একটা বই পড়ার ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি নিয়ে যদি নির্মিত হয় ওয়েবসিরিজ, সেখানে ‘দ্য নর্থ এন্ড’ নামের বইটির সঙ্গে আমার সংযোগের গল্পটি স্ক্রিপ্ট রাইটারদের দীপ্তিময় করে তুলতে পারে।
আনকনভেনশনাল বিষয়বস্তু আমাকে মোহাসক্ত করে; নাম, ভয়েস, শব্দ, স্থান সহ আরো অনেক কিছুই তার অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও যেমন অবসেসন তৈরি করে, অনুরূপ ডেনমার্ক, মিশর, ইথিওপিয়া, হাঙ্গেরি, ফিলিপাইন ধরনের দেশগুলোতেও অবসেসিত হই কেবলমাত্র নামের কারণেই। ব্যাপারটা অনেক শুভাকাংখীরই জানা, সেজন্যই কিছুদিন পূর্বে হোয়াটসঅ্যাপ এ মেসেজ পাঠায় একজন।
আমার পডকাস্ট শো ‘বাবল রেশিও’ এর প্রথম পর্বে অতিথি ছিলেন মিলজার ম্যাচেল। আলাপের এক জায়গায় তিনি গ্লোরিয়া জিন্স এ কফি খাওয়ার রেফারেন্স টানেন প্রসঙ্গক্রমে। সেসূত্রেই শুভাকাংখীর মেসেজ- ‘ভাইয়া আপনি কি কখনো নর্থ এন্ড কফিশপে কফি খেয়েছেন? এই নামে একটা বইও পাওয়া যায় রকমারিতে। আপনার জন্য আসল টুইস্ট, বইতে নায়িকা ডেনমার্কে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করে’।
ঘটনাক্রমে তার দিন কয়েক পরে বইমেলাতে কথা হচ্ছিল এক তরুণ ক্রিটিকের সঙ্গে। তাকে বলেছিলাম যদি কোনো সমকালীন লেখকের নাম জানি তার লেখা অন্তত ১টা বই পড়া আমার নিয়মিত শর্ত। সে ভাইভা পরীক্ষার আদলে বিভিন্ন লেখকের নাম বলে আর জিজ্ঞেস করে তার বই পড়েছি কিনা। এই প্রক্রিয়ায় নতুন বেশ কয়েকজন লেখকের নাম শোনা হয়। ফেরার পথে প্রশ্ন জাগে তরুণ ক্রিটিকের দেয়া তালিকায় আমার অপঠিত লেখকদেরই কি কেউ নর্থ এন্ড মতান্তরে ডেনমার্কে নায়িকার পালিয়ে যাওয়া বইয়ের লেখক? রকমারিতে বইটিকে আবিষ্কার করি লেখকের নামসমেত- ‘বর্ণালী সাহা’! লেখকের নাম প্রথম শোনা, এমনকি সে অনুপস্থিত ক্রিটিকের সেই সমকালীন তালিকাতেও!
আমার একটা অদ্ভুত খেয়াল আছে, বহুবছর ধরেই এর চর্চা করি, তবে সিগনেচার সরণ বইটি লিখবার পর থেকে প্রবণতাটা বৃদ্ধি পেয়েছে। হাসপাতাল, রেলস্টেশন, বাস স্টেশন, মেলা, বাজার, কফি শপ, রেস্টুরেন্ট প্রভৃতি জায়গায় বিনা প্রয়োজনে বসে থাকা চুপচাপ, এরপরে মানুষের চলাচল দেখে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝার চেষ্টা করি, কল্পনায় তাদের জীবনের গল্প অনুমান করে নিই। আমি এই অনুশীলনের নাম দিয়েছি ‘গল্প ফার্মিং’।
দ্য নর্থ এন্ড বইটা রকমারিতে অর্ডার করার পূর্বমুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই লেখকও কি বিভিন্ন জনারণ্যে পর্যবেক্ষকের চেহারায় চুপচাপ বসে থাকেন গল্প ফার্মিংয়ের উদ্দেশ্যে, তারই পরম্পরায় গিয়েছিলেন গুলশান বা ধানমন্ডিস্থ নর্থ এন্ড কফিশপে, সেখানে কাউকে দেখে নাযিল হয়েছে আখ্যান? হতেই পারে।
কিন্তু কানাডা, জার্মানি বা সুইডেন রেখে কেন ডেনমার্ক, তারও কি আমার মতো নাম বা স্থান সংক্রান্ত অবসেসন কাজ করে? ডেনমার্ক বাছাইয়ের অন্য কী কী কারণ থাকতে পারে! সম্ভব হলে লেখকের সঙ্গে একদিন এ বিষয়ে কথা বলবো!
বই পৌঁছানোর পর জানা গেল লেখক অস্ট্রেলিয়ান অভিবাসী, সুতরাং শেষের চিন্তাটা ছেটে ফেলা হলো শুরুতেই। বই পড়বার পূর্বে সমগ্র জার্নিটা রিক্যাপ হতে থাকে মাথার ভেতরে- ‘সেদিন যদি মিলজার ম্যাচেল গ্লোরিয়া জিন্সের রেফারেন্স না দিতেন, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও আসতো না, এবং নায়িকা যদি ডেনমার্কের পরিবর্তে পালাতো রাশিয়া বা নেদারল্যান্ডে, এই বই পড়ার কোনোরকম আগ্রহই বোধ করতাম না। এই বইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতে সমস্ত কৃতিত্বই কি মিলজার ম্যাচেলের? কিন্তু সে তো জানেও না তার একটা রেফারেন্সের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াস্বরূপ কত রাজা-উজির নিহত হয়ে গেল’!
বাংলাদেশে নাগরিক মোরাল ডিলেমা বিষয়ক যত সাহিত্য রচনা করা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে ডেমোগ্রাফিকাল নৈকট্য থাকে। কিছুদূর পড়লেই আপনি এখানকার প্রটাগনিস্টের যে অবয়ব ভেবে নিবেন সেখানে তার বসবাস ঢাকার মিরপুর, মুগদা বা এ ধরনের এলাকায়, তাদের মাসিক আয় বড়জোড় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। অথবা আপনি একটা ক্লাস্টার পাবেন যারা গুলশান-বনানী বা বারিধারায় থাকে, মাসিক ইনকাম ২-৩ লক্ষ বা তারও বেশি। কিন্তু ডিওএইচএস, শান্তিনগর বা সেগুনবাগিচা ধরনের এলাকায় থাকে, মাসিক ইনকাম ৮০-৯০ হাজার বা ১-১.৫ লাখ, এই শ্রেণিতে গত কয়েক বছরে বহু ক্যারেক্টারের সংখ্যাভারি হচ্ছে, তুলনায় সাহিত্যে তাদের উপস্থিতি যৎসামান্য।
আমরা এখনো ৩০ হাজারি মানুষের ডিলেমা পড়েই পৃষ্ঠা ফুরাই।
দ্য নর্থ এন্ড এ সেই সাব-শ্রেণির উপস্থিতি পাওয়া গেল। পড়ার ক্ষেত্রে আমার পছন্দ লেয়ারযুক্ত এবং মেটাফরিকাল কানেকশনযুক্ত স্টোরিলাইন। একরৈখিক ক্যারেক্টার এবং প্লটের স্টোরিলাইন পানসে ঠেকে বিধায় অধিকাংশ লেখাই শেষ করি না। বর্ণালী সাহা এক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার ছাপ রেখেছেন মাত্র ১২০ পৃষ্ঠার মধ্যে তার বয়ানকে সীমাবদ্ধ রেখে, কারণ তার ক্যানভাসের বেশিরভাগ অংশই সোজাসাপ্টা ন্যারেটিভপূর্ণ। এনজিওরা কীভাবে ফান্ড ম্যানেজ করে, ব্যক্তিগত ডোনারদের জীবন কীরকম অতিষ্ঠ করে তোলে বা ফার্মাসিটিক্যাল ব্যবসায় কী ধরনের মেকানিজম চলে— এ সংক্রান্ত বহু ফিঁসফাঁস চায়ের আড্ডায় কান পাতলেই শোনা যায়, দ্য নর্থ এন্ড এও আওয়াজটা উপস্থিত।
তবে এর মধ্যেও বর্ণালী সাহার দুটো দৃষ্টিকোণ ভাবনার খোরাক যোগায়
প্রথমত, কোনোরকম কলহ-সন্দেহ-অবিশ্বাস ব্যতিরেকেও একটি দাম্পত্য সম্পর্ক শেষ হয়ে যেতে পারে, প্রেম বর্তমান থাকা সত্ত্বেও জন্ম নিতে পারে নতুন প্রেম, সেজন্য দোষাদোষি বা অভিযোগের অবকাশ যেমন থাকে না, তেমনি একে নৈতিক স্খলন হিসেবেও স্বীকার করা যায় কি না সে সংক্রান্ত আলাপও হতে পারে। সবকিছু ঠিক থাকা সত্ত্বেও একটা সম্পর্ক বিকল হতে পারে, এমন একটা এসেন্স নর্থ এন্ড এ পাওয়া যায়। সে মুহূর্তে মনে আসে, এই যে গুলশান নর্থ এন্ড এ কফি খেতে গেলে কতরকমের মানুষকে দেখি মুখোমুখি বসে গল্প করছে সেখানে সম্পর্ক পুননির্মিত হচ্ছে নাকি ভাঙনের আনুষ্ঠানিকতা?
দ্বিতীয়ত, প্রটাগনিস্ট বর্ণালী যখন তার ডেনিশ প্রেমিকের প্রয়াত দাদী রোজম্যারি ইম্যাকুলেটের জীবনচরিত নিয়ে অবসেসনে আক্রান্ত হয়, আদতে বর্ণালী কি রোজম্যারির মধ্যে নিজের ভবিষ্যৎকে দেখে? রোজম্যারিও স্বামীর সঙ্গে থাকা অবস্থায় আরেকজনের প্রেমে পড়ে, স্বামীকে ত্যাগ করে অন্যভাবে বাঁচা শুরু করে; বর্ণালী দেশ-স্বজন সবাইকে ছেড়ে ডেনমার্ক চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে, এটা কি কেবলই প্রেমের আকর্ষণ, নাকি একঘেয়েমি থেকে নতুন অনিশ্চয়তা-অনোনুমেয়তাকে উপভোগ করা, সেই বৃহৎ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে বর্ণালী ক্যারেক্টারটাকে বারবার এক্সপ্লোর করতে ইচ্ছে হয়।
কিন্তু নানীর কাছে মানুষ হয়েছে, শৈশব কেটেছে মাতৃহীন আর সঙ্গীতের প্রতি সামান্য ফ্যাসিনেশনের বাইরে তার ক্যারেক্টারে স্পার্কিং উপকরণ সীমিত। তবে সে সিনেমা পছন্দ করে, নিজেকে ঘিরে মিস্ট্রি তৈরি করতে চায়, ক্রমাগত রোল প্লে করে— সবকিছুর মধ্যে একজন স্পিরিটেড ইনডিভিজুয়ালের ভাইব পাওয়া যায়, যদিও সে সামান্য প্রতিকূলতাতেই প্যানিকড হয়, ভালনারেবল হয়ে পড়ে; আমাদের আশপাশে এই ধরনের অসংখ্য বর্ণালীকেই দেখি নিয়মিত ভিন্ন নাম ভিন্ন চেহারা বা ভিন্ন পেশায়।
বর্ণালীর সঙ্গে অন্যদের সম্পর্কগুলো অবিকশিত; আছে অথচ নেই ধরনের। এটা সম্ভবত পোস্ট-মডার্নিজমের নতুন মাত্রার সংকট। আমাদের সম্পর্কগুলো অদ্ভুতভাবে স্থিতি জড়তায় আক্রান্ত, গাড়ি আগাচ্ছে না পিছিয়েও যাচ্ছে না, এক সুদীর্ঘ এবং অন্তহীন জ্যামচক্রে আটকে আছে।
লেখক রোমান্টিসিজমবশত কিছু উপকরণ রেখেছেন, যেগুলো সংবেদনশীল টিনেজারদের আকৃষ্ট করতে পারে। যেমন ২৩ রকমের অনুভূতি যেগুলো প্রকাশের জন্য ইংরেজিতে সুনির্দিষ্ট শব্দ রয়েছে। এ জাতীয় ডেজার্টগুলো একটা বিশেষ শ্রেণিকে মুগ্ধ করে অনেক ক্ষেত্রে।
দ্য নর্থ এন্ড বই হিসেবে গতানুগতিক, তবে এর সঙ্গে আমার যোগসূত্রের গল্পটা সেমি-সিনেমাটিক হওয়ায় লেখক কখনো দেশে এলে এবং সুযোগ মিললে তার সঙ্গে একটা পডকাস্ট শো করার ইচ্ছা রইলো ‘বাবল রেশিও’ তে।