একজন লেখকের ক্যারেক্টার সমাজের যে কোনো পেশাজীবীই। ডাক্তার-ডোম-মুচি-খুনি-আর্মি যেমন লেখকের লেখায় উঠে আসে, সেই পরম্পরায় আসতে পারে ক্রিকেটারও।
লেখক হিমালয় পাইয়ের ফিকশনাল ক্যারেক্টার– ক্রিকেটার ক্যাটেগরিতে– লিটন দাস৷ লিটনকেন্দ্রিক বিভিন্ন থিসিস বা হাইপোথিসিস লিখে সে মূলত আইডিয়া জার্নালিং করে, যাতে ১০ বছর পরে এখনকার সময়টা ধরতে সেগুলো রেফারেন্স ডেটা হিসেবে কাজ করে৷
ক্যারেক্টার হিসেবে লিটনকে বাছাইয়ের পশ্চাৎপট ছিল ২০১৭ তে সাউথ আফ্রিকার মাটিতে দেখা এক টেস্ট ইনিংস। তার আগেও তাকে দেখেছি, গুরুত্ব দিইনি। ক্যারেক্টার গড়তে গল্প ক্রিয়েট করতে হয়। আমি গল্পে অন্তর্ভুক্ত করলাম ফেসবুককেন্দ্রিক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শককে। লিটন পারফর্ম করলে মানুষজন পাচ্ছে বিচিত্র সব উপহার। স্পোর্টস বা এথলেটিক্স এর ইতিহাসেই এটা বিরল দৃষ্টান্ত হওয়ার কথা। এক-দুই সিরিজ নয়, একনাগাড়ে ৭ বছর ধরে।
টিপিক্যাল সোস্যাল পারসেপশনে যেমনটা হয়, আমাকে আখ্যায়িত করা হলো লিটনের ফ্যান। ভক্তিবাদ ঘৃণা করি, এবং টেন্ডুলকার ব্যতীত কোনো স্পোর্টস এন্টারটেইনারের ফ্যান হইনি।
লিটন যদি সামনে সিরিজের দল থেকে বাদ পড়ে, ৩ সিরিজ পরে মনেও থাকবে না লিটন নামে বাংলাদেশ টিমে কোনোদিন কেউ খেলত। পক্ষান্তরে ২ বছর আগে আমার বই যতজন পড়তো, বর্তমানে তার চাইতে বেশিজনে পড়ে, ২ বছর পরে পাঠক বাড়বে আরো। সুতরাং সময়ের সাথে সাথে আমি প্রাসঙ্গিক হব, লিটন অন্যান্য এন্টারটেইনারদের পরিণতি মোতাবেক বিবর্ণ বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। লিটনকে যদি কেউ জানতে বা বুঝতে চায়, সেও আমারই লেখা বইসূত্রে।
আপারহ্যান্ডে থাকা মানুষ কি ফ্যান হয়?
লিটন আহামরি কোনো ক্রিকেটার নয়, তবু তাকে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কেন লিখি, সেগুলো শেয়ারও হয় প্রচুর। তাতে লিটনের প্রতি যদি ৫ জন মানুষের কৌতূহল জাগে, ক্ষোভ জন্মায় ৭৩ জনের। তাদের মনে হয় সে আনডিউ প্রিভিলেজ পাচ্ছে। বাংলাদেশ দলে সবাই আন্ডারপারফরমার, ২-১টা বিচ্ছিন্ন পারফরম্যান্স যা আসে সিগনিফিক্যান্ট কিছু নয় (সাকিবের ২০১৯ বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স বাদে)।
লিটনের চাইতেও আন্ডারপারফরমার আছে অনেকেই। কিন্তু তার পারফরম্যান্সটা নজরে পড়ে। যদি সর্বশেষ টেস্টটাই রেফারেন্স হিসেবে নিই- শান্ত, দিপু, জয়, জাকির ৪ জনের আউটই অত্যন্ত ক্যাজুয়াল এবং নিম্নমানের ব্যাটিং টেকনিকের ফলাফল। কিন্তু সব আলোচনা দূরে চলে গেছে লিটনের ওই এক অদূরদর্শী শটে। আমি লিটনের ৭০ টেস্ট ইনিংসের প্রতিটি দেখেছি, গত ইনিংসের অভিজ্ঞতা আমার জন্য নতুন।
সোস্যাল মিডিয়ায় ক্রিকেট নিয়ে যারা লেখালিখি করে– যেমন শেখ মিনহাজ, তন্ময় বোস, সাদিদ, নাহিদ নেওয়াজ, ফুয়াদ ওমর— প্রায় প্রত্যেকেই লিটনের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করেছে অসংখ্য লেখায়। লাইক-শেয়ার আর কমেন্টপ্রবণ সাবস্ক্রাইবাররা হয়ত বুঝে উঠতে পারে না কেন এই প্লেয়ারটা এত এটেনশন পাবে। সঙ্গে যদি আমার অবিরাম ক্যারেক্টার জার্নালিং এবং পারফরম্যান্স ইনভেস্টমেন্ট স্কিম যোগ করা যায়, সাকিব-তামিম বা মাশরাফির চাইতেও সে অধিক পরিমাণে শব্দের বন্টন পেয়েছে, সে অনুপাতে পারফরম্যান্স নাথিং সিগনিফিক্যান্ট৷
মাঝেমাঝে তাই প্রশ্ন জাগে- লিটনের প্রতি গণক্ষুব্ধতার পেছনে আমার লেখারও বড় দায় নেই তো? তারা তো জানেও না হিমালয় পাইয়ের লেখা বইগুলোতে থাকা অন্য অনেক ক্যারেক্টারের মধ্যে লিটন দাস একজন মাত্র, তার ক্রিকেটিয় স্কিল সেখানে ঐচ্ছিক, ক্যারেক্টারের অন্যান্য লেয়ারের তুলনায়।
আজ বিসিবি প্রেসিডেন্ট পাপনের ইন্টারভিউ ক্লিপিংস প্রকাশিত হয়েছে অনলাইনে। দুটো পয়েন্ট আলাদাভাবে মনে রেখাপাত করলো
১. সে বিশ্বকাপ থেকেই লক্ষ্য করছে লিটন ছন্দে নেই৷ তারাও মনে করে লিটনকে ব্রেক দেয়া দরকার। টেস্ট থেকেও বাদ দেয়া হত। সাকিব আর মুশফিক না থাকায় তাকে খেলানো হয়েছে। ৬ বা ৭ এ লিটন যা খেলে একেবারে খারাপ নয়।
লিটন যে গত ৩ বছরে টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান করেছে, পাপনের তা অজানা থাকার কারণ নেই, কারণ ক্রিকেটারদের ডেটা সে খুব ভালোমতো মনে রাখে।
২. ক্যাপ্টেন্সি কাকে দেয়া হবে না হবে সম্পূর্ণ বোর্ডের সিদ্ধান্ত। কারো পছন্দ না হলে কিছু করার নেই।
পাপন বলা সত্ত্বেও ২য় টেস্টের দলে লিটন এলো কেন, এবং মিডিয়াকর্মীরা ক্যাপ্টেন্সি প্রসঙ্গটা কেন তুললো। কোনো কোরিলেশন কি থাকতে পারে?
ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরি।
তামিম ইকবাল আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে ১ম ওয়ানডের পরে অবসর নিলো আচমকা। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ১ দিন পরেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার, কিন্তু ক্রাইসিস মুহূর্তে ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন হলো লিটন। ম্যাচ পূর্ব প্রেস কনফারেন্স এ সব প্রশ্ন তামিমকে ঘিরে, এক পর্যায়ে লিটন বলে ‘এসব প্রশ্নের সাথে কালকের ম্যাচের সম্পর্ক কী। এগুলো উত্তর দিতে হলে কোচ বা বিসিবি প্রেসিডেন্ট আসুক, আমি চলে যাই’। তামিম ইকবাল কোরামের রিপোর্টারদের জন্য এটা ছিল ব্লাসফেমির মতো। সেই প্রেস কনফারেন্সেই একটা প্রশ্ন ছিল- অধিনায়কত্ব নিয়ে চাপে আছেন কিনা, সে উত্তর দেয়- ‘না ভাইয়া চিল মুডে আছি’
ব্যস তাকে ব্রান্ডিং করা হলো ‘চিল লিটন’ হিসেবে।
তামিম ইকবাল কোরামের রিপোর্টার বা কনটেন্ট ক্রিয়েটর টার্মটার কিছু বাস্তব উদাহরণ দিই।
১. নোমান মোহাম্মদের নট আউট নোমান চ্যানেলে তৈরিকৃত কনটেন্টের ৯০% ই বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং ক্রিকেটার নিয়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচাইতে ঘৃণ্য কাজ করেছে তামিম এবং মিরাজ নগদের প্রমোশনমূলক বিজ্ঞাপনে। নট আউট নোমানে এই বিষয়ে কোনো কনটেন্ট চোখে পড়েছে? আজ ২য় টেস্টের দল দিয়েছে, নোমানের কনটেন্টের বিষয় সাকিব এবং লিটন। সাকিব মাঠের বাইরে নানা কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত, সেগুলো থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাতে নিজ আগ্রহেই টেস্ট খেলছে— এটাই তার হাইপোথিসিস। বিশ্বকাপের আগে-পরে সাকিবকে নিয়ে যেসব কনটেন্ট সে তৈরি করেছিল এবং যে ভাষার প্রয়োগ, তা কি রুচিশীল? লিটনকে টেস্ট দলে রাখায় সে বিস্মিত। লিটনের ফর্ম নাকি এমন কিছু নয় যেজন্য তাকে ড্রপ দেয়া যাবে না৷ শেষ ৬ ইনিংসে মাত্র ১ ফিফটি, আর একটা ৪০+, এ আর এমন কি ফর্ম! আগের বছর হিসেব করলে সে তো অনেক দিন আগের কথা! এবং গত ইনিংসে লিটনের আউটটা কত বড় ব্লাসফেমি তার রেফারেন্স পোক্ত করতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রেফারেন্স! বাংলাদেশে টেস্ট টিমে কে খুব কনসিসটেন্ট পারফরমার? মমিনুল গত ১০ ইনিংসে কী করেছে? সেই পারফরম্যান্স কি লিটনের চেয়ে ভালো? চলতি টেস্টের ২ ইনিংসেই সিঙ্গেল ডিজিটে আউট হওয়া শান্ত? নোমান মোহাম্মদ তামিমের নিকৃষ্ট বদমাইশি নিয়ে কনটেন্ট বানান না, কিন্তু সাকিব কেন টেস্ট খেলছে সে সনক্রান্ত থিওরি বাজারজাত করে ফেলে দল ঘোষণার ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই। সাকিবের নাগাল পান না স্বয়ং বিসিবি প্রেসিডেন্ট, নোমান মোহাম্মদ কোন ছার! কিন্তু সাকিবপন্থী লিটন নিজের মুড সুইং আর ড্যাম কেয়ার এটিচুডের কারণে পারফরম্যান্সে কনসিসটেন্সি রাখতে পারে না, ফলে সে উলুখাগড়া হয়ে পড়ে ব্যাশিংয়ের মুখে।
২. আরিফুল ইসলাম রনি নামে বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোরে একজন সাংবাদিক আছেন। প্রথম আলো ‘সাদা বলে লিটনকে নিয়ে প্রশ্ন’ ধরনের ম্যানিপুলেটিং রিপোর্ট করায় স্ট্যাটাস লিখেছিলাম, প্রচুর শেয়ার হয়। আমার আর্গুমেন্ট ছিল টি২০ এর ফর্ম তো ভালো, এটা কি হলুদ বলে খেলা হয়। অনুমান করি অনেকেরই নজরে আসে লেখাটা। তার ঘন্টাখানেক পরে রনির একটা লেখার লিংক পাই, বলা হচ্ছে লিটনের টি২০ পারফরম্যান্সও নাকি ভালো নয়। সর্বশেষ ফিফটি কত ইনিংস আগে। টি২০ যে স্ট্রাইকরেটের খেলা, ফিফটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এ কি রনির অজানা? সর্বশেষ ৫ টি২০ তে বাংলাদেশ জিতেছে ২টিতে, দুটোতেই লিটনের সরাসরি ইমপ্যাক্ট, এবং একটা ডাক সত্ত্বেও এই ৫ ইনিংসে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান তার। কিন্তু ওই যে ম্যানিপুলেটিভ কথা-বার্তা।
একটা ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করতে পারেন। আপনি কাউকে বলেন তোমার সাথে মাত্র ১ ঘন্টা কথা বলবো৷ কিছুক্ষণ পরে বললেন তোমার সাথে ৬০ মিনিট কথা বলতে চাই। ১ এর সাপেক্ষে ৬০ এতটাই বড়, ইউনিট হিসেবে ঘন্টা নাকি মিনিট বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রেইন প্রসেস করতে পারে না।
৩. রিয়াসাত আজিম নামের রিপোর্টারের কনটেন্টগুলো চেক করুন।
আমাদের এই গল্পে শান্তও একজন গুরুত্বপূর্ণ ক্যারেক্টার।
২০২০ এ মাশরাফিকে যখন বাদ দেয়া হলো নতুন অধিনায়ক হিসেবে কোচ ডমিঙ্গো শান্তর নাম প্রস্তাব করেন। সেবছর করোনার পরে বিসিবি প্রেসিডেন্স কাপ নামে ৩ দলের টুর্নামেন্টে একটার অধিনায়কত্ব করে শান্ত। সব ম্যাচেই ফ্লপ। ২০২১ এ তামিমের ক্যাপ্টেন্সি সিরিজের ১ম ম্যাচেই সাকিবকে সরিয়ে ৩ এ খেলানো হয় শান্তকে, বলা হতে থাকে ২০২৩ বিশ্বকাপের প্ল্যান। সাকিব ফ্যানরা শান্তকে টার্গেট বানায়, এবং তার নাম হয় লর্ড শান্ত। অতি জঘন্য পারফর্ম করে শান্ত একসময় বাদ পড়ে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি মিডিয়ায় শান্তকে সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। কিন্তু তামিম-সাকিব দ্বন্দ্বে শান্ত হয়ে পড়ে ভিক্টিম। ২০২২ টি২০ বিশ্বকাপের আগে একদম ফ্রম নোহোয়ার আবারও আলোচনায় শান্ত, এবং বিশ্বকাপ টিমেও চান্স পেয়ে যায়। দুটো ফিফটি করেছিল, যদিও স্ট্রাইকরেট ইস্যু ছিলই, বিশেষত ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে লিটন যখন দ্রততম ফিফিটি করলো অপরপ্রান্তে শান্ত এক পর্যায়ে ১৯ বলে ৯ রান অবস্থাতেও খেলে গেছে। শান্তর ভাগ্য ঘুরেছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি২০ সিরিজে, আয়ারল্যান্ডের এওয়ে সিরিজে সেঞ্চুরি, টেস্টে সেঞ্চুরি এবং বছরের শেষভাগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি। এছাড়া বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জেতা ২ ম্যাচেই ফিফটি ছিল, যদিও বাকি ৬ ম্যাচেই সিঙ্গেল ডিজিট আউট যার মধ্যে দুটো গোল্ডেন ডাক!
আমার পর্যবেক্ষণ বলে বিসিবি একটা শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে। সাকিব এবং তামিমপন্থী কাউকে লিডারশিপ রোলে না বসিয়ে নিজেদের একজন মুখপাত্রকে গছিয়ে দেয়া হয়েছে। শান্ত বিসিবির আশীর্বাদপুষ্ট। শান্তর পারফরম্যান্স এতদিন ছিল প্রতিকূলে, যে কারণে তাকে সমস্ত মিডিয়া ব্যাক আপ দিয়েছে। ২০২৩ এ রান করেছে, এটার মাধ্যমে শান্তকে ২০২৫ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত অনায়াসে ক্যারি করা যাবে। এর মধ্যে কোনো না কোনো ইনিংসে সে পারফর্ম করবেই, একেবারেই ক্যালিবারহীন তো নয়।
যে কারণে তামিমপন্থী মিরাজ এবং সাকিবপন্থী লিটন—উভয়ই নানা কারণে কোণঠাসা। আপনি যদি এই ২ জনকে নেগোশিয়েসন অবস্থায় আনেন, নিজেদের মুখপাত্র শান্তকে আরো বড় দেখানো যাবে। শান্ত দুর্দান্ত লিডার, অসাধারণ ক্রিকেট মস্তিষ্ক— এসব ন্যারেটিভের উৎস কী?
সোহানকে মনে পড়ে? দারুণ মোটিভেশনাল ক্যারেক্টার, ভাই অনেকদিন বাড়ি যাই না ডায়লগ ভাইরাল; জিম্বাবুয়ে সিরিজে অধিনায়ক। আজ কোথায় সে?
ওয়ানডেতে তার যা স্ট্যাট, তাতে অনায়াসে এই ফরম্যাটে খেলতে পারত৷ কিন্তু মুশফিকের কিপিং ছাড়তে হয় বিধায় টি২০ আর টেস্টের ধোঁয়া তুলে ওয়ানডে থেকেও সে সেট আপ এর বাইরে।
লিটন আবাহনীর প্লেয়ার, গডফাদার তারও আছে নিশ্চিত। কিন্তু তার কোরামের গডফাদাররা সম্ভবত বিসিবিতে এখন কিছুটা ব্যাকফুটে আছে, যে কোরামের গডফাদাররা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের পছন্দ শান্ত। এবং মিডিয়াকে তারাই নানা ইস্যু সাপ্লাই দিয়ে পুষছে। লিটনের গল্পটাও অনেকখানি মিডিয়া ডক্টরিং, তাতে সহায়ক হয়েছে তার কুইক টেম্পারমেন্টাল ব্রেইন।
একটা রেফারেন্স দিই। সামিয়াতুল সামি নামে এক জুনিয়র বুয়েটিয়ানকে বাবল রেশিও পডকাস্টে ডেকেছিলাম। ক্রিকেট স্ট্যাট নিয়ে কাজ করে, সাকিবের ভক্ত। অফলাইন আলাপে সে বলছিল- ‘ভাই লিটনের তো খেলাধুলায় মন নাই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২য় টি২০ এর আগে সে হোটেলে ফিরেছে রাত দেড়টায়। এটা এক সাংবাদিক দেখে ফেলেছে, পরে লিটন তাকে নানাভাবে ম্যানেজ করেছে’
আমি এক প্রভাবশালী দৈনিকে কাজ করা স্পোর্টস জার্নালিস্ট বন্ধু যে ওই সিরিজ কভার করেছিল তাকে ফোন করি। সে বলে- ‘আপনার ওই জুনিয়র কি এটা জানে ক্রিকেটার আর সাংবাদিকরা থাকছে পুরোপুরি দুই হোটেলে? আর সিলেটের মতো শহরে রাত দেড়টা পর্যন্ত কী করার আছে! সে নিজে স্পটে উপস্থিত ছিল? আমিও তো আপনাকে একটা গল্প শুনিয়ে দিতে পারি, আপনি সেটাকেই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করবেন? সেকেন্ড হ্যান্ড সোর্স কেউ ব্যবহার করে! শোনেন ভাই, মিডিয়া কী জিনিস আপনার আইডিয়া নাই’!
গতকাল দেখি সেই সামি এক আর্টিকেল লিখেছে- লিটনের ডিসিপ্লিনারি ইস্যুতে কোচ সন্তুষ্ট নয়, সে গেম প্ল্যান অনুসারে খেলে না৷ এমন চলতে থাকলে সেও সাব্বিরের মতো সব ফরম্যাট থেকে বাদ পড়বে’
লিটন জাতীয় দলে খেলছে ৮ বছরের বেশি, এতদিন পরে ইস্যু হলো সে গেম প্ল্যান অনুযায়ী খেলে না? সাব্বির বিপিএল চলাকালে হোটেলে মেয়েসহ ধরা খেয়ে ১২ লাখ টাকা জরিমানা গুনেছে, মডেল নায়লা নাঈমের সাথে স্ক্যান্ডালে জড়িয়েছে, মিরাজকে পিটিয়ে শাস্তি পেয়েছে, দর্শককে পিটিয়েছে, ইলিয়াস সানিকে বর্ণবাদী গালি দিয়েছে, টিকটকের জন্য নিন্দিত—- লিটনের সাথে এর কোনটা প্রাসঙ্গিক?
সামি বুয়েটের হলে বসে কীভাবে এসব খবর পায়; সে কি কোনো পত্রিকার হয়ে সিরিজ কভার করছে? তার নিউজের সোর্স কোনো না কোন সাংবাদিক বা ক্রিকেটার; সে কি জানে তাদের মোটিভ?
অথচ সে ডেটাভিত্তিক লেখালিখি ছেড়ে নেমে পড়লো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখতে।
এই যে সামি বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট ক্রিয়েটররা ইনসাইড স্টোরি লিখছে, আমার অনুমান বিসিবির সেই প্রভাবশালী উইংয়ের ইচ্ছাও এমনটাই ছিল। সে লক্ষ্যেই বিভিন্ন রিপোর্টার পোষা, যারা গুজব বাজারজাত করবে। জিম্বাবুয়ে সিরিজে খেলাযোগ এতগুলো রিপোর্টার পাঠায় কিংবা অলরাউন্ডার নামের পেজটা স্রেফ ভিউ বা স্পন্সর থেকে কত টাকা পায় যে বিদেশে এতজন রিপোর্টার পাঠানো হয়?
কারা দেয় এই টাকাগুলো? নির্বাচক মিনহাজুল নান্নুকে যে ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে, বিনা মদদে তা সম্ভব!
আমার হাইপোথিসিস বলে লিটন অধিনায়কত্ব চায়, কিন্তু বিসিবির প্রভাবশালী অংশ তামিমের আকস্মিক অবসরের পরে লিটনের মিডিয়া হ্যান্ডলিং ইস্যুতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে।
আগুনে ঘি ঢেলেছে লিটনের স্ত্রী সঞ্চিতা। যেহেতু লিটনের সঙ্গে মিডিয়ার সমস্যা বহু পুরনো (২০১৯ এ কলকাতায় পিংক বল টেস্টের আগে কালের কন্ঠ রিপোর্ট করলো লিটন কালার ব্লাইন্ড। গত বছর আইপিএল থেকে চলে আসার পরে সমকাল রিপোর্ট করলো স্ত্রীর টানে দেশে ফিরলো লিটন), তার ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক এবং সচেতন হওয়া উচিত ছিল। সিলেক্টিভ বন্ধু-বান্ধবের বাইরে প্রোফাইল লক করে রাখা উচিত ছিল মনে করি। লিটন যেহেতু রিজার্ভ, সেক্ষেত্রে এক্সট্রিম প্রাইভেসি বজায় রেখে চলা উচিত। কিন্তু তার কনটেন্ট পাবলিক। বিশ্বকাপের সময় ২ বার দেশে আসা নিয়ে লিটন যখন সমালোচিত, সে বেবি শাওয়ারের ছবি দিচ্ছে। লোকজনও পেয়ে গেল- খেলা বাদ দিয়ে ফটোশ্যুট করে বেড়াচ্ছো। এসব ছবি পাবলিক করার মাধ্যমে সঞ্চিতা কিছু লাইকের বাইরে আদৌ কিছু পায়, নাকি লিটনের জন্য পথটা আরো জটিল করে তোলে? লাইকই যদি টার্গেট হয় লিটনকে বলো কিছু ইন্টারভিউ দিতে। রিজার্ভ অথচ কনটেন্ট পাবলিক— এ কেমনতর সেলিব্রিটি স্ট্যান্ড!
ফলে মিডিয়া এভাবেই ন্যারেটিভ ঘুরিয়ে দেয়।
আমার থিসিস বলে পাপন লিটনকে পছন্দ করে, শুধু এ কারণেই সে এখনো বহাল তবিয়তে আছে। লিটনকে টেস্টে খেলানো উচিত হয়নি, কথাটা সে বলেছে ভিউ ব্যবসায়ীদের শান্ত করতে। নইলে টেস্ট দলে লিটন থাকে!
আমার অনুমান পাপনের সঙ্গে আজ বা ২-১ দিনের মধ্যেই লিটনের একটা লম্বা বৈঠক হয়েছে। ওয়াইল্ড গেইস বলে লিটন চাচ্ছিল তাইজুলকে প্রথম ইনিংসের মতো নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নামানো হোক, সে পরদিন নামুক। কিন্তু শান্ত বলেছে আপনিই যান। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে তীব্র মনোমালিন্য হয়ে থাকারও সম্ভাবনা। ইগোসর্বস্ব ইমোশনাল ফুল লিটন সেই ক্ষোভেই মস্তিষ্ক বিকল বানিয়ে ফেলেছিল। ব্যাটিং খুবই মনোযোগের কাজ, লিটনের ADHD সমস্যা থাকলে একটুও অবাক হব না।
২০২০ এ করোনাকালে ইংল্যান্ড প্রবাসী এক তরুণের ইউটিউব লাইভে এসেছিল লিটন এবং মোসাদ্দেক। তরুণ তাদের বন্ধু। লাইভের এক পর্যায়ে যুক্ত করা হয় শান্তকে। সে তখন জাতীয় দলের অগুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। লাইভে সে মোসাদ্দেক এবং লিটনকে আপনি এবং ভাই সম্বোধন করে কথা বলছিল।
গতকাল প্রেস কনফারেন্সে দেখলাম ‘সে লিটন ভাই নয়, লিটন বলছে। উনি নয় ও’— আমাদের কালচারে সম্বোধন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ইন্ডিকেটর। এতবছর ধরে আপনি একজনকে আপনি বলে অভ্যস্ত, তারপর তার নাম ধরে কথা বলছেন— ব্যাপারটা আমাদের কালচারে অনেক বেশি আনইউজুয়াল।
আমার বক্তব্যগুলোকে ফ্যাক্ট হিসেবে দাবি করি না কখনো। বিভিন্ন সিনারিও পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে অনুমান।। এদের ফিকশনাল লেখা হিসেবে ভেবে নেয়াই সমীচীন।
পাপনের সঙ্গে লিটনের বৈঠক হওয়ার দুটো প্রেক্ষাপট থাকতে পারে
প্রথমত, গত বছর কোচ সালাহউদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন দয়া করে ড্রেসিংরুমটা সাবেক অধিনায়কের আখড়া বানিয়েন না। সাকিব আর তামিমের ইস্যুটা যেমন হয় সাকিব অথবা তামিম- এই পর্যায়ে পৌঁছেছিল, লিটন আর শান্তর কেইসটাও সেদিকে চলে যাচ্ছিল সম্ভবত। পাপন সিগনাল দিয়েছে তাদের পিক শান্ত, সুতরাং লিটন এডজাস্ট কর অথবা রাস্তা মাপো। লিটনের ওই শটের পরে মনে হতে পারে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। পাপন লিটনকে পছন্দ করে, তার কথার ধরনে মনে হয়। সাকিব-মুশফিক-রিয়াদ একসাথে ৩টা মিডল অর্ডার স্পট ফাঁকা হচ্ছে, আগামীতে লিটনকে মিডল অর্ডারে দরকার পড়বে৷ টি২০ বিশ্বকাপে তো অবশ্যই। এমনটা হতেই পারে টি২০ বিশ্বকাপ উপলক্ষে লিটনকে সে কোনো চ্যালেঞ্জ ধরিয়ে দিচ্ছে, পূরণ করতে পারলে বিশ্বকাপের পরে টি২০ দলের ক্যাপ্টেন, শান্ত টি২০ থেকে বাদ। উলটো ঘটলে সে এবছর আর ম্যাচ পাবে না, শান্তর চরম বাজে পারফরম্যান্স না আসা পর্যন্ত তাকে আর ডাকা হবে না। গত ডিসেম্বরে নোমান মোহাম্মদ এক ভিডিওতে মন্তব্য করেছিল- ‘লিডারশিপ গ্রুপ থেকে ছিটকে পড়েছে লিটন দাস। আগামীতে জাতীয় দল থেকেও বাদ পড়ে যেতে পারে’! নোমানকে এসব ইনসাইড স্টোরি কারা সরবরাহ করে? তার মানে আমরা বর্তমানে যে ফিল্মটা দেখছি তার স্ক্রিপ্ট লেখা হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই।
দ্বিতীয়ত, মুশফিককে অধিনায়কত্ব থেকে সরানোটা সে অপমান হিসেবে নিয়েছিল। পরবর্তীতে সে ঘোষণা দেয় বিসিবির তত্ত্বাবধানে চলা কোনো দলে অধিনায়কত্ব করবে না। লিটনের ক্যারেক্টার খুবই কমপ্লেক্স- সে এটিচুডে সাকিবের মতো এরোগেন্ট, প্রত্যাশা তামিমের মতো যেখানে প্রাপ্তিলোভ আর নিজেকে অনবরত ডিফেন্ড করা, কিন্তু চিন্তায় মুশফিকের মতো ইম্যাচিউর। ফলে এতটা কমপ্লেক্স ক্যারেক্টার নিয়ে সে পারফর্ম করতে খাবি খায়। পাপন হয়তবা তাকে ভাইস ক্যাপ্টেন রোল অফার করছে মিমাংসাস্বরূপ, কিন্তু সে ক্যাপ্টেন্সিই করবে।
গল্পের এই অংশে প্রাসঙ্গিক হতে পারে নাফিসা কামালও। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে তার গোল বা অবজেক্টিভ স্পষ্ট না। অক্রিকেটিয় অনেকগুলো কারণ আছে অনুমান করতে পারি৷ ক্রিকেটিয় দিক থেকে বিসিবির সাথে একটা সংঘাত থাকতে পারে। বিসিবি যখন শান্তকে সিংহাসন দিল, নাফিসা কাউন্টার হিসেবে ক্যাপ্টেন করে দিল লিটনকে। কুমিল্লা হলো রানার আপ, এখানেও লিটন ব্যর্থ।।আগামী আসরে লিটনকে যদি নাফিসা রিলিজ করে দেয়, হাই চান্স। ফলে পর্দার আড়ালে যত ঘটনাই ঘটুক লিটনের জন্য অপশন একটাই- ‘নেগোশিয়েট’!
গত বছর বিপিএল এ শান্ত সর্বোচ্চ রান করলো, তাকে নিয়ে কনটেন্টের অতিমারি। এবছর শান্ত আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ফ্লপ, তার এই ব্যর্থতা নিয়ে কোনো কনটেন্ট চোখে পড়েছে সমালোচনামূলক? পক্ষান্তরে কুমিল্লার হয়ে প্রথম কয়েক ম্যাচে লিটন আন্ডারপারফরমার ছিল, মনে হচ্ছিল বিপিএল এও তাকে বেঞ্চ করা হোক।
আমি এই ন্যারেটিভ পলিটিক্সটাই উপভোগ করি।
লিটনের সর্বোচ্চ পরিণতি আসলে কী হতে পারে? সব ফরম্যাট থেকে বাদ দেয়া। মূল প্রশ্ন হলো- ‘কতদিনের জন্য’?
পাপন এবং লিটন উভয়েই জানে ফিরতে হবেই। তাহলে তিক্ততা বাড়িয়ে লিটন নিজের ক্ষতি কেন করছে!
লিটনের জন্য আদর্শ কেইস হতে পারে বেন স্টোকস। সে ওয়ানডে থেকে অবসর নিয়ে টেস্ট এবং টি২০ খেলে। লিটনও ভাবতে পারে বিষয়টা। ২০২৭ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে কয়টা ওয়ানডে ওটুকু না খেললে এমন কিছু মিস হবে না। কিন্তু লিটন চাইলেও পাপন তাকে অবসর নিতে দিবে মনে হয় না।
নেগোশিয়েসনে যাও লিটন, কেবল পারফর্ম দিয়ে খেলে যাওয়ার হেডম বা মুরোদ কোনোটাই তোমার নেই। সাকিব বাদে অন্য মিডিওকর বা বিলো এভারেজগুলো যেমন গডফাদারের কৃপায় খেলে গেছে ৪০% পারফর্ম করেই, তোমার ক্যালিবার তাদের চাইতে একরত্তিও বেশি নয়। সুতরাং মচকাও, তবু ভেঙ্গো না।
গল্পে আরো কিছু দৃষ্টিকোণ যুক্ত হোক। ওয়াহিদ ইবনে রেজা নামের এক অভিনেতা, যিনি হুমায়ূন আহমেদের নাটকে ভাড়ামি করতেন, বর্তমানে হলিউডে কাজ করেন, তিনি গতকাল স্ট্যাটাসে লিটনকে ৩ বেলা জুতার বাড়ি দেয়ার বিধান দিয়েছেন।
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ তার সাথে সহমত। যে কোনো কালচারে জুতার বাড়ি সবচাইতে অপমানজনক শাস্তি। সালিশে অপরাধীকে কান ধরে উঠবস করানো হয় অথবা জুতার বাড়ি দেয়া হয় অথবা জুতার মালা গলায় হাঁটানো হয়। আপনি যে কোনো উপাসনালয় বা এরিস্টোক্রেট জায়গায় যাবেন, জুতা খুলে প্রবেশ করতে হবে। আপনি আমার হাত ধরে ক্ষমা চাইলে সেটা অক্ষমতা, কিন্তু পা ধরলে আপনার জন্য চরম অবমাননাকর। ২০০৩ এ বাংলাদেশ-সাউথ আফ্রিকার ম্যাচ চলাকালে গ্যালারি থেকে খালেদ মাহমুদ সুজনের উদ্দেশে জুতা প্রদর্শন করা হয়েছিল৷ এরপরে বাংলাদেশের বহু খেলোয়াড় বাজে খেলেছে, তামিম-মিরাজের মতো কলংক ঘটেছে, কেউ জুতা পায়নি। কিছু ভুইফোঁড় পেজ করে থাকতে পারে, ওয়াহিদ ইবনে রেজার মতো সমাজের আপার ক্লাস্টারের কেউ জুতার প্রসঙ্গ আনলো, এটা প্রথম। মানুষ এতটাই ক্ষুব্ধ কালচারালি চরম এবিউসিভ এবং অফেন্সিভ স্টেটমেন্টও নরমালাইজ হয়ে গেছে।
সুতরাং ইগো কোতোয়াল (নট সম্রাট) লিটন, either go for negotiation, or do gardening at your roof top, choice is yours!