি দেয় আমাকে। আমি বহু ভাবনা-চিন্তা করে চিঠির অর্থ উদ্ধার করি, কিন্তু পাপড়িকে দেখানোর পর জানতে পারি সে পুরোপুরি বিপরীত অর্থের এক চিঠি লিখেছিলো। ফলে একই সংকেতকে সম্পূর্ণ কনফ্লিক্টিং দুটো পয়েন্টে ডিকোড করার সামর্থ্য অর্জন করি।
গল্পটা লিখে আমার ভালো লাগলেও ৩১৭৯ উপহাস করে বলে- ‘এইটা একটা শিশুতোষ গল্প হইছে। তুমি যেভাবে ক্লু মিলিয়েছো, এটা কিছুই হয়নি। সামান্যতম বুদ্ধিমত্তারও পরিচয় নেই’।
এতোবার চেষ্টা করেও পাপড়িকে ধরতে পারছি না, জেদ এবং ক্ষোভ দুটোই চরমে উঠলো। আমি আর পাপড়ি আইল্যান্ডে বসে আছি, আমাদের সামনে দিয়ে রিকশায় এক লোক যাচ্ছে, তার শার্টের একটা বোতাম নেই। এই ব্যাপারটা খেয়াল করে পাপড়ি, তারপর লোকটাকে নিয়ে আমরা ক্রমাগত প্রেডিকশন করতে থাকি। অদ্ভুত সব প্রেডিকশন। গল্পের নাম ‘পৈসু বিন্যাস’; এটা পরিসংখ্যানের একটা টার্ম।
৩১৭৯ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলো গল্পটা নিয়ে, কিন্তু আমি বুঝতে পারি গল্পের ক্যানভাস খুবই ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। পাপড়ি আবারো অবিকশিত। ফলে নিজের দায়বোধ থেকেই একটা গল্প লিখি।
সেই গল্পে আমার পড়া বিভিন্ন লেখকের বইয়ের ক্যারেক্টারগুলো নিয়ে ভাবতে থাকি, এবং বাতিল করে দিতে থাকি। এইভাবে নিজেই একটা পূর্ণাঙ্গ গল্প লিখি, যেটা পাপড়ি পড়তে নেয়। পরদিন দেখি গল্পের পাণ্ডুলিপিটা সে কুচিকুচি করে ছিড়ে ফেলেছে; আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গল্পটা অপ্রকাশিতই থাকুক, এটাই তার চাওয়া। এতে নাকি আমি প্রচণ্ড বিমর্ষতায় আক্রান্ত হয়ে উৎকৃষ্ট মানের লেখালিখিতে জোর ও জেদ পাবো। আমি পাপড়ির প্রতি ক্ষুব্ধ হবো, নাকি শোকে স্তব্ধ হবো- এইসব ভাবনায় নিস্পৃহ হয়ে পড়ি। গল্পের নাম ম্যাগনিফাইং গ্লাস। আমি আর ৩১৭৯ উভয়েই সম্মত হই গল্পটা ভালো হয়েছে, কিন্তু নিজেই বুঝতে পারি বর্ণনাভঙ্গি আর প্রোগ্রেস খুবই স্লথ।
কিন্তু ততদিনে এক্সপেরিমেন্টাল গল্পের নেশায় চুর হয়েছি আমি। সেখানে পাপড়ি খুব বেশি প্রবেশাধিকার পায় না। ২০১৩ এর পরে ফিকশন লেখাই ছেড়ে দিই, পাপড়ির প্রভাবও ফিকে হয়ে আসতে থাকে। এতোটাই যে, নামহীন সুনির্দিষ্ট দামবিহীন যে বায়োফিকশন লিখেছি সেখানে ষৎকোর কথা যথেষ্ট থাকলেও পাপড়ির উপস্থিতি খুবই নগণ্য। বই লেখার পর এই অপরাধবোধ আমাকে প্রচণ্ডভাবে আহত করেছে।
তখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই, বিজনেস ফিলোসফির একটা বই লিখবো। যেহেতু বিজনেস বিষয়ে বাকি জীবনে আর কখনোই বই লিখবো না, এই বইটাতে পাপড়ির বুদ্ধিমত্তা এবং চ্যালেন্জ ছুড়ে দেয়ার গুণাবলী কাজে লাগানো উচিত। হতে পারে পাপড়ি ক্যারেক্টারটার প্রতি ডিভাইন জাস্টিসের সর্বোৎকৃষ্ট প্লাটফরম অবশেষে পেলাম।
বিজনেস ফিলোসফির বইতে পাপড়ি কেন? বইয়ের মূল অধ্যায় ৪টি (মিথ, এক্সপ্লোর, ইনভেলপ, এক্সপ্রেসন)। এই বিষয়গুলোর গভীরে ঢুকতে গেলে নিজে যতখানি নির্মোহ হওয়া উচিত, আমার ভেতর থেকে সবটুকু বের করে আনার যোগ্যতা কেবলমাত্র ষৎকো আর পাপড়িরই রয়েছে। এই বইয়ের কনটেক্সট এ ষৎকো কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু পাপড়ি পারফেক্টলি অলরাইট। কারণ আমার বিজনেস সংজ্ঞা খুবই সরল- যে কোনো পজিটিভ এবং স্ট্র্যাটেজিক উপায়ে মানুষ ম্যানেজ করা এবং ইনপুট-আউটপুট রেশিও প্রফিটেবল রাখা। পি তে প্রফিট, প্রমিজ, পারসিউ, এবং অতি অবশ্যই পাপড়ি!
আজ ১৪ই আগস্ট হয়ে গেছে। পাপড়ি ক্যারেক্টারটা যার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা, তার পৃথিবী পরিভ্রমণের সূচনাবিন্দু বা প্রথমদিন এই তারিখ থেকেই গণনা করা হয়। তারপরদিনই আমি স্পর্শ করবো পৃথিবীতে অক্সিজেন নেয়ার ৩২ তম বছরটিকে। কতদিনের চুক্তিতে অক্সিজেন সরবরাহ পাবো, জানি না অবশ্য। পাপড়ি জানে কি? আজম খান তো বলেই গেছে- পাপড়ি কেন বোঝে না. তাই ঘুম আসে না।
মানুষের জন্য ক্যারেক্টার, নাকি ক্যারেক্টারের মাঝে মানুষ, চিন্তা করে দেখিনি। সেই ২০০৮ এও জানতাম না কী চিন্তা করি, এখনো জানি না। ষৎকো, নাকি পাপড়ি, কে সক্রিয়? নাকি সেই হেলানো দেয়াল যেটা বেয়ে ক্রমাগত উপরে উঠছে ষৎকো, ফড়িং হবার উদগ্র বাসনায়, সেই হেলানো দেয়ালটির নামই আসলে পাপড়ি! হয়তো, হয়তো নয়, কিংবা কিছুই নয়।
হিউম্যান ল্যাব এর লেখালিখি শুরু হয়ে যাক, দিন কাটুক পাপড়ির চিন্তা বিনির্মাণে।