টেস্ট এবং টি২০, দুয়ের মধ্যে কোন ফরম্যাটে বাংলাদেশ অধিক বাজে খেলে?
নির্দ্বিধায় বলতে পারি টি২০। বৈচিত্রহীন নিরামিষ বোলিং, গা ছাড়া ফিল্ডিং আর রক্ষণাত্মক ব্যাটিংয়ের যোগফলে যে চিত্র দাঁড়ায় টেস্টে এর চাইতে কিছুটা ভদ্রস্থ রূপ দেখা যায়।
টি২০ মূলত মডার্ন টেকনোলজির খেলা, সাথে ট্রিক্স আর ট্যাকটিক্স এরও। বাংলাদেশের গড় মানুষ যেরকম টেকনোলজি বিমুখ এবং ভুলভাল ব্যাখ্যা দেয়, টি২০ এর ক্ষেত্রেও ক্রিকেট আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে বিরাট গ্যাপ। টেস্টের ভাইব তারা বুঝে, ওয়ানডেটা প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছে, কিন্তু টি২০ এর ক্যারেক্টারটাই ধরতে পারছে না। ফলে ভুল চিকিৎসা চলছে।
বাংলাদেশ টি২০ তে পারে না আন্দাজনির্ভর হাতুড়ে চিকিৎসার বলি হয়েই।
একটা সুনির্দিষ্ট কেইস ধরা যাক।
বাংলাদেশের টি২০ প্রসঙ্গ এলে ঘুরেফিরে একটা কথাই আসে ‘পাওয়ার হিটিং অক্ষমতা’, এবং কথার অসারতা ব্যাখ্যা করে অসংখ্য লেখাও চোখে পড়ে।
তখনই মনে হয়েছে কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। পাওয়ার হিটিংয়ের এসেন্স আসলে কী। আমার মনে হয়েছে দুটো
প্রথমত সিক্স হিটিং দক্ষতা। এখনকার ব্যাটগুলো ভারি, মাঠ বেশিরভাগই ছোট। ছক্কা মারতে তাই গায়ের জোর তেমন ম্যাটার করে না।
দ্বিতীয়ত, একটা কোয়ালিটি ডেলিভারিতেও ছক্কা মেরে দেয়া। দেখা গেল ডেভিড মিলার পুশ করেই অনায়াসে ছক্কা মেরে দিতে পারছে, সেই একই শট আফিফ খেলারই সাহস পাবে না। কারণ সে জানে বলটা যে লেন্থ এ পিচ করেছে এটা পিক করে বাউন্ডারি পার করা সম্ভব নয়।
আমার ধারণা বাংলাদেশের পাওয়ার হিটিং ন্যারেটিভ আসলে ২য় রিয়েলিটির উপর প্রতিষ্ঠিত।ক্রিকেটাররা বলতে চায় একটা ডিসেন্ট বলকেও ছক্কায় কনভার্ট করার দক্ষতা তাদের নেই। কিন্তু অদক্ষতার ব্যাপারটা নিজেরাই বুঝতে পারে না, ভাবে গায়ে জোর নেই বলেই ছক্কা হয় না।
আমার দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ বলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের হিটিং জোন খুবই লিমিটেড। স্লটে বল না পেলে তারা অসহায় হয়ে পড়ে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে স্লটে বল কয়টা পাবেন, স্লট নিজে তৈরি করে নিতে হবে। এটাই অন্য দেশের প্লেয়ারদের সাথে আমাদের পার্থক্য। কেইস স্টাডি হিসেবে গতকাল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টি২০ তে এনামুল বিজয়, নাজমুল শান্ত এবং নুরুল সোহানের হিটিংকে বিবেচনায় নেয়া যায়। ৩ জনে মিলে ৭টি ছক্কা মেরেছে, যার মধ্যে ছয়টাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাউন্ডারিতেও ছক্কা হবে অনায়াসে।
কিন্তু তারা পটেনশিয়াল সিক্স হিটার নয়।
বিজয়ের কেইস ধরা যাক। লেগ মিডল স্ট্যাম্প এ পিচ করা বলগুলো তার স্ট্রেন্থ এর জায়গা। এটাকে বলা যায় হিটিং আর্ক। এর বাইরে গেলেই সে ক্লুলেস হয়ে পড়ে।
সোহানের সিক্স হিটিংয়ের জন্য কাউ কর্নার ছাড়া অপশন নেই। ওয়াইড ইয়র্কার বা ফিফথ স্ট্যাম্প চ্যানেলে বল করলে তার ভাণ্ডারে আর অপশন থাকে না। গতকাল সে যে ৪ টা ছক্কা মেরেছে তার ৩টাই সেই সুনির্দিষ্ট চ্যানেলে। অফস্ট্যাম্প করিডোর, এমনকি লেগ সাইডেও তার তেমন শট নেই। পুল, হুক, ফ্লিক কোনটাতেই তার দক্ষতা আপ টু দ্য মার্ক নয়। হয় স্কুপ এর অপেক্ষায় থাকতে হয় অথবা কাউ কর্নারে টানতে হয়। এটা পিউরলি টেকনিকাল ত্রুটি এবং স্কিলের ঘাটতি। পাওয়ার এখানে ইস্যুই নয়।
নাজমুল শান্ত একজন টপ অর্ডারে খেলা ব্যাটসম্যান হয়ে পুল করতে জানে না, ব্যাপারটা বেদনাদায়ক। ফ্লিক আর ডাউন দ্য উইকেটের বাইরে তার অপশন নেই। একারণে স্পিন বোলিং না পেলে তার সিক্স হিটিং ক্ষমতা কাজ করে না।
বাংলাদেশের প্লেয়ারদের হিটিং জোন সীমিত কেন এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দুটো মতবাদ প্রচলিত।।
প্রথমত, স্লো-লো উইকেট। বল ব্যাটে আসে না ঠিকভাবে, যে কারণে অনেকগুলো শট কখনো খেলারই দরকার পড়ে না।
দ্বিতীয়ত স্বার্থপরতার কালচার। টিম জয়ে কন্ট্রিবিউট করার চাইতে যে কোনোভাবে ৩০-৩৫ করে একাদশে টিকে থাকাটাকে প্রধান টার্গেট বানিয়ে ফেলা হয়। স্ট্রোক খেলা বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ, এতে কনসিসটেন্সি কম্প্রোমাইজড হয়। কিন্তু আমাদের কালচারেই ঝুঁকি নেয়াকে অর্বাচীনতা হিসেবে দেখা হয়। ক্রিকেট যখন মাঠ থেকে চলে গেছে মিডিয়াবাজদের হাতে, এবং এপ্রোচ-ইনটেন্ট এর চাইতে ৫০+ ইনিংস এবং এভারেজ দিয়েই কারো অবস্থান নির্ণয় করা শুরু হয়েছে তখন টিম গেম কনসেপ্টই বিলুপ্তপ্রায় দশা।
দুই মতবাদের মধ্যে প্রথমটা মানি না, ২য়টা আংশিক মানি।
সিক্স হিটিংকে স্রেফ একটা স্কিল হিসেবে যদি ধরি সাঁতার বা ড্রাইভিং শেখার মতো, তাতে এফোর্ট বনাম রিওয়ার্ড সমীকরণটা সামনে চলে আসে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সমস্ত ন্যাচারাল রুল বা প্রিন্সিপলকে ভুল প্রমাণিত করে। জাতীয় দলে প্রতিটি পজিশনের বিপরীতে প্রার্থী খুব বেশি নেই, পারফরম্যান্সের জবাবদিহিতা নেই, অথচ ২০-২২ বয়সেই বাংলাদেশের টপ লেভেল সেলিব্রিটি, শীর্ষ আয়ের পেশাজীবী হওয়ার সুযোগ আছে। এফোর্ট যদি হয় ১০, রিওয়ার্ড ১০০০, অর্থাৎ ১০০ গুণ বেশি রিটার্ন৷
এর সাথে যদি দুর্নীতির শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠান জুড়ে যায়, গেমটা তখন সুবিধাভোগীতার দিকে চলে যায়।
তামিম ইকবাল ক্যারিয়ারের শুরুতে লেগ সাইডে কোনো শটই পারত না, ডাউন দ্য উইকেটের বাইরে ছিল না হিটিং এপ্রোচও। পরবর্তীতে সে হিটিং জোন বাড়িয়েছে। লিটন দাস মিডল স্ট্যাম্পের বল অনসাইডে ঘুরাতে গিয়ে লেগবিফোর আর টপ এজড হয়েছে কতবার ইয়ত্তা নেই, অফে ছিল না তেমন শট। সে এখন লেগের চাইতে অফসাইডেই বেশি স্ট্রং, পুল শটে দক্ষতা বেড়েছে বহুগুণ।
এই দুটো কেইস ছাড়া কোনো বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানকে দেখলাম না হিটিং বা স্কোরিং এরিয়া নিয়ে কাজ করেছে। তার মানে গ্রুমিং সিস্টেমটাই গলদপূর্ণ, সবটাই ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর।
তাহলে প্রতিষ্ঠান থাকার দরকার কী। কারণ মূল বেনিফিশিয়ারি তো প্রতিষ্ঠানই। তারা কেন রিসোর্স ম্যাক্সিমাইজিং প্ল্যানিংয়ে কোনো অবদানই রাখতে পারেনি, কেন ইকোসিস্টেম তৈরি করতে ব্যর্থ? ডিওএইচএস এরিয়াতে গেলে ঢাকা শহরকে অচেনা লাগে না? কীভাবে পারলো তারা! এখানেই চেইন অব কমান্ড ফ্যাক্টরটা সামনে আসে।
প্রশ্ন হলো, এই সমস্যার সমাধান কী?
সমস্যা যেহেতু লোকাল, সমাধানও হওয়া উচিত লোকাল মডেলে। আমি মনে করি বিকেএসপির সাথে বিসিবির ২ বছর মেয়াদী কোলাবরেশন মডেলে কাজ শুরু করা উচিত। এইচপি টিমের ৩০ জন ক্রিকেটার রেসিডেন্টশিয়াল হিসেবে থাকবে, এর মধ্যে যতরকম ট্যুর বা খেলা আছে সবকিছুতেই পার্টিসিপেট করবে, কিন্তু থাকবে বিকেএসপিতেই, যেভাবে থাকে ক্যাডেট কলেজে। সেই সাথে একই বয়সী বিভিন্ন দেশের দলের সাথে ট্যুর এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম এবং প্রচুর টুর্নামেন্ট আয়োজন। এই ২ বছরে এদের শট রেঞ্জ আর হিটিং নিয়ে কাজ করবে বিশেষায়িত কোচ। রেসিডেন্টশিয়াল ক্রিকেটারদের লাইফস্টাইল নিয়েও কাজ করা হবে।
টি২০ কে যতই রেসলিং, ফিক্সিং ফ্যাক্টরি বা পিকনিক ক্রিকেট বলা হোক, এগুলো আদতে বুড়ো মানুষের ভাবনা, আগামীর দিনে টি২০ই বাস্তবতা, যা ইতোমধ্যে প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। এই বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য না করে ইমব্রেস যত দ্রুত করবে টিকে থাকার সম্ভাবনা তত বাড়বে। কেবলমাত্র মিডিয়াবাজি আর দর্শকবাজি দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ক্রিকেট মার্কেটে প্রাসঙ্গিক থাকা অসম্ভব। ফোন কোম্পানি নোকিয়ার পরিণতির দিকেই হাঁটতে হবে বিসিবিকে, নো ওয়ে।
জাতীয় বা ‘এ’ দলে ঢোকার পরে একজন ব্যাটসম্যানের ব্যাটিংয়ে বড় ধরনের সংস্কার আনা সম্ভব হয় না। কারণ মাইন্ডসেট ততদিনে ফরমুলাবন্দী হয়ে পড়ে। ধরা যাক আপনি পাঙ্গাস মাছ অপছন্দ করেন, আপনি কি চাইলেই পাঙ্গাসকে সবচাইতে পছন্দের মাছ বানাতে পারবেন? আপনার শরীরই রেজিস্টিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। ১৬-১৭ বয়সে হলে ব্যাপারটা খুবই সম্ভব ছিল যদি ইনটেনসিভ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হত।
স্কিল জন্মগত নয়, যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে যে কোনো স্কিল রপ্ত করা যায়। সেই স্কিলের মাস্টারিংয়ে হয়তবা কালচার, সিস্টেম, জেনেটিক সিকুয়েন্স, ফুড হ্যাবিট, পলিটিক্স সহ বহুরকম অনুঘটক যুক্ত হবে। প্রথমে স্কিলটাই নাহয় রপ্ত হোক, মাস্টারিং পরেও ভাবা যাবে।
বাংলাদেশে ব্যাটসম্যানদের ওয়ান ডাইমেনশনাল হিটিং দেখাটা নার্ভের উপর অত্যাচার। ক্রিকেটিয় আবেগ পাশে রেখে যদি ফাইনান্সিয়াল পয়েন্টেও বলি ২০২৩-২৭ সাইকেলটাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের লাইফলাইন। এই সময়ের মধ্যে নিজেদের আপডেট করতে ব্যর্থ হলে পরের চক্রেই খাদে পড়ার অনিবার্য বাস্তবতা উপস্থিত।
হে দুর্নীতিগ্রস্ত বিসিবি অভিযোগ আর আত্মপক্ষ সমর্থনের ছেলেখেলা ছেড়ে সত্যিকারের ম্যানলি খেলায় নামুন। সময় মাত্র ৫ বছর!