অভিযোগ দুটো পুরনো এবং ক্লিশে।
অভিযোগ১- বাংলাদেশের যে কোনো জমকালো অনুষ্ঠান বলতেই সেখানে ভারতীয় আর্টিস্টদের একাধিপত্য লক্ষ্য করা যায়; দেশী শিল্পীদের উপস্থিতি নামমাত্র। এতে তাদের অপমান করা হয়।
অভিযোগ২- বাংলাদেশের ক্যাবল চ্যানেল ভারতে চলে না, অথচ জি বাংলা, স্টার জলসা, স্টার প্লাসের সিরিয়াল ছাড়া অনেকেরই বিনোদন চাহিদা পূরণ হয় না।এটা রীতিমত আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে।
‘অভিযোগ’ মানে সেখানে দুটো পক্ষ থাকবে- ভিক্টিম এবং জালিম। অভিযোগ দুটো নিয়ে পর্যালোচনা করলে দুক্ষেত্রেই ভিক্টিম, আর জালিম অভিন্ন- ভিক্টিম বাঙালিয়ানা, জালিম ভারতীয়তা।
যদিও স্কেপগোট বা উইটনেস হিসেবে বরাবরই কালচারাল কনফ্লিক্টকে সামনে আনা হয়, আদতে ইস্যুটা রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়, আরো ফাইনিং করলে শেষ পর্যন্ত হয়তোবা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ব্যাপারটিই পাওয়া যাবে নিউক্লিয়াসে।
ভিক্টিম তত্ত্ব যদি বাদ দিই, অভিযোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত শর্ত আর কী কী হতে পারে?
নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা— এ দুটো প্রবচনকে ভাবনায় নিলে সেখানেও অভিযোগপ্রবণতাই পাওয়া যাবে। তবে এখানে ভিক্টিম বা জালিম নেই, অজুহাত আর জিঘাংসা প্রকাশক হিসেবে এদের বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
পিক আর অফপিক সিজন মেনে অভিযোগের বাজার ওঠা-নামা করে বলা যেতে পারে। ফেব্রুয়ারি, মার্চ এবং ডিসেম্বরে, অর্থাৎ বছরের এক-চতুর্থাংশ সময়ে অভিযোগের মান সর্বোচ্চ বিন্দুর আশপাশে বিচরণ করে৷ অবশিষ্ট সময়গুলোতে পরিস্থিতি অনুসারে অভিযোগের সূচক পরিবর্তিত হয়।
অভিযোগ বিষয়ে কচলানির মূল উৎস সম্প্রতি শেষ হওয়া বিপিএল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। প্রতিবারের ন্যায় এবারও যথারীতি মূল আকর্ষণ ভারতীয় শিল্পীরা ( সালমান খান, ক্যাটরিনা কাইফ, কৈলাশ খের, সনু নিগম); বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলতে কেবল জেমস ( মমতাজের গান করার কথা ছিল, করেছে কিনা জানি না। শুভ আর রেশমি নিতান্তই অখ্যাত; এই দুজনকে সেই অর্থে প্রতিনিধি বলা উচিত হবে না)
প্রতিবার প্রোগ্রাম হয়, আর ফেসবুকে মানুষজন নির্বিচারে —সংস্কৃতির অবমাননা হেতু ব্যথিত হয়ে— স্ট্যাটাস দিতে থাকে। এটা একটা ইন্টারেস্টিং কেইস স্টাডি হতে পারে চিন্তা করে প্রসঙ্গটির আরো গভীরে ঢোকার তাড়না বোধ করি।
উত্থিত প্রশ্ন: কেন বারবার হিন্দি শিল্পীরাই অনুষ্ঠানের সমস্ত স্পটলাইট পেয়ে থাকে, কেন বাংলাদেশী শিল্পীদের প্রাধান্য দেয়া হয় না?
সুলুক সন্ধান- মিরপুর স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা ২৫০০০ প্রায়, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকেট সংখ্যা ৮০০০, যার মধ্যে সৌজন্য টিকেট আছে। বলা যায় পুরো স্টেডিয়ামের দর্শক ক্ষমতার এক চতুর্থাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে দর্শকদের জন্য। টিকেটের সর্বনিম্ন মূল্য ১০০০ টাকা, সর্বোচ্চ ১০০০০ টাকা।এখান থেকে দুটো ব্যাপারে অভিমত দেয়া যেতে পারে। প্রথমত, টিভি দর্শকই মূল টার্গেট; দেশে এবং প্রবাসে থাকা বাঙালিরা টেলিভিশনে প্রোগ্রাম দেখবে সেটাই ছিল প্রত্যাশা। মাঠের দর্শক একটি উপলক্ষ মাত্র। দ্বিতীয়ত, টিকেটের মূল্য ব্রান্ড ভ্যালু এবং সিলেক্টিভ পারসোনালিটি নির্দেশক। বাংলাদেশে এমন কোনো আর্টিস্ট কি আছে যাকে অনুষ্ঠানে আনলে টিকেটের মূল্য ১০০০০ টাকা রাখা যেত? নেই, বরং টিকেটের দাম ৪০০০ করলেই মানুষজন নিজেদের ক্রয়ক্ষমতার দোহাই দিত। পক্ষান্তরে সালমান খানের সিনেমা শত কোটি টাকা ব্যবসা করে; সে আসছে, কথাটার ব্রান্ড ভ্যালু আছে। সবসময় স্ক্রিনে দেখা সালমান খানকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ, মূলত এটাই প্রোগ্রামের সেলিং পয়েন্ট। মনে পড়ে, কোনো এক বিপিএল বা অন্য কোনো প্রোগ্রামে সম্ভবত ব্রায়ান এডামসকে আনা হয়েছিল। কিন্তু সালমান খানকে যেমন গ্রাম বাংলার মানুষজনও চেনে, তার প্রতি ফ্যাসিনেটেড থাকে, ব্রায়ান এডামস বিশ্বজুড়ে যতোই পরিচিত হোক, বাংলাদেশের সামগ্রীক প্রেক্ষাপটে সালমান খান বা শাহরুখ খানের পর্যায়ের কি পরিচিত?
উত্থিত প্রশ্ন- সালমান খানের ব্র্যান্ড ভ্যালু দিয়ে বিপিএল এর কী কাজে লাগবে?
সুলুক সন্ধান- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আগে বুঝতে হবে যে কোনো বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন বা এওয়ার্ড গিভিং অনুষ্ঠানগুলোর রেসিপি কেমন হয়। নাচ-গান-কমেডি/প্যারোডি- প্রজেক্টর শো, এই ৪ ধরাবাঁধা আইটেমের বাইরে সচরাচর কিছু কি চেষ্টা করা হয়? উপস্থিত দর্শকদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে এর বাইরে বিকল্প অপশনই বা কী। উদ্বোধন আর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ পৃথক সত্তা। যখনই অনুষ্ঠান বলা হচ্ছে সেই মুহূর্তেই অবধারিতভাবে ওই ৪ আইটেম এসে পড়ে। বাংলাদেশের কোনো অনুষ্ঠানে জেমস বা মমতাজ গান গাইতেই পারে, গায়ও, কিন্তু বাংলাদেশের অনুষ্ঠান হলেই সেখানে সালমান খান বা শাহরুখ খান এসে পারফর্ম করে না। তাদের ব্র্যান্ডভ্যালু ব্যবহার করে নিজেদের অনুষ্ঠানকে জাতে উঠানোর স্ট্র্যাটেজি বা তাদের বিভিন্ন রকম ফ্যানদের (হোক সেটা দেশে বা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে) আগ্রহী করে প্রোগ্রামের টি আরপি বাড়ানোর ব্যাপার থাকে, স্পন্সরদের ডিমান্ড থাকে; অনেক কিছু মাথায় রেখেই কাজ করতে হয়। যে ব্যক্তি জীবনে ১ মিনিটও ক্রিকেট অনুসরণ করে না, সে ক্যাটরিনা বা সালমানের নাচ দেখার জন্য টিভির সামনে বসে; এটাই প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য৷ কারণ ক্রিকেটপ্রেমিদের জন্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোনো কনটেন্ট নেই, তারা চায় মাঠের খেলা দেখতে৷ ফেসবুকে যাদের স্ট্যাটাস পড়ি বা অনলাইনের অন্যান্য মিডিয়ামে যারা হতাশা ব্যক্ত করে এরা সমাজের গ্রস লেভেলকে প্রতিনিধিত্ব করে না৷ ফেসবুকের স্ট্যাটাসকারীরা মূলত একটি সিলেক্টিভ বাবলের অংশ। এদের মধ্যেও দ্বৈতসত্তা বেশি। মুখে যা বলে এবং বাস্তবে যা আচরণ করে দুইয়ের মধ্যে ফারাক বিস্তর।
উত্থিত প্রশ্ন- বাংলাদেশী শিল্পীদের সমান গুরুত্ব দিয়েও তো প্রোগ্রাম করা যায়, ভারতীয়দের প্রতি এমন আহলাদিতা না দেখালেই কি নয়?
সুলুক সন্ধান- এটা বোঝার জন্য আত্মসমালোচনা জরুরী।ভারত আর চীন এই দুই দেশের প্রতি অতিনির্ভরশীলতা কি অস্বীকার করা যাবে? চীনের প্রতি নির্ভরশীলতাটা বাণিজ্যিক হওয়াতে এবং দেশের সাথে সরাসরি সীমান্ত সংযোগ না থাকায় সাধারণ জনজীবনে চীন সেরকম আলোচনায় স্থান পায় না।তাছাড়া সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈসাদৃশ্য চীনকে ঘিরে ইউরোপ বা আফ্রিকা মহাদেশের ন্যায় দূরবর্তী এক দেশের ইমপ্রেসন তৈরি করে। অন্যদিকে ভারতের সাথে প্রায় চতুর্দিকে সীমান্ত, বলা যায় ভারতের পেটের মধ্যে বেড়ে উঠেছে আরেকটি স্বাধীন দেশ। সেই সাথে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্বের একটা প্রভাব তো পড়েছেই। ফলে ভারত আর বাংলাদেশ হয়েছে একই পরিবারের দুই সন্তানের মতো, যাদের একজন পিএইচডি হোল্ডার, অন্যজন প্রাইমারি স্কুলপড়ুয়া। একই পরিবারের সন্তান হয়ে এই বিভাজন মানতে গেলে বরাবরই বৈষম্যের অনুভূতি আসবে মনের মধ্যে। এবং বৈষম্যটা নিছক অনুভূতি স্তরে থাকেনি, এটা ফ্যাক্ট বা প্রতিষ্ঠিত সত্য। উদাহরণ দিই, বিপিএল এর প্রোগ্রামে জেমস মাত্র ৪টা গান পরিবেশন করেছে,সালমান খানের পারফরম্যান্সের ব্যাপ্তিও ২০-২৫ মিনিটের বেশি হওয়ার কথা নয়।
এবার একটা পরীক্ষা চালিয়ে দেখুন। গতকাল যারা মাঠে উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে যতজনকে পারুন জিজ্ঞেস করুন, সে কেন এখানে এসেছে; জেমসের গান শুনতে, নাকি সালমান-ক্যাটরিনাকে দেখতে?
আপনার বাসায় যতজন মানুষ গতকাল প্রোগ্রাম দেখেছে একই প্রশ্ন তাদেরও করুন। উত্তরের পাই চার্ট তৈরি করে দেখুন কোন পারসেন্টেজটা বেশি হয়।
এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন। ধরা যাক, জেমস ৪টি নয়, ২টি অথবা ৬টি গান পরিবেশন করবে। শর্ত হলো, সে ২টি গান গাইলে অতিরিক্ত সময়টুকু সালমানের পারফরম্যান্স টাইমের সাথে যোগ হবে, আর যদি ৬টি গায়, সেই সময়টুকু সালমানের পারফরম্যান্স টাইম থেকে কেটে নেয়া হবে। কী মনে হয়, দর্শক কোনদিকে ভোট দিবে?
আপনি ভাবছেন, সনু নিগম বা কৈলাশ খের কে এত সময় না দিয়ে সেখানে আরো কয়েকজন বাংলাদেশী পারফরমারকে সুযোগ দেয়া যেত কিনা।
এটা কোনো আন্তঃসাংস্কৃতিক আদান-প্রদান অনুষ্ঠান নয়। এটা মূলত ভারতীয় আর্টিস্টদের প্লাটফরম, বাংলাদেশীদের রাখা হয়েছে নিছকই খ্যাপ আর্টিস্ট হিসেবে। একথা বাংলাদেশী আর্টিস্ট থেকে শুরু করে আপনি, আমি সবাই জানি। তবু ক্লিশের পুনর্চর্চা কেন?
প্রথম কারণ, আপনার সময় কাটে ভারতীয়তার বলয়ে। ভারতীয় সিনেমা, ভারতীয় গান, ভারতীয় সিরিয়াল, ভারতীয় সাহিত্য, ভারতীয় খেলা ( ক্রিকেট যদিও ভারতীয় খেলা নয়, তবু বিগত দুই দশকে ক্রিকেট অর্থনীতি সর্বান্তকরণে ভারতনির্ভর হওয়ায়, ক্রিকেটও ভারতীয় ব্রান্ডে পরিণত হয়েছে বলা চলে), ভারতীয় পণ্য— কোনো না কোনোভাবে আপনি ভারতীয় কমোডিটি কনজিউম করছেন। আপনার- আমার মনন প্রো-ভারতীয় অনেকটাই।
দ্বিতীয়ত, লোকাল কনটেন্টে নিজস্বতার রুগ্ন দশা। কনটেন্টকে আপনি সীমানা দিয়ে আটকে রাখবেন কীভাবে? যদি জিজ্ঞেস করি সালমান খানের সিনেমা কেমন, আপনি বলবেন মসলাদার, দেখেনই না। তাহলে আপনি কীভাবে জানলেন তার সিনেমা মসলাদার, এবং সিনেমা শত কোটি টাকা বিজনেসই বা করে কীভাবে!
অডিও ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে গেছে, বাংলা সিনেমা নিয়ে নিজেরাই ট্রল করেন, বইমেলায় যেসব বই প্রকাশিত হয় সেখানে বইয়ের চাইতে লেখকের মার্কেটিং কৌশল নিয়েই সমালোচনা করেন বেশি, সৌম্য সরকারের মতো দুটি বিশ্বকাপে খেলা খেলোয়াড়কে খেলতে পাঠান ইমার্জিং কাপের দলে; কোন কনটেন্টে আপনার নিজস্বতা রয়েছে?
উত্থিত প্রশ্ন- প্রকারান্তরে কি ভারতীয় আধিপত্যকে মেনে নেয়ার কথাই বলছেন ঠারেঠুরে?
সুলুক সন্ধান- এখানে আপনার বা আমার হাতে সিলেকশনের অপশন নেই৷ মানছি নাকি মানছি না তাতে আসলে পরিস্থিতির কিছুই যায়-আসে না। তবে ম্যাক্রো রিয়েলিটি বুঝলে মানসিক অস্থিরতা কিছুটা কমবে, প্রতিক্রিয়াশীলতা নিয়ন্ত্রণসীমায় থাকবে। মন চাইলে দেখুন, না চাইলে অন্য কাজে মন দিন। হাহাকার দেখানো যদি রুটিনওয়ার্ক বা দৈনিক হাজিরা দেয়ার মতো হয়, তবে দিতে থাকুন। ভাসা ভাসা চিন্তা করে কেবল অভিযোগই উগড়ে দিতে পারবেন, ‘কেন’ খুঁজতে গেলে আপনার শিল্পরুচি অনেকটাই নিজস্বতা বোধ আবিষ্কার করে নিতে সমর্থ হবে।
মঞ্চে কৈলাশ খের বা সনু নিগমের চেহারায় আদতে আমি একটি বারো ফুট বাই বারো ফুট রুমের টেলিভিশন দেখতে পাই, সেখানকার রিমোট কন্ট্রোল ক্রমাগত কেবল ভলিউম বাড়ানো, কমানোয় ব্যস্ত থাকে; চ্যানেল বিশেষ পাল্টায় না। সেই রিমোটের অধিকারীর পরিচয় জানতে আয়নার সামনে দাঁড়ান, অথবা ভনিতা পরিহার করে ঝেড়ে কাশুন।
কাশির জন্য তুলসি চা খান।