বিখ্যাত, অবিখ্যাত মিলিয়ে ২০০০+ মানুষের বায়োগ্রাফি পড়াসূত্রে একদম কনফিডেন্টলিই বলতে পারি, যে কোনো ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার মানুষের অন্তর্নিহিত যোগ্যতা বা বৈশিষ্ট্য জীবনের প্রথম ১৪ বছরের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায়, বাকি জীবনে সেগুলোর এক বা একাধিক এঙ্গেল পরিপক্বতা পায় মাত্র!
আমার জীবনের পুরোটাই খরচ করতে চাই কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টে, আত্মকেন্দ্রিক জীবনে প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু ফুলটাইম সুখী মানুষ হওয়া যায় বিশ্বাস করি না। স্বাবলম্বী হওয়ার পর আমার জীবনের একমাত্র বিলাসিতাচিহ্ন মোটামুটি দামি বাসায় ভাড়া থাকা। আমি একদমই বিত্তশালী মানুষ নই, মাস শেষে টানাটানির দশা অন্য যে কোনো মানুষের মতো বা ক্ষেত্রবিশেষে কিছুটা বেশি আমারও থাকে, এবং এই টানাটানির পেছনে আমার অমিতব্যয়ীতা আর পাগলামি স্বভাবকেই দোষারোপ করা হয়, কারণ আমার উপার্জনের একটা বড় অংশ ব্যয় হয় থট প্রসেস ডেভেলপমেন্ট খাতে বিনিয়োগে। আমার নিজের নয়, অন্য মানুষের থট প্রসেস ডেভেলপমেন্টে। এটাই আমার জীবনের পারপাস এবং ভিশন।

মানুষ শরীরে বাঁচতে চায়, কিন্তু আমি চাই মানুষ বাঁচুক চিন্তায়। খাওয়া, ঘুম, গোসলের মতোই চিন্তা করাও একটা অভ্যাস। ভোগবিলাসী আর তুমুল বৈষয়িক বিশ্বব্যবস্থায় মাথার চাইতে মুখকে দামি ভাবতে শিখিয়েছে, মানে কে কতটা আকর্ষণীয়ভাবে প্রেজেন্ট করতে পারে সেটাই মূখ্য, কে কত গভীরভাবে চিন্তা করতে পারে এটা বরাবরই ধর্তব্যের বাইরে থেকে যায়। ‘ কমিউনিকেশন স্কিল’ কথাটার এন্টারপ্রেটেশন শেষতক তাই কথা বলার পারঙ্গমতাতেই আটকে গেছে। ভিশন, ইনসাইট, ফোরসাইট বিহীন মানুষ কেবল উপভোগ, উপযোগ করতে পারে, বিপুল ইন্দ্রিয়বিল এর আধার হতে পারে, কিন্তু মিনিংফুল কোনো ইমপ্যাক্ট রাখতে পারে না।
আমার জন্ম নিয়ে কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করেনি, আমি বিশ্বব্যবস্থায় একটি ক্ষুদ্র পিঁপড়ার চাইতেও তুচ্ছ অবস্থান বিলং করি, আমার টার্গেটও তাই সীমাবদ্ধ। আমি ৭২৭ জন মানুষের জীবনে ইমপ্যাক্ট রাখতে চাই, সেটা করতে সমর্থ হলেই কেবল এটাকে মানুষের জীবন হিসেবে স্বীকার করতে পারবো; নইলে ক্ষুধা-তৃষ্ণা-কামের এই ফালতু শ্বাস-প্রশ্বাস খেলাকে অবলীলায় মহিষের সাথে রদ-বদল করে নেয়া যায়। ইমপ্যাক্টটাই শেষ কথা। গত ১৯ বছরে, আমার ধারণা আমি বড়জোর ৪১ জন মানুষের জীবনে ইমপ্যাক্ট রাখতে পেরেছি। ৭২৭ হতে এখনো অনেক দেরি, অথচ স্বাবলম্বী হওয়ার পর থেকে থট প্রসেস ডেভেলপমেন্টের উদ্দেশ্যে খরচ করে ফেলেছি বিপুল পরিমাণ অর্থ, সময় আর উদ্যম।
২০১৬ এর জুন মাসে আমার জীবনে বা চিন্তাজগতে শক্তিশালী এক পরিবর্তন এসেছে, যেটা আরো আগে আসা উচিত ছিলো। আমি উপলব্ধি করেছি মানুষের ডিসিশান মেকিং প্রসেস ৩টা ফ্যাক্টর দ্বারা নিওন্ত্রিত হয়: রেফারেন্স ডাটা, কম্পারেটিভ ডাটা এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির রেকমেন্ডেশন। এই উপলব্ধির পর আবিষ্কার করি, থট প্রসেস নিয়ে নিবিষ্ট থেকে যা যা করেছি সবই রেন্ডম, যে কারণে কোনো মিনিংফুল ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারিনি। কিন্তু আমি যেহেতু সংখ্যার মাঝে বাঁচা মানুষ এবং পৃথিবীর যে কোনো ডাটাকে সংখ্যায় কনভার্ট করা সম্ভব, সেক্ষেত্রে ইমপ্যাক্ট মেজার করা সহজ, এবং এফিশিয়েন্সি বাড়ানোও বাস্তব সম্ভাবনা। প্রায় দেড় বছর এই উপলব্ধিকে ক্রস চেক করে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিই, থট প্রসেস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে এই লারনিংকে প্রয়োগ করবো। তার প্রথম পদক্ষেপ itsimpact.org নামের কার্যক্রম। এটা কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগ নয়, জীবনভর আত্ম অন্বেষণ প্রক্রিয়ায় থট প্রসেস ডেভেলপ করতে যত কাজ করছি সেগুলোর আর্কাইভিং বলা যায় একে, এক অর্থে এটা চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানও, কারণ ব্যক্তিগতভাবে হলেও থট প্রসেস প্রকল্পগুলোতে আমার প্রচুর খরচ হয়ে যায় নিয়মিতই।
আমি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হই ২০১০ সালে। তখন থেকেই আমি ৩ টা প্রতিশ্রুতি নিয়ে জীবন যাপন করছি: কখনো ফ্ল্যাট কিনবো না, কখনো গাড়ি কিনবো না, ব্যাংকে টাকা জমাবো না। ফলে থট প্রসেস খাতে খরচ করতে তেমন পিছুটান বোধ করিনি কখনোই।

কিন্তু সমস্যা হলো, যে উদ্দেশ্য নিয়ে কাজগুলো করেছি সেটাকে এন্টারপ্রেট করার প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ, ভেবেছে এটাই তো হওয়ার কথা। যেমন গত ৪ বছরে চেনা, অর্ধচেনা অন্তত ৪৯৩ জন মানুষকে বিভিন্ন এমাউন্টের বই কিনে দিয়েছি তাদের পছন্দমতো, কিন্তু সেই বই দেয়ার পেছনে আমার উদ্দেশ্য কী জানতে চায়নি একজনও। আবার, ৩১ জন এর বেশি মানুষের সাথে বাজি ধরেছি; বাজির ধরনও একতরফা, সে হারলে কোনোকিছু দিতে হবে না, স্রেফ ক্ষমা চাইতে হবে, কিন্তু আমি হারলে সে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা পুরস্কার পাবে; বেশিরভাগ সময়ই আমি হারি, তবু কেউ প্রশ্ন করে না এটা কেমনতর বাজি! আরো বিভিন্ন ফরম্যাটে কাজ করেছি, কিন্তু ঘটনার পরিণতি প্রায় একই।

কলেজ এবং ভার্সিটি পড়ুয়া এত তরুণ তরুণীর সাথে কাজ করার ফলাফল বিশ্লেষণ করে যেটা বুঝেছি, তারা আমার কাজগুলোকে খামখেয়ালিপনা আর ত্রুটিপূর্ণ পারসোনালিটির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নিয়েছে, থট প্রসেস সংক্রান্ত আমার ইনটেনশনটা তাদের মাথায় আসেনি। ওদিকে সময় তো বুড়িয়েই যাচ্ছে ক্রমশই। তাই ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে মেথডলজিকাল একটা উদ্যোগ শুরু করতে চাচ্ছি, যেটা ১১ মাস ধরে চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। উদ্যোগের নাম দিয়েছি ‘ অন্তর্দৃষ্টি প্রকল্প’।
আমি পড়াশোনা করেছি মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। তার সন্নিকটেই এস,কে, গার্লস হাইস্কুল। এই দুই স্কুল থেকে ১ জন করে স্টুডেন্ট বাছাই করে উক্ত ২ জনের প্রত্যেককে আগামী ১ বছর ধরে মাসে ১৭০০ টাকা করে ‘insight appreciation grant’ হিসেবে দিতে চাই।
এই এপ্রিশিয়েশন প্রোগ্রামে প্রাথমিকভাবে মনোনীত হওয়ার শর্তগুলো এরূপ:
– ক্লাস সেভেন থেকে নিউ টেন, এই সীমার শিক্ষার্থী। বায়োগ্রাফিসূত্রে জানি, মানুষের জীবনের এই সময়টাই তার আমিত্ব নির্ধারণ করে দেয়। এই সময়ে তার দেখার জগত, ভাবনার জগতকে প্রসারিত করে দিলে তার জীবনদর্শনই রিডিফাইন্ড হয়ে যাবে।
– প্রতি মাসে গড়ে ২টা বই পড়ার অভ্যাস আছে। বই পড়ার চর্চা যার নেই তার থট প্রসেস নিয়ে কাজ করা দুরূহ।
– নিজে প্যারাগ্রাফ বা রচনা লিখতে পারে। কিংবা যে স্যারের সহায়তা ছাড়াই বইয়ের ৩৭% ম্যাথ সলভ করতে পারে। ( নিজস্বতা বা সৃজনশীলতার কিছু প্রাথমিক চর্চা থাকা উচিত)
– কারণে অকারণে প্রচুর প্রশ্ন করে। ( উত্তর দেয়া কোনো বিশেষ যোগ্যতা নয়, প্রশ্ন করতে পারাটাই মূল চ্যালেঞ্জ)
– সব বিষয়ে পাশ করে, কিন্তু ২ টার বেশি প্রাইভেট পড়ে না। ( প্রাইভেট পড়াটা একটা কালচার হয়ে গেছে, এর মধ্যে মাত্র ২টা প্রাইভেট পড়াটা একটা ক্রেডিট হিসেবেই দেখতে চাই)
– স্মার্টফোন ব্যবহার করে না।

এই শর্তগুলোর অন্তত ৩টি পূরণ সাপেক্ষে একজন শিক্ষার্থী আবেদন করতে পারবে। তারপর ডিসেম্বর মাসে আবেদনকৃতদের ইন্টারভিউ নিবো, একটা এসাইনমেন্ট দিবো, তার প্রেক্ষিতে নির্বাচিত হবে ২ জন। জানুয়ারি মাস থেকে তাদের বৃত্তি চালু হয়ে যাবে। এই বৃত্তির অধীনে তাদের ছোট ছোট কিছু টাস্ক করতে হবে বছরজুড়ে। এবং সেগুলো দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবো তাদের চিন্তাজগতে কতটুকু পরিবর্তন হচ্ছে, মানসিকভাবে তারা কতটা বিবর্তিত হচ্ছে। এক বছরে তাদের বিবর্তনের গ্রাফটা ট্র্যাক করে পরবর্তী বছরের করণীয় ঠিক করবো। আমি যেহেতু বিত্তশালী মানুষ নই, আমার পক্ষে ২-৫ জনের বেশি মানুষকে এপ্রিশিয়েট করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে আমার মেথডোলজি অনুসরণ বা মোডিফাই করে স্বাবলম্বী মানুষদের ছোট্ট একটা অংশও যদি তার স্কুলের একজন অল্পবয়েসী মানুষকে এপ্রিশিয়েট করে সেটাও একটা সিগনিফিক্যান্ট সোস্যাল রিফরমেশন হবে, এজন্য কোনো স্পন্সর, সরকারি অনুদান কিছুরই প্রয়োজন হবে না, কেবল আন্তরিক সদিচ্ছাটুকুই যথেষ্টরও বেশি। আত্মকেন্দ্রিক জীবনের চাইতে ঠাকুরগাঁওয়ে নির্বাসন নেয়া ঢের উওম।

এপ্রিশিয়েশনটা কেন জরুরী? আমরা I am GPA 5 নিয়ে ট্রল করি, বোধশূন্য প্রজন্ম তৈরির হতাশায় অক্ষরের মহাপ্লাবন ঘটাই, কিন্তু প্রজন্মের দায় পূরণে চেষ্টা কিছু কি করি আদৌ? সমস্যার সমালোচনা করা কঠিন কিছু নয়, সমালোচনায় নোবেলের ব্যবস্থা থাকলে এই খাতে বাংলাদেশের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতোই পাওয়া যেত না কাউকে, কিন্তু সমস্যার সমাধানে নিজের সামর্থ্যের মধ্যে চেষ্টা করা একটা সুতীব্র পজিটিভ ইনটেন্টের ব্যাপার, সেটা সচরাচর পাওয়া যায় কি?

আমরা গায়ক, নায়ক, মডেল,ক্রিকেটারকে এপ্রিশিয়েট করি, এমনকি ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হলেও এপ্রিশিয়েশনের অভাব হয় না, কিন্তু যারা ব্যতিক্রমী চিন্তা করে, পারিবারিক ও সামাজিক উভয়ক্ষেত্রেই তাদের যুদ্ধ করতে হয়। যাদের মেরুদণ্ড শক্ত তারা টিকে থাকে, যাদের মেরুদণ্ড কমজোরি তারা আপোষকামী হয়। একজন মানুষ ক্যারিয়ার হিসেবে যে কোনো পেশাতেই নিযুক্ত হতে পারে পরিণত বয়সে, কিন্তু ভিশন, ইনসাইট, ফোরসাইট প্রভৃতি প্রবণতাই একটি গড়পড়তা জীবনকে ম্যাক্রো লেভেলের জীবনে ধাবিত করে। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, ভোগবিলাসী সমাজকাঠামো, আর মূল্যবোধহীনতার মিডিয়া প্রভাবযুক্ত বিশ্বব্যবস্থায় একজন মানুষ যদি প্রতিনিয়ত ভোঁতা হতে হতে পিচঢালা পথের মতোই নিস্তরঙ্গ জীবনের চরিত্র হয়ে যায়, প্রজাতি বিলুপ্তির হতাশা থেকে সাময়িক স্বস্তির উপায় কী তখন!

আমার ২৩ বছরব্যাপী সহচর শুভাশিস গোস্বামী ইতিমধ্যেই আন্তরিক সম্মতি দিয়েছে এই প্রকল্পের প্রাথমিক শিক্ষার্থী বাছাইয়ের কাজটি সে করে দেবে, আমি চূড়ান্ত ইন্টারভিউ নিবো, কারণ মানিকগঞ্জে যাওয়া হয় কদাচিত, আমার এই ঘাটতিটুকু সে স্বেচ্ছায় পূরণ করে দিবে, এটাই ২৩ বছরের বড় প্রাপ্তি।

মানব গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের কিছু প্রাপ্তি এবার প্রকৃতিকে পে ব্যাক করার সময় হয়েছে। নির্বাচিত কিশোর আর কিশোরীটি সেই লক্ষ্যপূরণে কীভাবে কো অপারেট করে, অধীর আগ্রহে সেটাই পর্যবেক্ষণের প্রতীক্ষায় রইলাম।