আমার বিবেচনায় মিথ্যা ৩ প্রকার: ডাহা মিথ্যা, টেকনিকাল মিথ্যা এবং ক্লাসিকাল মিথ্যা। প্রথম দুপ্রকারের মিথ্যাকে একটু চিন্তা করলেই ধরে ফেলা যায়, কিন্তু ক্লাসিকাল মিথ্যা এতোই পাওয়ারফুল যে, সত্যেরও সাধ্য নেই তাকে মিথ্যা প্রমাণ করার এবং একটা পর্যায়ে সেগুলো প্রবচনে পরিণত হয়ে সত্য-মিথ্যা বিচারের ঊর্ধ্বে চলে যায়। ‘সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখি’- দীর্ঘদিন ধরে চলা এই নীতিবাক্যটিও আদতে একটি ক্লাসিকাল মিথ্যা, এবং এটি আমাদের চেতনায় গেঁথে গেছে।
সবাই বলতে আসলে কারা? তার চেনা সব মানুষ? অবশ্যই নয়।একজন মানুষ যতজনের সাথে ক্লোজলি মেশে বা কর্মসূত্রে কানেক্টেড সেই মানুষগুলোর সমষ্টিই ‘সবাই’। আমরা যেহেতু জেনেরিক কথা বলে অভ্যস্ত, ম্যাক্রো স্কেল ফ্যাক্টরকে মাথায় না রেখে মাইক্রো লেভেলেই আকাশ জয়ের আকাঙ্ক্ষায় মাতি; মানে কুয়োর মধ্যেই সমুদ্রের বিশালতা বুঝতে চাই।
সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখা একটি বাজে কথা, আমাদের মধ্যে বসবাস করা ডিভাইন এনটিটি এই প্রবোধ দিয়ে নিজেকে অন্যের চোখে বা নিজের চোখে প্রবল ব্যক্তিত্বশালী ভাববার ভ্রান্ত বিলাস দেখায়মাত্র। এমনকি মা-বাবাও সব সন্তানকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে পারে না। যে কোনো সন্তানের সাফল্যে তারা একইরকম খুশি হয়, ব্যর্থতায় সমপরিমাণ কষ্ট পায়- এই সমীকরণকে তারা সমান দৃষ্টিতে দেখার ভুল ব্যাখ্যা দেয়। যে সন্তানের সাথে ইন্টারেকশন বেশি হয়, যে তার বা তাদের নেওটা বেশি হয়, তার প্রতি প্রত্যাশা এবং নির্ভরতা দুটোই বেশি থাকে, কিন্তু এই সরল সত্যটা তারা মেনে নিতে পারে না পক্ষপাতিত্ব প্রমাণিত হওয়ার ভয়ে।
আমরা টার্ম বা শব্দগুলোকে বরাবরই ভুল ব্যাখ্যা করি। যেমন, সমান দৃষ্টিতে দেখা মানে মনে করি নিরপেক্ষতা বা নির্মোহতা, এবং এর ব্যতিক্রম মানে পক্ষপাতিত্ব। বস্তুত, পক্ষপাতিত্ব একটি নেগেটিভ বিহেভিয়েরাল এপ্রোচ; এর এন্টারপ্রেটেশন হলো কারো প্রতি অন্ধ সমর্থন, সে ন্যায়-অন্যায় যেটাই করুক; ফলে তখন ক্রিটিকাল এনালাইসিস এবং নিজের স্বচ্ছতার জায়গাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয় নিজের কাছে।
অন্যদিকে, নিরপেক্ষতা মানে মনে করা হয় সে কোনো পক্ষেই নেই। আদতে নিরপেক্ষতা একটি সুবিধাবাদী অবস্থান; একজন মানুষ যদি কোনো ঘটনার পারটিসিপেন্ট কিংবা অবজারভার হয়, তার অবশ্যই কোনো একটি পক্ষ থাকবে, নইলে সেখানে তার কোনো আগ্রহই থাকার কারণ নেই। নিরপেক্ষ বললে কোথায় যেন আত্মপ্রসাদ পাওয়া যায়। নির্বিকার আর নিরপেক্ষ মোটেই এক ব্যাপার নয়।
আসলে নিরপেক্ষ বলতে আমরা আনবায়াসড বুঝতে চাই। কিন্তু ইংরেজি আনবায়াসডকে বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায় নির্মোহ, আর নিরপেক্ষ এর ইংরেজি নিউট্রাল। নির্মোহ হওয়া খুব সহজসাধ্য কাজ নয়, একটা পুরো জীবন খরচ হয়ে যায় লোভ-কাম এর তাড়না থেকে ঊর্ধ্বে উঠে ভিন্নভাবে চিন্তা করার সামর্থ্য অর্জন করতে। এরকম মানুষ লাখে নয়, কোটিতে ১জন মেলে। সুতরাং নির্মোহতার আবরণে আমরা আসলে নিরপেক্ষতার সুবিধাবাদী অবস্থানকে জাস্টিফাই করতে চাই।
তবু আমরা প্রচণ্ড পক্ষপাতিত্ব দেখাই, দেখিয়ে ক্লান্ত বোধ করি না, উপরন্তু নির্মোহতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিরপেক্ষতার ভেক ধরে থাকি। আমরা প্রত্যেকে নিজেদের একটি কল্পিত ইমেজ ধারণ করি, অথচ যাপন করি পুরোপুরি আলাদা একটি ব্যক্তিচরিত্র। নিজেদের কল্পনার সাথে বাস্তবের চরিত্রের মিল না পেয়ে প্রতিনিয়ত হতাশ হই, সেটা ঢেকে রাখতে নানান ফন্দি-ফিকির করি; তারই রূপায়ণ এই সমান দৃষ্টি। ‘আমরা বাছ-বিচার করি না, আমরা সবাইকে সমান মূল্য দিই’- আমরা যেন মানুষের শরীরে বেড়ে উঠা একেক অপাপবিদ্ধ দেবদূত । চিন্তা করুন, একবার নয়, বারবার; দেখবেন সমান দৃষ্টিতে দেখা পুরোটাই এক রূপকথার গল্প।
কারো প্রতি ঝোঁক বেশি থাকা, বা স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি বন্ডিং হওয়া- এগুলো খুবই ন্যাচারাল। কিন্তু আমাদের কাঁচের তৈরি মহত্ত্বের ঘর, এটা মেনে নিলে, ভেঙ্গে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সমদৃষ্টির গল্প ছড়িয়ে দেয়ার প্রাণান্ত পরিশ্রমে সময়গুলো খরচ হয়ে যায়।
ব্যবধান মানেই কি বৈষম্য?
চিন্তার একমুখীতা এবং বিচক্ষণতার ঘাটতি দুয়ের সমণ্বয়ে আমাদের বেশিরভাগ এক্সপ্রেশনই চরমপন্থী বা মৌলবাদীসুলভ হয়ে থাকে। কাউকে পছন্দ করলে তার শতভাগ পছন্দ করতে হবে, অপছন্দ করলে দুইশোভাগ অপছন্দ। বিচ্যুতি মানতে না পারার একগুয়েমিতে আমরা কেবলই পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাই; আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারি না। বিচ্যুতি মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, এটা মানতে যতটুকু সাহসের দরকার তার অভাবেই যতসব লুকোচুরি খেলা। আমরা কারো সাথে মেশার সময় নিজেরা তার জন্য একটি অদৃশ্য ফ্রেম তৈরি করে ফেলি, সেই ফ্রেমে যতদিন বা যতক্ষণ সে ফিট করে ততক্ষণই সে গুডবুকে থাকে, ফ্রেমের বাইরে গেলেই সে হয়ে উঠে অসহনীয়। ছোট্ট একটা জীবন, অথচ রাশি রাশি ফ্রেম; এতো ফ্রেমের চাপেই তো পিষ্ট হয়ে যায় সব সহনশীলতা।
ভারটিকালি চিন্তা করার চাইতে, আমাদের আগ্রহ চিন্তার হরিজন্টাল বিস্তৃতির প্রতি। ফলে কেবল চিন্তার জট বাড়তেই থাকে, গভীরে আর ঢোকা হয় না।
সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখার বড় বিপদ হলো, এর মানে কাউকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে না করা। এধরনের মানুষগুলো সাধারণত অন্যের সাথে মেশে ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের চাহিদায়; প্রয়োজন শেষে মানুষটিও অতীত হয়ে যায়। এরা দূর থেকে দেখার জন্য, গল্প করার জন্য, কিংবা ২-১টা ট্যুর করার জন্য ভালো চয়েজ, কিন্তু এরা কখনো অবলম্বন হতে পারে না, আপন হতে পারে না। চোরাবালি হয়ে এরা দূর থেকে আহ্বান জানায়, কিন্তু সংস্পর্শে গেলে ডুবে যাওয়াই নিয়তি।
সবাইকে সমান চোখে দেখি, এই কথা বলার মধ্যে কি কোনো সমস্যা আছে? আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু যাকে একথা বলা হচ্ছে সে নিজেও জানে এটা কথার কথা, সত্যতা নেই। ফলে দূরত্বের দেয়াল আর ভাঙ্গে না, ১৭ বছর পরও একইরকম দৃঢ় থাকে।
দূরত্বের দেয়াল ভাঙ্গা কি জরুরী? এটা তর্কসাপেক্ষ উত্তর। কেউ দরজা-জানালা বন্ধ করে অন্ধকারে শুয়ে শান্তি পায়, কেউ জানালার বাতাস ছাড়া ঘুমুতে পারে না; প্রশ্ন হলো বাতাস আর অন্ধকারের মধ্যে কোনটার শক্তি বেশি।
ধরলাম, কেউ একজন মেনে নিলো, সে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখে না, তার মধ্যেও বায়াসনেস কাজ করে। এই স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে কী হবে? হয়তো কিছুই নয়। স্পষ্টবাদীতা ভালো গুণ, তবে তার চাইতে ভালো ডিপ্লোম্যাটিক হওয়া। এতে ব্যালান্স থাকে। ডিপ্লোম্যাট হওয়াকে কমন এন্টারপ্রেট করা হয় তৈলমর্দন হিসেবে। ভুল এন্টারপ্রেটেশনের মিছিল থামেই না আমাদের। যার যে গুণ নেই তার জন্য প্রশংসা করাকে তৈলমর্দন বলা হয়, কিন্তু কাউকে বাড়তি প্রশংসা করলে যদি সে খুশি থাকে সেটা তো মন্দ বলা যায় না। সিদ্ধান্ত বা মূল্যায়ন- দুটো ক্ষেত্রেই এমন ত্বরিত গতি কার্যত আমাদের বর্জনের তালিকাই দীর্ঘায়িত করে, অর্জন খরচ হয়ে যায় দেদারছে।
মানুষ পক্ষপাতিত্ব কেন করে? নির্বাণ লাভের আশা মনে, কিন্তু আচরণে বাঁচে ইন্দ্রিয়সর্বস্ব শয়তান হয়ে। নির্বাণ আর শয়তানের টানাহেঁচড়ায় ইন্দ্রিয়পরায়ণতা বিজয়ী হয়। এই বিজয়োচ্ছ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে একে ঢেকে রেখে মহত্ত্বের খোলস জড়াতে হয়। জীবনভর এই প্রক্রিয়া চলমান থাকে।
মিথ্যা যতপ্রকারই হোক, শেষপর্যন্ত সেটা মিথ্যাই। প্রবাদ-প্রবচন বলতে কিছু নেই, সমস্তটাই কিছু মানুষের অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাসের প্রতিফলন; এর ব্যত্যয় ঘটবে বলেই জীবন গতিময়।
মহত্ত্বের মোহে নয়, শুদ্ধতার সত্যে বাঁচার সংকল্প নিয়ে পঙ্কিলতাতেই ডুবে যাই সুবহে সাদিক লগ্নে রোজ ।
বিচ্যুতির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসুক, খোলসগুলো বিলুপ্ত হোক সৎসাহসের বিপুল সমারোহে………