“তো, তারপর কী হলো”?
– অতীব সরল অথচ প্রচণ্ড শক্তিশালী এক মৌলিক এক প্রশ্ন যার উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে সহস্র কোটি ফিকশন এবং ভিজুয়াল (নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন)।
যখনই নিজেকে ক্রিয়েটিভিটির এই সুনির্দিষ্ট শাখায় কেউ নিযুক্ত করে, মাথায় একটিই ভাবনা সক্রিয় থাকে- সহস্র বছরের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসের পরম্পরায় চলে আসা ওই একটিমাত্র মৌলিক জিজ্ঞাসাকে সুনিপুণভাবে ডিল করতে হবে। সেই ডিলিংয়ের সূত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সাসপেন্স, টুইস্ট, ক্লাইম্যাক্স, এন্টি-ক্লাইম্যাক্স, উইট, হিউমার, গতি প্রভৃতি ধারণাসমূহ। ‘ধারণা’ বললে দার্শনিকতা চলে আসে, যদি মশলা বলা হয় রান্নার আবহ থাকে, যা ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের সাথে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
তারপর কী হলো বা হবে, এটা জানার জন্য উদ্বাহুতার কারণ ইমোশনালি যুক্ত হয়ে পড়া। কাহিনীর অগ্রগতিতে কখনো আনন্দ হয়, কখনোবা টেনশন কাজ করে। একজন লেখক আর পাচক এক্ষেত্রে প্রায় একইরকম। খাদক তৃপ্তি নিয়ে খেলে পাচকের কৃতিত্ব, পাঠক লেখা গোগ্রাসে গিললে লেখকের সার্থকতা। ইমোশন না বলে যদি ইন্দ্রিয় বলি ব্যাপকতা আরো বৃদ্ধি পায়। ক্রিয়েটিভ রাইটিং আদতে ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণেরই কলাকৌশল।
তাই সবকিছুর সারবেত্তা হিসেবে যদি এডিকশন বা আসক্তি ব্যবহার করি, সেটাই ক্রিয়েটিভ রাইটিংকে যথার্থভাবে প্রতিনিধিত্ব করে।
এনালাইটিক রাইটিংয়ের প্রকৃতি-আকৃতি আলাদা। সেখানে একটি ঘটনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে চাইতে হয়। প্রাসঙ্গিকতাহীন বহু উপকরণকে সংযুক্ত করতে হয়, যা পড়ার ক্ষেত্রে ফ্রিকশন বা প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। তারপর কী হলো নয়; কেন হলো, কীভাবে হলো, বা আদৌ কি হলো জাতীয় প্রশ্নগুলোর জট খুলতে হয়। কল্পনাশক্তি, ইনটিউশন আর পর্যবেক্ষণকে ব্যবহার করতে হয়। কখনোবা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রবণতা থাকে, অনেক সময়ই অনুসিদ্ধান্ত স্তরে উপনীত হয়ে পরিভ্রমণরত অবস্থায় থাকতে হয় আরো সুগভীর কোনো পর্যবেক্ষণের প্রত্যাশায়। এনালাইটিক লেখা ক্লান্তিকর, একটানা বেশিক্ষণ পড়লেই মাথায় চাপ পড়ে।
তিন-চতুর্থাংশ এনালাইটিক, বাকিটুকু ক্রিয়েটিভ- এরকম কম্পোজিশনে লিখতে চাওয়াটা অত্যন্ত বিপজ্জনক চিন্তা। তাতে লেখাটা না হয় ক্রিয়েটিভ, না পুরোপুরি এনালাইটিক। তেতুলের সাথে মিষ্টি মেশালে যে স্বাদ ধারণ করবে, লেখার এই সংকরায়ণের ফলাফলও অনেকটা সেরকমই।
ডেলিবারেটলি কোনোকিছুর প্রতি কাউকে আসক্ত করতে চাওয়াটা তাকে প্রলুব্ধ করার মতোই। উদ্বুদ্ধ আর প্রলুব্ধ সমার্থক নয়। উদ্বুদ্ধ মানে কাউকে জড়তা ভেঙ্গে জাগিয়ে তোলা, প্রলুব্ধ মানে জড়তাসহই সাময়িক হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করা বা সোজা কথায় বশীভূত করা। মোটাদাগে, প্রলোভন অসমর্থনীয় প্রবৃত্তি। লেখার মৌলিক শর্তের মধ্যেই প্রলোভন ইন্টিগ্রেটেড। সবকিছুর মতো লেখালিখিরও নৈতিকতা থাকা বাঞ্ছনীয়। সেই নৈতিকতার মানদণ্ডে বিচার্য হলে ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
একটা বই প্রথম ৪০ পৃষ্ঠা যদি আগ্রহ জাগাতে না পারে খুব কম ক্ষেত্রেই বইটি শেষ করা হয়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়লাম, কথাটাকে যদি বিবেচনায় নিই, এর মধ্যেই এক বিরাট ঝামেলা আছে। মন্ত্রমুগ্ধ শব্দটির ইংরেজি spellbound যাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় hold the complete attention of (someone) as though by magic; গল্পের জাদুকর উপমাটা হরহামেশাই প্রয়োগ করি আমরা। মানুষের মধ্যে আগ্রহ জাগানো এবং অন্তত ৭-৮ঘণ্টা সেটা ধরে রাখা পৃথিবীর দুরূহতম কাজ। ফিকশন লেখকেরা কীভাবে আয়ত্ত করেন এই যোগ্যতা?
এমনকি আমরা যখন ননফিকশন পড়ি তখনো অবচেতনভাবে সেখানে গল্প খুঁজি। গল্পের বদলে বর্ণনাত্মক ন্যারেটিভ থাকলে পড়া চালিয়ে যাওয়ার গতি কিছুটা অমসৃণ হয়। গল্পের লিখিত রূপ আবিষ্কৃত হওয়ার বহুকাল আগে থেকেই মুখে মুখে গল্প বলার চল ছিল- এটাকেই হয়তোবা গল্পাসক্তির অন্যতম কারণ বলবেন অনেকে। তবে আমার পর্যবেক্ষণ বলে গল্পাশক্তির পেছনে ইমপ্যাথিশূন্যতা একটি গুরুতর নিয়ামক। আমরা বই পড়ি বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে অথবা সরাসরি প্রায়োগিক উদ্দেশ্যে। দুটোই অতিমাত্রায় ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। অন্যকে জানা, বুঝতে চাওয়া, কারণ খোঁজা প্রভৃতি প্রবণতার মধ্যেই ইমপ্যাথি নিহিত থাকে, বিনোদনের মধ্যে সেগুলো অনুপস্থিত। যখন আমি বিনোদন চাইছি, তখন উৎস আমার কাছে গৌণ, চূড়ান্ত প্রাপ্তিটাই একমাত্র ধর্তব্য হয়ে থাকে।
‘বিনোদন’ পড়ার অনেকগুলো কারণের একটি হতে পারে, একমাত্র কখনোই নয়। কিন্তু বিশ্বজুড়েই পড়ালেখার প্রধা্ন সূচক বিনোদন। চিন্তার সাথে বিনোদনের বিরোধ কখনোই ছিলো না, তবু কীভাবে যেন এরা বিপরীত রাস্তার পথিক হয়ে গেছে কালক্রমে। বিনোদন প্রধান উদ্দেশ্য হওয়ায় সমস্যা যেটা হয়েছে, যারা লিখছেন তাদের উপস্থাপনায় প্রতিনিয়ত কৌশলাবলম্বন করতে হয়। বর্ণনা শুনে যদি ধাক্কা না খাই কিংবা বিষয়টা কী হইলো জাতীয় প্রশ্ন না জাগে, সেই লেখা পাঠযোগ্যতা হারায়।
পাঠক-লেখকের সম্বন্ধটা তাই ‘বক্তা-শ্রোতা’ না হয়ে ‘দোকানী-খদ্দের’ এ রূপান্তরিত হয়েছে। দোকানীকে মাথায় রাখতে হচ্ছে যে কোনো উপায়ে খদ্দেরের মনোরঞ্জন করে পণ্য বিক্রি করতে হবে, খদ্দের ভাবছে সবচাইতে সস্তায় কোন্ দোকানীর কাছ থেকে পণ্য কিনে প্রয়োজন পূরণ করা যাবে। ‘পাঠক ধরে রাখতে হবে’- এই আপ্তনীতির কারণে লেখক তার চিন্তায় গ্ল্যামার যুক্ত করেন,বইয়ের ফ্ল্যাপ আর মুখবন্ধকে যথাসম্ভব আকর্ষণীয় করেন; ওই দুটো অংশ যদি ক্যাচি হয় তবেই পাঠক বইটি হাতে তুলে নিবেন। পরিমিতি বোধের চর্চা তখন ইমপ্রেস করার কৌশল হিসেবে পরিদৃষ্ট হয়। লেখক আর পাঠক মিলে এক কম্প্রোমাইজিং জগত গড়ে তোলেন, তাদের মধ্যে অদৃশ্য এক সামাজিক চুক্তি হয়, যার শর্তানুসারে পাঠক নিজের সম্বন্ধে, জগত সম্বন্ধে যে সকল অভ্যান্তরীণ ফ্যান্টাসি চর্চা করে লেখক সেগুলোকেই অলংকারময় ভাষায় লেখার শরীরে স্থাপন করতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
যে লেখা পাঠক-ফ্যান্টাসির সাথে মেলে না, বা তার কল্পনা আর চিন্তাশীলতার পরীক্ষা নেয় অথবা চ্যালেঞ্জ জানায় সেটি তার মধ্যে ডিসকমফোর্ট তৈরি করে। একারণে বহু বই পড়া সত্ত্বেও আমাদের মতামত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাজারচলতি রয়ে যায়, বিশ্লেষণ হয় রিফ্লেক্টিভ আর লিনিয়ার, এবং মূল্যায়নগুলো প্রেডিক্টেবল আর জাজমেন্টাল; বোধ বা রুচির ভিত্তি নাজুকই থাকে চিরকাল্। এতে লেখক-পাঠক দু’পক্ষেরই মেন্টাল গ্রোথ স্তিমিত হয়ে পড়ে। লেখক তাই লিখেন যা লিখতে পাঠক কর্তৃক আদিষ্ট হন, পাঠক তা-ই পড়েন যা তাকে চিন্তাশূন্য বিনোদনের খোরাক যোগায় আর অবিরাম শিহরণের এক দীর্ঘ জার্নিতে আটকে রাখে।
একটা বই পড়ার পর ৫ লাইনে হলেও নিজস্ব উপলব্ধি লিখে রাখবার চর্চা করতে হয়। কেউ যদি এই চর্চাটা মাত্র ৫০ টা বইয়ের ক্ষেত্রেও করে তার চিন্তার জগতে আলোড়ন ঘটা অনিবার্য। সে তখন কোনো লেখা পড়তে গেলে নিজ থেকেই সেটা নিরীক্ষণে ব্রতী হবে, লেখকের টুইস্ট আর সাসপেন্সের ফরমুলাকে মনে হবে আরোপিত।
ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের ইথিক্স হওয়া উচিত কল্পনাকৌশলকে সম্প্রসারিত করা, যেখান থেকে সে বোধের অনুশীলন করবে। কিন্তু অব্যর্থ ফরমুলার অনুসরণের কারণে ক্রিয়েটিভ রাইটিংগুলো শেষ পর্যন্ত কমার্শিয়াল রাইটিং হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এটা এক ধরনের পারভারশন বা বিকৃতি। মানুষের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণজনিত জটিলতাই প্রথমে বিচ্যুতি, পরে বিকৃতি ঘটায়। প্রায় প্রত্যেক মানুষ সুপারহিরো হতে চায় যার খ্যাতি আর ক্ষমতা হবে বিশ্বজোড়া। এই লক্ষ্যের ভয়ঙ্কর দিকটি হলো, জীবন চলে গেলেও ফ্যান্টাসি বাবল থেকে বের হতে পারে না। প্রতিনিয়ত পারফেক্ট হতে চায়, ভুলকে ভাবে ভয়ংকর শত্রু, যে কারণে উপর্যপরি ভুল করেও সেখান থেকে শিক্ষা নেয়া হয় না। মানুষকে হতে হবে ট্রাপিজিয়াম, সে হয়ে থাকে রম্বস। এর প্রভাবেই সপ্তাহ, মাস, বছর, মহাকাল ধরে মানুষ কেবল ধোঁকা খায়, আর বিষণ্নতা, হতাশা আর বিরক্তির সাড়াশিতায় অসহনীয় এক জীবনের ভার বহন করে চলে। ব্যাপারটা দুঃখজনক।