একজন ব্যাটসম্যান টেস্টে ১০ ইনিংস টপ অর্ডারে ব্যাট করে সর্বোচ্চ স্কোর যদি হয় ৩৩, সেই একই ব্যাটসম্যান ৫ থেকে ৮ নম্বর পজিশনগুলোতে ১৬ ফিফটি ৩ সেঞ্চুরি করলে দুটো অনুমান অবধারিতভাবেই তৈরি হয়
প্রথমত, ব্যাটসম্যানটি নতুন বলের মুভমেন্ট আর সুইংয়ে অস্বস্তিতে ভুগে, তবে মিডল অর্ডারে নামলে সে আমূল বদলে যায়।
দ্বিতীয়ত তার মনোসংযোগের ঘাটতি রয়েছে, যে কারণে কনভারশন রেট সন্তোষজনক নয়।
এই দুটো ইমপ্রেসনকে আমলে নিলে ওয়ানডে ফরম্যাটেও তাকে মিডল অর্ডারে খেলতে দিলে বেটার আউটপুট আসবে। টি২০ যেহেতু মাত্র ১২০ বলের খেলা, সেখানে এক্সপেরিমেন্ট করাই যেতে পারে।
টেস্টে মিডল অর্ডারে খেলে ওয়ানডেতে ওপেন করা কেইস প্রচুর। টেন্ডুলকার আর মার্কওয়াহ এই ধারায় সর্বাধিক জনপ্রিয়। তবে হাশিম আমলা, জনি বেয়ারস্টো, কালুভিথুরানা, গিলক্রিস্ট, জয়াবর্ধনে সহ অনেকেই এই রোল পালন করেছে।
লিটন দাস কেমন ব্যাটসম্যান?
২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি দেখে সাময়িক প্রত্যাশা জন্মেছিল আমরা একজন টপ লেভেলের ব্যাটসম্যান পেতে যাচ্ছি। ২০২০ এ পাকিস্তান সফরের পরে উপসংহারে পৌঁছাই- ‘ভুল ভেবেছিলাম’
তবু লিটন রান করলে খরচ কেন করি?
অনলাইনের অসংখ্য লোকজন ধরেই নিয়েছে আমি লিটনের শ্রেষ্ঠত্ব আশা করি অথবা তাকে সেরা মনে করি।
লেখকেরা রিয়েলিটিকে রিক্রিয়েট করে। রিয়েলিটির অবিকল বয়ান মূলত প্রতিবেদকের কাজ। লিটন ক্যারেক্টারের মধ্যে নানা বর্ণের লেয়ার পেয়েছিলাম যা তাকে রিক্রিয়েট করার অবকাশ দিয়েছে। অবশ্যই তার ব্যাটিং এখানে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল শুরুতে, তবে একটা সময়ের পর থেকে এথলেটের চাইতে তার ফিলোসফিকাল অন্তর্জগতের প্রতি অধিক আগ্রহ জন্মে।
যে কোনো স্পোর্টস নিয়ন্ত্রণ করে বিজনেস মাফিয়ারা, তাদের মোসাহেবের দায়িত্বে থাকে মিডিয়া হাউজগুলো।
বাংলাদেশে এই ডায়নামিক্সটা কাজ করে অন্যভাবে। ফেসবুক আমাদের ভ্রম বাবলের ভেতরে ঠেলে দেয়, সেই বাবল ক্রমাগত ভুল পারসেপশন তৈরি করে।
দুটো সুনির্দিষ্ট রেফারেন্স দেয়া যেতে পারে-
প্রথমত, বাংলাদেশের উপজেলা শহর এবং গ্রামগুলোতে যদি এক নাগাড়ে পরিব্রাজনের সুযোগ ঘটে, এবং সেখানকার যুবক এবং মাঝবয়সী পুরুষের সঙ্গে ক্রিকেট বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পান, দেখবেন তাদের বড় অংশই মনে করে ভারত ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশকে জিততে দেয় না। সবচাইতে জনপ্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি, কারণ সে দিলখোলা প্রকৃতির। সাকিবের টাকার অহংকার বেশি। মাশরাফি, সাকিব, আশরাফুল, তামিমের বাইরে পরের প্রজন্মের ক্রিকেটাররা তাদের আগ্রহ জাগায় না, মুস্তাফিজকে চিনে কারণ সে আইপিএল এ খেলে। —- এই ন্যারেটিভের একটা পলিটিক্যাল আবেদন রয়েছে। মফস্বল আর শহুরে নাগরিকতার যে ন্যারেটিভ তারা ওই ম্যাস রিয়েলিটির কাছে নস্যিমাত্র। একারণেই তামিম বা মাশরাফি স্পোর্টস ছাপিয়ে রাষ্ট্রীয় ইস্যু হয়ে উঠে।
দ্বিতীয়ত, অন্য অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যারা ক্রিকেট খুব সিরিয়াসলি দেখার সময়-সুযোগ পান না, তারাও ক্রিকেট নিয়ে দীর্ঘ লেখালিখি বা বক্তব্যের মাধ্যমে অবচেতনভাবেই ন্যারেটিভ তৈরি করেন। তাদের উপাত্তের উৎস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ম্যাচ হাইলাইটস, কিংবা ক্রিকইনফো, বড়জোড় কিছু রিপোর্টিং; কিন্তু যেহেতু তারা অন্য অঙ্গনে পরিচিত, তাদের বক্তব্যকে ফেলনা ভাবতে পারে না প্রিভিলেজড বাবলে থাকা মানুষের বৃহদাংশ। যেমন অধ্যাপক আসিফ নজরুলের একটা টকশো ক্লিপিং পাওয়া যায় ইউটিউবে, যেখানে তিনি নাসির কেন জাতীয় দলে নেই এই ইস্যুতে বিসিবি প্রেসিডেন্ট পাপনের সমালোচনা করতে করতে সেখানে পলিটিক্যাল ফ্লেভার যুক্ত করে দেন৷ সম্প্রতি তামিম ইকবালের অবসর পরবর্তীতে সমালোচনা লিখেছেন ফাহমিদুল হক নামের আরেক অধ্যাপক। স্পোর্টস নিয়ে লিখতে স্পোর্টস পেশাতেই থাকতে হবে বলছি না, তবে লেখা পড়ে যদি নিশ্চিত হওয়া যায় খেলা নিয়মিত দেখা বা খোঁজ রাখা হয় না, তখন মোটিভ বা লেখকের ইন্টারেস্ট নিয়ে প্রশ্ন জাগে।
আমাদের বাবলের বাইরে যে রিয়েলিটি সেটাই আদতে ক্রিকেট মার্কেট, এবং সেখানে ষড়যন্ত্র, জুয়া, ভক্তিবাদ আর উগ্রবাদীতাই স্পোর্টস ফ্যান্ডমের মৌলভিত্তি!
লিটনের ৮-২=৬ বছরের সক্রিয় ক্যারিয়ারে আইকনিক কোনো মুহূর্ত তৈরি হয়নি, যা তাকে বাবলের বাইরে থাকা ম্যাস জনগোষ্ঠীর কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে।
ভাগ্য ৩ বার খুব কাছে নিয়ে প্রবেশপথে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
-২০১৮ এর এশিয়া কাপ ফাইনালটাতে মাত্র একজন ব্যাটসম্যানও যদি তাকে সঙ্গ দিত বাংলাদেশ ফাইটিং স্কোর তুলতে পারত, হয়তবা জিতেও যেত। প্রথম কোনো বড় টুর্নামেন্ট জেতা, তাতে সেঞ্চুরি, লিটন ঢুকে পড়তো ম্যাসের অন্তরে।
– ২০২২ টি২০ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ২১ বলে ফিফটি করা ইনিংসটার পরিসমাপ্তি যদি না ঘটতো অদ্ভুতুড়ে রান আউটের মাধ্যমে?
-২০২১ টি২০ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ডোয়াইন ব্রাভোকে মারা শটটা ছক্কা হয়ে গেলে দর্শক সেই মুহূর্তটাকে মনে রাখতো দীর্ঘদিন।
বরং ভাগ্য লিটনের আইকনিক মুহূর্ত বানিয়েছে শ্রীলংকার বিপক্ষে ক্রুশিয়াল মুহূর্তে ২ লোপ্পা ক্যাচ মিস করে দল হারিয়ে দেয়া।
লিটনের প্রতি ম্যাসের ক্ষোভ কি অযৌক্তিক?
আমি বলবো শতভাগ যৌক্তিক।
প্রথমত, সফট ডিসমিসাল দেখতে সবারই বিরক্ত লাগে। লেগসাইডে একটা ফিল্ডার থাকলেও আপনি তাকেই ক্যাচ দিবেন, ৫ম বা ৬ষ্ঠ স্ট্যাম্পের বল পুল করতে গিয়ে টপ এজড হবেন বা মিড অফ দিয়ে ওভার দ্য টপ খেলতে গেলেই ক্যাচ দেবেন— দিনের পর দিন দর্শক এটা সহ্য করার কারণ দেখি না৷ লিটনের চাইতেও বিশ্রি সফট ডিসমিসালের দৃষ্টান্ত নিয়মিত স্থাপন করে সাকিব। কিন্তু সেগুলো মনে রেখাপাত করে না, কারণ আউট হওয়ার আগে সাকিব কিছু না কিছু রান করে। লিটনের ক্ষেত্রে এটাই বড় প্রতিবন্ধকতা। লিটন তার ৭২ ইনিংসের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রায় ৪০% ইনিংসে আউট হয়েছে ২০ বল খেলার আগেই। একজন টপ অর্ডার যদি ২০ বল টিকতে না পারে ম্যাচের পরে ম্যাচ, এবং সফট ডিসমিসালের শিকার হয়, দর্শক নিজের বাপ-মা হলেও ক্ষুব্ধ হবেই।
টেস্টে সে মিডল অর্ডারে ব্যাট করে, এই সমস্যায় ভুগতে হয় না। টি২০ তে একটাই গিয়ার, তাই কোনো কোনো ম্যাচে ক্লিক করে যায়। তার যাবতীয় কনফিউশন ওয়ানডে! ৭২ ইনিংসের মধ্যে ৫০+ ইনিংস সংখ্যা মাত্র ১৫!
তাতেও দর্শক ক্ষমা করে দিত যদি ২৫ থেকে ৪০ এর ঘরে ইনিংসের সংখ্যা বেশি হত। আমাদের দর্শকদের প্রত্যাশা বার ওটকুই৷
কেউ যদি নিয়মিত ২৫-৩৫ করে আউট হয়, চোখে পড়বে না, সিঙ্গেল ডিজিট বা ১০-১৫ করলে সে শেষ!
লিটনও বুঝে গেছে এই ফ্যাক্ট। তাই যেনতেনভাবে ২০-২৫ বল টিকবার চেষ্টা করে, ততক্ষণে পাওয়ার প্লে প্রায় শেষ। ২০-২২ বল খেলে রান ৬ বা৭! পরে অবশ্য স্ট্রাইক রোটেট বা বাউন্ডারি মেরে ৩৭ বলে ৩০ জাতীয় চেহারায় উন্নীত করতে পারে। তার ইনিংস দেখলে এখন আপনি অনুমান করতে পারবেন কেমন পারফর্ম করবে-
১. ইনিংসের প্রথম ৭-৮ বলের মধ্যে যদি একাধিক বাউন্ডারি পেয়ে যায়, প্রবল সম্ভাবনা আছে ২০ এর আশপাশে আউট।
২. প্রথম ৮-৯ বলের মধ্যে যদি একাধিক সিঙ্গেলস এবং পরের ৩-৪ বলে বাউন্ডারি আসে, সেটাই তার অপটিমাম রিদম। ধরে নেয়া যায় অন্তত ৪০+ করবে।
৩.যদি ইনিংসের প্রথম ২ ওভারের মধ্যে অন্তত ৩-৪ বল খেলার সুযোগ না পায় সেদিন তার সিঙ্গেল ডিজিটে আউট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
৪. যদি প্রথম ৭-৮ বলের মধ্যে বাউন্ডারি শট খেলে, কিন্তু গ্যাপ বের করতে না পারে সেদিনও হবে না।
একজন মানুষ এত বেশি প্রেডিক্টেবল হওয়া সম্ভব নয়, তবে স্যাম্পল সাইজ বড় হলে কিছু প্রবণতা অনুমান করা যায়।
লিটনের সোশ্যাল মিডিয়া বাবল তৈরি হয়েছে মূলত কয়েকজন ক্রিকেট রোমান্টিকের কৃপাদৃষ্টির প্রেক্ষিতে।
তার ব্যাটিংয়ের ধরন, রানিং তাদের আশাবাদী করে তোলে, তার প্রেক্ষিতে তৈরি হয় কনটেন্ট। যেহেতু লৈখিক কনটেন্টের নিজস্ব শক্তিমত্তা থাকে, সে ছড়িয়ে পড়ে ওয়েব জালে, সেখান থেকে সাবস্ক্রাইবাররা প্রত্যাশার ফানুস নির্মাণ করতে থাকে, এবং ধাক্কা খায়!
সেই ক্রিকেট রোমান্টিকদের মধ্যে কি আমিও একজন, যেহেতু তাকে নিয়ে সবচাইতে বেশি লেখালিখি আমিই করেছি?
২০২০ পাকিস্তান সিরিজের পরে কোনোদিন লিখিনি লিটন ক্যাপাবল ব্যাটসম্যান, সে আমার বইগুলোতে ক্যামিও চরিত্র হিসেবে থাকে, তাই তার প্রতি আলাদা দৃষ্টি রাখি। নইলে সেও এতদিনে একজন তামিম ইকবাল বা ইমরুল কায়েস হয়ে যেত আমার কল্পজগতে।
লিটন খুব ক্যাপাবল ব্যাটসম্যান নয় মেনে নিলাম৷ কিন্তু ফরম্যাটভেদে ব্যাটসম্যানশিপ প্রশ্নে যদি তুলনায় যাই?
টি২০ তে সে অবধারিতভাবেই এযাবৎকালের সেরা।
ওয়ানডেতে সাকিব তার চাইতে অনেক এগিয়ে। মুশফিকও যা যা করেছে ক্যারিয়ারের বাকি অংশে সে পারবে মনে হয় না। তবে তামিমের চাইতে অবশ্যই এগিয়ে।
টেস্টে তামিমের মতো ইমপ্যাক্ট সে তৈরি করতে পারেনি। মমিনুলের পর্যায়ের কনভারসন রেটও নেই। মুশফিক অবসর নিলে ব্যাটিং অর্ডারে উপরে উঠার পরে কতটুকু কী করতে পারে দেখার অপেক্ষায়। আমার এসেসমেন্ট অনুসারে টেস্টে সে তামিমের চাইতে পিছিয়ে থেকেই ক্যারিয়ার শেষ করবে।
তার মানে সামগ্রীক বিচারে টি২০ ব্যতীত বাকি ২ ফরম্যাটে তার প্রথম ২ অবস্থানে আসার সম্ভাবনা অতি নগণ্য।
তাহলে আর লিটনকে এত রেইট করে ফায়দাটা কী হলো! সম্ভবত সেকারণেই লিটনকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখানোটা ম্যাস দর্শকের চোখে আদিখ্যেতা মনে হয়।
যদি তাকে স্পেশাল কেইস হিসেবেও নিই, সেখানে তার চাইতে অনেক ব্যবধানে এগিয়ে আছে আশরাফুল! অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি, কার্ডিফ, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০০৫ এ ৫২ বলে ৯৪, ভারতের বিপক্ষে টেস্টে ১৫৮, সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই ৮৭, টি২০ তে উইন্ডিজকে ২৭ বলে ৬১ করে হারিয়ে দেয়া, ৪৭ ম্যাচের জয় খরা ঘুচানো ম্যাচে ৩১ বলে ৫০!—- লিটন সেখানে কোথায়!
সংখ্যার মারপ্যাচে আপনি পিছিয়ে, স্পেশাল শ্রেণিতেও আপনি প্রতিদ্বন্দ্বীতার বাইরে; তাহলে কেন আপনি এত ফুটেজ পাবেন?
কংক্রিট রিয়েলিটিতে এই প্রশ্নের কনভিন্সিং উত্তর কোনোভাবেই দিতে পারবেন না। এই পোয়েটিক আনএবিলিটিই লিটনকে ক্রিকেটারের চাইতে ক্যারেক্টার হিসেবে রিকনস্ট্রাক্ট করে!
তামিম তার ক্যালিবারের পূর্ণ ব্যবহারে ব্যর্থ হলো দুর্বল ফিটনেসের কারণে, লিটনের ক্ষেত্রে সেটা টেম্পারমেন্টের অভাব।
তুচ্ছ সব কারণে সে মেজাজ হারায়৷ একটা শট গ্যাপে প্লেস করতে না পারলে হতাশ হয়, টাইমিং না হলে-স্লেজিং করলে, এমনকি ২ রানের জায়গায় ১ রান নিলেও। ফলে মনোসংযোগ তার জন্য চ্যালেঞ্জ সবসময়ই।
এটাও উতরানো সম্ভব হত যদি তার ক্রিকেট ফিলোসফি উপমহাদেশিয় কালচারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হত।
নিউজিল্যান্ড বা সাউথ আফ্রিকায় ক্রিকেট ১ নম্বর খেলা নয়, যে কারণে ক্রিকেটটা তাদের কাছে নিছক বিনোদন, একে জীবন-মরণ ইস্যু বানায় না; হুট করেই অবসর নিয়ে বসে।
লিটনকে পর্যবেক্ষণ করে আমার অনুমান, তার ক্রিকেট ফিলোসফি হয়তবা নিউজিল্যান্ড ঘরানার নয় পুরোপুরি, তবে একটা উল্লেখযোগ্য অংশে মিলে যায়। যে কারণে পারফর্ম করলে অতি উচ্ছ্বাস যেমন দেখাবে না, খারাপ খেললেও ধরণী দ্বিধা হওয়ার অনুভূতি দেখাবে না। রান আজ পাব, অন্যদিন পাব না, একসময় টানা খারাপ খেলব, তখন বুঝে নিতে হবে দিন ফুরিয়ে এসেছে— এই যে অতি বাস্তববাদী মনোভাব, এটাই এখানকার কালচারে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
এর সর্বশেষ ক্লাসিকাল উদাহরণ আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২য় ওয়ানডে পূর্ব প্রেস কনফারেন্স। সাংবাদিক প্রশ্ন করেছে- ‘অফ ফর্ম নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে কিনা’
তার উত্তর- ‘ফর্ম কী ভাই?
সাংবাদিক জানায়- শেষ ১০ ইনিংসে গড় ২৫-২৬, তার পালটা মন্তব্য- ‘আপনি কত হলে খুশি? প্রতি ম্যাচে ফিফটি করতে হবে! ২৫-২৬ তো খারাপ না, ৩ ফরম্যাটেই যেহেতু খেলি, কোনো একটা ফরম্যাটে তো খারাপ যেতেই পারে’
আলাপের এসেন্স ছিল ৩ ফরম্যাট খেললে ১ ফরম্যাটে আন্ডার পারফর্ম হতেই পারে, তাতেই অফ ফর্ম বলা যায় না।
আর্গুমেন্টটা হতে পারত তার ফর্ম সংক্রান্ত ভাবনা বিষয়ে। কিন্তু প্রতিটি মিডিয়া মন্তব্যের খন্ডিতাংশ সর্বত্র যেভাবে প্রচার করলো তাতে ন্যারেটিভ তৈরি হলো সে ২৫-২৬ গড় নিয়ে সন্তুষ্ট!
এই যে উস্কানিমূলক ন্যারেটিভ, এটা কি ইচ্ছাকৃত?
আমার অভিমত, হ্যাঁ৷ সাকিবের এরোগেন্স কিংবদন্তীতুল্য, সেই সাকিবও প্রথম আলো নামের মাফিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলে। আশরাফুল, মাশরাফি, তামিম, মুশফিক প্রত্যেকেই মিডিয়াবান্ধব হিসেবে বিদিত।
কিন্তু লিটন বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার, যে কোনোরকম মিডিয়াবাজির সঙ্গে জড়িত নয়৷ এরকম একজন প্লেয়ার স্পটলাইটে থাকলে মিডিয়ার জন্য কিছুটা অসুবিধাজনক। সেদিক থেকে মিরাজ, তাসকিন, শান্ত এই ৩ জন অনেক বেশি কমিউনিকেটিভ এবং মিডিয়ানুকূল। সুতরাং লিডারশিপ রোলে লিটনকে আমরা দীর্ঘমেয়াদে দেখব না, এটা অনেকটাই নিশ্চিত। মিরাজ অধিনায়ক হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র!
আমি মিরাজের পারফরম্যান্সকে খাটো করছি না। অধিনায়ক সে হতেই পারে। তবে সেখানে ক্রিকেটিয় ব্রেইন বা পারফরম্যান্সের চাইতে উপমহাদেশিয় কালচারে সে অধিকতর ফিট, এবং মিডিয়া প্রশ্নে দিলখোলা– এটাই তার জন্য প্রথম ক্রাইটেরিয়া হয়ে উঠবে।
বরং লিটনের ক্যারিয়ার থেমে যেতে পারে অনেকটা আচমকাই। এর সব রসদ মজুদ করে রাখছে নিজেই। সে জেদি প্রকৃতির, তোয়াজ করার অভ্যাস নেই, নিজের যোগ্যতার উপর অতি আস্থা। বিপরীতক্রমে খেলাটাকে দেখে লটারির দৃষ্টিতে, কোনোদিন মিলবে অন্যদিন মিলবে না, যে কারণে চাতুরি দিয়ে আন্ডার পারফরম্যান্সকে ঢেকে দেয়ার মেকানিজমেও বিন্দুমাত্র প্রয়াস দেখা যায় না। নেগোসিয়েসন বা ডিপ্লোম্যাসি স্কিল না থাকায় সাফল্য ধারণাটাই তার কমপ্লেক্স। ধরা যাক সে সব ফরম্যাট মিলিয়ে ৫০ টা সেঞ্চুরি করতে চায়, কিন্তু কখনো ভাবনাটা শেয়ার করবে না, তাই ৫০ এর বদলে যদি মাত্র ১০ সেঞ্চুরিতেই থেমে যায় ক্যারিয়ার, তাকে ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে, নিয়তিবাদের জায়গা থেকে মূল্যায়ন করবে। মেনে নিবে নিয়তি এটাই চেয়েছিল যে ১০টার বেশি সেঞ্চুরি তার হবে না।
অনুশোচনাহীনতা যে জাগতিক সাফল্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক, এটা তাকে বিশ্বাস করানো অসম্ভব!
আমার অনুমান অনুভূতির ক্ষেত্রে সে সিলেক্টিভ। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের প্রতিই তার বিশেষ অনুভূতি নেই, যাদের প্রতি কাজ করে সেখানে চরম সেনসিটিভ!
এই বৈশিষ্ট্যের মানুষ আচরণে যে নির্লিপ্ততা বা নির্বিকারত্ব দেখায়, সেটা জনরুচি এবং গণ অনুভূতিকে সরাসরি অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
২০২৩ বিশ্বকাপের পরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে বড় পালাবদল ঘটবে। তামিম, সাকিব, মুশফিক ৩ জনই আগে-পরে অবসর নিবে। সাকিবকে মাঠে দেখে মনে হয় খেলাটা থেকে তার আর চাওয়ার বা পাওয়ার কিছু নেই, খেলছে স্রেফ খেলতে হয় বলে। তামিমের ফিটনেস ইতোমধ্যে এক্সপোজড। একমাত্র মুশফিকই এখনো সতেজ, তবে খেলার ধার কমে গেছে।
বিশ্বকাপ পরবর্তী বাংলাদেশ দলে লিটন আর মিরাজের বাইরে কোনো কোর মেম্বার ক্যান্ডিডেট নজরে পড়ছে না। শান্ত যদিওবা ৩ ফরম্যাটে খেলছে, তার উপর আস্থা পাই না।
মিরাজের মূল সমস্যা গ্ল্যামারহীনতা। তার ব্যাটিংয়ে তেমন এক্স ফ্যাক্টর নেই, বোলিংও নিরীহ অফস্পিন— তাই ম্যাস জনগোষ্ঠীর কাছে তাকে সেলেবল বানানো চ্যালেঞ্জিং; সেদিক থেকে আদর্শ চয়েজ হতে পারত তাসকিন। ইনজুরি প্রবণতা মূল বাধা।
নিকট ভবিষ্যতে এমন কোনো এক্সাইটিং ক্রিকেটার দলে আসছে না যে বহুজনকে আকৃষ্ট করতে পারবে।
এই কনটেক্সট এ লিটনের জন্য কিছুটা সুবিধা রয়েছে। অন্তত পঞ্চপান্ডব ধরনের কোনো সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে না। সে পাবে একঝাঁক টিম প্লেয়ার, যারা দলগতভাবে দারুণ, একক প্লেয়ার হিসেবে নন-গ্ল্যামারাস।
পঞ্চপান্ডব সিন্ডিকেটের সদস্যদের ক্যারিয়ার ১৫-১৬ বছর দীর্ঘায়িত হওয়াও দলের ব্যালেন্সের জন্য সমস্যাপূর্ণ। তাতে পজিশনগুলোতে ব্লক তৈরি হয়েছিল।
লিটনের জন্য কাজটা খুব কঠিন কিছু নয়। সিঙ্গেল ডিজিটে আউট হওয়া ঠেকাতে হবে যে কোনো মূল্যে এবং সিরিজের কোনো এক ম্যাচে ফিফটি। আমাদের মেনে নিতে হবে সে হাই ক্যালিবারের ব্যাটসম্যান নয়, তবে বাংলাদেশের মানদন্ডে সমকালীনদের চাইতে এগুনো।
লিটনের বাংলাদেশ কি সাকিব-তামিমদের বাংলাদেশের চাইতে বেটার পারফর্ম করবে? আমার বিশ্বাস, হ্যাঁ। কিন্তু ইনডিভিজুয়াল প্লেয়ার হিসেবে তাদের চাইতে বেটার স্ট্যাট তৈরি করাটা দু:সাধ্য হবে। তাতে একদিক থেকে ভালোই। ২০২০ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে যে দলটা চ্যাম্পিয়ন হলো, সেখানে খুব ওয়াও ফিল দেয়া কোনো ক্রিকেটার ছিল কি?
দর্শক রেজাল্ট মনে রাখে!
লিটন বনাম মিডিয়া ক্ল্যাশে আগামীতে আরো চটকদার কনটেন্ট তৈরি হবে, তাতে লিটনের মানসিক শক্তি কতটা অবশিষ্ট থাকে, সেই জমজমাট খেলার অপেক্ষায় থাকাই আমাদের একমাত্র করণীয়!