সৌম্য আর লিটন যতটা প্রতিভাবান, আমি বরাবরই তাদের তার চাইতেও বেশি সামর্থ্যবান হিসেবে উপস্থাপন করি। একই সঙ্গে রকিবুল, ইমরুল, মিথুন, সাইফুদ্দিন, রাহিদের ব্যাপারে বিরক্তি অব্যাহত রাখি।
একটা দলে খেলে মাত্র ১৫ জন, যারা সারা দেশ থেকে বাছাইকৃত। সেখানে যদি মিডিওকর প্লেয়ার খেলে, দল হিসেবে আরো তলানীতে চলে যেতে হবে। আমরা যদি বৈশ্বিক মানদণ্ড ধরি বাংলাদেশের প্রতিভাবানরাও সেখানে মিডিওকর হিসেবেই পরিগণিত হবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সেখানে বাংলাদেশের মানেও যারা মিডিওকর তারা আদতে ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে খেলারই যোগ্য নয়।
খেলাধুলায় সিমপ্যাথি দেখানোর সুযোগ নেই। ১৫০ কিঃমিঃ গতিতে ধেয়ে আসা বল সামান্য এদিক সেদিক হলেই ঘটাতে পারে মৃত্যু, তবু কি শর্ট পিচ বা বাউন্সার দেয়া বন্ধ করে বোলাররা?
ফলে মিডিওকর প্লেয়াররা পরিশ্রমী, ডেডিকেটেড, সেল্ফলেস প্রভৃতি মানবিক গুণের জন্য প্রশংসা পেতে পারে, একটি উঠতি দলের স্কোয়াডে জায়গা কখনোই নয়; সিমপ্যাথি তো অবশ্যই নয়।
১৯৯৬ থেকে ২০১১ বিশ্বকাপের পূর্ব পর্যন্ত, সামর্থ্য বিবেচনায় দলগুলো ৪ টি ক্লাস্টারে বিভক্ত ছিল আমার পর্যবেক্ষণ মতে
ক্লাস্টার১- অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা
ক্লাস্টার ২- ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলংকা
ক্লাস্টার৩- ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড
ক্লাস্টার ৪- বাংলাদেশ, জিম্বাবুইয়ে, আয়ারল্যান্ড
কিন্তু ২০১১ বিশ্বকাপের পর থেকে দৃশ্যপটে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। এখন ক্লাস্টার মাত্র ২টি, এদের সঙ্গে এক মধ্যবর্তী সাব-ক্লাস্টার তৈরি হয়েছে বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসির মতো।
এখনকার বিভাজন খুবই সুস্পষ্ট
ক্লাস্টার১- ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া
ক্লাস্টার২- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, জিম্বাবুইয়ে, আয়ারল্যান্ড
সাব-ক্লাস্টার- নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা
সাব-ক্লাস্টারের বৈশিষ্ট্য হলো, এদের উঠা-বসা প্রথম ক্লাস্টারেই, কিন্তু মানের দিক থেকে পুরোপুরি তা অর্জন করতে পারেনি।
অন্যদিকে ২য় ক্লাস্টারের দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বাদে বাকিগুলো এলোমেলো, এবং ক্রিকেটিয় ভবিষ্যত খুব গোছালো নয়, যদিও পাকিস্তান আর শ্রীলংকা হয়তোবা পুনর্গঠিত হবে।
বাংলাদেশ কাদের সাথে বেশি খেলে এর চাইতে কাদের সাথে খেলেই না বলতে গেলে সেই হিসাব করা যেতে পারে।
২০১১ এর পরে অস্ট্রেলিয়ার সাথে আর কোনো ওয়ানডে খেলা হয়নি। ২০১৫ আর ২০১৭ তে দুইটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে।
২০১৫ বিশ্বকাপের পরে ইংল্যান্ডের সাথে একটি হোম সিরিজ খেলেছিল, তবে সেটি ছিল খর্বশক্তির ইংল্যান্ড।
২০১৫ তে ভারতের বিপক্ষে হোমসিরিজ খেলে জেতার পরবর্তী ৪ বছরে ভারতের বিপক্ষে টুর্নামেন্ট ব্যতীত খেলা হয়নি।
সাব-ক্লাস্টারের দল দুটির সাথে খেলা হয়েছে, পারফরম্যান্স অনুকূলে ছিল না।
বাংলাদেশের খেলা ঘুরেফিরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলংকা, জিম্বাবুইয়ের সাথে। এই বিশ্বকাপের পরে তালিকায় আফগানিস্তান যুক্ত হতে পারে।
হোম বা এওয়ে যেটাই হোক, খেলা উচিত ক্লাস্টার-১, সাব-ক্লাস্টার মিলিয়ে ৫ দল, আর নিজেদের ক্লাস্টারের পাকিস্তানের সাথে বেশি বেশি। নিজ ক্লাস্টারের অন্য দলগুলোর বিপক্ষে খেলবো না সেই মানসিকতা ভুল, অবশ্যই খেলবো, তবে মাত্রা বজায় রেখে। এইসব দলের বিপক্ষে বেশি খেলে জয় সংখ্যা, প্লেয়ারদের স্ট্যাটিসটিক্স, সমর্থকদের আনন্দ সবই পাওয়া যায় যেহেতু, আমাদের বোর্ড সেই ফাঁদেই পা দেয় বারংবার।
কিন্তু ক্লাস্টারের উপরে থাকা দলের বিপক্ষে খেলতে গেলেই জারিজুরি ধরা পড়ে যায়, এবং উন্নতির জায়গাগুলো প্রকট হয়ে উঠে।
আমাদের ক্রিকেট বোর্ড অত্যন্ত স্বচ্ছল, কিন্তু কূটনৈতিক দক্ষতা তাদের হতাশাজনক। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারত বা ইংল্যান্ডের সাথে সিরিজ খেলে ফেলে, আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক দিয়েও ক্লাস্টার১ এর দলগুলোর সাথে সিরিজ আদায় করতে পারি না।
পারি না বলে বলবো করতে চাই না। জয় নামের যে নিষিদ্ধ আখড়ায় মজেছি, উপরের দলের সাথে খেললে তা কেটে যাবে।
মিডিওক্রিটির সাথে বোর্ডের এই ভিশনহীনতা, সাহসহীনতা প্রচণ্ডভাবে জড়িত।
অনলাইনে ক্রিকেট গ্রুপগুলোতে নীতি নির্ধারণী বিষয়ে ক্রিটিকাল চিন্তাধারা একেবারেই চোখে পড়ে না, বরং ভারত আর পাকিস্তান বিদ্বেষ এবং নিজেদের মধ্যে রেষারিষিতেই সময় পার করে দেয়।
গ্রুপ মানে একটি অর্গানাইজড প্লাটফরম। বিসিবি পপুলারিস্ট থিওরিতে চলে, ফেসবুকে যেসব আলোচনা হয় সেগুলো তাদের নজরে আসে।
সমর্থক আর ফ্যানের মধ্যে পার্থক্য আছে এটা আমাদের দর্শক-ক্রিকেটার কোনো পক্ষই বোঝে বলে মনে হয় না। ফ্যান স্তুতি-বন্দনা করে, ভালো-খারাপ সব পরিস্থিতিতেই ‘সহমত ভাই’, ‘পাশে আছি ভাই’ মনোভাবের, সমর্থক মানে নীতি আর আদর্শের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে তাকে প্রমোট করা, সেই জায়গায় বিচ্যুতি দেখা দিলে গঠনমূলক সমালোচনা করা।
কিন্তু আমরা কেবল ফ্যান চাই, যারা হয় দেবতা অথবা অসুর বানিয়ে ফেলে। বিজনেসের জন্য সমর্থকের দরকার কম, ফ্যানের বেশি। ক্রেজি ফ্যান হলে আরো ভালো। একারণে অনলাইনজুড়ে লক্ষ লক্ষ ফ্যানের দেখা মিললেও সমর্থক নেই ১০০ জনও৷ অথচ মাত্র ১০০ জন সমর্থক হলেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্ট্যান্ডার্ড উপরে উঠতো। ভারত বা অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট লেখক আছেন অনেক, বাংলাদেশে ক্রিকেট নিয়ে যারা লেখেন বা জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, প্রায় প্রত্যকেই সাংবাদিকতা পেশাসূত্রে লিখেন৷ সাংবাদিকতা আর লেখালিখি সম্পূর্ণ আলাদা দুটো বিষয়। যে কারণে দিনের পর দিন ফ্যান বাড়ছে, সমর্থক তৈরি হচ্ছে না।
যাদের কমেন্টে আমরা ছিঃছিঃ করি, তারাও আদতে ফ্যান, বলা যেতে পারে উগ্র ফ্যান। যখনই আপনি ফ্যানের মোহে পড়বেন, সেখানে কোনো বাঁধ নির্মাণ করতে পারবেন না; উগ্র, ক্রেজি, ডাই-হার্ড সবশ্রেণিই থাকবে; একটা নেবেন, অন্যটা নেবেন না, তা হবে না তা হবে না।
যেহেতু সমর্থক তৈরি হয়নি বা হচ্ছে না, ক্রমাগত নিম্ন আর মধ্যমসারির দলের বিপক্ষে খেলতে খেলতে আমরা যে নিজেদের গ্রোথ আটকে ফেলছি তা খেয়াল করছি না। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিসিবির মেরুদণ্ডহীনতা চোখে পড়ছে না, আমরা ক্রিকেটের মান নিয়ে চিন্তার পরিবর্তে ক্রিকেটারের উপাসনায় মেতে থাকছি৷ অবশ্য এটাই টিপিকাল ফ্যানের বৈশিষ্ট্য।
মিডিওকর থাকতে চাওয়ার কারণে দলের গেমপ্ল্যানও মিডিওকর হয়। আমাদের ব্যাটসম্যানরা ৩ রান নিতেই পারে না বলতে গেলে, ২ রানগুলো ১ হয়ে যায় সেই মিডিওক্রিটির দোষেই।
মিডিওক্রিটির এমন বিশাল মহাযজ্ঞের কারণেই স্বীকৃত মিডিওকর প্লেয়ারদের ব্যাপারে নাখোশ থাকি। টিপিকাল ফ্যানরা স্কোরকার্ড দেখে খেলা বিচার করে, সামিগ্রীক ম্যাচ কনটেক্সট বোঝার প্রজ্ঞা বেশিরভাগেরই নেই। যে কারণে মিডিওকরদের ঢাল হিসেবে চলে আসে পরিসংখ্যান।
যেমন, ইমরুল কায়েস। এই ক্রিকেটারটিকে নিয়ে ২০০৯ থেকে সরব আমি। বাংলাদেশ যখন ২০০ করতে হিমশিম খায়, তখনো সামহোয়ার ইন ব্লগে ইমরুল কায়েস আর রকিবুলকে নিয়ে ক্রমাগত লিখেছি, এসব স্কোরকার্ড ভিত্তিক প্লেয়ার দিয়ে চলবে না বারবার বলেছি। লোকজন এসে বাজে কমেন্ট করতো। রকিবুল হারিয়ে গেছে, কিন্তু ২০১৮ সনে এসেও ইমরুলকে নিয়ে লিখতে হয় আমাকে, যা দুঃখজনক। সময় পাল্টালেও ফ্যানের ধর্ম পাল্টায় না, এখনো তাদের আঁতে ঘা লাগে, তারা ম্যাচ ইমপ্যাক্ট না বুঝে ক্রিকইনফো থেকে স্ট্যাট নিয়ে আসে।
আমি দীর্ঘদিন পর্যন্ত মাহমুদুল্লাহ আর নাসিরের এর ব্যাপারেও সরব ছিলাম। একজন গায়েব হয়ে গেছে, আরেকজন ২০১৫ বিশ্বকাপে নিজের ক্যালিবার প্রমাণ করেছে অভিষেকের ৭ বছর পরে। তবে মাহমুদুল্লাহ আর অলক কাপালীর কেইস দুটো প্রথার বাইরে, যেমনটা ঘটেছে অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ স্মিথ, পাকিস্তানের শোয়েব মালিক, কিংবা শ্রীলংকার জয়াসুরিয়ার ক্ষেত্রে। এরা প্রত্যেকেই দলে আসে বোলার হিসেবে, কালক্রমে জেনুইন ব্যাটসম্যানে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে এরকম চরম ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে মানবিক ভুল হতেই পারে।
২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত টানা ৪ বছর তামিম স্ট্রাগল করেছে, কিন্তু তার ব্যাপারে সবসময়ই পজিটিভ ছিলাম। অভিষেকের পর থেকেই মুশফিকের ব্যাটিং নিয়ে আশাবাদী ছিলাম, সে বাদ পড়েছে, তবু সে ফিরবে নিশ্চিত ছিলাম। সাকিব যখন টেস্টে ৭ উইকেট পেল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে, তখনো সে ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবেই পরিচিত, তাকে নিয়ে সামহোয়ার ইন ব্লগে লিখেছিলাম ‘সাকিব প্লিজ হারিয়ে যেও না’। তার ৯ বছর পরে ‘কী-ওয়ার্ড সাকিব আল হাসান’; তার ব্যাটিং বা বোলিং কোনোটাই এলিগেন্ট লাগে না, এটা লেখার কারণে অন্ধভক্তরা অবশ্য সময় পেলেই আমাকে উত্যক্ত করে।
অভিষেক ম্যাচেই রুবেলের বোলিং দেখে মনে হয়েছিল মাশরাফির পরে বাংলাদেশ একজন জেনুইন বোলার পাচ্ছে। রুবেলকে নিয়ে অনলাইনে বহু মানুষ নেগেটিভ মন্তব্য লিখেছে সময়ে-অসময়ে, কিন্তু আমি প্রতিনিয়ত তার ব্যাপারে লিখেছি।
মিরাজকে ২-১টা ম্যাচ দেখার পর থেকেই তার মেন্টাল স্ট্রেন্থ এ আশ্বস্ত হয়েছি। কিন্তু সে খেলছে ভুল প্লেয়িং রোলে, তার বোলিং পার্ট টাইমারের চাইতে সামান্য উন্নত। মেন্টালি সে যেহেতু টাফ, চেষ্টা করলেই ইফেক্টিভ ব্যাটসম্যান হতে পারবে। তা না করে সে মিনি অলরাউন্ডার হিসেবে চাকরি বাঁচানোর চেষ্টায় আছে। দীর্ঘমেয়াদে ক্যারিয়ার গড়তে হলে মিনি অলরাউন্ডার থেকে ব্যাটিং অলরাউন্ডার হতে হবে, এই সত্যটা কেউ তাকে উপলব্ধি করাচ্ছে কিনা ঠাহর করতে পারছি না।
মিডিওকর হটাও নীতিতে অটল থাকতে হবে যতদিন ক্রিকেট দেখবো। ইমরুল কায়েস সম্ভবত ইতিহাস হয়ে গেছে, তার জায়গায় এসেছে মিথুন, রাহি আর সাইফুদ্দিন।
মিথুন আর রাহিকে নিয়ে খুব বেশি লিখতে হবে না, এমনিতেই বাদ পড়ে যাবে।
কিন্তু আমি চিন্তিত সাইফুদ্দিনকে নিয়ে। স্টিভ রোডস যেদিন ইন্টারভিউতে বলেছে তাকে মাশরাফির রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চায় সেদিন থেকেই স্টিভ রোডস এর ক্রিকেট প্রজ্ঞা আর বোলার সাইফুদ্দিন দুজনের ব্যাপারেই সন্দিহান হয়ে পড়ি।
মাশরাফি এককালে স্ট্রাইক বোলার ছিল, বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্রুততম বোলার, কিংবা পেস বোলিং কালচার তৈরিতে মাশরাফির ইমপ্যাক্ট- এসব রোডসের না জানারই কথা, সে পেয়েছে ক্যারিয়ার সায়াহ্নে থাকা মাশরাফিকে যে মূলত লাইন-লেন্থ নির্ভর ইফেক্টিভ বোলার, সেই সাথে স্পিন বলে বিগ হিট করার সামর্থ্যযুক্ত।
সাইফুদ্দিনের ক্যারিয়ার এখনো শিশুদশায়; এই সময়ে তার মধ্যে বারুদ থাকবে, সময়ের সাথে সাথে তা বিকশিত হবে। কিন্তু বোলার হিসেবে তার গতি কতটা, সুইং কিরকম, উইকেট টেকিং ডেলিভারি কী; সুতরাং বারুদ তার মধ্যে নেই। ফলে সে আসলে স্ট্রাইক বোলার মাশরাফি, নাকি ইফেক্টিভ বোলার মাশরাফি- কাকে রিপ্লেস করবে সেই প্রশ্ন থেকে যায়।তখনো সাইফুদ্দিন আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি, কিন্তু গত ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের ২য় ম্যাচের পূর্বে প্রথম আলোর এক রিপোর্টে পড়ি, রুবেল রান বেশি দেয় এজন্য কোচ অসন্তুষ্ট, সে সাইফুদ্দিনকে খেলাতে চেয়েছিল, মাশরাফি রুবেলকে খেলিয়েছে। কিন্তু ২য় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ হেরে বসায় ৩য় ওয়ানডেতে রুবেলকে বসানো হয়, সাইফুদ্দিন খেলে। তখন থেকেই মিডিওকর ক্যাটেগরিতে সে ঢুকে পড়ে, এবং বিশ্বকাপের মতো সর্বোচ্চ আসরে তাকে জেনুইন বোলার হিসেবে খেলতে দেখে আরো বেশি বিরক্তি জমেছে।
ইমরুল কায়েসের মতো সাইফুদ্দিনের জন্যও ঢাল হিসেবে চলে আসবে পরিসংখ্যান।
তবে তার পূর্বে সাইফুদ্দিন বিষয়ক ভাবনাটা লেখা উচিত। সে কিছু ব্যাটিং আর কিছু বোলিং জানা একজন প্লেয়ার। বাংলাদেশ যদি ৬ জন জেনুইন ব্যাটসম্যান আর ৪ জন ফ্রন্টলাইন বোলার খেলায়, তবে ব্যালান্সিং এর জন্য সাইফুদ্দিন একটি ভালো চয়েজ। সাকিবের মতো জেনুইন অলরাউন্ডার থাকায় ৩ জন ফ্রন্টলাইন বোলার হলেও চলে৷ সাকিবকে ধরে ৪ জন হয়ে যায়। মাশরাফির প্লেয়িং রোল আমি ইফেক্টিভ বোলার হিসেবে দেখি, ফ্রন্টলাইন বোলার নয়, ফলে মুস্তাফিজ আর সাকিব দিয়ে ফ্রন্টলাইন বোলার হচ্ছে ২ জন মাত্র। যে কারণে মিরাজ আর সাইফুদ্দিন একত্রে তখনই খেলবে যখন এদের একজন ৭ নম্বরে ব্যাট করার উপযোগী হবে।
কিন্তু কোচ তাদের খেলায় ৮ আর ৯ এ; মিরাজের মেন্টাল টাফনেসে আর স্বতঃস্ফূর্তার কারণে সে কিছুটা ছাড় পায়, কিন্তু ফ্রন্টলাইন বোলার হিসেবে সাইফুদ্দিন কৌতুকের বেশি কিছু নয়।
ক্রিকেট খেলাটা রিদম নির্ভর, সেটা পেয়ে গেলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার প্রভাব থাকে। যুবরাজ সিংকে আমরা পছন্দ করি ব্যাটসম্যান হিসেবে, কিন্তু ২০১১ বিশ্বকাপে সে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হয়েছে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংয়েও উইকেট পাওয়ায়। দলের অধিকাংশ ফ্রন্টলাইন বোলারের চাইতেও তার উইকেটসংখ্যা বেশি ছিল। তাতেই ম্যানেজমেন্ট তাকে জেনুইন বোলার বানিয়ে দেয়নি।
কিংবা বেন স্টোক্স ডেথ ওভারে নিয়মিত বোলিং করে, উইকেট পায়, তবু সে ইংল্যান্ডের ফ্রন্টলাইন বোলার নয়, সে স্টক বোলারের রোল প্লে করে।
স্টক বোলারের ইকোনমি একটা ফ্যাক্টর। মুস্তাফিজ বা রুবেল রান দিবে, কিন্তু আচমকা একটা স্পেল করে সেট ব্যাটসম্যানের উইকেট নিয়ে নতুন ব্যাটসম্যানকে আউট করে দিবে। এজন্য তাদের চ্যালেঞ্জের মুখেও বেশি পড়তে হয়। মুস্তাফিজ রান দেয়াতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, সে কয়টা কোয়ালিটি ডেলিভারি দিল এটাই বড়ো কথা।
সাইফুদ্দিন ৭ ওভার বোলিং করার মতো বোলার। ১৫- ৩৫ এর মধ্যে ৪ ওভার, ৪০ এর পরে ৩ ওভার। কোনোদিন রিদম ভালো থাকলে ১০ ওভার করানো যেতে পারে।
কিন্তু ফ্রন্টলাইন বোলার হিসেবে খেলানোর ফলে যেটা হয়েছে, সে বোলিংয়ে আসছে ১৫ ওভারের আগে, ব্যাটসম্যান তাকে অবলীলায় খেলছে, রান লিক করছে, এবং শেষ দিকে গিয়ে ইউ মিস আই হিট অবস্থায় রান দিচ্ছে, উইকেটও পাচ্ছে। ২০ থেকে ৪০ তম ওভারের যে সীমা, যেখানে ম্যাচের গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয় সেই জায়গাটায় আমরা ফ্রন্ট লাইন বোলার ব্যবহার করতে পারছি না, পার্ট টাইমাররা বোলিং করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। সমশক্তির দলের বিপক্ষে এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলো বোঝা যায় না, তাছাড়া ক্লাস্টার ১ আর ক্লাস্টার ২ এর মধ্যে পার্থক্য এতটাই বেশি যে, বড় দলের বিপক্ষে শুরুতে ১-২ উইকেট তুলে নিয়ে খুশি হয়ে যাই, তারপর উইকেট টেকিং বোলারের অভাবে ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়ে কখনো কিপারের, কখনো ক্যাপ্টেনের, কখনো মুস্তাফিজের দোষ ধরে রাগারাগি করি।।
বাংলাদেশের গেমপ্ল্যান তাই বারেবারে হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে এবং তার প্রধান কারণ স্টক বোলার সাইফুদ্দিনকে ফ্রন্টলাইন বোলার হিসেবে খেলানো নীতি। যতদিন পর্যন্ত সে ৭ এ খেলার উপযুক্ত না হবে মিডিওকর হটাও সূত্রে সে সমালোচিত হবেই।
এবার আসা যাক সৌম্য আর লিটন প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ডে তারা প্রতিভাবান, কিন্তু লেভেল আপগ্রেড না করায় তারা নিয়মিত রান পায় না৷ তবু আমি এদের অনবরত সমর্থন দিয়ে যাবো তাদের চাইতে প্রতিভাবান কিংবা মেন্টালি প্রচণ্ড টাফ কাউকে না পাওয়া পর্যন্ত।।
মানুষ একটা কমন ভুল প্রায়ই করে সৌম্য আর লিটনের মধ্যে কে সেরা সেই অহেতুক তর্কে গিয়ে।
সৌম্য একজন বিস্ফোরক প্রকৃতির ব্যাটসম্যান, সে লফটেড খেলতে পছন্দ করে, রিস্টে প্রচণ্ড শক্তি থাকায় পাওয়ার প্লে কাযে লাগাতে পারে। তাকে বলা যেতে পারে বামহাতি শেওয়াগ, কিংবা ছোট হেইডেন। তবে শেওয়াগ বা হেইডেন দুজনই বড় ইনিংস খেলতে পারতো স্কোরিং শট বেশি হওয়ার কারণে। সৌম্য কেবলমাত্র হিটিংয়ের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় ইনিংস বড়ো করতে অসুবিধায় ভুগে, স্কোরিং শট খুবই কম। সুইংগিং এবং ১৫০ এর আশপাশের গতির বিপক্ষে সে এখনো স্ট্রাগল করে, ১৩৫-১৪৫ তার জন্য আদর্শ বোলিং, বিশেষত শর্ট পিচ আর থ্রি কোয়ার্টার লেন্থ পিক করাটা তার পক্ষে বেশি আরামদায়ক। তামিমও দীর্ঘদিন পর্যন্ত খুবই প্রেডিক্টেবল ব্যাটসম্যান ছিল, কালক্রমে স্কোরিং শট বেড়েছে। সৌম্যকে নিয়ে আশাবাদী আমি। ফলে জংলি ফ্যানরা যখনই তাকে নিয়ে মাত্রা ছাড়ানো ট্রল করবে, তার সমর্থনে লিখবো।
পক্ষান্তরে লিটন আপাদমস্তক ক্লাসি ব্যাটসম্যান। শুরুর ২৫ টি বল সে শেকি থাকে৷ পন্টিং, জয়াবর্ধনে, ইনজামাম, আজহার, ইউসুফ, লক্ষণ প্রত্যেকেই এই অভিযোগে দুষ্ট। ওই ২৫টি বল টিকে গেলে সে বড়ো ইনিংস খেলতে পারে, বোলারকে মনে হয় অতি সাধারণ। তার স্কোরিং শট অনেক বেশি, ফিটনেস দুর্দান্ত। যে কোনো পজিশনেই সে রান পাবে। শেকিনেসটা সারা ক্যারিয়ারেই থাকবে, বলসংখ্যা ২৫ থেকে কমিয়ে ১০-১৫ এর মধ্যে নিয়ে আসতে পারে কিনা সেটাই চ্যালেঞ্জের বিষয়।
তবে সে খুবই অলস প্রকৃতির, অল্পতেই খুশি হওয়ার রোগ আছে, ভাবগতিকে মনে হয়, যে কারণে কিছু ম্যাচ পর পরই একাদশের বাইরে রাখাটা তাকে আরো বেশি ডেসপারেট হতে টনিক হিসেবে কাজ করবে। সমর্থন পেলে বাংলাদেশের হয়ে ব্যাটিংয়ের সব রেকর্ডই তার হওয়া উচিত৷ আরো যদি ১০-১২ বছর খেলতে পারে এবং ২৫০ টা ওয়ানডেতে সুযোগ পায়, প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ১০ হাজার+ রান করাটা খুবই সম্ভব।
ফলে শেকিনেস বা ব্যাটিং গড় নিয়ে যে সমস্ত ফ্যান ট্রল করবে তাদের মাত্রা অসহনীয় উঠলে লিটনকে সমর্থন জানিয়ে লিখতে হবে।
আমি কোনো ক্রিকেট বিশ্লেষক বা বিশেষজ্ঞ নই, এ দিয়ে আমার সংসার চালাই না, ক্রিকেট পর্যবেক্ষণে অনাবিল আনন্দ পাই বলেই লিখি। কিন্তু হিউম্যান বিহেভিয়ার এবং পটেনশিয়ালিটি আমার সবচাইতে আগ্রহের বিষয়। চিন্তা-ভাবনায় মিডিওকর প্রকৃতির মানুষেরা সেফটি-সিকিউরিটি- স্ট্যাটাসের বিচ্ছিরি কারাগারে অবরুদ্ধ। তাদের জীবনের অপছন্দনীয়তম শব্দ চ্যালেঞ্জ আর রিস্ক।
ফলে মিডিওক্রিটির বিপক্ষে চিন্তাবৃত্তিক প্রয়াস অব্যাহত থাকবেই;
i don’t like to be liked