বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির রক্ষক, অভিভাবক এবং মুর্শিদ, কিংবদন্তী বাংলা একাডেমি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসন্ন বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দিবে না। আমার সমস্ত বই আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়, সেগুলোর বিক্রিসংখ্যা বড়জোর ১৫০-২০০, এবং বইমেলা সেখানে কোনো গুরুত্ব বহন করে না।
তবে ব্যক্তিগতভাবে আদর্শ প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী মাহাবুব রাহমান আমার কৌতূহল জাগানো মানুষদের একজন।
আদর্শ স্টল না পাওয়ার প্রসঙ্গটি ফেসবুকসূত্রে জানবার পর গতকাল থেকে প্রচুর লেখালিখি চোখে পড়ছে। সকল লেখার মূল সুর মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে, অন্যায় করা হয়েছে, নিন্দা জানাই প্রভৃতি।
আমার অবস্থান এক্ষেত্রে ভিন্ন। আমি মনে করি হাজার বছরের বাঙালিয়ানার ধারক বাংলা একাডেমির এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের জন্য এক প্যারাডাইম শিফটিং হতে পারে। সেই মিসিং লিংকগুলো অন্বেষণের অভিপ্রায়েই এ লেখার অবতারণা। রামমোহন রায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে যদি সমাজ সংস্কারক মানা হয়, বাংলা একাডেমি অবিসংবাদীভাবে সেই কৃতিত্বের দাবিদার।
আর্গুমেন্টটা প্রতিষ্ঠায় আপাতত ৭টি কারণ এন্ট্রি দিলাম-
কারণ১- রিয়েলিটি চেক। যে কোনো ক্রাইসিস থেকেই বৃহৎ অপরটুনিটি তৈরি হয়। বছরের ক্ষুদ্রতম মাস ফেব্রুয়ারি। বিগত ১৯ বছরের বইমেলা পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা থেকে আমার অনুসিদ্ধান্ত হলো শুক্র-শনি এবং ২১ শে ফেব্রুয়ারি, মেলা মূলত এই ৯ দিন। মাত্র ৯ দিনের আয়োজনের উপর নির্ভর করে একটা ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়ে আছে, এর চাইতে হাস্যকর ব্যাপার হতে পারে কিছু? যারা জামা-কাপড়ের ব্যবসা করে তাদের ব্যবসাটাও ঈদ নির্ভর, কিন্তু সেখানেও পিক সিজন মাত্র ৯ দিন ব্যাপী নয়! করোনার কারণে ২০২১ এর বইমেলাটাও তো ঠিকঠাক হতে পারলো না। তাই মেলামুখীতা থেকে সরে না এলে যে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে, এই সত্যটা মেনে সেই অনুসারে বিবর্তিত হওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের ধাক্কা প্রয়োজন ছিল। ধরা যাক আদর্শ সহ স্টল না পাওয়া প্রকাশনীর সংখ্যা ১৫-২০ টা, তারা কি তবে ব্যবসার সেক্টর বদলে ফেলবে? যদি এমন হয় অন্য ব্যবসার টাকা প্রকাশনাতে খরচ করে তাদের সমীকরণ আলাদা। কিন্তু বই বিক্রি করেই যদি কেউ বাজার-সদাইয়ের অর্থ যোগায়, তার জন্য এরকম আনস্টেবল বিজনেস মডেল কখনোই ইতিবাচক কিছু নয়। বাংলা একাডেমি সেই সত্যটা প্রমাণ করেছে।
কারণ২- সাপ্লাই চেইন মনোপলি ভাঙা। প্রকাশনা ইন্ডাস্ট্রির ১ নম্বর সমস্যা সাপ্লাইচেইন। ডিসপ্লে এর ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি, ডিস্ট্রিবিউশনে রকমারি ডট কম— এই একাধিপত্য বলয়ের বাইরে চিন্তা না করায় কিছুদিন পরপর মনোপলিতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে হয়। রকমারি সিদ্ধান্ত নিল অমুক লেখক বা প্রকাশকের বই বিক্রি করবে না, কিংবা সাইটে দৃশ্যমান অবস্থায় রাখবে না, আপনার কিচ্ছু করার নেই। বাংলা একাডেমি জানয়ে দিল স্টল পাবেন না, আপনার মাসব্যাপী কুয়াকাটা ভ্রমণ ব্যতীত কোনো করণীয় থাকবে না, যদিও ভ্রমণের অর্থ থাকবে না পকেটে। কিন্তু ডিসপ্লে আর ডিস্ট্রিবিউশনের যদি অনেকগুলো চ্যানেল থাকতো, রকমারি কিংবা বাংলা একাডেমি কারো জমিদারিই আপনার সহ্য করতে হতো না, নিজেই অপশন নির্বাচন করতে পারতেন। আপনার কাজ যদি কেবলমাত্র বই প্রকাশ হয়, তাহলে এর চাইতে অনেক প্রফিটেবল হলো প্রিন্টিং ব্যবসায় নামা। ধরা যাক বাংলা একাডেমি নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, রকমারি ডট কম বইয়ের পরিবর্তে কসমেটিক্স বিক্রি শুরু করলো, তখনো কি আপনি প্রকাশনা ব্যবসাতেই থাকবেন? এর উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলার জন্য যা যা দরকার সেই মেকানিজম প্রস্তুত করুন, নইলে অবসরে চলে যান। এমন রূঢ় মেসেজ বাংলা একাডেমি ব্যতীত কে দেয়ার সামর্থ্য রাখে; তবুও কি তারা কৃতজ্ঞতা পাবে না?
কারণ৩- ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট অন্তর্ভুক্তি সম্ভাবনা। যত যাই বলা হোক প্রকাশনা ইন্ডাস্ট্রির মূল ক্রাইসিস স্বল্প পুঁজি এবং লো-প্রফিট মার্জিন। একারণে প্রফেশনাল সেট আপই তৈরি হয়নি। বইমেলায় যদি ৪০০ প্রকাশনী স্টল বরাদ্দ পায় এর ৭.৫% অর্থাৎ ৩০টিও পাওয়া যাবে না যাদের স্থায়ী অফিস এবং সেখানে ১৫-২০ জন চাকুরিজীবী রয়েছে। এমন ভালনারেবল অবস্থার কারণেই বইয়ের বাজার তৈরি হয় না। তারা তাকিয়ে থাকে ১৫ থেকে ২৫ বয়সী টিনেজ আর তরুণদের দিকে, কখনোবা লেখকের সোস্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্স ফ্যাক্টরের দিকে, কনটেন্টও তৈরি করে সে নিরিখেই। ইমিগ্র্যান্ট বাঙালি, পশ্চিম বঙ্গ এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে যে বিশাল বাজার সেদিকে দৃষ্টিপাত করে সাসটেইনেবল কোনো একশন প্ল্যান নিতে পারে না। আইটি বা অন্যান্য স্টার্ট আপগুলোতে যখন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট যুক্ত হয় তখন ইনভেস্টরদের চাপ এবং চাহিদা সামলাতে অনেক ধরনের কৌশল নিতে হয় উদ্যোক্তাদের।।যেমন বই মানে কেন শুধু হার্ডকপি হবে। ই-বুক, অডিও বুক এর বাজার তৈরি হচ্ছে, সেদিকে কি খেয়াল রাখা হচ্ছে? তখন কিসের বাংলা একাডেমি! এগুলো তখনই সম্ভব যদি ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের এই বিজনেসে যুক্ত করা যায়, তারা তখনই যুক্ত হবে যখন প্রফিটেবিলিটি দেখানো যাবে, প্রফিটেবিলিটি তখনই বাড়বে যখন স্মার্ট বিজনেস পলিসি এবং সিস্টেম তৈরি করা যাবে। অনেকটা চেইন রিএকশনের মতো। তখন চাইলে প্রতি মাসে ৫ জেলায় সপ্তাহব্যাপী মেলা আয়োজন করা যাবে। বরগুনা বা ঈশ্বরদীতে যদি ৫ দিনব্যাপী মেলার আয়োজন হয় সেখানে বাংলা একাডেমি কি আদৌ কোনো ইস্যু। একজন সামান্য ইজারাদার যদি জমির মালিক হয়ে যায় তখন জটিলতা তৈরি হবেই।
কারণ৪- লেখকের ঘুম ভাঙানো। একতরফাভাবে প্রকাশকদের দোষ না দিয়ে লেখকদেরও কিছু দায় দেয়া উচিত। যেহেতু আমি প্রচুর সংখ্যক মানুষের ইন্টারভিউ নিই, সে তালিকায় লেখকও থাকে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি লেখকদের বড় অংশই বই প্রকাশের জন্য মেলামুখী, বছরের অন্য সময়ে বই প্রকাশে ভীষণ অনাগ্রহী। যারা মূল উৎপাদক তারাই যদি নির্দিষ্ট সময়ের চক্রে বাধা পড়ে তখন সমগ্র সিস্টেমটাই স্থবির হয়ে পড়ে অথবা কলাপ্স করে। মেলামুখীতার কারণে লেখকদেরও অনেকে আয়েশ করতে করতে মেদবহুল হয়ে পড়েছেন। এরকম ঘটনা তাদের জন্য ওয়েক আপ কল হতে পারে। বাংলা একাডেমি ছাড়া কে পেরেছে সেই দায়িত্ব পালন করতে!
কারণ৫- লিটারেরি এজেন্সি অনিবার্যতা। বইয়ের মার্কেটিং এবং প্রমোশনের ক্ষেত্রেও হযবরল অবস্থা। দেখা যায় বই লেখার পর লেখকের নিজেরই অনবরত প্রমোশন চালাতে হয়। পুরো ব্যাপারটা আনহেলদি। টিকে থাকতে হলে প্রমোশনের বিকল্প নেই এটা অনুধাবন করলে লিটারেরি এজেন্সিও জন্ম নিবে। কিন্তু ১মাস মেলা ১১ মাস ঘুম নীতিতে অধিকাংশ প্রকাশক একেকজন কুম্ভকর্ন হয়ে আছে। কম্বলে আগুন ধরলে কুম্ভকর্নগিরিও ছুটে যাবে সহসা। বাংলা একাডেমি বুঝিয়ে দিয়েছে এতদিনেও লিটারেরি এজেন্সি তৈরি না হওয়াটা কত বড় দৈন্য আর লজ্জার বিষয়
কারণ৬- প্রাইসিং মডেল ফ্যালাসি। বাংলাদেশে বই ই বোধহয় একমাত্র প্রোডাক্ট যেটা কখনো MRP তে বিক্রি হয় না। আমরা একটা নারিকেল তেল কিনতেও প্রাইস ট্যাগ অনুসারে কিনি। কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে বই বিক্রি হয় প্রাইস ট্যাগের ১৫বা ২০% ডিসকাউন্টে, মেলা চলাকালীন সেটা ২৫%! প্রকাশনা খাত প্রফেশনাল বিজনেস সেক্টর না হতে পারার পেছনে এই খয়রাতি মানসিকতারও দায় নিদারুণ। ধরা যাক কেউ মনে করে ডিসকাউন্ট দিবে না, কেউ মনে করে বিক্রি বাড়াতে ২৫ এর বদলে ৩৫% ডিসকাউন্ট দিবে— ব্যবসায়িক পলিসি নির্ধারণের অধিকার নিজের কাছেই৷ যদি স্টল না দেয়া হয় বাংলা একাডেমির গণশিক্ষা কার্যক্রমও ইনভ্যালিড হয়ে পড়বে।
কারণ৭- meme শিল্পের বিকাশ। আমরা যদি বাংলা একাডেমিকে একটি এন্টারটেইনমেন্ট প্রতিষ্ঠান গণ্য করি যাদের মূল দায়িত্ব হাস্যরসের খোরাক যোগানো, তখন সমগ্র ডায়নামিক্সটাই অন্যভাবে কাজ করবে। বর্তমান সোস্যাল মিডিয়ায় সবচাইতে জনপ্রিয় বিভিন্ন meme, সেসব কনটেন্ট আসে চলমান সমাজ থেকেই। বাংলা একাডেমি যদি নিজেদের তৎপরতা জারি রাখে নিত্যনতুন meme তৈরি হবে, সেসবের ভিউ থেকে আসবে ডলার, তাতে রিজার্ভ সংকট একটু হলেও কমবে।
বাংলা একাডেমির এমন দূরদর্শী কর্মকাণ্ডের অন্যরা যতই নিন্দা করুক, আমার নিরংকুশ সমর্থন রয়েছে তাদের প্রতি। আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে নিবেদন করলাম ৭৭৯ খানা টকটকে জবা ফুল!
পুনশ্চ- বাংলা একাডেমি স্টল না দেয়ার পেছনে ৩ জন লেখকের বইয়ের রেফারেন্স দিয়েছে শুনলাম। জিয়া হাসান যে বই লিখে তা ই জানতাম না, তাকে একজন সোস্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্ট হিসেবেই জানতাম। ফাহাম আব্দুস সালাম যে মির্জা ফখরুলের জামাতা তাও প্রথম জানলাম। বাংলা একাডেমি এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মূলত ওই ৩ লেখক এবং তাদের বইগুলোর ব্যাপক ব্রান্ডিং করে দিল। আগে যদি বিক্রি হত ১০ কপি এখন সেটা অনায়াসে ৭০ এ উঠে যাবে। নেগেটিভ মার্কেটিংই যে বড় মার্কেটিং বাংলা একাডেমির বিজ্ঞ পরিচালকদের তা অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। সুতরাং বিএনপি-জামাতের যোগসাজশে খোদ বাংলা একাডেমিই সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কিনা, সেই তদন্তের দাবি তুলে সকলের সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করছি।