ক্রিকেটও যে হতে পারে সত্তার পুননির্মাণ এবং লিমিট যাচাইয়ের ক্রিটিকাল এনালাইসিস অনুষঙ্গ, ২০২৩ বিশ্বকাপটা ভারতে অনুষ্ঠিত না হলে, এবং ফুয়াদ বিন ওমর তমালের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে না উঠলে, উপলব্ধিটা রয়ে যেত অনাবিষ্কৃতই।
ক্রিকেটের প্রতি আমার আসক্তি সর্বজনবিদিত, তবে তার মাত্রা এতটাও তীব্র নয় যে একনাগাড়ে ৪০ দিন ভিনদেশে একাকী পড়ে থেকে বিশ্বকাপের খেলা দেখব৷
১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দর্শকরা গ্যালারিতে আগুন ধরিয়েছিল, কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স এ, মাত্র ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ি, তখন বোধ করেছিলাম বড় হলে এই মাঠে একটা খেলা দেখব৷ একই ধরনের চিন্তা কাজ করে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, পার্থের ওয়াকা, নিউজিল্যান্ডের বেসিন রিজার্ভ, ইংল্যান্ডের হেডিংলি নিয়েও।
তাই যখন থেকে জানি ২০২৩ এর ওয়ানডে বিশ্বকাপ হবে ভারতে, অবচেতনেই বোধ করি ইডেন গার্ডেন্স এর সঙ্গে সাক্ষাতের কাল সমাগত।
১টা ম্যাচ দেখাই ছিল যথেষ্ট।
সেখান থেকে ক্রেজি প্ল্যানে কীভাবে স্থানান্তরিত হলাম, তার পশ্চাৎপট শেয়ার করা নৈতিক দায়িত্ব জ্ঞান করছি।
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমি ৩ বার আত্মঘাতী হবার পরিকল্পনা করেছিলাম। জীবন মিনিংলেস, এটা অনুধাবনের পরে কেবলমাত্র কনজাম্পশন বৃদ্ধির জন্য শরীর বয়ে বেড়ানো আত্মগ্লানিকর।
প্রতিবারই আত্মহত্যার চিন্তা থেকে ফিরে এসেছি বেঁচে থাকবার সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ তৈরি করে। প্রথমবার ফেরত আসি অন্তত ৫টা বই লেখা আর নাটক নির্মাণের টার্গেট সেট করে। ২য়বারও নতুন কোনো টার্গেট পূরণের সংকল্প থেকে৷
একসময় উপলব্ধি করি প্রচুর সংখ্যক বই লেখা হয়ে গেছে, হাজার হাজার মানুষের ইন্টারভিউও নেয়া শেষ। কিন্তু অনবরত একই লুপেই ঘুরপাক খাচ্ছি। বাংলাদেশ কালচারালি হোমোজেনাস, খাদ্যাভ্যাসেও পার্থক্য যৎসামান্য। ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক সংকট, শখ, বিনোদন, প্রথা, আচারেও কাছাকাছি৷
আরেকটু বৃহৎ পারসপেক্টিভে মানুষ দেখার চেষ্টা করছি না কেন?
সেটা তখনই সম্ভব হতে পারে যদি ভিন্ন দেশ এ লম্বা সময় ধরে পদচারণা করি৷
কিন্তু আমার যা আর্থিক কাঠামো তাতে অনেকগুলো দেশ ঘুরা সাধ্যাতীত।
তাই অনেক চিন্তা করে ৭টা দেশ বাছাই করি, যেগুলো দেখলে একটা আনুপাতিক ইমপ্রেসন তৈরি হতে পারে- ভারত, চীন, আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রাজিল, গ্রীস এবং মিশর।
শুভাকাংখী ফুয়াদ বিন ওমরের সঙ্গে রসিকতা করা হয় প্রচুর।
গতকাল সে বলছিল আমি যেন ৪২ দিন ধরে বিশ্বকাপের বিভিন্ন ভেন্যু ঘুরে একবারে ১৯ নভেম্বর বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরে আসি৷ এই দীর্ঘ জার্নিতে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করতে পারব, নতুন ধরনের পারসেপশন তৈরি হবে। আর্থিক ভালনারেবিলিটির কারণে কখনোই দীর্ঘ কোনো পরিব্রাজন পরিকল্পনা করার চিন্তা আসে না।
তবু তার দুষ্টুমিচ্ছলে করা মন্তব্যটা হঠাৎই স্পার্ক তৈরি করে। কথা আগাই৷ সে একজন হার্ডকোর পরিব্রাজক, ঘোরা হয়ে গেছে ৪০ দেশ! আমাকে বিস্তারিত রুট প্ল্যান তৈরি করে দিবে৷ ধর্মশালায় বাংলাদেশের প্রথম ২ ম্যাচ দেখতেও যাবে৷
বাকি সময়ে কোথায় কীভাবে থাকতে পারি জানিয়ে দিবে।
আইসোলেশন উপভোগ করি। গত বছর থেকেই ভাবছিলাম ১১ মাস জাগতিক কাঠামোতে থেকে ১ মাস পুরোপুরি অজ্ঞাতবাসে কাটালে স্পিরিচুয়াল গ্রোথ সম্ভবত আরো শার্প হবে। বুয়েটে ৬ বছর হলে কাটানো সময় ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায়, সবকিছু নিজ দায়িত্বে করতে হত, কারো মুখাপেক্ষী হওয়ার সুযোগ ছিল না। ৪০ দিনে যদি সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে অচেনা কালচারে পরিভ্রমণ করি, আত্ম অণ্বেষণ প্রক্রিয়ায় তা রসদপূর্ণ হবে সুনিশ্চিত।
তাই একরাশ দ্বিধা নিয়ে জানতে চাই আনুমানিক খরচ হতে পারে কত। সে যা ধারণা দিল, ম্যানেজেবল৷
কলেজ লাইফ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত প্রতি বইমেলায় পরিচিত এবং অনুরাগী প্রত্যেকের থেকে ১০০ টাকা অনুদান নিতাম। জীবনে যখন যা করতে চেয়েছি, টাকার অভাবে থেমে থাকেনি। ১৫০ জন শুভাকাংখীর থেকে যদি গড়ে ১০০০-১৫০০ টাকা অনুদান নিই, অনায়াসে পরিভ্রমণ সমাপ্ত করা যাবে৷
চেষ্টা-চরিত্র করলে আরো উপায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে৷ টাকা কখনোই বিগ ডিল নয়; মানসিক শক্তি, মরিয়াপনা এবং নৈর্ব্যক্তিকতাই শেষ পর্যন্ত পার্থক্যসূচক হয়ে উঠে। এসবে কমতি নেই আমার।
তার মানে চিন্তাটা ক্রেজি, তবে বাস্তবায়ন একদমই দুরূহ নয়।
ভারতকে দেশের চাইতে মহাদেশ মনে হয়, সবসময়ই। একেকটা প্রদেশ যেন স্বতন্ত্র দেশ।
ক্রিকেটকে উপলক্ষ করে যদি ৮-১০টা প্রদেশ পরিব্রাজন করি, এবং তার ভিত্তিতে দুটো বই লিখি, অন্তত ৭০০ জন স্থানীয় মানুষের ইন্টারভিউ নিই বা গল্প শুনি— কত বিচিত্র সব কনটেন্ট তৈরি হবে।
বিশেষত ফুড হ্যাবিটে আমার বিশেষ ফ্যাসিনেশন রয়েছে। যতদিন থাকব স্থানীয় সব খাবার পরখ করে দেখব।
মানুষ যে উদ্দেশ্যে তীর্থ যাত্রায় রওয়ানা হয়, আমার ৪০ দিনের পরিব্রাজনের মূল এসেন্সটাও অবিকল এক।
লোভ আর মোহমুক্ত হয়ে জগতকে আরো নির্মোহ লেন্সে দেখতে চাওয়া। ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে ব্যাসার্ধ আঁকলে বিকল্প ইন্টারপ্রেটেশন তৈরি হবে৷ নইলে ৪০ দিন ধরে একটা দেশে থাকার জন্যও তো ভেতর থেকে স্পার্ক আসতে হবে!
আমার এখনকার প্রস্তুতি ৩ ধরনের
প্রথমত, যেসব প্রদেশে যাব খেলা দেখা উপলক্ষে সেখানে পরিচিত লোক খুঁজে বের করা। আমার জিওগ্রাফি নলেজ হতদরিদ্র। পরিচিত ব্যক্তি পেলে পরিভ্রমণ মিনিংফুল করা সহজ হবে।
দ্বিতীয়ত, গল্প করার বাইরে আর কোন কোন উপায়ে রিসোর্স এবং ইনসাইট সংগ্রহ করা যায় তার নকশা নির্মাণ
তৃতীয়ত ১৫০ জন শুভাকাংখীর তালিকা তৈরি যারা অনুদান দেবে খুশিমনে৷ বই বা অন্য যে কোনো ক্রিয়েশনে এই অনুরাগীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ক্রিয়েটিভ উপায়গুলো আত্মস্থ করা।
অনুশোচনা এবং অনুতাপহীন জীবন কাটানোর সংকল্পে প্রতিনিয়ত নতুন কারণ তৈরি করতে হয় বেঁচে থাকবার, একটা কারণ শেষ হওয়ামাত্র আবির্ভূত হয় নতুন কারণ। কোনো একদিন ফুরিয়ে যাবে কারণের যোগান, তার পূর্ব পর্যন্ত আত্মজিজ্ঞাসা অভিযান জারি থাকুক।