সৌম্য সরকার কি আরেকজন আশরাফুল হতে চলেছেন? প্রশ্নটা উত্থাপনের জন্য এটা too early call, কিন্তু সমর্থকদের প্রত্যাশার বিপরীতে অসহিষ্ণুতা আর ২০১৫ এর শেষ এবং ২০১৬ এর পুরোটা ঘরোয়া লীগ আর টি২০ গুলোতে সৌম্য সরকারের টানা ব্যাড প্যাচ এই ব্যাপারপটিকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
ব্যাটসম্যান হিসেবে আশরাফুল আর সৌম্য সরকারের মিলের জায়গা দুজনই দৃষ্টিনন্দন শট খেলেন, তবে ব্যাটিং এপ্রোচে পার্থক্য বিস্তর।
টেকনিকের দিক থেকে আশরাফুল অনেক সাউন্ড ছিলেন, সৌম্যের প্রধান শক্তি হ্যান্ড আই কোঅরডিনেশন; ফুটওয়ার্ক, ডিফেন্স এসবে তার মৌলিক দুর্বলতা রয়েছে।
আশরাফুল স্ট্রোক খেলতে পছন্দ করলেও তার রিস্টে পাওয়ার কম, যে কারণে ওভার দ্য টপ খেলতে গেলে বেশিরভাগ সময়ই বাউন্ডারিতে আউট হতেন, সৌম্যের সেই সমস্যা নেই, রিস্টে এতোই পাওয়ার যে অবলীলায় বল গ্যালারিতে পাঠাতে পারেন।
আশরাফুলের সাথে সৌম্যর তুলনা হচ্ছে একটি প্র্যাকটিকাল কারণে। ১২ বছরের ক্যারিয়ারে আশরাফুলকে ঘিরে কেবল মিথই তৈরি হয়েছে, এবং বরাবর বলা হয়েছে প্রতিভা অনুযায়ী পারফরম করতে পারেন না। সৌম্যর ক্যারিয়ার ২ বছরের, এর মধ্যেই দীর্ঘ অফ ফর্মের খড়গে পড়ে গেছেন। কিন্তু ২০১৫ এর বিশ্বকাপে কয়েকটি ৩০+ ইনিংস, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং তাকে আগামী দিনের তারকা হওয়ার সম্ভাবনাযুক্ত করে তোলে, এবং অল্পদিনের মধ্যেই ফ্যান-ফলোয়ার বাড়তে থাকে। ফলে ২০১৫ এর ইন্ডিয়া সফর (‘এ’ দলের হয়ে) থেকে যে অফ ফর্মের শুরু, সেটা যখন ২০১৬ তেও কন্টিনিউ হয়, সমর্থকদের মধ্যে আবারো বিভক্তি শুরু হয়, এক দল সৌম্যকে বারডেন মনে করে তাকে অপসারণের দাবিতে সোচ্চার, আরেকদল সৌম্যের মাঝে অপার সম্ভাবনা আবিষ্কার করে তাকে আরও সুযোগ দেয়ার পক্ষে। ফলে ভারচুয়ালি একটি কী-বোর্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছে ক্রিকেট কমিউনিটিতে।
একজন খেলোয়ার সম্পর্কে ইমপ্রেশন তৈরির পূর্বে অন্তত ২ বছর তার পারফরম্যান্স দেখা উচিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একটু ভিন্ন। খেলা এতদিন পরপর হয় যে সিরিজ বাই সিরিজ মূল্যায়ন হয়। ২ বছরে সিরিজ যে কয়টা তার বেশিরভাগই হোমে, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ১-২ টা বিদেশ সফর পাওয়া যেতে পারে। সৌম্য টানা ৩টি সিরিজে ভালো করেছেন, দ্রুত তাকে টেস্টে সুযোগ দেয়া হলো, এরপর ২০১৬ তো প্রায় পুরোটাই টি২০ খেলে কাটলো। সৌম্যর জন্য আদর্শ ফরম্যাট ওয়ানডে, সেখানে সে ৩টা মাত্র বাজে ইনিংস খেলেছে, অথচ টি২০ এর পারফরম্যান্স দিয়ে তার ব্যাপারে কথা উঠছে। প্রত্যেকটা ফরম্যাট যে আলাদা, এটা বাংলাদেশের নির্বাচকরা যেমন বোঝে না, সমর্থকদেরও মাথায় থাকে না। ফলে টেস্টে ভালো করলে ওয়ানডেতে চান্স পায়, আবার টি২০ তে খারাপ করলে ওয়ানডে থেকে বাদ পড়ে। বড়ই অদ্ভুত নিয়ম!
আশরাফুল যেসব ম্যাচে ভালো খেলেছেন, দর্শকের তৃপ্তি মিটেছে, বেশ কিছু ইনিংস আছে মনে রাখার মতো, কিন্তু সৌম্য কয়েকটি ফিফটি আর একটি সেঞ্চুরি করলেও আলাদা করে নজর কাড়ার মতো কিছু করার আগেই সমর্থকদের প্রেসারে সম্ভবত খরচার খাতায় চলে যাবেন। এটা শুধু সৌম্য না, যে কোনো তরুণ ক্রিকেটারের জন্যই অশনি সংকেত। মুস্তাফিজ ১টা সিরিজ আর আইপিএল এ ভালো করার কারণেই তাকে নিয়ে মাতামাতির চূড়ান্ত হচ্ছে, কিন্তু এরই মধ্যে ২ বার ইনজুরিতে পড়ে নিজের ইফেকটিভনেস আর একুরেসিকে যে শংকার মুখে ফেলে দিচ্ছেন, সেটা নিয়েও ভাবা দরকার। তা না করে মুস্তাফিজ যদি নিউজিল্যান্ড সিরিজ আর পরের ২টা সিরিজে ভালো করতে না পারেন (মানে বেশ কিছু রান দিলেন, উইকেটও পেলেন না সেভাবে), তখনই মুস্তাফিজ গেল রব উঠে যাবে।
সৌম্যকে নিয়ে একটু এনালাইসিস করা যাক। তিনি এজ লেভেলের দলগুলোতে খেলেছেন, সেখানে মোটামুটি পারফরমও করেছেন। ২০১৫ এর বিশ্বকাপের কিছু আগে একটা সিরিজে সুযোগ পান, ২টা ম্যাচে খেলেছিলেন, কিছুই করতে পারেননি। সেখান থেকে তিনি যখন বিশ্বকাপগামী দলে অন্তর্ভুক্ত হন, ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। নির্বাচকেরা তার মাঝে হাতি-ঘোড়া আবিষ্কার করেছেন, হাথুরুসিংহের প্রিয় ব্যাটসম্যান প্রভৃতি কথা অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছিলো। তখন তার হার্ড হিটিং ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি অকেশনাল মিডিয়াম পেস বোলিংটাকেও বিবেচনায় আনা হয়েছিল। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তাকে একাদশে রাখা হয়েছিল ৭ নম্বরে বিগ হিটিং ক্যাপাবিলিটির বিষয়টি মাথায় রেখে, ৩ এ ব্যাট করার কথা ছিলো মুমিনুলের। ম্যাচে আচমকা সৌম্যকে ৩ এ প্রোমোট করা হয়, মুমিনুল ব্যাট করেন ৮ নম্বরে। এ নিয়ে বিস্তর কথা চালাচালি হয়েছিলো, বলা হচ্ছিল মুমিনুল ৮ এ খেলার ব্যাটসম্যান নন, সৌম্যকে নিচে খেলানো হোক। শ্রীলংকার সাথের ম্যাচে মুমিনুল ব্যর্থ হন, সৌম্যও ততটা সুবিধা করতে পারেননি, কিন্তু ইংল্যান্ডের সাথেকার ম্যাচে মাহমুদুল্লাহর সাথে তিনি একটা ভালো পার্টনারশিপ গড়েন, ৪০+ স্কোর করেন। রানের হিসাবে খুব বেশি না হলেও ইনিংসগুলোতে সাহসী কিছু শট খেলেন, যা তার ফ্যানবেইজ গড়ে তোলে। সৌম্য নাম করেন পাকিস্তান সিরিজে সেঞ্চুরি করার পর, তার আনঅর্থোডক্স একটা শট পেরিস্কোপ নাম পেয়ে যায়। ভারত সিরিজে ভালো খেলেন, এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে বোলারদের বেধড়ক স্ট্রোক খেলে শেষ ম্যাচে ৯০ করেন, তার পাশে তামীম ইকবালকে মনে হয় অনেক স্থির।
সৌম্যর ইনিংস বিল্ড আপ এবং স্কোরিং জোনের দিকে নজর দেয়া যাক। বিশ্বকাপের ইনিংসগুলোতে একটা বিষয় প্রায় নিয়মিত ছিলো, সেটা হলো প্রথম ২০ রান খুব স্মুথলি করতেন, এরপর নড়বড়ে হয়ে যেতেন, এবং হুট করে আউট হয়ে যেতেন। ফলে টেম্পারমেন্টের সমস্যাটা প্রথম থেকেই ছিলো। স্পিন বল খেলার ক্ষেত্রে তার দুর্বলতা প্রথম থেকেই লক্ষণীয়; স্পিন বলে সুইপ অথবা বিগ হিটিং এর বাইরে পুশ করে সিঙ্গেলস নেয়া বা গ্যাপ বের করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখা গেছে। তিনি খেলেন মূলত প্লেসমেন্ট আর বলের পেসকে কাজি লাগিয়ে। এক্সট্রা কভার আর মিড অফ এর মধ্যবর্তী জায়গাতে তিনি সবচাইতে স্বতঃস্ফূর্ত, অফ স্ট্যাম্পের রাইজিং বা সুইঙ্গিং ডেলিভারিগুলোকে তিনি মিড উইকেটের দিকে টানতেন, অথবা মিড অন বরাবর লফটেড শট খেলেন, যে কারণে তার ইনিংসগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিতে মিস শট থাকতো যেগুলো স্লিপের উপর দিয়ে চলে গেছে অথবা মিড অন ফিল্ডার মাথার সামান্য উপর দিয়ে গিয়ে চার হয়েছে। অর্থাৎ তার ইনিংসগুলোতে লাক ফেভার ফ্যাক্টর ছিলো, এটা আরও স্পষ্ট হবে, যখন একটু খেয়াল করলেই মনে পড়বে তার ৫০+ সবগুলো ইনিংসেই ডিরেক্ট লাইফ ছিলো, সলিড নয়। বড় ইনিংস খেলার জন্য ভাগ্যের পরশ লাগে, কিন্তু সৌম্যের ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত ভাগ্যই বিরাট ইনফ্লুয়েন্সিং ফ্যাক্টর হয়েছে। এখন বেশিরভাগ ইনিংসে আউট হচ্ছেন পয়েন্ট এ, যেগুলোতে আগে গ্যাপ বের করে ৪ অথবা ডাবল বের করতে পারতেন। যেহেতু ফুটওয়ার্ক ছাড়া স্রেফ রিফ্লেক্স এর উপর নির্ভর করে খেলেন, ইদানিং এলবিডব্লিড হওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। শর্টপিচ বল ভালো খেলেন তিনি, কনফিডেন্সহীনতার কারণে এখন সেসব শট খেলতে গিয়েও মিসটাইমিং হচ্ছে।
সাধারণত হ্যান্ড আই কোঅরডিনেশনের খেলোয়াড়রা বয়স বাড়ার সাথে সাথে রিফ্লেক্স কমে আসতে শুরু করে, তখন তাদের ইফেকটিভনেস কমে আসতে শুরু করে। এরা একবার ফর্ম হারিয়ে ফেললে আবার ফিরতে অনেক সময় লাগে। শেওয়াগের এই সমস্যা হয়েছিল, শেষের দিকে জয়াসুরিয়া, এমনকি ক্রিস গেইলও। অন্যদের সাথে গেইলের পার্থক্য হলো, তিনি তার লিমিটেশন বুঝে নিজের স্কোরিং জোনের জন্য ওৎ পেঁতে থাকেন, সেখানে বল পেলে ছক্কা মারেন, অথবা ক্রমাগত ডট দিতে থাকেন। সৌম্যর দুর্ভাগ্য, তিনি খুব তাড়াতাড়িই ব্যাড প্যাচ এ পড়ে গেছেন।
ব্যাড প্যাচ প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জীবনেই আসে। এই সময়টাই তাদের ক্যারিয়ারের সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং অধ্যায়। ঢালাওভাবে সমর্থকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, দুনিয়ার সিস্টেমই এমন। আপনি ভালো করলে সবাই মাথায় নিয়ে নাচবে, খারাপ করলে মুণ্ডপাত করবে। সমর্থকরাই শক্তি, আবার সমর্থকরাই বোঝা। কিন্তু একজন এথলেটের তো সমর্থকের মতো মাইন্ডসেট নিয়ে চললে হবে না। একজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার কতদিনেরই বা হবে; সর্বোচ্চ ১৫ বছর (সেটাও বিরল দৃষ্টান্ত এদেশের প্রেক্ষাপটে)। এই স্বল্প সময়ে চরাই-উতরাই পেরিয়েই টিকে থাকতে হবে, নইলে ফয়সাল হোসেন ডিকেন্স, হান্নান সরকারদের মতো হারিয়ে যেতে হবে। হিসাবটা তো খুব সহজ। একটা জায়গার জন্য ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে ৫-১০ জন, নিজে যদি ক্যালকুলেটিভ এবং ডিপ্লোম্যাটিক না হন, বিলুপ্তিই নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে।
সৌম্যর জন্য আদর্শ মেন্টর হতে পারেন তামীম ইকবাল আর মাহমুদুল্লাহ। তবে সবদিক থেকে বিচার করলে তামীমই পারফেক্ট। কারণ, তিনিও একসময় স্পিন বল এ ভয়ানক দুর্বল ছিলেন, স্ট্রাইক রোটেট করতে পারতেন না, লেগ সাইডে খেলতে পারতেন না, শর্ট পিচ বলে অস্বস্তিতে ভুগতেন এবং সবচেয়ে বড় কথা টানা প্রায় ২ বছর অফ ফর্মে ছিলেন, যে সময়টায় বাংলাদেশ টিমও স্ট্রাগল করেছে। তামীম ক্যালা পারে না, এটা হয়ে গিয়েছিল অনলাইনের জনপ্রিয় ট্রল। আবারো সামনে তামীমের ব্যাড প্যাচ আসবে, কিন্তু তার ক্যালিবার নিয়ে বাকি জীবনে আর কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না, বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই এখনো পর্যন্ত (ভবিষ্যতে আসবে অনেকেই)। তামীমের সাথে বেশ কিছু ম্যাচে ওপেনও করেছেন তিনি। তামীম অবশ্যই তার তুলনায় টেকনিকালি সাউন্ড, কিন্তু রান করার জন্য টেকনিক সবসময় জরুরী নয়, স্রেফ কনফিডেন্স দিয়েই সাকিব আল হাসান ওয়ানডে টেস্ট এ হাজার হাজার রান করেছেন। ক্রিকেট পুরোপুরি সাইকোলজিকাল গেম, শেষ পর্যন্ত কনফিডেন্সই আসল কথা। তাই সৌম্য যদি প্র্যাকটিসের পাশাপাশি তামীমের সাথে বেশি সময় দেন, সেটা হয়তোবা তার জন্য ইফেকটিভ হবে।
সৌম্যর বড় সম্পদ তার এটাকিং মাইন্ডসেট। বোলার দেখে ভড়কে না গিয়ে চার্জ করেন, ওয়ানডের জন্য এরকম একজন ব্যাটসম্যানের পেছনে ইনভেস্ট করা যেতেই পারে। মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক, তামীম, নিকট ভবিষ্যতে সাব্বির- ৪ জন ব্যাটসম্যান আছেন যারা স্বাভাবিক ছন্দে খেলতে পারেন, ওয়ানডেতে সাকিবও যথেষ্ট সেনসিবল ব্যাটসম্যান (টেস্ট আর টি২০ তে তার সাম্প্রতিক ব্যাটিং অনেকটাই গ্যাম্বলিং এর মতো লাগে, তবু এই গ্যাম্বলিংয়ের আমি পক্ষপাতী)। কাজেই এতোজন ব্যাটসম্যানের মধ্যে একজন সৌম্যকে নিয়ে বোধহয় এক্সপেরিমেন্ট করা যেতেই পারে।
সৌম্য যে স্টাইলের ব্যাটসম্যান তাকে ওয়ান ডাউন বা ৭ নম্বরে খেলানোর যৌক্তিকতা নেই, তার জন্য পারফেক্ট পজিশন ওপেনিং। সেখানে তিনি রান না পেলে কিছু ম্যাচ ড্রপড রাখা যেতে পারে, ম্যাচ প্র্যাকটিসের সুযোগ দিতে বিসিবি ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াড, এ দল প্রভৃতিতে খেলানো হোক, কিন্তু এরকম প্রমিজিং একজন ব্যাটসম্যানকে জাস্ট ম্যাচ খেলাতে হবে বলে কখনো ওয়ান ডাউন, কখনো ৭ নম্বরে ট্রাই করে তার কনফিডেন্স, ক্যালিবার নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এখানেই প্রাসঙ্গিক হন আশরাফুল। তিনিই বোধহয় বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি ওপেনিং থেকে শুরু করে ৭ নম্বর পর্যন্ত সব পজিশনে ব্যাটিং করেছেন। এই যে অদূরদর্শীতা, অপরিপক্বতা, এসব থেকে বেরিয়ে আসার সময় চলে এসেছে। Be sensible, Be sporting minded ; এক আশরাফুলকে হারিয়েছি,আরেকজন স্পেশাল ট্যালেন্টকে নষ্ট করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
প্রশ্ন হতে পারে, সৌম্যকে না খেলিয়ে শুধুমাত্র টিমে রেখে দেয়া এটা করার মতো বিলাসীতা একটা জাতীয় দল দেখাতে পারে কিনা। স্পোর্টিং গ্রাউন্ডে চিন্তা করলে অবশ্যই পারে। আমাদের রিজার্ভ বেঞ্চে এমন কোনো স্পেশাল ট্যালেন্ট বসে নেই যার জায়গাটা সৌম্য দখল করে আছে। শাহরিয়ার নাফিস পুরোনো খেলোয়াড়, তাকে নতুন করে দেখার কিছু নেই। ইমরুল কায়েস যদি ফর্ম হারিয়ে ফেলে তখন হয়তো তাকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। তার ফিল্ডিং, ফিটনেস এসব নিয়ে একটু ভাবুন, তাহলে বোধহয় শাহরিয়ার নাফিসকে ঘিরে হাপিত্যেশ কিছুটা কমবে। ইমরুল কায়েস তার খেলা অনেক পাল্টেছেন, কিন্তু কোয়ালিটি বোলিংয়ের এগেইনস্টে প্রতিটি রান করতে যেভাবে স্ট্রাগল করেন এবং ম্যাচের ক্রুশাল মোমেন্টে যেভাবে আউট হন, তাতে এই টাইপ ব্যাটসম্যানদের ব্যক্তিগত স্ট্যাটিসটিক্স ভারি করা ছাড়া অন্য কোনো পারপাস ফুলফিল করার সামর্থ্য কম। হিসাব খুব সিম্পল; হয় জিতো, অথবা হেরে যাও। জিততে হলে এগ্রেসিভ খেলতে হবে, সেটা করতে গিয়ে বিধ্বস্ত হলেও সমস্যা দেখি না। লড়াকু হারের মানসিকতা দিয়ে কখনো বড় টিম হওয়া সম্ভব নয়, আজীবন এভারেজ বা মিডল ক্লাসের মতো ধুঁকে ধুঁকে চলতে হবে। সাকিব আল হাসানের কথাটিই সবচাইতে পারফেক্ট; ১ রানে হারলেও হার, ১০০ রানে হারলেও তা-ই।
একসময় বাংলাদেশের জয়ের একটা রেসিপি ছিলো। আগে ব্যাটিং করে ২৩০+ করতে হবে, এরপর বোলিংয়ের সময় অপোনেন্ট টিমের ব্যাটিং কলাপস করবে। অথবা ফিল্ডিং করলে ২৫০ এর নিচে রাখতে হবে, ১০০ রানের মধ্যেই অপোনেন্ট এর ৪-৫টি উইকেট তুলে নিতে হবে, ব্যাটিংয়ে একটা ফ্লাইং স্টার্ট লাগবে। কিন্তু এই মুখস্থ ফরমুলাতে টানা ভালো রেজাল্ট সম্ভব নয়, অবশ্যই যে কোনো দলের বিপক্ষে ৩২০-৩০ রান চেজ করার মেন্টালিটি থাকতে হবে, যে কোনো পিচে ২৮০+ রান টার্গেট দেয়ার এবিলিটি থাকতে হবে। ৯০ এর দশকের ক্রিকেট ফরমুলা এখন অচল। এখনকার ছোট মাঠ, ব্যাটিং প্যারাডাইসে কোনো রানই নিরাপদ নয়, বোলারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। মুল পার্থক্যটা করে দেবে ব্যাটিংই। সেখানে যদি সৌম্য টাইপ একজন ব্যাটসম্যান থাকে ওপেনিংয়ে, যার কাছ থেকে কোনো রেগুলার এক্সপেক্টেশন নেই, ফ্রি ফ্লাইং খেলে যাবে, গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আপনার পয়সা উসুল হবে।
সমর্থকদের বুঝতে হবে সৌম্য আর ফরহাদ রেজা বা শুভাগত হোম একই ম্যাটেরিয়াল নয়, এমনকি ইমরুল কায়েস টাইপ ওপেনারও ভয় ধরিয়ে দিতে পারবে না, বা ম্যাচের মোমেন্টাম নিজেদের ফেভারে নিয়ে আসতে পারবে না। তাই সৌম্যকে যদি দলে জায়গা ধরে রাখা নিয়ে টেনশনে থাকতে হয়, ডিফেন্সিভ খেলতে হয়, সেটা একা সৌম্য নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ক্ষতি। এই বিপুল ক্ষতির দায় কে নেবে?
সৌম্যকে অবশ্যই নিজের ব্যাটিং নিয়ে কাজ করতে হবে। বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে, কিন্তু সেটা দলের বাইরে গিয়ে নয়। প্রয়োজনে টানা ড্রপড থাকুক। আরেকটা ব্যাপার বুঝতে হবে, বিস্ফোরক ব্যাটিং মানেই টি২০ নয়, সৌম্যর জন্য আদর্শ ফরম্যাট ওয়ানডে। টেস্ট বা টি২০ তার জন্য বারডেন। কিন্তু এই সূক্ষ্ম ব্যাপারটিই বুঝতে পারছি না আমরা। প্রয়োজনে টি২০ স্কোয়াড থেকে তাকে বাদ দেয়া হোক, কিন্তু ওয়ানডে ফরম্যাটে তার মতো একজন ব্যাটসম্যান বাংলাদেশের জন্য স্পেশাল গিফট। আমরা বড় দুর্ভাগা, এই গিফটের মর্ম নিজেদের অতি সংবেদনশীলতায় বলি হয়ে যাচ্ছে।
২০১৯ বিশ্বকাপ হবে ইংল্যান্ডে, সৌম্য যে স্টাইলে ব্যাট করে তাতে ওই কন্ডিশনে তিনি সফল হবেন আশা করা যায়। এই ব্যাডপ্যাচটা একদিক থেকে ভালো হয়েছে। তিনি হয়তোবা স্টারডমে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, ফ্যান-ফলোয়ারদের বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গের ফ্যানদের ব্যাপারে বেশি ফ্যাসিনেটেড হয়ে পড়েছিলেন, বিশ্বকাপের অনেক আগেই মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখে অন্তত এটুকু বুঝতে পারবেন, অস্ট্রেলিয়া অনেক দূর।
শুনতে হাস্যকর লাগলেও ২০১৯ বিশ্বকাপে আমি বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলার ব্যাপারে খুবই কনফিডেন্ট। সেটাকে বাস্তবায়িত করতে হলে সৌম্যর মতো একটা ট্রাম্পকার্ড ভাণ্ডারে থাকা উচিত। আশরাফুলকে ইউটিলাইজ করার ক্ষেত্রে যে ভুল হয়ে গেছে, সৌম্যর বেলায় সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি না হোক। তিনি নাহয় হয়ে থাকুন দলছুট একজন।