আমার আর্গুমেন্টটা খুবই সিম্পল: বহুদিন বাদে একটি বাংলা সিনেমা মুক্তির পূর্বেই তুমুল দর্শক আগ্রহের কেন্দ্রতে। অভিনব সব প্রমোশন কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে। দর্শকেরা টিকিট পাচ্ছে না। হাওয়াকে ঘিরে দর্শকের যে উন্মাদনা তার যদি মাত্র দুটো অনুঘটক বিবেচনায় নেয়া হয় সেখানেও ১ নম্বরে থাকবে একটি গান- ‘তুমি বন্ধু কালা পাখি আমি যেন কী, বসন্তকালে তোমায় বলতে পারিনি’৷
এর গীতিকার ও সুরকার হাশিম মাহমুদ। সেই অর্থে তিনি জনপ্রিয় এবং জনশ্রুত কেউ নন। তাকে উপস্থাপনের অনেক উপায়ের মধ্যে সবচাইতে ফালতু যা যা হতে পারত সেখান থেকে একটি বেছে নিয়ে তাকে ব্রান্ডিং করা হচ্ছে মানসিক ভারসাম্যহীন হিসেবে।
এ ধরনের ব্রান্ডিংয়ের বিপজ্জনক দিকটা হলো, ব্যক্তিকে তখন অবজেক্টিফাই করা হয় সিমপ্যাথির উপকরণ হিসেবে। সিমপ্যাথি নিজেই একটি ভয়াবহ সমস্যা। মানুষ তখন ভাবে আহারে বেচারা কেমন কষ্টে আছে, দিই একে ৫০০ টাকা বিকাশ করে। এতে করে একই ব্যক্তি যে নিজ যোগ্যতাতেই ৫ লাখ টাকা পাওয়ার সবরকম দাবিদার সেই প্রসঙ্গটি ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যায়।
পর্যাপ্ত সম্ভাবনা আছে হাশিম মাহমুদও আরেকজন সিমপ্যাথি ভিক্টিম। যদি তাই হয় ক্রিয়েটিভ মানুষদের স্বচ্ছলতার চিরায়ত দাবিটি অপাঙক্তেয় হিসেবেই রয়ে যাবে। ক্রিয়েটিভ মানুষমাত্রই দরিদ্র, এই ন্যারেটিভ ভাঙতে ‘হাওয়া’ সিনেমার হাইপটাই হতে পারে মোক্ষম হাতিয়ার।
স্বচ্ছলতা মানে কোটিপতি হওয়া নয়, মৌলিক চাহিদা নিবৃত্তির দুশ্চিন্তা থেকে স্থায়ী অথবা দীর্ঘমেয়াদী মুক্তি।
হাওয়া সিনেমার প্রমোশন এবং নির্মাণ বাজেট কত জানা নেই, তবে হাশিম মাহমুদ ক্যারেক্টারটি স্বয়ং যে প্রমোশনের অংশ এটা বুঝতে না পারার কারণ নেই৷ গানটি ব্যবহারের জন্য পরিচালক অবশ্যই তার অনুমতি নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো গানের রয়্যালটি মডেলটা কীরকম। এককালীন কিছু থোক বরাদ্দ দেয়া, নাকি সময়ে-অসময়ে চা-সিগারেট খাওয়া কিংবা চিকিৎসার জন্য দান-খয়রাত ধরনের কিছু টাকা দিয়ে থাকলে সেগুলোকেও রয়্যালটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা?
প্রশ্নটা একারণে করলাম, ব্যক্তিগতভাবে এই কিসিমের অসংখ্য মানুষের সাথে মেশার সুযোগ ঘটেছে। এরা সাধারণত খেয়ালি, মাদকাসক্ত এবং অর্থ উপার্জনবিমুখ হয়ে থাকে। তাদের সময় কাটে ডিভাইন ডিলিউশনের মধ্য দিয়ে। আমি এদের ডাকি ‘নাগরিক ঋষি’।
এরা পরিচিতদের কাছে ধরনা দেয় ২০০-৫০০ টাকার জন্য, এরপর দীর্ঘদিন ডুব মেরে থাকে, কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারার সুনাম থাকে সর্বজনবিদিত। একটা পর্যায়ে পরিচিতরা এদের এড়িয়ে চলে। হাশিম মাহমুদেরও সম্ভাবনা আছে কাছাকাছি ধরনের ক্যারেক্টার হওয়ার। হয়তবা সে ক্রিয়েটিভ ঋষি।
হাশিম মাহমুদকে সিমপ্যাথি ভিক্টিম বানাতে তাকে কেন্দ্র করে যে গল্পগুলোর প্রমোশন চালানো হয়েছে ‘হাওয়া’ সিনেমার স্বার্থে, এখানে ইমেজ রাইটের কোনো চুক্তি কি করা হয়েছে? যেহেতু গানটি নিজেই দর্শক যোগাড়ের বৃহত্তম প্রমোশন টুলস, এখানে রয়্যালটি মডেলটা কীরকম; এখানে কি প্রফিট শেয়ারিং জাতীয় কোনো চুক্তি থাকার সম্ভাবনা আছে? কিংবা গানটিকে যে ইউটিউবে কপিরাইটমুক্ত হিসেবে যে কেউ গাইতে পারে বা ব্যবহার করতে পারে শুনেছি, সেক্ষত্রে সুরকার-গীতিকারকে কোন মডেলে কমপেনসেট করছে ‘হাওয়া’ এর মালিকপক্ষ?— এই গুরুতর প্রশ্নগুলো নিয়ে সরব হলেই কিছুদিন পর পর সিমপ্যাথি ভিক্টিম এর আবির্ভাব ঘটবে না মার্কেটে।
কাউন্টার ন্যারেটিভও আসতে পারে। কে বা কয়জন চিনতো হাশিম মাহমুদকে? হাওয়া সিনেমায় তার গানটি সম্পূর্ণ নিজস্ব কম্পোজিশন এ রিক্রিয়েট করা হয়েছে। সেই জোরেই আজ দেশের অসংখ্য মানুষ তাকে চিনে। তাকে নিয়ে গল্প হচ্ছে। দেখা গেল এসূত্রেই তার আরো ১০টি গান সামনে এলো। হাওয়া না থাকলে কি সম্ভব হত সেটা? হাওয়া যে তাকে প্রমোট করলো কিংবা সুযোগ দিল তার একটা সার্ভিস চার্জ থাকবে না? হাশিম মাহমুদ কি পরিশোধে সক্ষম?
— ফ্যালাসিটা এখানেই। হাওয়া সিনেমাসূত্রে পাওয়া পরিচিতি থেকে হাশিম মাহমুদ যদি আরো ১০টা কাজ পায় এবং সেখান থেকে ১০০ কোটি টাকাও আসে তাতে কি হাওয়ার সাথেকার নির্ধারিত চুক্তি প্রভাবিত হওয়া উচিত? দুটো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ঘটনা, কোনোরকম সম্পর্ক নেই। হাশিম এর গান এবং ব্যক্তিচরিত্র তোমার বিজনেসের জন্য প্রফিটেবল বলেই তার দ্বারস্থ হয়েছ, নইলে চারুকলার সামনে কিংবা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে এরকম ভাবের চারণকবি অনেকই দেখা যায়, তাদের কেউ তো বিষয়বস্তু হয়নি, কারণ সেই এক্স-ফ্যাক্টর তাদের মধ্যে ছিল না বা নেই। সুতরাং হাশিমের কাছে হাওয়া কর্তৃপক্ষের কোনো পাওনা থাকার প্রশ্নটাই অবান্তর।
আমি ‘হাওয়া’ এর পরিচালক-প্রযোজকের ইথিকাল গ্রাউন্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না, ট্রান্সপারেন্সি নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছি না৷ কেবল বলতে চাইছি হাশিম মাহমুদ এর ভুল ক্যারেক্টারাইজেশন হচ্ছে। তার গল্প শুনে শ্রদ্ধা বেড়ে গেলে, মন উথলে উঠলে বা স্যালুট দিতে ইচ্ছা করলে তাতে তার লাইফস্টাইলের কী এলো-গেল! শ্রদ্ধায় পেট-পকেট কোনোটাই ভরে না। বরং সে এবং তার পরিবার যাতে আরো পছন্দের এবং প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারে সেই তহবিলের যোগানটা নিশ্চিত করা জরুরী। কারো অনুকম্পা নয়, সম্পূর্ণ নিজস্ব মেধা-প্রতিভার কাঁচামালে তৈরি কালচারাল প্রোডাক্ট মার্কেটে বিক্রি করে সেখানকার প্রাপ্য হিস্যা দিয়েই সেটা সম্ভব। তা না করে প্রথমে সিমপ্যাথি ভিক্টিম রূপে ব্রান্ডিং এবং পরে নগণ্য এমাউন্টের একটা টাকার চেক হস্তান্তর করে পুনরায় বাহবা কামানো— দুটোই নিন্দনীয় অপরাধ হওয়া উচিত।
যতবার সাদা সাদা কালা কালা লাইনটি শুনবেন বা দেখবেন স্ক্রিনে অন্তত একবার হলেও প্রশ্ন করিয়েন- এরকম একটা জোশ প্রোডাক্ট যে তৈরি করেছে ডিস্ট্রিবিউটররা তাকে ভাঙিয়ে খাচ্ছে না তো?
এটুকুই যথেষ্ট। ম্যাসিভ কোনো পরিবর্তন হয়ত ঘটবে না, তবে ভাইরালিটিসর্বস্ব এই তলানীবিহীন সময়ে সিমপ্যাথি ভিক্টিমের পুনরোৎপাদন স্তিমিত হয়ে আসবে।
তাতে কোনো একদিন ক্রিয়েটিভ নাগরিক ঋষিদের জীবনে স্বচ্ছলতার দেখা মিলতেও পারে! অন্তত ইকোসিস্টেমটা তৈরি হোক।