১. কোনো এক ঈদে ‘বড়ো ছেলে’ নামের এক টিভিনাটক জনপ্রিয়তার তোড়ে ভাইরাল হয়েছিলো অনলাইনে। কয়েক মাস ধরে সে নাটকের প্রশংসা-নিন্দা-সমালোচনামুখর লেখালিখি আর বাক্যালাপে আচ্ছন্ন ছিলো অনলাইন-অফলাইন।
২. হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশী সাহিত্যের জনপ্রিয়তম লেখক, এবং টিভি নাটকের ক্ষেত্রেও সম্ভবত জনপ্রিয়তম নাট্যকার। অয়োময় ব্যতিরেকে তার জনপ্রিয় আরো কিছু ধারাবাহিক নাটক বহুব্রিহী, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, নক্ষত্রের রাত, উড়ে যায় বকপক্ষী, চন্দ্র কারিগর প্রভৃতি।
৩. ব্যান্ডসঙ্গীত, ফোকসঙ্গীত এবং সিনেমার গানের বাইরে আরেকটি ধারা ৮০ এর দশকে এদেশে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। আধুনিক গান। রেন্ডম নির্বচনের মাধ্যমে কয়েকটি জনপ্রিয় আধুনিক গানের শিরোনাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে, কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে, আমি হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা, কী ছিলে আমার বলো না তুমি, তুমি আমার প্রথম সকাল, আমার মনের ফুলদানিতে। জনপ্রিয় আধুনিক গানের তালিকা করতে গেলে বিশাল এক বহর তৈরি হয়ে যাবে।
৪. প্রভাবশালী এবং গ্রহণযোগ্য মানুষের যদি কাঠামো নির্মাণ করতে চাই সেখানে যে সকল উপাত্তের উপস্থিতি নিশ্চিত থাকে- ন্যূনতম ১টি বহুতল ভবন, ১টি গাড়ি, ব্যাংকে কোটি টাকার সঞ্চয়, সরকারী দলে গুরত্বপূর্ণ পদ, আমলা, বিসিএস ক্যাডার (বিশেষত এডমিন, ফরেইন, পুলিশ, ট্যাক্স ক্যাটেগরি হলে ভালো), ব্যাংক বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর এমডি/সিইও, জাতীয় দলের ক্রিকেটার, রকস্টার, ফিল্মস্টার, বিভিন্ন প্রফেসর ডাক্তার, ভার্সিটিগুলোর ভিসি। আরো বেশ কিছুসংখ্যক উপাত্ত যুক্ত হতে পারে এর সাথে, তবে লেখার মূলভাব প্রকাশ করার জন্য যতটুকু বলা প্রয়োজন বলা হয়ে গেছে।
৫. সর্বশেষ কয়েক বছরে বলিউড, কলকাতা, দক্ষিণি, ঢাকাই সিনেমায় এক ধরনের গানের উদ্ভব ঘটেছে। সারা সিনেমার সাথে সাযুজ্যহীন সেইসব গানে ধুম-ধাড়াক্কা নাচ থাকবে,গানের লিরিক হবে চটুল প্রকৃতির, সেই ১ গানই সিনেমার বাণিজ্যিক সাফল্যে অনেকখানি অবদান রাখে। সিনেপাড়ায় এর নাম ‘আইটেম সং’। একটা গানের লিরিক এরকম-
যতই ঘুড়ি উড়াও রাতে, লাটাই তো আমার হাতে
স্বাভাবিক বিবেচনায় মনে হতে পারে ৫টি পয়েন্টে আলাদা বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। কিন্তু পয়েন্টগুলোর মধ্যে যোগসূত্র খুঁজতে গেলে পুলকিত হতে হবে। ৫টি পয়েন্টকে আমরা তখন মাত্র ২টি শব্দে একীভূত করতে সমর্থ হবো- ‘মিডলক্লাস মাইন্ডসেট’।
ছোটবেলায় সামাজিক বিজ্ঞান বইতে ‘শ্রেণিবিভাজন’ বিষয়ক আলোচনাগুলো পড়তে গলদঘর্ম দশা হতো আমার। সাহিত্য, নাটক বা সিনেমাতে কয়েকটি শব্দবন্ধ বহুল ব্যবহৃত- ‘মিডলক্লাস সেন্টিমেন্ট’, ‘মিডলক্লাস কমপ্লেক্স’, ‘টিপিকাল মিডলক্লাস’। যে কোনোকিছুর জন্য মধ্যবিত্তকে দোষারোপ করা, তার দিকে আঙ্গুলি তোলা, তাকে শিল্প-সংস্কৃতি-রুচি-নীতি-আদর্শের ধারক-বাহক জ্ঞান করা এবং সবশেষে তাকে ‘হিপোক্রেট’ হিসেবে বিশেষায়িত করা— অভিমন্যূর মতো এক দুর্ভেদ্য চক্রব্যূহে আটকে পড়া এক চিন্তাকাঠামো যেন।
এসব লক্ষণ দেখে ভাবতে ইচ্ছে করে পৃথিবীটাই যেন মধ্যবিত্তের। এর সাথে যদি মিডিওক্রিটিকে যোগ করে নেয়া যায়, আর কিছু বাকি থাকে না। আমরা প্রায় প্রত্যেক মানুষই এই শ্রেণির ক্ষেত্রফলের মধ্যেই নিজেদের আস্ত জীবনটা পার করে দিই।
আমরা বিশেষত্বহীন, সংকীর্ণ এক গণ্ডিতে বসবাস আমাদের। একই মহল্লার সব মানুষই চেনে না আমাদের, আমরাও চিনি না অনেককেই। বায়োলজি আর বৈবাহিকসূত্রে পাওয়া আত্মীয় (এদের মধ্যেও বাছ-বিচার আছে), পড়াশোনা আর কর্মসূত্রে পরিচিত হওয়া কিছু মানুষ- এটাই আমাদের জগত। মাসিক খরচ যোগাড় করতে আমরা হিমশিম খাই, আমাদের কারো নাম সিয়াম, কারো তৌহিদ, কারো শুভাশিস- কিন্তু সেই নামে কিছুই আসে-যায় না, ভিন্ন নামের হলেও অভিন্ন নিয়তিসূত্রে আমরা সহযাত্রী।
নিজেদের আমরা ‘ছা-পোষা’ পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমরা নির্ঝঞ্ঝাট, নির্বিবাদী, আমরা সুযোগের অভাবে সৎ, আমরা (পরশ্রী এবং পরস্ত্রী) কাতর, আবার পরোপকারী, সমব্যথী-সহমর্মীও। আমাদের মনস্তত্ত্ব তাই নিজেদের কাছেও দুর্বোধ্য লাগে। তাকে সুবোধ্য করার আকাঙ্ক্ষায় কেউ হই ভ্রমণপ্রিয়, কেউ সিনেমা-সাহিত্যানুরাগী, কেউ ছবি আঁকি-গান করি, কিংবা খবরের কাগজ পড়ে-টেলিভিশনে টকশো দেখে আকাঙ্ক্ষার পূর্তি ঘটাই।
তবু নিজেদের ব্যাপারে অতিউচ্চ ধারণা আমাদের, বিশেষত যারা নিজেদের মনস্তত্ত্বকে কিছুটা বোধগম্য করতে পারে, আপাত দৃষ্টিতে যাকে সৃজনশীলতা বলে ভ্রম হয়, তারা ইউনিকনেস ইলিউশনে ভুগতে গিয়ে সংকীর্ণ গণ্ডিতেও উপগণ্ডি তৈরি করে অদৃশ্য সামাজিক কারাগারে বসবাস করে। পত্রিকায় এক কোণে হাফ কলাম হাফ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গায় যদি কোনো জনারণ্যের ছবি থাকে এবং সেখানে কোনোরকমে নিজের মুখটা বোঝা যায়, কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় ৭ সেকেন্ডের এক ফুটেজে ‘আমি শুনেছি’ জাতীয় অগুরুত্বপূর্ণ কথার মাধ্যমে নিজের মুখটা প্রদর্শিত হয়, সেইসকল সংবাদ আমরা গণ্ডির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই, স্মৃতিগুলো বহন করি আজীবনের শর্তে।
প্রভাবশালী বা গ্রহণযোগ্য মানুষের সান্নিধ্যে আমরা শিহরিত হই। তাদের সাথে দুটো কথা বলতে পারলে দুদিন না খেয়ে থাকার কষ্ট স্বীকার করতেও আপত্তি থাকে না। তাদের সান্নিধ্যের প্রমাণস্বরূপ বিগতযুগে সংগ্রহ করতাম অটোগ্রাফ, এখন করছি ফটোগ্রাফ। আত্মীয়তাসূত্রে এরকম কেউ থাকলে মুদি দোকানে এক হালি ডিম কিনতে গিয়েও তাদের রেফারেন্স দিয়ে ফায়দা লুটতে উদ্যমী হই, ব্যক্তিগত গণ্ডিতে এক্সট্রা ভাব নেয়ার চেষ্টা করি, অথচ পাঙ্গাস মাছের সালুন দিয়ে দুপুরের ভাত খাওয়ার সময় তার/তাদের নামেই বিষোদগার করে বলি- ‘হারামের কামাই দিয়ে এরকম কতকিছু করা যায়’।
আমাদের জীবনের প্রধান দুটো ভয় পুলিশ আর হাসপাতাল। আঁৎকা পুলিশী ঝামেলায় পড়লে আমরা পরিত্রাণ পেতে মরিয়া হয়ে খুঁজি প্রভাবশালী মানুষের আনুকূল্য, সেজন্য অর্থের লেনদেন করি, যারা সেটাও পারি না তারা দুর্ভোগ পোহাই। একটু কঠিন রোগে পড়লেই চিকিৎসাব্যয় মেটানোর সামর্থ্য থাকে না আমাদের; আমাদের গড় লিমিট ৫-৭ লাখ টাকা। এর বেশি হলেই অন্যের কাছে হাত পাততে হয়, ধনে-প্রাণে নিঃশেষিত হই।
আমাদের কৌতূহলের পরিধি সীমিত, সেটাও নিবৃত্ত হয় মূলত পরচর্চায়। চেনা গণ্ডির প্রায় প্রত্যেকের সামর্থ্য-সীমাবদ্ধতা ( ত্রুটিই বেশি থাকে সবসময়) সম্বন্ধে পূর্ণ মেডিকেল রিপোর্ট থাকলেও নিজের ব্যাপারে ধারণা শূন্যের কোঠায়, যা আছে তার বেশিরভাগই ভুল। আমরা যন্ত্রের মতো নিপুণ দক্ষতায় কেবল গাইডলাইন চাই, এবং অক্লান্তভাবে অন্যকে গাইডলাইন দিই, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে সেগুলোর বেশিরভাগই রয়ে যায় অচর্চিত।
আমরা অনুসন্ধানী কম, জাজমেন্টাল বেশি। আমাদের খাদ্যোভ্যাস জঘন্য, আমরা টাকা জমলেই সঞ্চয়পত্র অথবা জমি কিনি। আমরা নতুন কিছু দেখলেই সন্দেহ পোষণ করি, এবং নতুনটা জনপ্রিয়তা পেলেই সেখানে প্রতারণার অনপ্রবেশ ঘটিয়ে শুরুর সন্দেহবাতিকগ্রস্ততাকে বৈধতা দিই। আমরা প্যারাডক্সিকাল সাজিদের মাধ্যমে রিচার্ড ডকিন্সের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে গিয়ে কাশেম বিন আবু বাকারের ‘ফুটন্ত গোলাপ’ নিয়ে ট্রল করি; পক্ষান্তরে রিচার্ড ডকিন্স, বিবর্তনবাদ, অস্তিত্ববাদ, অদৃষ্টবাদ, মরমিবাদ প্রভৃতি থেকে কিছু কিছু অংশ টুকলিফাই করে আত্মবাদ প্রচার করি এবং শেষতক সুবিধাবাদ এর অর্চনা করি।
আমরা ‘বিনামূল্যে’ শব্দটির কাঙাল। আমরা কথায় কথায় টুপি খোলা অভিনন্দন জানাই, স্যালুট দিই, চোখ ছলছল হয়ে যায়, সহমত হই কিংবা ধিক্কার জানাই। আমরা বাস ভাড়া করে ওয়াজে শরীক হই, পীরের জন্য গরু-ছাগল নিয়ে আসি। সেই পীরকেই একটু আধুনিকায়ন করে নাম দিই ‘আইডল’। সেই আইডলের এক বা একাধিক প্রতিপক্ষ নির্বাচন করে তার/তাদের নামে মুর্দাবাদ জানাই, তাদের অনুসারীদের গণ্য করি প্রতিপক্ষ শিবির, তারপর যার যার লেভেল আর পজিশন অনুযায়ী দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হই।
আমরা মেষশাবকের মতো ভিড় দেখলে আরো ভিড় বাড়াই। ‘কেন’ এবং ‘কোথায়’- এ অস্বস্তি, ‘কী’ আর ‘কীভাবে’ নিয়ে হট্টগোল বাঁধিয়েই পরম শান্তি খুঁজি। তুলনা আমাদের ধর্ম, শ্রেষ্ঠত্ব ইবাদত। আমরা দিবাস্বপ্ন দেখি, অপেক্ষায় থাকি দিনবদলের, কিন্তু চেষ্টা করি জলের দরে। আমরাই মার্কেট, আমরাই টার্গেট।
কিন্তু আমরা এরকম কেন?
শৃঙ্খল ভাঙার ইচ্ছা পোষণ করি, সাহস আর সামর্থ্য অর্জন রয়ে যায় বহুদূরবর্তী আত্মীয়রূপে। যে কারণে আমাদের নাম বলামাত্র কেউ চিনতে পারে না, আমাদের জন্ম বা মৃত্যুতে বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাবান্তর ঘটে না। আমরা অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসি না। আমরা তাই সফল, অসফল, ব্যর্থ কোনোপ্রকার মানুষ হিসেবেই নিরঙ্কুশ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হইনি। আমাদের নামের পূর্বে একটাই শব্দ ব্যবহৃত হয়, মসৃণ কাপড়ের চাইতেও মিহি সেই শব্দের আবেদন। আমরা কেবল সংখ্যাবৃদ্ধির খেলায় উত্তাপহীন সান্ত্বনা-পুরস্কার পাওয়া প্রতিযোগী হয়ে থাকি, আর প্রবোধ দিই- অংশগ্রহণই বড়ো কথা। আমরা ২০ জনের মধ্যে ১, ২, ৩ এ থাকি না, আবার শেষের ৩ এও থাকা হয় না; আমরা ৭ থেকে ১২ এর মধ্যে থেকেই কোটা পূরণ করি। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত শব্দটিও তাই ‘জনৈক’ এর চাইতে আহামরি কিছু হয় না।
আমাদের অস্তিত্ব ধারণ তাই নিছক ‘জনৈক’ হয়ে থাকার গল্প। আমাদের কোনো দেশ নেই , ভাষা নেই; সংস্কৃতি-রাজনীতি-ইতিহাস-বিজ্ঞান—কিচ্ছু নেই। সকল মতবাদের সংমিশ্রণে আমরা জনৈকবাদ এর নির্ভুল পরিচর্চা করি। যখন যেখানে থাকি সেখানেই জনৈকবাদীতাই আমাদের একমাত্র অবলম্বন হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে সামষ্টিকতার। আমরা কখনো তাজমহলের ২২ হাজার শ্রমিক, কখনো চেঙ্গিস খানের বিশাল সৈন্যবাহিনী তো পরমুহূর্তেই তার হাতে নিধন হওয়া লক্ষ লক্ষ বেসামরিক প্রাণ।
পিঁপড়া, মাছি কিংবা দাঁড়কাকের মতোই মানুষ হিসেবে রিফিউজি আমরা। তবুও জনৈকবাদীতা থেমে থাকে না। সময় আর নদীস্রোত যদিওবা ভুলেভালে কারো জন্য অপেক্ষা করেও ফেলে, জনৈকবাদীতায় অপেক্ষার স্থানই নেই।