৫ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এক নিবন্ধ লেখার মতো সাব্বির রহমান কী করেছে? ক্রিকেটার হিসেবে বিবেচনা করলে এশিয়া কাপ টি২০ তে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮০ আর বিপিএল এ ১২১,ইংল্যান্ডের সাথেকার টেস্টে টেলএন্ডারদের সাথে নিয়ে ম্যাচ বাঁচানোর লড়াই; এইটুকু পরিসরে বিচরণ যার তাকে নিয়ে ৩ লাইনের স্ট্যাটাস লেখা যেতে পারে, তাই বলে নিবন্ধ? অনুর্ধ্ব ১৭ তে খেলার সময় থেকে সাব্বিরকে লক্ষ্য করছি, ক্রিকেট কখনোই শুধুমাত্র ব্যাট-বলের খেলা নয়, খেলাটা অনেকটাই দাবার মতো কঠিন সাইকোলজিকাল। সেই কনটেক্সট থেকে সাব্বিরকে নিয়ে লেখাটা আবশ্যক বোধ করছি।
• টেকনিকালি সাব্বির যথেষ্ট সলিড। ডিফেন্স দেখলেই সেটা বোঝা যায়, আউটসুইং বলেও সাবলীল। স্পিনের তুলনায় পেস বলে সে বেশি স্বচ্ছন্দ। দুর্বলতা বলতে, থার্ড স্ট্যাম্পে রাইজিং ডেলিভারি, আর ইনকামিং বল- এ দুটো ক্ষেত্রে তাকে কিছুটা নড়বড়ে লাগে।
• স্পিন বিশেষত বাঁহাতি স্পিন খেলার ক্ষেত্রে সাব্বিরের কিছুটা আড়ষ্টতা আছে। সে পুশ করে সিঙ্গেল বের করতে পারে না, বরং প্রায় প্রতি ডেলিভারিতে সুইপ অথবা রিভার্স সুইপ খেলতে যায়, এলবিডব্লিউ হওয়ার প্রবণতাও তাই বেশি। স্পিনারদের জোরের ওপর করা বলগুলোতে জায়গা করে নিয়ে খেলতে গিয়ে অফস্ট্যাম্প খোয়ানোর দৃষ্টান্ত প্রচুর। কিছুদিন আগ পর্যন্তও এগেইনস্ট দ্য স্পিন মিড উইকেটের উপর দিয়ে ক্রস ব্যাটে ছক্কা মারার প্রবণতা লক্ষ্য করা যেতো, এবং বাউন্ডারি লাইনে ধরা পড়তো। সে যত ছক্কা মেরেছে বেশিরভাগই লং অনের ওপর দিয়ে।
• সাব্বির অনসাইড প্রবণ ব্যাটসম্যান। শর্ট পিচ বলে সে পুল করবেই, ফ্লিক শটটাও দারুণ খেলে। অফ সাইডে তার শটগুলো কেতাবি ঢঙের চাইতে পাওয়ার হিটিং ধরনের হয়ে থাকে সাধারণত। অফস্ট্যাম্পে রুম পাওয়া ডেলিভারিগুলোতে ড্রাইভ করার চেয়ে ওভার দ্য টপ বেশি খেলে থাকে; প্রোপার কভার ড্রাইভ খুব বেশি তাকে খেলতে দেখা যায় না।
• সাব্বিরের ব্যাটিংয়ের দুটো গিয়ার। হয় হিটিং, অথবা ডিফেন্স, স্কোরিং শট যথেষ্ট কম, যে কারণে এটাকিং ফিল্ড সেট করলে প্রায় সময়ই সে উইকেট দিয়ে আসে। সে খুবই ইনডিসিশনে ভোগে, যে কারণে তার পার্টনারের রান আউট হওয়ার একটা ঝুঁকি থাকে প্রায় সময়ই। সে পুশ করে যেসব সিঙ্গেল বের করে সেগুলোতেও প্রচণ্ড পাওয়ার থাকে, সফট হ্যান্ডে খেলা তার মধ্যে প্রায় নেই-ই বলা যায়।
• সাব্বিরের ব্যাটিং খুবই প্রেডিক্টেবল। সে যদি কোনোভাবে ১৫ করতে পারে, তাহলে ৪০ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে চলে যাবে, তারপর শেকি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আউট হয়ে যায়। ভাগ্যেরও একটা ব্যাপার আছে। প্রায় প্রত্যেক ব্যাটসম্যানই বড় ইনিংস খেলার পথে ছোটখাটো লাইফ পায়; সাব্বির এই ফেভারটা খুব কম সময়ই পায়। তার ফেভার বলতে, শর্ট পিচ বলে পুল করেছে, ইনসাইড এজ হয়ে পেছন দিয়ে চার হয়ে গেছে। কিন্তু নো ম্যানস ল্যান্ডে ক্যাচ পড়া, ক্যাচ ড্রপ হওয়া- এগুলো তার ক্ষেত্রে খুব সময়ই ঘটে থাকে।
• সাব্বির বাংলাদেশের সবচাইতে ফিট খেলোয়াড়। শুরুর দিকে পয়েন্ট এবং মিড পর্যায়ে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করে থাকে সে, এবং চমৎকারভাবে সার্ভিস দেয়।
শুরুর এতোগুলো পয়েন্ট পড়ে মনে হতে পারে, সাব্বিরের দু্র্বলতাগুলোই তো বেশি করে বলা হয়েছে, একে নিয়ে আর কথা বলার কী আছে। কিংবা, তরুণদের মধ্যে সৌম্য, তাসকিন, মুস্তাফিজ বা মোসাদ্দেককে ঘিরে যতো আগ্রহ আছে, সাব্বির তো বরং নেগেটিভ কারণেই খবরে আসে বারবার। সাব্বির মানে নায়লা নাঈমের সাথে বিজ্ঞাপন, হোটেলে নারী কেলেঙ্কারীতে জরিমানা, সেলিব্রিটি ক্রিকেট লীগ খেলে সমালোচিত; এসবই। কিছু পজিটিভ মানুষ বলেন, ‘ছেলেটার হিটিং এবিলিটি দারুণ, সে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আগামীতে বহন করবে’, কিন্তু পরের লাইনটাই দাঁড়ায় ‘একটাই সমস্যা, ইনিংস বড় করতে পারে না, সৌম্যের মতো ৩০-৩৫ করেই আউট হয়ে যায়’।
‘সৌম্যের মতো’ কথাটা নিয়েই কথা পাকাতে চাই খানিকটা। সৌম্য অবশ্যই দৃষ্টিনন্দন ব্যাটসম্যান, সাব্বির-সৌম্য দুজনই স্ট্রোক প্লেয়ার, কিন্তু মিলটুকু এখানেই শেষ। সৌম্য রিফ্লেক্স এবং হ্যান্ড আই কোঅরডিনেশনের ব্যাটসম্যান, ফুটওয়ার্কে অনেক ঘাটতি; এই ধরনের ব্যাটসম্যান বয়স বাড়ার সাথে সাথে রিফ্লেক্স হারাতে শুরু করে। সৌম্য তাই স্ফূলিঙ্গ, কিন্তু সাব্বির হলো সলিড কয়লা। সে একজন কমপ্যাক্ট ব্যাটসম্যান। যত দিন যাবে সাব্বির এগোবে, সৌম্য পিছিয়ে পড়বে, এবং ক্যারিয়ার শেষে সাব্বির হয়তোবা বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানের স্বীকৃতি পেয়ে যাবে।
সাব্বিরকে যদি মেলাতেই হয় রিকি পন্টিংই বোধহয় সেরা অপশন হবে। ইনিংসের শুরুতে পন্টার বরাবরই নড়বড়ে থাকতো, লেগবিফোর হতো অহরহ, কিন্তু কোনোভাবে ২০-২৫টি বল খেলে ফেলতে পারলে পন্টিংয়ের চাইতে ভয়ানক ব্যাটসম্যান কমই পাওয়া যেতো।
রিভার্স সুইপ খেলার অভ্যাস, টি২০ নিয়ে অবসেশন, কাজ চালানোর মতো ফিল্ডিং- এসব কিছুর প্রেক্ষিতে ম্যাক্সওয়েলের সাথেই হয়তোবা সাব্বিরকে মেলাবেন অনেকে। এবং সাব্বির নিজেও হয়তোবা ম্যাক্সওয়েলকে নিয়েই স্বচ্ছন্দ বোধ করবে, কিন্তু তার সামর্থ্য এবং সবরকম সম্ভাবনা আছে পন্টিং হওয়ার। তার খেলার যা ধরন তাতে ৩ নম্বর ছাড়া অন্য কোনো পজিশনে তাকে মানায় না; টিম ম্যানেজমেন্ট খুব দ্রুতই এটা বুঝতে বলে তারা ধন্যবাদ পেতেই পারে।
সাব্বিরের ইনিংসগুলো বড় হয় না কেন? এটা অনেকটা টেন্ডুলকারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি পাওয়ার আগেকার নাটকের মতো। প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেতে টেন্ডুলকারকে বোধহয় ৭৮ বা ৭৯তম ওয়ানডে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। সাব্বিরের ডিসমিসালগুলো যদি পর্যবেক্ষণ করা হয়, দেখা যাবে সে খুব কম ক্ষেত্রেই উইকেট থ্রো করে এসেছে। সুইপ করে আাগে ৪ পেয়েছে, কিন্তু ৪০ এ এসে হয়তোবা লেগবিফোর হয়ে গেলো, কিংবা কাট করতে গিয়ে কট বিহাইন্ড হয়ে গেলো। আউট হওয়ার ধরন দেখে মনে হতে পারে ক্যাজুয়াল, কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন, সেইম শটেই আগের রানগুলো এসেছে। সম্ভবত ৩৫ পার করার পর তার মধ্যে একধরনের মেন্টাল ব্লক ভর করে, ইনডিসিশনের পরিমাণ বেড়ে যায়। আশরাফুল ব্যাটিংয়ের সময় প্রত্যেকটা রান গুনে রাখতো, এটা বাড়তি প্রেসার বাড়িয়ে দেয়। সম্ভবত সাব্বিরও অনুরূপ কাজটা করে। আরেকটা কারণ হতে পারে, সে জীবনে হয়তোবা খুব কম ক্ষেত্রেই ৪০০ বা ৫০০ বল ব্যাটিং করেছে। তার ফার্স্ট ক্লাসে সেঞ্চুরি সম্ভবত ৪ বা ৫টি, এবং বয়সভিত্তিক দল থেকেই সে হার্ডহিটার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। যে কারণে, ইনিংস বিল্ড আপের দায়িত্বটি কখনোই তাকে সেভাবে পালন করতে হয়নি, সে শুধু হিট করতে চেয়েছে। ক্রমাগত হিট করে নিয়মিত বড় রান করাটা আসলেই অবাস্তব কল্পনা। অন্য দেশে ক্রিকেটাররা বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচ খেলে ধাতস্থ হয়ে টেস্টে এসে সেটার সুবিধা নেয়, আর আমাদের দেশের ব্যাটসম্যানরা টেস্ট খেলতে খেলতে বড় দৈর্ঘ্যের সাথে পরিচিত হয়। তামীম ইকবাল যখন প্রথম এসেছিলো, ডাউন দ্য উইকেটে তুলে মারা ছাড়া বিশেষ কোনো শট জানা ছিলো না; সময়ের পরিক্রমায় সেই তামীম এখন কতরকম শট শিখেছে। সাব্বির যেহেতু অনেকদিনই হলো, মিড উইকেট দিয়ে এক্রোস দ্য লাইন ছক্কা মারার চেষ্টা করছে না, ধরে নেয়া যায় সে ভুল থেকে শিখছে।
কোচরা একটা কাজ করতে পারে। প্র্যাকটিস ম্যাচগুলোতে ৪০ করতে পারলে ২টা লাইফ দেয়া হবে, এই শর্তে সাব্বিরকে ব্যাটিং করিয়ে দেখতে পারে। মানে, ৪০ করার পর ২ বার পর্যন্ত আউট হওয়া থেকে নিষ্কৃতি পাবে। এতে করে সে বড় স্কোর গড়ার একটা অভ্যাস গড়তে পারে। ক্রিকেটের মতো কঠিন সাইকোলজিকাল গেম এ কেন শুধুমাত্র ব্যাট আর বলের মধ্যেই যাবতীয় স্পৃহা নিবদ্ধ থাকে ভেবে অবাক হই। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জায়গা যেখানে রাতারাতি ক্রিকেট ফ্যানের সংখ্যা ১০ লাখ থেকে ৩ কোটিতে চলে গেছে, সেখানকার একজন উঠতি ক্রিকেটারকে মেন্টালি স্ট্যাবল রাখার জন্য হলেও তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ স্কিম রাখা উচিত। এটা নিছক ১১ জনের একটি টিম গেম নেই আর, কোটি কোটি আবেগী মানুষ যুক্তিহীনতার পরশ মাখিয়ে টিভির সামনে, স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়; সামান্য একটা মিসফিল্ডিং বা দুর্দান্ত ক্যাচ মুহূর্তের মধ্যে ভিলেন আর নায়ক বানিয়ে দেয়। এরকম স্নায়বিক পরিবেশে মেন্টাল ট্রেনিংয়ের অপরিহার্যতা নিয়ে ভাবা যেতে পারে বোধহয়।
আগামী ৫ বছরে ওয়ানডেতে বাংলাদেশ বিশ্বক্রিকেটের ৩য় পরাশক্তিতে পরিণত হবার যথেষ্ট বাস্তব সম্ভাবনা আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুইয়ে বাতিল। কোটাপ্রথার কারণে সাউথ আফ্রিকাও বিপাকে পড়ে যাবে। পাকিস্তান আর কখনোই সঞ্চালকের ভূমিকায় আসতে পারবে না। শ্রীলঙ্কার পুনর্গঠিত হতে আরও সময় লাগবে। নিউজিল্যান্ড ঠিক কখনোই ক্রিকেট নিয়ে সিরিয়াস থাকে না, অনেকটা সাইলেন্ট কিলারের মতো। ইংল্যান্ড গড়পড়তা এক টিম হয়ে থাকবে, অস্ট্রেলিয়ারও ক্রান্তিকাল চলে আসছে, একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়।তবু তারা পরাশক্তি হয়েই থাকবে, ভারতের পরাক্রম আরও বাড়বে। সুতরাং বাংলাদেশের ঢুকে পড়াটা অনিবার্য। তার সঙ্গে যোগ করুন, ভারতের সাথে রাজনৈতিক ইস্যু এবং দুদেশের সমর্থকদের মধ্যকার সাইবার যুদ্ধ; ফলে বাংলাদেশ ওয়ানডেতে খুবই সম্ভাবনাময় একটি পজিশনে অবস্থান করছে।
সাব্বির নিয়ে লেখা নিবন্ধতে বিশ্বক্রিকেটের পরিক্রমা উল্লেখের কারণ, আগামী ৩ বছরের মধ্যে সাব্বির একজন আন্তর্জাতিক তারকা হয়ে উঠতে পারেন, এবং আইপিএল এ খেলার সম্ভাবনা যথেষ্ট ভাস্বর। বড় কোনো টুর্নামেন্টে ম্যাজিকাল একটা ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে জিতিয়ে দিলেই সেই প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে যাবে। ভাগ্য বারবার তাকে আটকে রাখছে, এটা বড় কিছুর লক্ষণ। আসন্ন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেই ইংল্যান্ড বা বড় কোনো দলের বিপক্ষে সাব্বির যদি সেঞ্চুরি করে ফেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। জগতের সবকিছুর মতো ভাগ্যেরও একটা প্যাটার্ন আছে সম্ভবত। যত যা-ই বলা হোক, ক্রিকেট খেলার সাথে ভাগ্য ব্যাপারটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করে যেভাবে খেলে, হুবুহু একই কায়দায় ব্যাটিং করেও টানা ৩ ম্যাচে শুন্য রানে আউট হতে পারে। স্রেফ ২ টা ইনিংসে সাব্বিরের একটু ভাগ্যের সহায়তা লাগবে, সে একজন পরিপূর্ণভাবে বদলে যাওয়া ক্রিকেটার হয়ে উঠবে।
পূর্বসূরীদের মতো ইনকনসিসটেন্সি সাব্বিরের এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য। কোনো সিরিজে একটি ৫০+ ইনিংস খেলার পর পরের ৩-৪টি ইনিংসে ৩০ এর নিচে স্কোর করাটা প্রায় নিয়ম। টেস্ট অভিষেকের পর কয়েকটা ইনিংসে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে, তারপরই যথারীতি পুরনো অধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন। এই কারণটাও মানসিক; সম্ভবত সে এখনো নিজেকে দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন হিসেবে ভাবতে পারছে না, এক ম্যাচে রান করলেই পরের সিরিজে নিশ্চিত, এই মাইন্ডসেট চেপে বসায় রিল্যাক্সেশন চলে আসে। একই পজিশনের জন্য আরও ১০ জন নিঃশ্বাস ফেলছে, এরকম একটা কম্পিটিটিভ এনভায়রনমেন্ট তৈরি করতে পারলে হয়তোবা এরকম মাইন্ডসেট বদল হতে পারে। এখনকার ক্রিকেটাররা জানে, তার বিকল্প আছে বড়জোড় ১-২ জন, তারা ব্যর্থ হলেই আবার ফেরত আসতে পারবে; সুতরাং ভয়ের কী আছে! একবার দল থেকে বাদ পড়লে সহসা ফেরা হবে না, এমন একটা আবহ থাকলে তাদের মধ্যে মরিয়ানেসটা জোরালো হতো।
এটা দুর্ভাগ্যজনক, সাব্বিরের মধ্যেও এই তুষ্টির দুষ্টভুত ভর করে আছে। যার সম্ভাবনা আছে ক্রিকেট বিশ্বেরই একজন বড় তারকা হওয়ার, সে বাংলাদেশের স্বল্পপরিসরে প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটারের তকমা নিয়েই ক্যারিয়ার শেষ করলো- এটা ক্রিকেটের জন্যই অবর্ণনীয় লস হবে ।
প্রশ্ন হলো, সাব্বির কি এতো দীর্ঘ রেসের ঘোড়া? সে তো টি২০ নিয়েই মহাখুশি। তার সবুজ চোখের গ্ল্যামার ব্যবহার করতে চায় ব্যবসার জগত, মাঠের বাইরের উশৃঙ্খলতা বারবার শিরোনাম হচ্ছে। স্টারডমের বারডেন সে কি সহ্য করতে পারবে? অতীতের পতিত তারকাদের মতো সেও কি অবিকশিত একজন হিসেবেই হারিয়ে যাবে? এই জায়গাটিতে সামাজিক অনুশাসন বনাম স্টারডমের আসপেক্টটি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। ডিয়েগো ম্যারাডোনা নিত্যনতুন উদ্ভট কাজ-কর্ম করে সমালোচিত হন, ভিভ রিচার্ডস, ইয়ান বোথামদের উশৃঙ্খলতা এখনো স্পোর্টস ওয়ার্ল্ডে ছড়িয়ে আছে, এমনকি হালের ভিরাট কোহলিও উশৃঙ্খলতার চরম পরাকাষ্ঠা। কিন্তু মাঠের সীমানায় তারা খেলার মুনিঋষি। যে পন্টিংয়ের সাথে তার মিল আবিষ্কার করা হচ্ছে সেও একসময় জুয়া আর নাইটক্লাবের নিয়মিত গ্রাহক ছিলো। সোশ্যাল বিহেভিয়ার আর নর্মস এর পার্থক্যের কারণে বাংলাদেশের সাথে অন্য দেশের উশৃঙ্খলতাটা ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হয়। যেমন, অস্ট্রেলিয়ায় শ্যাম্পেইন ছিটিয়ে বিজয় উদযাপন করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা, বাংলাদেশ জেতার পর কোনো ম্যাচে এই কাণ্ড করলে পুরো দলকে সাসপেন্ড করা হবে। সামাজিক অনুশাসন এবং নীতিবোধের ধারণা আমাদের এখানে অন্যরকম। যেকারণে, অন্যদেশে যে আচরণকে স্বাভাবিক উদ্দামতা হিসেবে দেখা হয়, আমাদের এখানে সেটা উশৃঙ্খলতা বা স্খলনের প্রতীক। ফলে, আমাদের দেশে উশৃঙ্খল খেলোয়াড়রা ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে পারে না; মাঠ বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে এতোটাই ফ্যাসিনেটেড হয়ে পড়ে যে খেলায় তার প্রভাব পড়ে। খুব হাস্যকর লাগলেও, ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে সাব্বির বিয়ে সেরে নেয়ার পরিকল্পনাটা করে নিতে পারে। মাশরাফি, সাকিব, তামীম কারোরই উশৃঙ্খলতার রেকর্ড না থাকার পেছনে তরুণ বয়সেই বিয়ে করার একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকতে পারে। বিয়ে করার জন্য প্রধান শর্ত যে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা, সেটা যদি ২০ বছর বয়সেই এসে পড়ে, বিয়ে হলোই বা। উশৃঙ্খলতার উত্তাপ যেহেতু নিতে পারা যাচ্ছে না, বিকল্প ভাবনা ভাবা যেতেই পারে।
সাব্বির টিকবে, নাকি হারিয়ে যাবে, ২০১৭ সালেই তার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। তবে টিকুক বা হারিয়ে যাক, ক্রিকেটের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পজিশন যে নাম্বার থ্রি, যেখানে এযাবতকালে বাংলাদেশ কোনো স্থায়ী ব্যাটসম্যান পায়নি, সাব্বিরের মধ্যে সবরকম সম্ভাবনা ছিলো সেই অপ্রাপ্তির অনুযোগ ঘুঁচিয়ে দেয়ার। আমি খুব করে প্রত্যাশা করি, আগামী ১০ বছরের জন্য এই জায়গাটির প্রতিশব্দ হোক, সাব্বির রহমান।