কিছু কিছু শব্দ আর কনসেপ্ট এর প্রাকটিকাল এন্টারপ্রেটেশন শাখের করাত এর মতো; ‘প্রফেশনাল’ শব্দটাকে এই ধারায় রাখা যেতে পারে নির্দ্বিধায়। কারো কাছে প্রফেশনাল মানে প্রশংসা, কারণ সে কাজের বাইরে কিছু বোঝে না; আরেকদলের কাছে প্রফেশনাল মানে নিন্দা, যে টাকা ছাড়া কোনো কাজ করে না।
যখন থেকে আমরা উপার্জনক্ষম হই, আমাদের ব্যক্তিসত্তা দুটো পৃথক আইডেন্টিটিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে- পারসোনাল লাইফ, প্রফেশনাল লাইফ; ইনডিভিজুয়ালিজম, ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রভৃতি ফ্যান্সি কনসেপ্টের মোহে পড়ে ‘ইটস পারসোনাল’ কথাটা হয়ে পড়ে বেদবাক্যের মতো। পারসোনাল আর প্রফেশনাল লাইফের মধ্যে বিরাট ফারাক। একজন মানুষ ড্রইংরুমে যেভাবে কথা বলে, বন্ধুদের আড্ডায় যেভাবে মেশে, তার কর্মক্ষেত্রে অবশ্যই সে সেরকমটা নয়; সেখানে প্রোটোকল, অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ারের ফিল্টারিং প্রসেস এ ব্যক্তির আচরণ এবং অভিব্যক্তি সবই মেকি। যেহেতু কর্মজীবী মানুষের দিনের বড় সময়টা কর্মক্ষেত্রেই চলে যায়, মেকিনেসটাই বরং প্রকট হয়ে যায় একসময়।
কেন এই মেকিনেস? কারণ কর্মক্ষেত্রে আমরা যা করি বা যাদের সাথে মিশি সবটাই প্রয়োজন বা সুনির্দিষ্ট স্বার্থনিবৃত্ত করতে। যাদের সাথে ইন্টারেকশন হয় তারা পারিবারিক মানুষ নয়; সেখানে নেগোশিয়েশন মুড কাজ করে, এবং লাভ-লোকসানের ব্যাপার জড়িত থাকে। ফলে আবরণ এবং চাতুর্য দুটোই মেইনটেইন করতে হয়। হ্যান্ডশেক হয় যান্ত্রিকভাবে, কথা হয় মেপে মেপে, এমনকি হাসি, সেটাও কৃত্রিম।
এই প্রফেশনালিজমের আদৌ কি ইমপ্যাক্ট আছে? কত সহজে আমরা ক্ষুধা-তৃষ্ণার চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করি।
একজন প্রফেশনাল মানুষ বললে সাধারণত কোন্ ইমেজ মাথায় আসে? তিনি কাজের বাইরে কথা বলেন না, তার প্রতিটি সেকেন্ড হিসেব করা। একজন প্রফেশনাল হেসে কথা বলছেন, আগত অচেনা আগন্তুকের কাছে বাহুবলী সিনেমার গল্প শুনতে চাইছেন, কিংবা এক বোর্ড দাবা খেলতে বসে যাচ্ছেন- এগুলো কোনোভাবেই ‘প্রফেশনাল’ ধারণার সাথে মেলে না। কিন্তু কেন?
যে কোনো ট্রাডিশন বা সিস্টেম এস্টাব্লিশড হতে দীর্ঘদিন সময় লাগে, এবং এর সঙ্গে বহুমানুষের মেন্টালি এটাচড হতে হয়। আমরা প্রফেশনালদের জন্য কিছু ম্যানার, গেশচার এবং এটিচুডের ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে দিয়েছি; কারা করেছে কেউ জানে না, কিন্তু এস্টাব্লিশড হয়ে গেছে। আগ বাড়িয়ে কথা বলা হালকা বা সস্তা পারসোনালিটি, রাশভারি হওয়া মানে স্ট্রং পারসোনালিটি- এরকম একটি কমন ধারণা তো বহুদিন ধরেই প্রতিষ্ঠিত। ফলে কাউকে বুঝতে বা জানতে চাওয়াটা ন্যাকামি বা সময় অপচয় হিসেবেই গণ্য হয়। আমাদের সঙ্গে একজন ব্যাংকার বা কোনো একটি কোম্পানীর কর্মকর্তা যদি ইনফরমাল এপ্রোচে কথা বলে সেটাই বরং আমাদের সন্দেহগ্রস্ত করে তোলে, তার মোটিভ কী এ নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। পারস্পরিক বিশ্বাস বা আস্থার জায়গাটা এভাবেই হারিয়ে গেছে।
সম্প্রতি ২ মাসের একটা হিউম্যান বিহেভিয়েরাল এক্সপেরিমেন্ট প্রজেক্ট শুরু করেছি, যেখানে ২ মাস ধরে ১০ জন মানুষের থট প্রসেস নিয়ে কাজ করবো এবং প্রজেক্ট শেষে তারা ‘অন্যরকম ইলেকট্রনিক্স কোম্পানী’তে সেলস এ চাকরি পাবে। গতকাল একটা টাস্ক ছিলো এমন, ১জন মানুষ তার সাথে থাকা অপর ২ জনের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ জন মানুষের নাম এবং ফোন নম্বর নিবে, অর্থাৎ ১০ জনে মিলে ৫০ জন অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলবে। ৫ জনের ক্রাইটেরিয়া এমন: ২ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ২ জন স্বল্প পরিচিত মানুষ, এবং ১জন যার সাথে খারাপ সম্পর্ক। ফোনের প্রেক্ষিতে এনালাইটিক রিপোর্ট জমা দিতে হবে। ১০ জনের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখলাম, অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন রিসিভ করতেই প্রবল অনীহা, কথা তো বলবেই না। কেন বলবো, এসব জেনে কী হবে, জেরায় জেরায় জেরবার।
অপরিচিত ফোন নম্বর থেকে চাদা চাওয়া, হুমকি, প্রতারণা করাসহ বহুবিধ ঘটনা ঘটে বলেই ইনসিকিউরিটি ফিলিং চরমে। যেহেতু আমাদের জীবনযাপনের প্রতি ইঞ্চিতে ইনসিকিউরিটি ফিলিং, সেটা কর্মক্ষেত্রেও ঢুকে পড়েছে, এবং সেই তুলনায় প্রফেশনালের ফ্রেমওয়ার্কটা অনেক বেশি নিরাপদ এবং নির্ঝঞ্ঝাট।
আরও একটা কারণে, প্রফেশনালের তথাকথিত ফ্রেমওয়ার্কটা এস্টাব্লিশড হয়েছে: অধিকাংশ মানুষ স্বভাবতই সুযোগসন্ধানী এবং যে কোনো সুবিধা মিসইউজ করায় ওস্তাদ। আপনি কারো সাথে আন্তরিক ব্যবহার করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটাকেই সে আপনার দুর্বলতা মনে করবে, এবং মাথায় চেপে বসতে চাইবে।
একটা কথা বহুবার লিখেছি, আমরা মানুষকে বিচার করি তার একশন দিয়ে, ইনটেনশন দিয়ে নয়। ফলে আমরা কখনোই ব্যক্তিগত তালগাছের অধিকার ছাড়তে রাজি হই না। একজন মানুষ আপনাকে গালি দিলো এতে আপনার মন খারাপ হলো, আরেকজন আপনাকে ভরপেট মোরগপোলাও খাওয়ালো, আপনি মহাখুশি। কিন্তু গালি কেন দিলো, এবং পোলাও কেন খাওয়ালো- এগুলোর পেছনকার ইনটেনশন নিয়ে ভালোমতো চিন্তা করলে হতেও পারে গালি দেয়া লোকটিকে আপন আর পোলাও খাওয়ানো লোকটিকে পর মনে হবে। ইনটেনশন আর মোটিভ সমার্থক নয়। আমরা নিজেরাও নিজেদের ইনটেনশন সম্পর্কে ক্লিয়ার না; অন্যদের ইনটেনশন বিচারের তো প্রশ্নই আসে না। একারণেই পেছন থেকে ছুরি মারা মানুষের সংখ্যা এতো বেশি; সেই জুলিয়াস সীজারের আমল থেকেই ছুরি মারা চলছে, চলবে আগামীতেও।
সম্ভবত একারণেই প্রফেশনালিজমের মেকি আবরণ এতোটা নিরাপদ অপশন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রফেশনালিজমকে ৪টি প্রধান প্যারামিটারে বিভক্ত করি: ১. কমিটমেন্ট ২. মিউচুয়াল রেসপেক্ট ৩. ট্রান্সপারেন্সি ৪. ট্রানজেকশন
অথচ প্রফেশনালিজমের প্র্যাকটিকাল উদাহরণে আমরা কেবল এটিচুডটাই রপ্ত করি। কথার সাথে কাজের মিল নেই, কী বলছি কেন বলছি জানি না, যার সাথে কাজ করছি তার প্রতি রেসপেক্টও নেই, ডিসরেসপেক্টও নেই, শুধু জানি তার সাথে কাজ করতে হবে, ট্রান্সপারেন্সির কনসেপ্টেই বিশ্বাস করি না, কিন্তু ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে ষোলআনা রেডি। প্রফেশনালিজম শব্দটার মধ্যেই ট্রানজেকশন আছে। কারণ, প্রফেশন হলো সেটা যার মাধ্যমে বাজার-সদাই করার বা পোশাক-আশাক কেনার খরচ জোটে। আপনি যদি নিজের ঘনিষ্ঠ কারো কাজ করেন তবু সেখানে ট্রানজেকশন থাকা উচিত; হতে পারে আপনি তাকে ৯৯% ডিসকাউন্ট দিলেন। ট্রানজেকশন বা এক্সচেঞ্জ না থাকলে সেটা চ্যারিটি হয়ে যায়, প্রফেশনাল এক্টিভিটি নয়। আপনি প্রতিবার ৯৯% ডিসকাউন্ট দিলে সেটা তার প্রতি আপনার ফিলিংস আর পারস্পরিক বন্ডিংয়ের স্ট্রেন্থটাই বোঝাবে। আমরা সবকিছুতে ফ্রি চাই, আপনি তার কাছ থেকে ২০০ টাকা ফি নিয়ে প্রয়োজনে ৩০০ টাকার গিফট দিন, কিন্তু নিজের প্রফেশনকে সম্মান জানানোর জন্য হলেও ট্রানজেকশনটা জরুরী। ফ্রি কোনোকিছুকে মানুষ মূল্যায়ন করতে চায় না।
কিন্তু আমরা শুধু টাকাটাই চিনি, বাকি ৩টা প্যারামিটারের লেশমাত্র না থাকা সত্ত্বেও আমার নিজেদের সুপার প্রফেশনাল ভেবে পুলকিত হই; ‘এটা অফিস, আপনার ড্রইংরুম না’ এই সংলাপ শুনিয়ে শান্তি পাই; বা স্কুলের বন্ধু একই অফিসে নিচের পোস্টে কাজ করে, আপনাকে যদি সে ‘স্যার, আপনি’ এসব না বলে আপনি মাইন্ড করবেন; কারণ নিচের পোস্টের একজন নাম ধরে বললে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়বে, বন্ধু হিসেবে সে বাড়তি ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করতে পারে, এরকম কত বিচিত্র যুক্তি আপনার! তাহলে ওই বন্ধুকে চাকরিতে নেয়ার দরকার কী, আর যদি নেনই, তাকে সতর্ক করে দিন, কোনোরকম সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করলে চাকরি থাকবে না।
অফিসে প্রফেশনাল এনভায়রনমেন্ট, অফিসের বিল্ডিং থেকে বের হলেই দুই বন্ধু একসাথে সিগারেট খাই- এই আরোপিত প্রফেশনালিজমের আলটিমেটলি কোনো ইমপ্যাক্টই নেই। সুপার ক্যাজুয়াল হয়েও যে চরম প্রফেশনাল হওয়া যায়, এই বোধ জাগ্রত হতে এবং মানতে পারার মতো মাইন্ডসেট তৈরি হতে আরও বহুবছর লাগবে আমাদের, এমনকি কোনোদিন নাও হতে পারে। কারণ আমাদের ছেলেবেলায় ঘুমপাড়ানো হয় দৈত্য-দানোর গল্প শুনিয়ে, ভাত খাওয়ানো হয় বর্গী দস্যুদের ভয় দেখিয়ে, অর্থাৎ একদম আর্লি লাইফ থেকেই আমাদের সাবকনশাস মাইন্ডে একটি ডেমন চরিত্র ঢুকিয়ে দেয়া হয়; সমগ্র জীবনধরে কোনো না কোনো ডেমন চরিত্রই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। অফিসে কাজ করতে হবে, নইলে বস অসন্তুষ্ট হবে, পরের বছর ইনক্রিমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে; খেলায় জিততে হবে, নইলে স্পন্সর চলে যাবে, বাজারে সকালে যেতে হবে, নইলে দুপুরে পঁচা মাছ কিনতে হতে পারে………….এরকম অজস্র ডেমন চরিত্র আর ডেমন সিস্টেমের সমণ্বিত ধাঁধাতেই আমাদের জীবন কেটে যায়। যে কারণে, ক্যাজুয়াল হলে, ফ্র্যাংক হলে ডেমন চরিত্রেরও প্রয়োজন থাকে না। হাজার বছর ধরে যে চরিত্র বেড়ে উঠেছে, সেটা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ক্রাইসিসে পড়ে, তা কীভাবে বরদাশত করা যায়! সুতরাং ব্যস্ত পৃথিবীতে ক্যাজুয়াল আর প্রফেশনাল এই দুই শব্দের সহাবস্থান অসম্ভব এবং এর চিন্তাও এক কথায় ইমপ্র্যাকটিকাল! ‘ক্যাজুয়াল’ পুরোটাই লুজার টাইপ মানুষদের জন্য বিধিবদ্ধ।
এবং ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, এই লেখাটি যাদের পড়া উচিত তারা এটাকে ফ্যান্টাসি বলে উড়িয়ে দেবে, আর যারা পড়ে প্রশংসা/সমালোচনা করবে, তারা নিজেরাও ক্যাজুয়াল আর প্রফেশনাল এর মধ্যবর্তী বর্ডারলাইনকে ভেঙ্গে ফেলতে উদগ্রীব কিনা এ নিয়ে সংশয় আছে। তারা বরং ‘এই বেশ ভালো আছি’ টাইপ গান গুনগুন করতে এক লহমায় মিষ্টি খেয়ে তৃপ্তি নিয়ে বলে, ‘বি প্রফেশনাল’। সেই প্রফেশনালের ভিজুয়ালাইজেশন কী এই প্রশ্ন ছুড়ে দিলে খুব কনফিডেন্টলি বলবে’ প্রফেশনাল মানে হলো প্রফেশনাল; এইটাও বুঝিয়ে বলতে হবে?’
তারা বুঝতেও পারবে না, ‘ফরমাল’ আর ‘প্রফেশনাল’ কখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এটিচুড দিয়ে বেলের শরবত খান সকাল-বিকাল ২ বেলা।