২০০০ সাল পর্যন্ত ওয়ানডেগুলোতে বাংলাদেশ প্রায় শুরুতেই হেরে বসতো, কারণ প্রতিপক্ষ দলের ওপেনাররা এমন তাণ্ডব শুরু করতো, মনে হতো ৩০০ রান হয়ে যাবে নিশ্চিন্তে।আর যদি আগে ব্যাটিং করতো, ফিল্ডিংয়ে নেমে ম্যাচে টিকে থাকার আশা প্রথম দশ ওভারেই হারিয়ে ফেলতো। কিংবা স্পিনাররা বেশ কিছু চান্স ক্রিয়েট করতো, কিন্তু ১জন বা ২ জন ব্যাটসম্যান ঠিকই ম্যাচ বের করে নিয়ে যেত। অথচ, একটা স্পেলে আচমকা ২-৩টা উইকেট নিয়ে হেরে যাওয়া ম্যাচ জিতিয়ে দেয়ার ঘটনা বিশ্ব ক্রিকেটে ভুরিভুরি, এবং এই কাজটা বেশিরভাগ সময় পেসাররাই করে থাকে। ২০০১ এ মাশরাফি আসার পর আমরা একজন সত্যিকারের স্ট্রাইক বোলার পাই, যে ইনিংসের শুরুতে ব্রেকথ্রু এনে দিতে পারতো। কিন্তু ইনজুরি তার পুরো সামর্থ্য বিকশিত হতে দিলো না। ২০০৭ বিশ্বকাপের পর স্ট্রাইক বোলার মাশরাফিকে হারিয়ে ফেলি, তার ভূমিকা বদলে যায়, সে হয়ে উঠতে থাকে একজন ইফেকটিভ বোলার; উইকেট পায় নিয়মিতই, কিন্তু সেটা স্ট্রাইক বোলার সুলভ বৈশিষ্ট্যে নয়, ইফেকটিভ বোলার থিওরিতে।
রুবেল হোসেন কি স্ট্রাইক বোলার? সে এসেছিলো পেসার হান্ট প্রতিযোগিতা থেকে, সে সময় মালিঙ্গার স্লিঙ্গার একশন বেশ মুখরোচক বিষয় হওয়ায় ব্যতিক্রমী একশনের কারণে শুরুতেই তাকে পরিচিতি পেতে হয় বাংলাদেশের মালিঙ্গা হিসেবে। মাশরাফির মতো অভিষেকের আগেই এন্ডি রবার্টসের কাছ থেকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পাওয়া, বা ‘এ’ দলের হয়ে ভারত ট্যুরে গিয়ে ১৪৫ কি:মি:/ঘণ্টা বেগে বল করে আলোচনায় আসা, কিংবা প্রচণ্ড দুরন্তপনার জন্য ‘পাগলা’ খেতাব পাওয়ার সৌভাগ্য জুটেনি; তাসকিনের মতো দলে ঢোকার আগেই লাখো মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারেনি, কারণ বিপিএল ছিলো না তখন, কিংবা মোস্তাফিজের মতো এসেই কাটার দিয়ে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করে খ্যাতি পাওয়া হয়নি, তবু বিপক্ষ দলের জিততে ১২ বলে ১৩ রান লাগবে, ক্রিজে একজন সেট ব্যাটসম্যান, হাতে আছে ৩ উইকেট- এরকম সমীকরণে বাংলাদেশের কোনো একজন বোলারকে যদি বেছে নিতে হয় বল করতে যে ম্যাচটা জিতিয়ে দিতে পারে, কিংবা ওই ওভারেই হারিয়ে দিতে পারে, একদম নির্দ্বিধায় রুবেল হোসেনকে স্মরণ করতে হবে। এখানেই স্ট্রাইক বোলারের সার্থকতা।
রুবেলের নাম উঠলেই সর্বপ্রথম মনে পড়বে মুরালিধরনের সেই পাগুলে ব্যাটিংয়ের কথা যেখানে একদম জেতা ম্যাচ বাংলাদেশ হেরে গিয়েছিলো মুরালিধরন রুবেল হোসেনকে বেধড়ক পেটানোয়। রুবেলের ক্যারিয়ার ইকোনমিও অন্যদের তুলনায় বেশি, কিন্তু সেটা বোঝাতে পারবে না রুবেলের ইমপ্যাক্ট। ২০১০ এ বাংলাদেশ যেবার নিউজিল্যান্ডকে প্রথম হোয়াইটওয়াশ করলো সেই সিরিজে রুবেলের বোলিং মনে আছে? পরেরবার যখন আবারো নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো প্রথম ম্যাচটা মনে করুন। নিউজিল্যান্ড জেতার পথেই ছিলো, আচমকা এক ঝড়ো স্পেলে শেষ করে দিলো। গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচটা মনে করুন। শেষের ওই দুই ইয়র্কার নয়, মাঝপথে মরগানকে আউট করার স্পেলটা মনে করুন; ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট ছিলো আসলে ওটা। ভারতের সাথে কোয়ার্টার ফাইনালে বিরাট কোহলিকে স্বল্পরানে ফেরত পাঠিয়ে চাপটা সে-ই ক্রিয়েট করেছিলো, রোহিত শর্মাকে আউট করা ডেলিভারিটা নো বল হয়ে গেলো, সেটা ভিন্ন ব্যাপার, কিন্তু ম্যাচের সিচুয়েশন ক্রিয়েট করার ক্যাপা্বিলিটি ধরলে রুবেল হোসেনের মতো পেসার বাংলাদেশে বিরল। মোস্তাফিজ একটা স্পেশাল ট্যালেন্ট, তবে কাটারের কার্যকারিতা কমে গেলে সে কীভাবে নিজেকে শাণিত করবে সেটা একটা চ্যালেঞ্জ। আর ২০০৭ পূর্ব মাশরাফি ম্যাজিকের বেশিরভাগই প্রথম স্পেলের ৫ বা ৬ ওভারে, বল পুরনো হয়ে গেলে ম্যাজিক দেখানোটা তার জন্য কঠিন হতো।
কিন্তু রুবেলই বোধহয় একমাত্র বাংলাদেশী পেসার যে পুরনো বলে টুকটাক রিভার্স সুইংও করাতে জানে। ২০১৫তে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে সিরিজের ২য় ওয়ানডের একটা ঘটনার ইমপ্যাক্ট খুব গভীর মনে হয়েছে আমার। মোটামুটি ভালোই খেলছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা, খেলার ধারার বিপরীতে রুবেলের একটা দুর্দান্ত গতির ডেলিভারিতে হাশিম আমলার অফস্ট্যাম্প ডিগবাজি খেতে খেতে উইকেটকিপারের কাছে চলে গেলো। সাউথ আফ্রিকার ব্যাটিং কলাপস করেছিলো এরপর, এবং বাকি যতগুলো উইকেট পড়েছিলো সবকটিই টিপিক্যাল কলাপস ধরনের ডিসমিসাল। আমি বলবো না, রুবেলের ওভাবে বোল্ড করার সাইকোলজিকাল প্রেসারেই ব্যাটিং কলাপস করেছে, এটা নিশ্চয়ই পাড়ার ক্রিকেট নয়, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে একটা প্রফেশনাল দল জাস্ট একটা উইকেটের কারণে এভাবে কলাপস করে না, কিন্তু ওই আউটটার একটা অদৃশ্য ইমপ্যাক্ট অবশ্যই ছিলো। তার আগের ২ টি-টোয়েন্টিতে কীভাবে হেরেছি, প্রথম ওয়ানডেতে রাবাদার হ্যাটট্রিকে কীভাবে আমাদের ব্যাটিং কলাপস করেছিলো, এবং দলের পারফরম্যান্স নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে সমর্থকদের হতাশার চিহ্নগুলো এখনো হয়তোবা রয়ে গেছে। এবং তার আগের ম্যাচগুলোতে রুবেলকে বসিয়ে রাখা হয়েছিলো; সেই সিচুয়েশনে কামব্যাক ম্যাচে এসেই হাশিম আমলাকে ওভাবে বোল্ড করা, পুরো দলের মনোবলই বদলে দেয়। ক্রিকেট খেলাটা তো সাইকোলজিকাল ওয়্যারের মতো, হতে পারতো রুবেলের শর্টপিচ বলে আমলা হুক করে লং লেগের ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে দিয়েছে, কিন্তু ওভাবে বোল্ড করার প্রেক্ষিতে মেসেজ দেয়া হয়, উই আর আপ ইন দ্য ব্যাটল। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ডের ম্যাচটা মনে আছে? শোয়েব আখতারের গোলার সামনে পড়ে এস্টল একদম অসহায়ের মতো বোল্ড হয়ে গিয়েছিলো, নিউজিল্যান্ডের পরের ব্যাটসম্যানরা আর দাঁড়াতেই পারেনি। উল্টো উদাহরণ আছে একই বিশ্বকাপে সাউথ আফ্রিকার সাথে ম্যাচটাতে। দক্ষিণ আফ্রিকা হেরে যাচ্ছে, ক্লুজনার শোয়েবের দুরন্ত গতির বলটাকে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিলো, এরপর আর কোনো বোলারই ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারলো না। ক্রিকেট খেলার মূল সৌন্দর্য যদি ব্যাটসম্যানের অপূর্ব ড্রাইভ হয়, তবে মূল কনফ্লিক্টটা অবশ্যই পেস বোলারের আগ্রাসনের সাথে ব্যাটসম্যানের টিকে থাকার। যে কোনো এন্টারটেইনমেন্ট সেক্টরের সেলিং পয়েন্ট হলো কনফ্লিক্ট, এটার কারণেই দর্শক আসে। পেসার-ব্যাটসম্যানের কনফ্লিক্ট থেকেই দর্শকের দেখার তৃপ্তি আসে।
রুবেলের বোলিংয়ের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সে বল করে গায়ের জোরে, বুদ্ধির প্রয়োগ খুবই সামান্য। এই জায়গাটাতে এসেই সে বাংলাদেশের অন্য পেসারদের চাইতে পিছিয়ে পড়ে। সে নিজেও জানে না এখন যে ডেলিভারিটা দিচ্ছে, পরের ওভারে কাছাকাছি ধরনের ডেলিভারি দিতে পারবে কিনা। ফলে তার সাফল্য বা উইকেট টেকিং ডেলিভারিগুলো অনেকটাই দৈবক্রমে পাওয়ার মতো লাগে। কিছুদিন আগে মাশরাফি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলো, আমাদের দেশের পেসাররা সুইং করাতে পারে না, সুইং হয়ে যায়। এই কথাটা রুবেলের ক্ষেত্রে আরও বেশিমাত্রায় সত্যি। যেহেতু ন্যাচারাল এবিলিটি নয়, বোলিংয়ে নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে, যে কারণে তার পারফরম্যান্সও চরম বৈপরীত্যে ভরা; এক ম্যাচে দুর্দান্ত তো টানা অনেকগুলো ম্যাচে মারাত্মক খরুচে বোলিং। এই ইনকনসিসটেন্সির কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটে রুবেলের যে জায়গায় থাকা উচিত ছিলো, তার ধারেকাছেও সে নেই। ক্যারিয়ারের বয়স ৮ বছর হয়ে গেছে, অথচ এখনো আসা-যাওয়ার উপরেই আছে। এটা একজন ক্রিকেটারের প্রোডাক্টিভিটি যে কতখানি নষ্ট করে দেয়, রুবেল যদি সেটা বুঝতো। অনেকে বিসিবির দোষ দেয়, কোচের সমালোচনা করে, কিন্তু আমি মনে করি রুবেলের এই আনস্টেবল পরিণিতির জন্য সে নিজেই দায়ী।
রুবেলের এখন যা বয়স, এসময়েই একজন পেসার নিজের সেরা ফর্মে থাকে, কিন্তু রুবেলের এখনো নিজেকে প্রমাণ করার মিশনে থাকতে হয়। সে যে কোনোদিন যে কোনো মুহূর্তে ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারবে, এরকম গ্যাম্বলিং করার মতো পর্যায়ে বাংলাদেশ এখন আর নেই। সবকিছুর মতো মাঠের খেলাটাও এখন মেথডোলজিকাল হয়ে গেছে। যে বোলার নিয়মিত ৪০ এর নিচে রান দিবে, ১-২টা উইকেট পাবে, এরকম কয়েকজন দলে থাকলেই তো ম্যাচ জেতার পরিস্থিতি তৈরি করা যায়। একজন কবে ম্যাজিক স্পেল করবে, সেই ভরসায় বাকি ম্যাচগুলোতে এলোমেলো বোলিং করা সত্ত্বেও তাকে টেনে নেয়ার মানে হয় না। এই প্রসেস আমাদের মিরাকলের উপর আস্থা রাখতে শেখায়, প্রসেস ডেভেলপমেন্টকে নিরুৎসাহিত করে। বাংলাদেশের মতো দলে ইনডিভিজুয়াল পারফরমারের চাইতে টিম পারফরম্যান্সটাই বেশি জরুরী, তাতে কনসিসটেন্সি বজায় থাকে। ২০১৪ সালে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের এতো খারাপ করার মূল কারণ কী আসলে? অনেকেই অনেক কিছু বলবেন, কিন্তু আমি মনে করি তামীমের উপর অতিনির্ভরতা থেকেই এই অবস্থা হয়েছিলো। ওই সময়টাতে তামীম দীর্ঘ ব্যাডপ্যাচে ছিলো, তার আগের বছরগুলোতে তামীম ফ্লাইং স্টার্ট এনে দিতো, তার ভিত্তিতে বাকি ব্যাটসম্যানরা ভরসা পেতো। ফলে যে ম্যাচগুলোতে তামীম ব্যর্থ হয়েছে, দলও সুবিধা করতে পারেনি। ২০১৩-১৪তে তামীম পুরোপুরি ব্যর্থ, দলও থমকে দাঁড়িয়েছিলো। ২০১৫ তে এসে আরও কয়েকজন পারফরমার যুক্ত হয়েছে, সেই পারফরমারদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে, মোটিভেশন ধরে রাখতে মাশরাফির লিডারশিপের বিশাল ভূমিকা আছে; তারই প্রেক্ষিতে ইনডিভিজুয়াল নয়, টিম পারফরম্যান্সই সারকথা হয়ে উঠেছে। একারণেই রুবেল এখনো নড়বড়ে অবস্থান থেকে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
তবে এখনকার দলেও রুবেল অবলীলায় বেস্ট ইলেভেনে চলে আসতে পারে। তাসকীন, আলআমিন বা শফিউলদের স্ট্যান্ডার্ডের সাথে তুলনা করলে রুবেল এখনো বহুযোজন ব্যবধানে এগিয়ে। শুভাশিস, রাব্বি এদের তো বিবেচনাতেই আনার কারণ দেখি না। আবু জায়েদ রাহী ছেলেটাকে প্রমিজিং মনে হয়েছে, তবে সে তো এখনো অনেক দূরের পথের যাত্রী। মুল প্রতিদ্বন্দ্বীতাটা তাসকীনের সাথে। ক্যালিবারের দিক থেকে তাসকীন এখনো অনেক অনেক পিছিয়ে। খেলোয়াড়ি স্কিলের চাইতে গ্ল্যামারবয় ইমেজই তাকে বেশি জনপ্রিয়তা দিয়েছে মনে হয় আমার। আর গত টি২০ বিশ্বকাপের সময় একশন বিতর্কে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে প্রবল সিমপ্যাথি আদায় করে নিয়েছিলো। কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বোলার হিসেবে এতোদিনে যে লেভেলে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো, সেখানে পৌঁছাতে এখনো অনেকটাই বাকি আছে তার। বলা যায় সে একটা লেভেলে এসে আটকে গেছে, ডেভেলপমেন্ট নেই। তার বোলিংয়ের লেন্থ একটাই, এবং উইকেট টেকিং ডেলিভারিগুলোও প্রায় একইরকম। সে যে লেন্থ এ বোলিং করে তাতে কট বিহাইন্ড আর মিসটাইমিংয়ে ক্যাচ- এ দুটো ডিসমিসালই বেশি; বোল্ড বা এলবিডব্লিউয়ের হার তুলনামূলক যথেষ্ট কম।
বাংলাদেশের পেসারদের প্রধানসমস্যা ইনজুরিপ্রবণতা আর ফিটনেস। সেই ১৯৯৬ থেকে বাংলাদেশের ওয়ানডে খেলা দেখি, কিন্তু আলআমিন বাদে এখনো পর্যন্ত কোনো ভালো ফিটনেসের পেসার দেখলাম না। ফিটনেস সমস্যার কারণে ইনজুরিপ্রবণতাও বেশি। মাঝখানে রবিউল নামে একজন পেসার টেস্টে খেলেছিলো কিছুদিন যে লম্বা স্পেলে বল করতে পারতো, কিন্তু তার মান টিপিক্যাল বাংলাদেশী পেসারদের মতোই। তাকে নিয়ে ঠিক লম্বা রেসের বাজি ধরা যায় না। ইনজুরিপ্রবণতার কারণে ১ বছর সুস্থমতো সবকয়টা সিরিজ খেলতে পারে এমন পেসার খুঁজতে হয় আমাদের। দেখা যাবে, দুটো সিরিজ তাসকীন খেলেছে, পরের সিরিজে সেখানে চলে আসে শফিউল বা আলআমিন। অনেকটা রোটেশনালি খেলার মতো। মাশরাফির প্রকৃত বয়স বোধহয় ৩৫, এই বয়স পর্যন্ত বর্তমান সময়ের কোনো বাংলাদেশী পেসার ক্যারিয়ার টেনে নিয়ে যাবে এটা তো স্বপ্নের মতো ব্যাপার।
কনসিসটেন্স পেস ধরলে রুবেল বাংলাদেশের সবচাইতে দ্রুতগতির পেসার। সে প্রচুর লুজ বল দেয়। এর আগে চামিন্দা ভাসের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম, সেখানে সে বলেছিলো ভালো বা অসাধারণ ডেলিভারিতে উইকেট পাওয়া যায় না, উইকেট আসে এভারেজ বা বাজে ডেলিভারিতে। আপনি একটা ভালো ডেলিভারি দিলে ব্যাটসম্যান যেভাবেই হোক সেটা ঠেকিয়ে দিবে, কিন্তু আলগা বল পেলে সে চার্জ করতে গিয়ে ভুল করবে।
ভাসের এই বক্তব্যকে আমি সমর্থন করি। বিশেষত পেসারদের জন্য একথা আরও বেশি প্রযোজ্য। ওয়ানডেতে রান চেক দেয়াটা যেমন জরুরী, উইকেট পাওয়াটাও তেমন। তাই ইকোনমি বেশি হলেও উইকেট পাওয়ার পটেনশিয়ালিটি বিবেচনায় রুবেলকে খেলানো উচিত, যেহেতু তাসকীন এই ফ্যাক্টরে তার চাইতে পিছিয়ে থাকবে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না টি২০ আর টেস্টের বোলিং ফিলোসফি পুরোপুরি আলাদা, যে কারণে রুবেলকে আমরা টেস্টে নামিয়ে দিই, টি২০ তে রাখি, এরপর সেখানকার পারফরম্যান্স দেখে ওয়ানডে থেকে বাদ দিই। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের যে মানসিকতা এবং টেম্পারমেন্ট, তাতে টেস্ট বা টি২০ কোনোটাই তাদের সাথে মানানসই নয়, তাদের পারফেক্ট মৃগয়াক্ষেত্র হলো ওয়ানডে, এবং সেই ড্রিম প্রোজেক্টে অন্তত রানিং টিম ফরমেশন কনটেক্সট এ রুবেল অবিসংবাদিতভাবে থাকতে পারে। মাশরাফি ইফেকটিভ বোলিং করছে, মোস্তাফিজ নিয়ন্ত্রিত বোলিং করবে, সাকিব আর মিরাজ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি রান চেপে রাখবে, মাঝখান থেকে গ্যাম্বলিং করার জন্য একজন রুবেলকে রেখে দেয়া যেতেই পারে বোধহয়। শফিউল যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু করেছিলো, ২০১১ এর পরে সেটা অনেকখানিই হারিয়ে ফেলেছে; তাসকীনের পরিণত হতে আরও সময় লাগবে। হোয়াই নট রুবেল? বসিয়ে রেখে কনফিডেন্স নষ্ট না করে মাঠিয়ে নামিয়ে দেখা যাক না কতটা খারাপ করে।
রুবেলের ফিটনেসের বাইরেও বড় সমস্যা ডিসিপ্লিন। এটা অবশ্য একা রুবেল নয়, জাতীয় দলের অধিকাংশ উঠতি ক্রিকেটারেরই কমন সমস্যা। স্টারডমের প্রভাবে ধরাকে সরাজ্ঞান করা, এবং তার প্রেক্ষিতে ঝরে পড়া। এটার একটা বড় কারণ মেন্টাল ম্যাচিউরিটির অভাব। ২০ বছর বয়সে একজন বাংলাদেশী তরুণ যদি মাসে ২-৩ লাখ টাকা বেতন পায়, দেশের কোটি কোটি মানুষ চেনে এবং লীগ খেলে ৪০-৫০ লাখ টাকা পেয়ে যায়, বিজ্ঞাপনসূত্রে আরও লক্ষ লক্ষ টাকা- জীবনের এই পটপরিবর্তনের সাথে অভ্যস্ত হওয়ার মতো স্মার্টনেস থাকে খুব কম ক্ষেত্রেই। শিক্ষা-দীক্ষার ঘাটতিও একটা কারণ। সাকিব, তামিম,মাশরাফি বা তারও আগের আকরাম, বুলবুল বা লিপু-ফারুকদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে দেখুন; প্রত্যেকেরই একটা মিনিমাম লেভেলের এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। কিন্তু এখনকার কম্পিটিটিভ ক্রিকেট পার্থক্যটা এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে, ক্রিকেট খেললে পড়াশোনা ছাড়ো, পড়াশোনা করলে ক্রিকেট ছাড়ো। ব্যালান্স করেও যে দুটো চালিয়ে নেয়া যায়, এই মেসেজটা কনভে হচ্ছে কম।
বিসিবি একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ক্রিকেটাররা তাদের এমপ্লোয়ি। যে কোনো বিজনেস অর্গানাইজেশনের ফার্স্ট প্রায়োরিটি হওয়া উচিত এমপ্লোয়ি নার্চারিং পলিসি। সেই নার্চারিং পলিসিতে ক্রিকেটারদের জন্য পড়াশোনা, কাউন্সেলিং, মোরালিটি, এথিকস প্রভৃতি বিষয়ে বিনিয়োগ করা উচিত। আপনি বলতে পারেন, ক্রিকেটার হলো তারকা, সে এডাল্ট, তার পারসোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার বিসিবির নেই, সে মাঠে ভালো করছে কিনা এটাই আসল; অন্য সময় সে কোন্ হোটেলে কোন্ নায়িকার সাথে ঘুমালো বা কোন্ মেয়েকে মোবাইলে আপত্তিকর মেসেজ পাঠালো বা গাঁজা-ভাঙ খেলো সেটা খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। ধরা যাক, আপনি প্রতিদিন সময়মতো অফিসে যান, কিন্তু অফিসের বাইরের সময়ে নাইটক্লাব, মেয়েমানুষ, মাদক এসবে সময় দেন; আপনি বলতে পারেন আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে কী করবো তা বলার অধিকার অফিসের নেই। কিন্তু আপনার এই উদ্দামতা যদি আপনার পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে তাতে অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হবে; সেক্ষেত্রে হয় অফিস আপনাকে বরখাস্ত করবে, অথবা সংশোধনের উদ্যোগ নেবে, আর সেটা করতে গেলে আপনার উদ্দাম জীবনে ইন্টারফেয়ার করতে হবেই, আপনি সেটাকে যেভাবেই নেন। ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। শুধুমাত্র মাঠের মধ্যের ওইটুকু সময়ের মধ্যে সে নিবদ্ধ নয়, মাঠের বাইরের মানুষটিই তার সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সাম্প্রতিককালে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের উশৃঙ্খলতার বিষয়টা যেহেতু মাঝেমধ্যেই উঠে আসছে, এক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে বিসিবির অবশ্যই করণীয় আছে অনেক কিছুই। রুবেল, আরাফাত সানী বা সাব্বির-আলআমিনের মতো ক্রিকেটাররা উশৃঙ্খলতার বলি হয়ে হারিয়ে গেলে সেটা শুধু সমর্থকদের জন্য নয়, বিসিবির জন্যও বিরাট ক্ষতির, কারণ প্রত্যেক ক্রিকেটারের পেছনে তাদের বিপুল ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে। অন্য দেশের ক্রিকেটাররা চরম উদ্দাম জীবন যাপন করলেও সেটা তাদের পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে না, কারণ তাদের লাইফস্টাইল, কান্ট্রিকালচারে এসব খুব বেশি অমার্জনীয় কিছু নয়।
কিন্তু আমাদের সামাজিক অনুশাসনে উদ্দামতা এক ধরনের বিচ্যুতি হিসেবে গণ্য হয়, কারণ এধরনের লাইফস্টাইলে আমরা অভ্যস্ত নই। যে কারণে নাইটক্লাব, জুয়া, মাদক প্রভৃতি কর্মকাণ্ডকে আমাদের তরুণেরা এডভেঞ্চার হিসেবে দেখে, এবং এসবের মোহে পড়ে যায়। এক চামচ সিরাপ আর এক বোতল সিরাপের মধ্যে যে মাত্রাগত পার্থক্য, আমরা এই পরিমিতিবোধের অভাবে ভুগতে ভুগতেই অতলে ডুবে যাই।
বাংলাদেশে পেস বোলিং দেখার আনন্দ তৈরি করেছিলো মাশরাফি, সেটা আরও গ্ল্যামারাস হতে পারতো রুবেলের আনপ্লেয়েবল সব ডেলিভারি দেখার মধ্য দিয়ে, বিরাট কোহলির সাথে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব দেখার মধ্য দিয়ে, কিন্তু রুবেলের সেসব ভাবতে বয়েই গেছে! এখানেই মাশরাফির সাথে রুবেলের পার্থক্য। ব্যক্তি মাশারফির মতো বিশাল হৃদয় আর অতুলনীয় পারসোনালিটি না-ই থাকতে পারে, কিন্তু বোলার মাশরাফির মতো এডাপ্ট করা, এডজাস্ট করার গুণটুকুও যদি তার থাকতো, আজ এই ২০১৭ তে এসেও রুবেলকে নিজের জায়গা খুঁজে খুঁজে হয়রান হতে হয়। এখানেই জীবন আর ক্রিকেট এক লাইনে মিলে যায়।
জীবন হয়তো কোনো বিরল উপহার, হেলায় হারালে বাড়ালে ব্যর্থতার অহংকার। রুবেলের বিচ্যুতি তাই হেলা আর অবহেলার হিসাব মেলাতে মেলাতেই ক্যারিয়ারের রৌদ্রকে গোধূলির দিকে টেনে নিয়ে যাবে। রুবেল, এখনো সময় আছে কিন্তু……..