হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে শুধু ফেসবুকেই বোধহয় কয়েক হাজার স্ট্যাটাস বা পোস্ট লেখা হয়েছে। পেপার, লিটলম্যাগ বা অনলাইন পোর্টাল মিলিয়েও সংখ্যাটা আরও কয়েকহাজার অতিক্রম করে যাবে অবলীলায়। আমিও তরুণ বয়সে ৮ বছর আগে তাঁর সাহিত্যকর্ম বিষয়ে ব্লগে লিখেছিলাম, বলতে দ্বিধা নেই টিপিকাল আঁতেলীয় দৃষ্টিভঙ্গিই সেখানে রিফ্লেক্টেড হয়েছিল, যেটা উচিত হয়নি এটা স্বীকার করতে সংকোচ বোধ করছি না একটুও। আজও লিখছি সেই একই মানুষের বিষয়ে, তবে এই লেখার আঙ্গিক একটু আলাদা; বই নয়, তাঁর নাটক, গান, সিনেমা এবং খুবই ব্যক্তিগত একটি সিদ্ধান্ত- মূলত এসবেই দৃষ্টিপাত করতে চাই, প্রাসঙ্গিকভাবেই হয়তোবা বইয়ের কথা আসবে, তবে সেটা এই লেখার মূল ফোকাস পয়েন্ট নয়।
হুমায়ূন আহমেদের নাটক আসলে কেমন, এই সিম্পল প্রশ্নের সরল উত্তর দেয়া কঠিন। ইন্টেলেকচুয়ালি এনরিচড মানুষেরা সম্ভবত বলবেন, একসময় তাঁর নাটকে মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন ছিলো, সেখানকার আনন্দ-বেদনা ছিলো, সূক্ষ্ম ইমোশন ছিলো, যে কারণে মানুষ গোগ্রাসে সেসব গিলতো, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতো। রেফারেন্স হিসেবে ‘কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রিহীর’ কথা বলবেন তাঁরা। কিংবা বলতে পারে শ্রেণী-সংঘাত ও ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব এর কথা, যার রেফারেন্স হিসেবে আসবে ‘অয়োময়’। তাঁরা আরও বলবেন, এরপরে তাঁর রূপান্তর হয়েছে, তিনি হাস্যরসের দিকে ঝুঁকেছেন। রেফারেন্স হিসেবে, সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড ,তারা তিনজন (এটাকে অনেকেই বলবেন বিদেশী সিরিজের অনুকরণ। হিমু, মিসির আলি নিয়েও একই ধরনের কথা প্রচলিত আছে বোদ্ধামহলে, তাঁদের হাতে শক্ত রেফারেন্সও প্রস্তুত),প্যাকেজ সংবাদ প্রভৃতির কথা। এবং সবচাইতে নির্মম যে কথাটি এরপর তাঁরা বলবেন সেটা হলো, পরবর্তীতে তাঁর সৃজনশীলতা শাওন বলয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে, নাটকের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠে শাওনকে ওভারগ্লোরিফাই করে রিপ্রেজেন্ট করা। এটারও পর্যাপ্ত রেফারেন্স ডাটা এভেইলেবল। ‘উড়ে যায় বকপক্ষী, কালা কইতর, গুনীন, হাবলঙ্গের বাজারে’ – এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া এবং তার আলোকে প্রমাণ করা জীবনের শেষ কয়েকবছরে হুমায়ূন আহমেদের যাবতীয় ক্রিয়েটিভিটির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল শাওন। আমি কোনো বোদ্ধা মানুষ নই, নিজের ইন্টেলেক্টকেও খুব এনরিচড মনে হয়নি কখনো, তাই রেফারেন্স দিয়ে একটা কিছুকে জাস্টিফাই করার যে চিরাচরিত প্রথা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত, বিনয়ের সাথে বলতে চাই, আমি একে জাস্ট ইগনোর করি। তাতে আমি অর্থোডক্স বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন আখ্যা যদি পেয়েও যাই, সমস্যা নেই; দিনশেষে কিছুই ম্যাটার করে না আসলে। আপনি আমাকে ফুলিয়ে তালগাছে তুলেন, অথবা সমালোচনা করে পাতালে পাঠান, আমি সেই আগের মতোই ৫ফুট ৪ ইঞ্চির খর্বাকৃতির এভারেজ মেধার একজন মানুষ হয়ে মাটিতে থাকবো, ৬দিন কাজ করবো, শুক্রবারে বিশ্রাম করবো। আমার পর্যবেক্ষণ বলে রেফারেন্স দেয়া অধিকাংশ মানুষেরা একটা কাঠামোবদ্ধ ধারণার বাইরে সচরাচর বের হতে পারে না, মেধার দিক থেকে তারা বিলো এভারেজ এবং পরিবর্তনকে তারা সহজে একসেপ্ট করতে পারে না। তাদের হুমায়ূন-মূল্যায়ন নিয়েও আমি একই অভিমত ব্যক্ত করবো। ডিয়ার স্যার, রেফারেন্স দিয়ে একাডেমিক থিসিস লেখা যায় (যেটা আপনি নিজেও পড়েন না পুরোটা), কিন্তু একটা আইডিওলজি বা কনসেপ্ট বুঝার জন্য রেফারেন্স নয়, ইনটেনশন বুঝতে চাওয়ার ইনকিউজিটিভ মাইন্ডটা জরুরী; রেফারেন্সপ্রিয়তার কারণে আপনার সেই বৃত্তিটা ভোঁতা হয়ে গিয়েছে; আমার কথায় হার্ট হলে এক্সট্রিমলি স্যরি।
হুমায়ূন আহমেদ এর নাটক নিয়ে বলতে গেলে আমি প্রথমেই বলবো, তার চরিত্রের ধরন এবং ভাষা, এবং খুব বিশেষভাবে বলবো বাচ্চাদের ব্যাপারটা। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে বা সিনেমায় বাচ্চাদের যেভাবে প্রেজেন্ট করা হয়েছে, এতো নিখুঁত এবং ইন্টারেস্টিং এন্টারপ্রেটেশন আমি কোনো বাংলাদেশী নাটকে দেখেছি কিনা মনে করতে পারছি না (আমি টেলিভিশন খুব একটা ফলো করি না, আমার দেখায় ভুল থাকতে পারে)। সাধারণত, নাটকগুলোতে বাচ্চাদের রোল থাকে আহলাদী ধরনের বা স্ট্রাগলিং, যেখানে বাচ্চাই হয়তো খুব পাওয়ারফুল ক্যারেক্টার, কিন্তু বাচ্চার মধ্যে বাচ্চামি নেই। সেটা হয় নাট্যকারের কল্পিত বাচ্চা অথবা কিশোরকে বাচ্চা হিসেবে চালিয়ে দেয়া। হুমায়ূন আহমেদের বাচ্চাগুলোকে বলা যায় পারফেক্ট বাচ্চা; ওরা হয় চরম দস্যি প্রকৃতির, নয়তো ভাবুক, কিংবা খুবই ইঁচড়ে পাকা। বাচ্চাদের সাইকোলজি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ মজা করেছেন বিভিন্ন নাটকে। যেমন, কোথাও কেউ নাটকে একটা দৃশ্য ছিলো এমন, বাবা ছেলে-মেয়েকে পড়াতে বসেছেন, বাবা কিছু একটা ভুল করায় বাচ্চারা হেসে ফেলে, বাবা জিজ্ঞেস করে জবাব না পেয়ে সন্দেহের বশে মেয়েকে চড় মারে; কিন্তু আসলে হাসে ছেলেটা, এবং পরে বাবা যখন বোনকে মারে ওর মায়া হয়, স্বীকার করে নিজের কৃতকর্ম। খুবই সিম্পল দৃশ্য, কিন্তু এর এন্টারপ্রেটেশন অনেক গভীর। হুমায়ূন আহমেদের নাটক বা সিনেমার বাচ্চাগুলোকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখুন; নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই লোকের প্রতি আপনার রেসপেক্ট বেড়ে যাবে। রেফারেন্স দিয়ে তাঁকে মাপতে চাওয়া স্বচিন্তিত আলোকিত ব্যক্তিবর্গ সেই অনুভূতির সন্ধান কখনোই পাবে না, কারণ তারা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়বে সৈয়দ শামসুল হককে আসলেই সব্যসাচী লেখক বলা উচিত কিনা, কিংবা হুমায়ূন আজাদের সাথে আহমদ সফার ব্যক্তিগত রেষারেষিটা কোনো ফিলোসফিকাল ইনসিকিউরিটি থেকে উদ্ভূত কিনা তার যথাযোগ্যতা বিশ্লেষণের তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করতে।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকের আরেকটা খুব পাওয়ারফুল চরিত্র বাড়ির চাকর, দারোয়ান বা কাজের বুয়া টাইপ মানুষগুলো। তারা খুবই বোকা কিসিমের হয়ে থাকে সাধারণত, কিন্তু হুট করে এমন একটা কথা বলবে যা আপনাকে ভাবাবে। আমি নিজেও রেফারেন্স দিচ্ছি, কিন্তু সেটা দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চাইছি না, জাস্ট ব্যাপারটা বুঝাতে চাইছি। যেমন, বহুব্রিহী নাটকে কাজের লোক কাদের বলে ‘ভালোবাসা হইলো শরমের জিনিস, তয় জিনিসটার দরকার আছে’! এই যে স্বল্পজ্ঞানের মধ্য দিয়ে গভীর অনুভূতি ট্রান্সফার, এই কাজটা হুমায়ূন আহমেদ নিয়মিতই করেছেন। কিন্তু সেগুলো গুরুত্ব পায়নি, তার সাহিত্যকর্ম গণ্য হয়েছে পাল্প ফিকশন হিসেবে।
আলবেয়ার কাম্যুর ‘আউটসাইডার’ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত একটি বই, এবসার্ডিটির জন্য তিনি প্রসিদ্ধ। কিংবা জা পল সার্ত্র অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসেবে অনেক ইনফ্লুয়েন্সিয়াল, দস্তয়ভস্কির উপন্যাসে অস্তিত্ববাদীতা খুঁজে বোদ্ধারা হয়রান হয়ে আবারো খুঁজেন। আউটসাইডারের নায়ক মায়ের কফিনের পাশে বসে যখন সিগারেট খায়, কিংবা কোনোরকম বিকার ছাড়াই ফাঁসির জন্য প্রস্তুতি নেয়, আমরা এবসার্ডিটির মোহে পড়ে যাই, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের হিমু যখন পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হাঁটে সেটাকে আমরা বলি ইমপ্র্যাকটিকাল, তখন আর এবসার্ডিটি আমাদের মাথায় আসে না। তাঁর নাটকের ছোটমির্জা যখন সর্বশান্ত হয় তার অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে আমরা অস্তিত্ববাদীতা পাই না। কারণ, তার এলিমেন্টগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তিনি জটিল দর্শনকে খুবই হালকাচালে প্রেজেন্ট করার বিরল প্রতিভা অর্জন করেছিলেন। আমাদের সীমিত মেধার বিজ্ঞ বোদ্ধারা এই বিরল প্রতিভাকে ‘বাজারী’তকমা দিয়ে মহাখুশি হয়ে এনজিও বা এম্বাসিতে গিয়েছেন দাক্ষিণ্য পাওয়ার আশায়। তাদের ভারি তত্ত্ব মানুষ গ্রহণ করেনি এটা তাদের সীমাবদ্ধতা হিসেবে মেনে না নিয়ে মেজরিটি মানুষ স্থূলরুচির এই রায়ে পৌঁছে গিয়ে তারা আরও দুর্বোধ্য রচনা লিখবার বাসনায় শ্যশব্যস্ত হয়েছেন। এই ইনফেরিওরিটির ব্যাপারটা হুমায়ূন আহমেদ খুব ভালো বুঝতেন, যে কারণে তার প্রখর সেন্স অব হিউমার দিয়ে সেগুলোর জবাব দিতেন। যেমন, তাকে যখন বাজারী লেখক বলা হতো তিনি বলতেন বাজারে যে লেখকের বই পাওয়া যায় তিনি বাজারী লেখক, আর যার বই ঘরেই পড়ে থাকে তিনি হচ্ছেন কালজয়ী (শব্দটা সঠিক মনে নেই) লেখক। এই একটা লাইনেই তিনি ১০০০ শব্দের নিবন্ধের সারকথা বলে দিয়েছেন।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকে এবসোলিউট খারাপ বা পুরোপুরি ভালো কোনো চরিত্র নেই। খারাপ লোকটিও এমন কোনো আচরণ করে বসে যার জন্য তার প্রতি মায়া হয়, আবার ভালো লোকটিও গোপন কোনো ভুল করেছে এরকম একটা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কাজ করে। এই যে এভিল-এনজেল ব্যালেন্স, এটা বোধহয় হুমায়ূন আহমেদের নাটক-সিনেমা ছাড়া বাংলাদেশের বাকি মাধ্যমগুলোতে বেশ ভালোমতোই অনুপস্থিত। অন্য নাটকের নায়ক মানে সত্যের জন্য জীবন কুরবানী করে দেবে, খারাপ মানে সে ঘুমের মধ্যেও মানুষের ক্ষতি চায়।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকের আরেকটা বড় অনুষঙ্গ বাদ্য-বাজনা। যে কোনো আমোদ-ফূর্তি মানেই সেখানে ব্যান্ডপার্টি আসবে, হুলস্থূল বাঁধবে, এক এলাহী ব্যাপার। মাস্টার, মাওলানা, চেয়ারম্যান প্রভৃতি চরিত্রগুলো ম্যানার (যেমন কদমবুসী, সালাম দেয়া, শিক্ষাগত যোগ্যতা) নিয়ে খুবই কনছার্ন থাকবে, কিন্তু অন্যের বিরক্তির উদ্রেক হচ্ছে এ ব্যাপারে উদাসীন থাকবে। আপনি বলতে পারেন, এটা তো কমন প্যাটার্ন, খুবই প্রেডিক্টেবল, রিপিটিটিভ, ভ্যারিয়েশন কোথায়? একবাক্যে উত্তর দিলে, আপনার প্রশ্নকে খুবই যৌক্তিক এবং বৌদ্ধিক বিবেচনায় চিন্তাশীল মনে হবে, কিন্তু একটু বিরতি নিয়ে বললে,আপনার প্রশ্নটা খুবই লিনিয়ার এবং ইনভ্যালিড, যার কোনো ইন ডেপথ থিংকিং নেই। একটা কথা বলি, রিপিটিশনই আলটিমেট বিউটি, বৈচিত্র্য আমাদের কল্পনায় থাকে, বাস্তবে তার দেখা মেলে কদাচিৎ। একটু নিজের দিকে তাকান, একইভাবে খাচ্ছেন, একই ভাবে কথা বলেন,একই স্টাইলে হাঁটেন, এমনকি যদি ধর্ম বিশ্বাসী হন, প্রতিদিন অন্তত ৫ বার নামায পড়েন; অর্থাৎ সারাদিনে বেশিরভাগ কাজই করেন যা আপনি আগের দিনও করেছেন। এর মধ্যে বৈচিত্র্য আসে, যেটা ঠিক সচেতনভাবে নয়, অবচেতনভাবে চলে আসে, এবং এই বৈচিত্র্যের সংখ্যাও আনলিমিটেড নয়। একটা সময়ে বৈচিত্র্যটাও অভ্যস্ততা হয়ে যায়। বৈচিত্র্য একটি ফ্যান্টাসি, রিপিটেশনই আইডেন্টিটি। প্রেডিক্টিবিলিটির মধ্যেই মূল মজা। যেমন, হুমায়ূন আহমেদের নাটকে ক্যাবলা ক্যারেক্টার মানেই সে হেনস্তা হবে এবং কীভাবে হবে তাও আমরা জানি, তবু আমরা দেখে মজা পাই, এখানেই রিপিটেশনের ম্যাজিক। হুমায়ূন আহমেদ সেই ম্যাজিকের ইন্টারনাল কনসেপ্টটা ধরতে পেরেছিলেন বলেই মোহটা বজায় ছিলো।
তাঁর নাটকের ভাষারীতিও একটা ইউনিক ব্যাপার। তাঁর চরিত্রগুলো যে ভাষায় কথা বলতো, সেটা একটা নিজস্বতা তৈরিতে সমর্থ হয়েছিল।
নাটক নিয়ে অনেক কথা বলতে গিয়ে সিনেমার প্রসঙ্গটি চাপা পড়ে যাচ্ছে। আসলে হুমায়ূন আহমেদের সিনেমাগুলোকে আমার বড় দৈর্ঘ্যের নাটকই মনে হয়েছে। তবু স্টোরি-টেলিংয়ের কারণে সেগুলোকে অসাধারণ বলাই যায়। আমাদের উপমহাদেশে সিনেমার মেকিং, সিনেমাটোগ্রাফি, আর্ট ডিরেকশন প্রভৃতি টেকনিকাল বিষয়গুলো খুব বেশি আলোচিত হয়নি, আমাদের এদিকটায় দর্শক সিনেমার মধ্যে স্টোরি খুঁজে, প্লটের মধ্যে ইমোশনটাল এটাচমেন্ট চায়। এই আঙ্গিক থেকে হুমায়ূন আহমেদকে আমি সফলই বলবো। শঙ্খনীল কারাগার, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন এদের স্টোরিপ্লে কে সমালোচনা করা কঠিনই বটে; সেখানে প্লটে ইনোভেশন হয়তো নেই, কিন্তু ইমোশনাল এটাচমেন্ট আছে, হুমায়ূনীয় আবেশ আছে ভালোমাত্রাতেই। দুই দুয়ারী সিনেমাতে তিনি নিজেকে ভাঙতে চেয়েছিলেন, যে কারণে এটার দর্শকপ্রিয়তা তুলনামূলক কম। চন্দ্রকথা সিনেমাটা বোদ্ধারা শাওনকেন্দ্রিক বলবেন, আমার কাছে স্টোরিপ্লেতে সেই স্পার্কিংটা মিসিং লেগেছে।শ্যামল ছায়া তেও স্পার্ক কম। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে সবচাইতে আশ্চর্যান্বিত হয়েছি নয় নম্বর বিপদ সংকেত সিনেমাটা দেখে, বিপুলভাবে আলোড়িতও হয়েছি। যারা দেখেছে প্রায় সবাই এটাকে জঘন্য বলেছে, কিন্তু আমি এই সিনেমাকে দেখেছি একটা শিল্পবিপ্লব হিসেবে।ফারুকী এবং ভাই-বেরাদার গং নাটক-সিনেমা নিয়ে যে স্টাইলটা এক্সপেরিমেন্ট করছেন, তিনি যে সেটাতে খুবই বিরক্ত, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ছিলো সেই বিরক্তির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। আর্টের জবাবে আর্ট, এই যে প্রতিক্রিয়া একে আমি খুবই উচ্চ মর্যাদা দিই। হুমায়ূনের ঘনিষ্ঠজনেরা এই মূল্যায়নের সাথে একমত নাও হতে পারেন, তবে আমি মনে করছি স্পেশালি এই সিনেমাটা একটা সমকালীন ট্রেন্ডকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করার একটা স্যাটায়ার। আপনারা সম্ভব হলে ইউটিউবে সিনেমাটা আবারো দেখে নিন, এরপর আমার কথা মিলিয়ে নিতে পারেন। ঘেটুপুত্র কমলা সিনেমাটা দেখার সুযোগ পাইনি, তবে প্লট জানি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছুটা সাহসীই বলবো। হুমায়ূন আহমেদ নিজের জনপ্রিয়তাকে বাজি রেখে এরকম একটা কাজ করার সাহস করেছেন, এটাই আমাকে যথেষ্ট মুগ্ধ করেছে। সাধারণত জনপ্রিয় মানুষেরা নিজেরা একটা ‘ইমেজ ফোবিয়া’ তে ভুগেন, এই কাজটা আমার ইমেজের সাথে যায় না, ওটা করলে মানুষ কী ভাববে- এসব ভাবনা তাদের এক ‘ইমেজ খোলস’এ আটকে ফেলে। ফলে তারা ক্রমাণ্বয়ে এক কাঠের পুতুল এ পরিণত হন, তাদের ব্যক্তিসত্তা, নিজস্বতা বলতে কিছু আছে এই ধারণাটিই বিসর্জন দিয়ে দেন এক পর্যায়ে। হুমায়ূন আহমেদের সেই গাটস ছিলো, তিনি জানতেন মানুষ আসলে ইঁদুরের মতোই অনুসরণপ্রিয়, তাদের গোল্ডফিশ মেমরি। আজ রিএকশন দেখাচ্ছে, কাল একটা হাসির নাটক দেখলেই এরা হিমু সেজে হলুদ রঙকে জনপ্রিয় করার মিশনে নামবে। বাঙালির হুজুগ নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করার সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি।
তার গান প্রসঙ্গে আলাদা করে লিখলে ভালো হতো। কিন্তু এক লেখাতেই সেটা কাভার করতে চাই। আমি সাহিত্যিক হুমায়ূনের ততটা ফ্যান নই, নাট্যকার হুমায়ূনের গুণমুগ্ধ, শ্রেষ্ঠ সেন্স অব হিউমার ওয়ালা বাঙালি এটাও হয়তো মেনে নিব, কিন্তু এই সব পরিচয়ের চাইতেও গীতিকার হুমায়ূন আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গাটা আরও সম্প্রসারিত করে। তিনি খুব বেশি গান লিখেননি, কিন্তু যে কয়টা লিখেছেন, প্রত্যেকটা গানের কথায় আমি অভিভূত। দুই দুয়ারি সিনেমার ‘মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ’ – এমন সিম্পল অথচ সুরিয়েল লিরিক আমি খুব বেশি শুনেছি এটা বলবো না। ‘একটা ছিলো সোনার কন্যা’ ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে যা যা তুই উড়াল দিয়া যা’, ‘চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’, ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো- এক বরষায়’ ‘ঝিলমিল করে মেঘ ’ – লিরিক হিসেবে কোনটাকে উপেক্ষা করা যায়! অথচ, তার এই বিস্ময়কর প্রতিভার ক্ষেত্রটি সেভাবে বিকশিতই হয়নি, হয়তোবা গল্প লিখে যে মজাটা পেতেন, গানের মধ্যে সেভাবে পাননি। একটা মানুষ এতো বিপুল আনন্দের উৎস কোথায় পেলো, এটা ভেবে প্রায়ই বিমূঢ় হয়ে যাই।
তিনি ছবি আঁকতেন, ম্যাজিক জানতেন- একটা মানুষকে কত বিচিত্র উপায়ে ইমপ্রেস করা যায়, কত উদ্ভটভাবে ট্রিট করা যায় এটা তার চাইতে ভালো আর কোনো বাঙালি জানেন, এটা বিশ্বাস করতে হলে আমাকে দীর্ঘদিন তাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে তার এই কার্যক্রম দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। মানুষকে নিয়ে মজা করা, তাকে কমফোর্ট জোন থেকে বের করে আনা- এসবের জন্য আমি যেসব আপাত উদ্ভট কিন্তু অভিনব কাজগুলো করেছি এবং এখনো প্রতিনিয়ত করি, স্বীকার করতে একটুও লজ্জা পাচ্ছি না, তার প্রায় পুরোটাই হুমায়ূন আহমেদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। আমি জীবনে আমার চাইতে মেধাবী, আমার চাইতে শতগুণ ট্যালেন্টেড এরকম বহু মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, কিন্তু তাদের কারো দ্বারাই প্রভাবিত হতে ইচ্ছা করেনি, কিন্তু হুমায়ূনের উদ্ভটতার মধ্যে আমি এমন কিছু পেয়েছি যা আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে মানুষের ব্যাপারে কৌতূহলী হওয়া যায় এবং কৌতূহলটা তার মধ্যেও সঞ্চার করা যায়।
সবশেষে সেই বিব্রতকর ইস্যু যা নিয়ে না লিখলে এই লেখাটা শেষ হয় না আসলে। তিনি শাওনকে বিয়ে করেছেন, যিনি তার মেয়ের বান্ধবী ছিলেন। এটা নিয়ে সাধারণ পাঠকমহলে তিনি নিন্দিত হয়েছেন, আখ্যায়িত হয়েছেন পারভার্ট একজন মানুষ হিসেবে। আমি তার ২য় বিয়েকে সমর্থন করি কিনা এই প্রশ্নটা আসলে আমার মাথায় আসারই কথা নয়। এটা নিয়ে কথা বলার একমাত্র রাইট পারসন গুলতেকিন খান, এবং পরের ধাপে তাঁর সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা। গুলতেকিন খানের সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, পরিবারের সদস্যদের মনোভাব তাদের নিজস্ব। কাজেই ব্যাপারটা এখানেই মিটে যেতে পারতো, কিন্তু যায়নি কারণ তিনি হুমায়ূন আহমেদ, তিনি আমার-আপনার মতো আমজনতার কাতারে পড়েন না, তিনি বাংলা সাহিত্যের এযাবৎকালের জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিক, এবং তার প্রতিভার ক্ষেত্র সুদূরবিস্তৃত। তিনি পাবলিক ফিগার, তাকে অনুসরণ, অনুকরণ করে লক্ষ মানুষ; সুতরাং এমন মানুষ চাইলেই যা খুশি করতে পারেন না। আপনার কথায় যুক্তি আছে। এবার তাহলে আমি বলি। হুমায়ূন আহমেদ ১৫০টির বেশি বই লিখেছেন, সেগুলো থেকে নাটক-সিনেমা হয়েছে প্রায় ১০০ টির কাছাকাছি, তিনি অনেকগুলো অসাধারণ লিরিক লিখেছেন, তিনি ছবি আঁকতেন, তিনি মেট্রিক-ইন্টারে স্ট্যান্ড করেছেন, তিনি ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। অনুসরণ করতে চাইলে আপনি এগুলোর এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য থেকে ইনস্পাইরেশন নিন, সেটাই আপনার জন্য ভালো হবে। তা না করে সে মেয়ের বান্ধবীর সাথে বিবাহিত জীবন শুরু করেছেন সেটা দেখে যদি আপনি অনপ্রাণিত হন, সেটা তো ভাই আপনার সমস্যা। এই আপনাদের কারণেই সাদিয়া প্রভা বা চৈতির ভিডিও ভাইরাল হয়, নিজেদের সংযত করুন। একজন মানুষের যৌনরুচি কী হবে সেটা নিয়ন্ত্রণের আপনি-আমি কেউ নই। আপনি যদি মাইকেল মধুসূদনকে নিয়ে স্টাডি করেন, দেখবেন তিনি তার কলিগের মেয়েকে ২য় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, টলস্টয়কে নিয়ে পড়েন, জানবেন তিনি ১৩ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু আজ এতোদিন পরে মাইকেল মানেই মেঘনাদবধ কাব্য, সনেট, আর টলস্টয় মানে আসলে কী নয়, সেটাই প্রশ্ন। অথচ, তাদের সেসব স্খলন হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে। তেমনিভাবে ৭০ বছর পরে আপনি-আমি হারিয়ে যাব, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তখনও একইরকম প্রাসঙ্গিক থাকবেন; শাওনের সাথে তার কেমিস্ট্রিটাকে একটা অসম রোমান্সের নান্দনিক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়ে প্রোমোশন বা পদক পাবে কোনো রেফারেন্সপ্রিয় গবেষক। কাজেই নিজের দিকে তাকান; হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বিচলিত হবেন না, তিনি আপনার-আমার চাইতে অনেক অনেক উপর লেভেলের লোক। আপনার যদি গুলতেকিন খানের প্রতি সিমপ্যাথি হয়, মানুষ হিসেবে আপনার সেটা হতেই পারে। সেক্ষেত্রে, আপনি নিজের স্ত্রীকে বেশি সময় দিন, পরস্ত্রী বা ফেসবুকে মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করা ছেড়ে দেন, ফেক আইডি খুলে মেয়েদের হয়রানি বন্ধ করুন, বাসে বা কোনো ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের শরীর ধরার ধান্ধা ছেড়ে দেন, বা যদি এর কোনো টাইপ না হন, তাহলে সংকল্প করুন ভবিষ্যতে যাকে বিয়ে করবেন, তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন। সেটাই হবে গুলতেকিন খানের প্রতি সত্যিকারের ট্রিবিউট। আমাদের সোসাইটিরও সমস্যা আছে। এক মণ দুধে এক ফোঁটা চুন পড়লে পুরো দুধ নষ্ট হয়ে যায়। আমি মনে করি, যত প্রবাদ আছে এটা হচ্ছে অন্যতম প্রতিক্রিয়াশীল প্রবাদ। এর মানে হলো, একটা মানুষের সারা জীবনের অর্জন জাস্ট এক মুহূর্তের ছোট্ট ভুলে নাই হয়ে যায়, প্রতিনিয়ত নিজেকে ঠিক রাখতে হয়, উপরে উঠা কঠিন, নেমে যাওয়া ১ সেকেন্ড এর ব্যাপার। কিন্তু আমি বলবো, মানুষ এতো স্থূল কোনো ব্যাপার নয়। একটা মানুষ ভুল করবে, অন্যায় করবে এটাই ন্যাচারাল, সুপার হিউম্যান খুবই বিরল দৃষ্টান্ত। কাজেই একটা ভুলে তার সব ধূলিসাৎ এই ফালতু দৃষ্টান্ত দিয়ে মানুষের মূল্যকে ছোট করা হয়। সবকিছুর পরও মানুষ আসলে মানুষই। তার যেটুক ভুল শুধু সেটুকুর জন্য তাকে আমি অপছন্দ করতে পারি, কিন্তু ভুলের কারণে সমস্ত অর্জন মিথ্যা, এটা চরম প্রতিক্রয়াশীলতা। এক কাজ করা যেতে পারে, দুধে যদি চুন পড়েই যায় দুধটাকে গাছের গোড়ায় ঢেলে দিন, সার হিসেবে পুষ্টি পাবে, গাছের উপকার হবে, তার সুফল আপনিই ভোগ করবেন। শুধু দেহের তৃপ্তি দিয়ে তো জীবন চলে না, আত্মিক তৃপ্তি লাগবে না কিছু? আপনি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে মজা পেয়েছেন, তাঁর নাটক দেখে হেসেছেন, সিনেমা দেখে ভালো লাগা অনুভূতি পেয়েছেন; একটা মানুষ ৪০ বছর ধরে আপনাকে বিনোদন দিয়ে গেছে। সেই মানুষ দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, তাতে কি আপনার বিনোদনেন ভাঁড়ারে কমতি পড়েছে কোনো? তার যেসব রিসোর্স আছে, সেগুলো দিয়ে বাকি জীবনটাও বিনোদিত হতে পারবেন, আর কী চাই আপনার?
বাংলাদেশে মেধাবী মানুষের অভাব নেই। সোসাইটিতে কন্ট্রিবিউট করেছেন এমন মানুষও অসংখ্য। কিন্তু শুধুমাত্র প্রতিভার কথা চিন্তা করলে, সত্যজিত রায় ছাড়া আমি আর একজন মানুষকেও পাইনি যিনি প্রতিভার ডাইমেনশনে হুমায়ূন আহমেদের কাছাকাছি আসতে পারেন। (রবীন্দ্রনাথকে এই আলোচনায় না টানার অনুরোধ, তিনি ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান)। সেই হুমায়ূনের প্রতিভাকে আপনি বুঝতে পারলে ভালো, না পারলে আরও ভালো। কারণ যখন বুঝবেন, তখন আপনার একধরনের যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি হবে, তার জীবনের শেষদিনগুলোর কথা মনে পড়লে কান্না আসবে; সেই ভার আপনার কাঁধ বহন করতে পারবে না।
‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়……’