সাপ, কুকুর, পাগল,ক্রিমিনাল। যখনই সামাজিক মানুষ আপনার সঙ্গে মেলামেশায় অস্বাচ্ছন্দ বোধ করছে বা আপনার প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিচ্ছে, নিশ্চিত থাকুন তাদের অভ্যন্তরীণ সংবিধানে আপনি উল্লিখিত ৪ শ্রেণির কোনো একটাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, চক্ষুলজ্জার কারণে যথাযথ শ্রেণিটি জানানো হচ্ছে না কেবল।
একটা জেলা যখন ক্ষমতার দাবা খেলায় নাইট, বিশপ, ক্যাসল হয়ে উঠতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, সামান্য সৈন্য হয়েই খেলা শেষ করে এই প্রহেলিকায়, শেষ ধাপটি পেরুলেই পদোন্নতি পাবে কুইনে, তার পেছনে থাকে চিরায়ত ঐতিহ্য, স্থানীয় রাজনীতি, স্থাপনযোগ্য পর্যাপ্ত দৃষ্টান্ত, এবং বিক্রিযোগ্য রিসোর্স, এই ৪ অনুঘটকের সক্রিয়তা অথবা নিষ্ক্রিয়তা।
৪ অনুঘটকের প্রভাবে তৈরি হয় জনশক্তি, যার পরিশীলিত নাম ‘হিউম্যান ক্যাপিটাল’
যে কোনো ব্যক্তি একক বা সম্মিলিতভাবে হিউম্যান ক্যাপিটাল হিসেবে এসেট নাকি লায়াবিলিটি বাড়াচ্ছে তার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় তার রেডিয়াসে থাকা স্থলভূমির ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ!
এই থিসিসটাই বাস্তবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ মিললো মানিকগঞ্জ এবং কুমিল্লা জেলার দুটো গ্রামে যুগপৎ পরিদর্শন করায়।
ঢাকা থেকে ঠাকুরকান্দি গ্রামের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলো, ব্যক্তিগত গাড়িতে পৌঁছুতে লাগবে ২ ঘন্টা বড়জোর।
কুমিল্লার মহালক্ষ্মীপাড়া গ্রামের দূরত্ব ১২৫ কিলো। ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের মতো রাস্তা তৈরি হয়নি বেশ কিছু অংশে, যে বাড়িতে যাওয়া পড়েছিল, গাড়ি রেখে আসতে হয় অনেকটা দূরে, তারপর অটো অথবা পায়ে হাঁটা।
আদর্শ গ্রামের মডেল বা রেফারেন্স হিসেবে যখনই ঠাকুরকান্দির পাশে টিক চিহ্ন বসাতে যাবেন, বোধ করবেন কেউ বলছে- মস্ত ভুল!
কুমিল্লার মহালক্ষ্মীপাড়া গ্রামে থাকাকালীনই স্থির হয়েছিল ঢাকা পৌঁছেই ভোরে রওয়ানা হব ঠাকুরকান্দিতে।
মহালক্ষ্মীপাড়াতে অবস্থানকালে আপাত নির্বোধ অথচ মৌলিক এক জিজ্ঞাসা উদিত হয় মনে। মহালক্ষ্মীপাড়া কেন গ্রাম এবং কুমিল্লা কেন শহর?
অর্থাৎ কী কী শর্তের কারণে একটি অঞ্চলকে আমরা গ্রাম বলি, কোনটিকে নগর; কেবলই কি ফ্যাসিলিটির ভিন্নতা?
মহালক্ষ্মীপাড়ার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যদি বেড়ে যায়, নির্মিত হয় শপিং মল, সিনেপ্লেক্স, গড়ে উঠে কোম্পানি— তখনো কি সে গ্রামই থেকে যাবে, নাকি তাকে দেয়া হবে শহরের স্বীকৃতি।
সংশয়টা জারি রেখেই কথা বলি এক অগ্রজের সঙ্গে। তার অভিমত যেখানে আবাদযোগ্য কৃষিজমি আছে সেটাই গ্রাম; ফ্যাসিলিটি বাড়তে পারে ক্রয়ক্ষমতার অনুপাতে।
তার সংজ্ঞায়নে গ্রাম বুঝলেও শহর এবং উপশহরের আইডেন্টিটি রয়ে যায় অস্পষ্টই।
গ্রামের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত ঠাহর করতে পারি না৷ তবে এটা বুঝি হিউম্যান ক্যাপিটালের গ্রোথ না হলে ফ্যাসিলিটিও আহামরি বাড়ে না।
সকল অনুঘটক হয়ে পড়ে স্থবির।
কুমিল্লা বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ জেলা। মানিকগঞ্জ রাজধানীর অন্যতম নিকটবর্তী জেলা হওয়া সত্ত্বেও এখানকার হিউম্যান ক্যাপিটাল আদৌ কি গ্রো করলো?
হরিরামপুর উপজেলাকে ব্যতিক্রম ধরলে অন্য উপজেলাগুলো রাজধানীর নিকটবর্তীতার সুযোগ ম্যাক্সিমাইজ করতে পেরেছে কি?
সবগুলো উপজেলা পরিব্রাজনের প্রেক্ষিতে আমার উত্তর না-সূচক।
ঠাকুরকান্দি আমার নানুবাড়ি। তবে ২০০৩ এর পরে সর্বশেষ ২০ বছরে যাওয়া পড়লো মাত্র ৪র্থবার, রাত্রি যাপন করা হলো ২০১৪ এর পরে প্রথম। আমাদের শৈশবে ইলেকট্রিসিটি ছিল না, রাস্তা অতি বাজে, ঘিওর থেকে মনে হতো ৫০০ মাইল দূর।
এবার ঘিওর থেকে অটোরিকশায় উঠলাম, ১০ টাকা ভাড়ায় নামিয়ে দিল মামাবাড়ির সামনে। গ্রামে পৌঁছে গেছে ওয়াইফাই।
শৈশবে দেখতাম গ্রামটা নিয়ন্ত্রণ করে কয়েকটি পরিবার। তাদের ছেলেরা সকালে ঘিওর বাজারে যায়, দোকানে বসে চা খায়, জমি বিক্রি করে। তাদের অনুসারিরা বসে তাস-জুয়া খেলে, বিকেলে মাঠে ক্রিকেট-ফুটবল৷ আমার মায়ের এক আত্মীয় নিজেকে পীর ঘোষণা করেছিল। জ্বিন চিকিৎসা, বান মারা, তাবিজ-কবজ প্রভৃতির মাধ্যমে করতেন জীবিকা নির্বাহ। তার ছিল অনুসারিও।
ঘিওর ডিএন স্কুলে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পড়তো কেবল পড়তে হয় বলেই। বুয়েট-মেডিকেল বা প্রথম সারির পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ে এমন কারো কথা শুনিনি। আগের প্রজন্মে পড়েছে কেউ কেউ। এমনকি প্রবাসির সংখ্যাও খুব বেশি নয়।
ফলে শিশু বয়সেই ঠাকুরকান্দি গ্রাম আমার কাছে ছিল পরিত্যক্ত ছিটমহল।
এত বছর পরে সেখানে ফিরে মামাতো ভাইকে জিজ্ঞেস করি তুই জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হয়েছিলি ২০১০ এ, পরের ১৩ বছরে এই গ্রাম থেকে কয়জন ছেলে-মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হয়েছে জানা।
তার জানামতে একজনও না!
মামার থেকে শুনলাম গ্রামের ভোটার সংখ্যা ১২০০ এর অধিক!
পরিসংখ্যানটা শোনামাত্র ঢালাই রাস্তা, ওয়াইফাই কে আলেয়া মনে হতো লাগলো। ২০ বছর আগেও হিউম্যান ক্যাপিটাল যা ছিল, একরত্তিও হয়নি গ্রোথ!
এই গ্রামের অর্থনীতির ভিত্তি কি তবে!
অথচ মাত্র ৮০ কিলো দূরত্ব। বিত্তশালীরা প্রচুর জমি কিনে রিসোর্ট অথবা ফ্যাক্টরি গড়বে, এখানকার ছেলে-বুড়ো সেখানে সস্তাশ্রম বিক্রি করবে, এটাই কি ভবিষ্যৎ?
কথাপ্রসঙ্গে জানলাম মায়ের সেই স্বঘোষিত পীর আত্মীয় প্রয়াত হলেও তার নাতি পেয়েছে উত্তরাধিকার। শনি এবং মঙ্গলবারে তার বাড়িতে বসে উরশ।
তার বাড়িতে যাই। ধাতু দুর্বলতা, পরকীয়া ছোটানো, জ্বীন ছাড়ানো, শত্রু বশীকরণ— বহুরকম চিকিৎসা সে করে থাকে। অত্যন্ত কনফিডেন্টলি বলে দিলো- ‘এভাবে আমাকে বুঝবেন না। আমাকে ভুল প্রমাণ করতে হলে অন্তত ২০ জন রোগি যোগাড় করতে হবে যারা আমার কাছে এসে প্রতারিত হয়েছে। ১ জনও পাবেন না। আগামী ১ মাসের মধ্যে টাকা-পয়সা নিয়ে আপনার সঙ্গে ১ জনের ঝামেলা বাঁধবে, নম্বর নিয়ে যান আমার, ফোন করিয়েন তখন’!
ফিরতি পথে মনে পড়ে আগেরদিনই ছিলাম মহালক্ষ্মীপাড়ায়। সেখানেও বাড়িতে বাড়িতে ওরশ হয় শুনলাম। ভোটার প্রায় ৮ হাজার। কিন্তু মূল পার্থক্যটা হিউম্যান ক্যাপিটালে। সেখানে প্রচুর সংখ্যক প্রবাসী যেমন, অনুরূপ ভার্সিটি বা মেডিকেলে পড়ুয়াও অসংখ্য। গ্রামের মধ্যে কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি চোখে পড়লো বেশ কয়েকটি। ফুটবল এবং ভলিবল টুর্নামেন্ট চলছে।
ঠাকুরকান্দি গ্রামের একমাত্র মাঠটিতেও দেখলাম মাশকলাই বোনা হয়েছে। দোকানের সামনে ক্যারম বোর্ড খেলা চলছে ধুন্ধুমার, গ্যালারির মতো করে দর্শকের ভিড়, খেলোয়াড়রাও দুর্দান্ত স্কিল্ড, কেউ ২ বারের বেশি স্ট্রাইক পাচ্ছে না, তার মধ্যেই খেল খতম। জানলাম ক্যারম খেলাতেও আর্থিক বাজি ধরা!
অথচ হতেই পারত ক্যারম টুর্নামেন্ট!
হিউম্যান ক্যাপিটাল কোথাও বাড়ে, কোথাও লায়াবিলিটিতে দেউলিয়া দশা!
তার পরিণতি ভোগ করতে হয় বংশানুক্রমে। বাংলাদেশের গ্রামগুলোর মধ্যে ঠাকুরকান্দিকে প্রতিনিধিত্বকারী বেশি, নাকি মহালক্ষ্মীপাড়া? ২য়টিকে আমি কোনো মডেল ধরছি না, তবে ঠাকুরকান্দির সাপেক্ষে হিউম্যান ক্যাপিটাল সূচকে নি:সন্দেহে মডেল!
অনুমান করছি, সমগ্র বাংলাদেশেই ‘ঠাকুরকান্দি ভাইরাস’ সংক্রমিত হয়েছে।