ক্রিকেট মাঠের পারফরম্যান্সে সিনিয়র-জুনিয়র আসলেই কি কোনো ইস্যু হতে পারে? ১৯ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান কি ৩২ বছর বয়সী বোলারের বলে চার-ছক্কা হাকাবে না, কিংবা ১৯ বছরের বোলার কি ৩২ বছরের ব্যাটসম্যানকে বোল্ড আউট করতে বিব্রত বোধ করে কখনো? প্রশ্নটা খুবই হাস্যকর, কিন্তু ২০১৬ এর টি২০ বিশ্বকাপের পর থেকে বাংলাদেশের ওয়ানডে ম্যাচ মানেই সিনিয়র-জুনিয়র নামে স্পষ্ট দুটো বিভাজন লক্ষ্য করছি। সুনির্দিষ্ট করে বললে, ২০১৬ এর টি২০ বিশ্বকাপ চলাকালে হোটেলরুমে মাশরাফি, মুশফিক, সাকিব, তামিম, মাহমুদুল্লাহ এর একত্রিত একটা ছবি সম্ভবত অনলাইন পত্রিকায় এসেছিলো, যার ক্যাপশন ছিলো ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডব’। খুবই ক্যাচি ক্যাপশন, মহাভারতসূত্রে পঞ্চপাণ্ডব শব্দবন্ধটা এমনিতেই প্রচলিত ছিলো।

ওই ক্যাপশনের সুবাদে পঞ্চপাণ্ডব শব্দবন্ধটা বাংলাদেশ ক্রিকেটে এস্টাব্লিশড হয়ে যায়, এবং কাকতালীয়ভাবে তারপর থেকে পরিসংখ্যানও প্রমাণ করে যে- বাংলাদেশ যেসমস্ত ম্যাচে জিতেছে তার প্রতিটিতেই ওই ৫ জনেরই কেউ না কেউ ম্যাচসেরা হয়েছে অথবা অন্যতম শীর্ষ পারফরমার ছিলো। অথচ ২০১৬ এর আগে সৌম্য, মুস্তাফিজ, নাসির, সাব্বির, এনামুল, তাসকিন, আলআমিন দের দেখে ধারণা করা হচ্ছিলো একটা ব্যালান্সড ওয়ানডে দল হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। হঠাৎ কেন এই ছন্দপতন? সেটা বুঝতে চাই বলেই এই লেখার অবতারণা। ২০১৭ এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শেষে তৎকালীন কোচ হাথুরুসিংহ তার প্রতিক্রিয়ায় – দলের জুনিয়ররা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না জাতীয় স্টেটমেন্টের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ‘জুনিয়র’ শব্দটা সামনে নিয়ে আসে। ২০১৬ সাল প্রায় পুরোটাই টি২০ খেলে কেটেছে; কেবল আফগানিস্তান আর ইংল্যান্ডের সাথে দুটো ওয়ানডে সিরিজ হয়েছিলো সম্ভবত।

অভিজ্ঞ আর তারুণ্যের মিশেলেই ব্যালান্সড দল হয় সবসময়। ১৯৯৬ সালে বয়স খুবই কম ছিলো, তবু স্মৃতিশক্তির প্রতি অগাধ আস্থা রেখে ৯৬ বিশ্বকাপের শ্রীলংকা দলটিকে যদি দেখি- রানাতুঙ্গা, ডিসিলভা, গুরুসিংহা, মাহনামা, হাশান তিলকারত্নে, বিক্রমাসিংহের সাথে তরুণ জয়াসুরিয়া, কালুভিথুরানা, মুরালিধরন, ধর্মসেনা, চামিণ্ডা ভাসের সমণ্বয়েই গড়ে উঠেছিলো ডার্ক হর্স এক ওয়ানডে দল।

এমনকি ৯৬ পরবর্তী ক্রিকেট পর্যবেক্ষণ থেকে বাংলাদেশ দলের ডেভেলপমেন্টকেও একই প্যাটার্নে ফেলে দেয়া যায়। অভিজ্ঞ নান্নু, আতহার, আকরাম, বুলবুল, সুজন, মনি, সাইফুলদের পাশে তরুণ দুর্জয়, পাইলট, রফিক, শান্ত, জাভেদ ওমর, হাবিবুল বাশার খেলছে। ব্যাকআপ বা রিজার্ভে আছে বিদ্যুৎ, অপি, রোকন, মঞ্জুরুল, শফিউদ্দিন বাবু, মোর্শেদ আলী খান সুমনরা। পাইলট, হাবিবুলরা যখন অভিজ্ঞ তখনই চলে আসছে বা আসার জন্য তৈরি হচ্ছে আশরাফুল, মাশরাফি, নাফিস ইকবাল, আফতাব, শাহরিয়ার নাফিস, তালহা জুবায়ের, অলক কাপালী, শাহাদাত হোসেন রাজীব, মাহমুদুল্লাহরা। আশরাফুল, মাশরাফিরা অভিজ্ঞ হতে হতেই দলে এলো বা আসতে থাকলো সাকিব আল হাসান, তামিম, মুশফিক, ইমরুল, জুনায়েদ সিদ্দিকী, সোহরাওয়ার্দি শুভ। এইসময়ে আইসিএল ইস্যুতে বাংলাদেশের ক্রিকেট একটা বড়ো ঝাঁকুনি খায়; তাছাড়া পাইলট, হাবিবুলদের সাথে আশরাফুল, মাশরাফিদের বয়সের বা ক্যারিয়ারের যা গ্যাপ, তুলনায় সাকিবদের ব্যাচের সাথে গ্যাপটা অনেকটাই কম। এই সময়টায় তাই একটা ব্লেন্ড বা সংমিশ্রণ ঘটে দলে; নিরঙ্কুশ অভিজ্ঞ অথবা তরুণের লেয়ারটা কার্যত ছিলো না তখন।

কাছাকাছি সময়ে এনামুল, মিঠুন, নাসির, সাব্বির, সৌম্য, মমিনুল, লিটনরা তৈরি হচ্ছিলো। এবং পাইপলাইনে মুস্তাফিজ, মোসাদ্দেক, মিরাজ, শান্তরা।

প্রসেসটা মোটামুটি স্মুথলিই চলছিলো। সমস্যাটা শুরু হয়েছে আদতে এনামুলদের ব্যাচ থেকে। সুনির্দিষ্ট করে বললে নাসির, সাব্বির, এনামুল, সৌম্য, তাসকিন এই ৫জন। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, চাইলে এদেরও পঞ্চপাণ্ডব বলা যেতে পারে। ২০১২ এর এশিয়াকাপে নাসির বেশ ভালো পারফরম করেছিলো, ২টা ম্যাচে সম্ভবত ৪ এ ব্যাট করেছিলো। টেস্টেও কিছু রান করেছিলো, সেই সময়ে তাকে আর এক নায়িকাকে ঘিরে স্ক্যান্ডাল শোনা যায়, যদিও সেসময় দর্শকরা তার পারফরম্যান্সকেই প্রায়োরিটি দিচ্ছিলো। নাসির যখন ফর্ম হারিয়ে ফেলছে প্রায়, সেই সময়টাতে সাব্বির ঢুকে পড়ে দলে। ২০১৫ বিশ্বকাপের অল্পদিন আগে হ্যাপি কেলেংকারীতে রুবেল হাজতে ঢুকে, বিশ্বকাপ চলাকালে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে দেশে ফেরত পাঠানো হয় আলআমিনকে। বিশ্বকাপে টিম কম্বিনেশনের কারণে সাব্বিরের কাছে ৭ নম্বর পজিশনটা হারিয়ে ফেলে নাসির। ৭ নম্বরে সাব্বির মোটামুটি সাফল্যই দেখায়। সৌম্য দারুণ ফ্ল্যাশি ব্যাটিং করে বেশ কয়েকটা ৩০+ ইনিংস খেলে, স্কটল্যান্ডের সাথে ম্যাচটাতে ফিল্ডিংকালে ইনজুরিতে পড়ে বিজয় দেশে ফিরে আসে। পরের ৩টা সিরিজে সৌম্য ওপেন করে, এবং চোখ ধাঁধানো কয়েকটা ইনিংস খেলে। পাকিস্তানের সাথে একমাত্র টি২০তে অভিষিক্ত মুস্তাফিজ আহামরি কিছু না করলেও ভারত সিরিজেই হৈচৈ ফেলে দেয়, সাউথ আফ্রিকা সিরিজেও সেটা অব্যাহত থাকে। সৌম্য দারুণ দুটো ইনিংস খেলে। সিরিজ শেষে ‘এ’ দলের হয়ে ভারত সফরে যাওয়ার কথা থাকে তার, তখন একবার ইনজুরিতে পড়ে, এবং সৌম্য ম্যাজিকের সমাপ্তি। অন্যদিকে সাব্বির তখনো পর্যন্ত ওয়ানডেতে ৭ নম্বরে আর টি২০ তে ওয়ানডাউনে ব্যাট করছিলো। এশিয়া কাপ টি২০ তে শ্রীলংকার বিপক্ষে ৮০ করার পর ওয়ানডেতেও তাকে ৩ এ উঠিয়ে আনা হয়, সুযোগ পায় টেস্টেও। ফার্স্ট ক্লাসে দুর্দান্ত খেলতে থাকা মোসাদ্দেক দলে ঢুকলেও ৭-৮ খেলিয়ে খেলিয়ে তাকে একজন ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে কাজে লাগানো হতে থাকে, যদিও সে পিউর ব্যাটসম্যান, বোলিংটা অপশনাল। মমিনুল টেস্টে সাফল্য পায়, ২০১৫ এর বিশ্বকাপে দলেও ছিলো। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে তার নামার কথা ছিলো ৩ নম্বরে, টিম ম্যানেজমেন্ট সৌম্যকে ৭ থেকে ৩ এ উঠিয়ে আনায় তাকে নামতে হয় ৮ নম্বরে। শ্রীলংকার বিপক্ষের ম্যাচে ওপরে খেললেও স্কোর করতে ব্যর্থ এবং তারপরই হঠাৎ করে তার টেস্ট স্পেশালিস্ট হয়ে যাওয়া।

২০১৫ বিশ্বকাপের পূর্বে সাবেক ক্রিকেটাররা তাদের পছন্দের দল বানাতে থাকে পত্রিকার জন্য। পাইলটের দলটা আমাকে কৌতূহলী করে; তার দলে সে লিটন দাসকে রেখেছিলো, এবং বলেছিলো, সে হতে পারে দলের এক্স-ফ্যাক্টর। রনি তালুকদার আর লিটন দাসের নাম তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিলো। বিশ্বকাপের দলে তাদের কারোরই জায়গা না হলেও তার ঠিক পরের মাসে পাকিস্তান সিরিজে রনি তালুকদার, এবং ভারতের বিপক্ষে লিটন দাস দলে সুযোগ পেয়েছিলো; অবশ্য পাকিস্তান সিরিজে একটি ম্যাচেও একাদশে ছিলো না রনি। সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে টি২০ তে রনিকে ব্যাট করানো হয়েছিলো ৮ এ, যদিও সে একজন ওপেনার। ভারত-সাউথ আফ্রিকা ওয়ানডে সিরিজে লিটন ব্যাট করেছিলো ৩ এ, এবং এই কয়েকটা ম্যাচের ব্যাটিং দেখেই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা রায় দিয়ে দেয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার কোনো যোগ্যতাই নেই লিটনের, সে আপাদমস্তক লেগ সাইডের প্লেয়ার। সাউথ আফ্রিকার সাথে বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত টেস্টটিতে স্পেশালিস্ট কিপার হিসেবে ৬-৭ এ ব্যাট করে লিটন ৪০+ একটি ইনিংস খেলেছিলো, ডেল স্টেইনকে স্ট্রেইট ড্রাইভ করে চার মারার পর ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের খুব ছোট্ট একটা অংশ আশ্বস্ত হয়, আশরাফুলের পরে একটা স্পেশাল ট্যালেন্ট পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু বিপিএল এ চরম বাজে পারফরম্যান্সের কারণে তাকে ঘিরে প্রত্যাশাটা ফিঁকে হয়ে যায়, তবুও শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্ট দলে সুযোগ পায় সে, যদিও ইনজুরিতে পড়ার কারণে বাংলাদেশের শততম টেস্টটিতে একাদশে থাকা হয় না।

তবে লিটনের ক্যারিয়ার সেটেল করতে সঞ্জীবনী হিসেবে কাজ করে সাউথ আফ্রিকা সফরে কোনো এক টেস্টে ৭০ রানের ইনিংস খেলা এবং নিদহাস ট্রফিতে শ্রীলংকার ২১৫ চেজ করে জেতা ম্যাচে ওপেনিংয়ে ৪০+ ইনিংস খেলে মোমেন্টাম নিজেদের ফেভারে নিয়ে আসার প্রেক্ষিতে। সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই ৭০ রানের ইনিংস যারা দেখেছে তারা নির্দ্বিধায় স্বীকার করবে, আশরাফুলের চাইতেও ট্যালেন্টেড, এবং পরের প্রজন্মের তামিম ইকবাল যদি কেউ হয়, সেটা এই লিটন দাসই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি২০ তে ৬১ করার পর, এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়, ইনজুরিতে না পড়লে ২০১৯ বিশ্বকাপে লিটনই ওপেন করবে।

৬-৭ বছর আগেও বাংলাদেশ ক্রিকেট কালচার ছিলো, বয়স একটু বাড়লেই তাকে ব্রাত্য বানিয়ে ফেলা হতো, তারুণ্যকে প্রমোট করা হতো। এ নিয়ে লেখালিখি হতো বিস্তর। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে যেখানে ৩০ পেরুনোর পরে টেস্ট অভিষেক হয় অনেক প্লেয়ারের, সেখানে বাংলাদেশের কারো বয়স ৩০ হয়ে গেলেই তার ক্যারিয়ার সায়াহ্নে চলে আসে; চিরকালই বাংলাদেশ কচি-কাঁচার আসর ছিলো। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই হাইপোথিসিসের সমালোচক ছিলাম, কিন্তু ২০১৪তে নিজে যখন একটা ক্রিকেট টিম গঠন করি তখন থেকেই দেখতে পাচ্ছি, বাঙালিদের বডি স্ট্রাকচার এবং ফিটনেসের সাথে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের তুলনা করা যাবে না, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে ভৌগলিক যথেষ্ট মিল থাকা সত্ত্বেও তুলনাটা করা যাবে না, কারণ লেগে থাকা এবং ধারাবাহিকতা (পারসিসটেন্স এবং কনসিসটেন্সি) এই দুটো যোগ্যতা সুপ্রাচীনকাল থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মধ্যে নেই বললেই চলে।

ক্রিকেট একটা খেলা, এবং এটাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে হলে যে দূরদর্শীতা এবং ভিশনের প্রয়োজন হয় সেটার নিদারুণ ঘাটতি। এখানে ক্রিকেটার মানে তার কিছু স্কিল আছে মাত্র; স্পোর্টস ইথিক্স, স্পোর্টসম্যানশিপ, এবং স্পোর্টস মাইন্ডসেট প্রভৃতি গুণাবলীর সাথে পরিচয়ই নেই। যে কারণে, ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা হয় লীগে খেলবো, বিভিন্ন জেলার লীগে খ্যাপ খেলবো, তারপর একদিন একটা ফাঁকা জায়গায় নেট বসিয়ে একাডেমি নাম দিয়ে কোচ হয়ে যাবো, নয়তো দোকান দিবো; জাতীয় দলে খেলতে পারলে বোনাস, না পারলেও সমস্যা নেই।

এই থিংকিং প্রসেসকে কি দোষ দেয়া যায়? ইকোনমিক্সের অন্য সেক্টরগুলোর সাথে তুলনা করলে উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে রেফারেন্স ডাটা পাওয়া যাবে। একজন চাকরিজীবী রিটায়ার করে ৫৭-৫৮ বছর বয়সে, ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার থেমে যায় ৩৫-৩৬ এর আশপাশেই, ফিটনেস ভালো হলে আরো ২-৩ বছর খেলে কেউ কেউ। অবশ্য চাকরিজীবীর ক্যারিয়ার শুরু হয় ২৫ এর পরে, ক্রিকেটারেরটা ১৭-১৮ এর আশপাশে। সমাজ কাঠামোতে ৩৫-৩৬ বছরের একজন মানুষ পুরোমাত্রায় প্রোডাক্টিভ, সেখানে ওই বয়সে একজন ক্রিকেটারের প্রোডাক্টিভিটি ফুরিয়ে যাওয়ার শেষপ্রান্তে। তাছাড়া যে কোনো মুহূর্তে ভয়ানক কোনো ইনজুরিতে ক্যারিয়ার চিরতরে শেষ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তো থাকেই। নদীভাঙা এলাকার মানুষগুলো সবসময় যেমন অস্তিত্ব সংকটে ভুগে, ক্রিকেটারদের মানসিক অবস্থাটাও তেমনই, যদিও বিশ্বজুড়েই স্পোর্টসম্যানদের উপার্জন অন্য যে কোনো গতানুগতিক পেশাজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা তবু সারভাইভাল ইস্যুতে আতঙ্কিত থাকে, কারণ অধিকাংশেরই বেড়ে উঠা মধ্যবিত্ত অথবা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। হঠাৎ করে পাওয়া তারকাখ্যাতি, স্পন্সর, টাকা- এই উত্তাপের সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য যে ম্যাচিউরিটি দরকার সেটা বেশিরভাগেরই থাকে না।

প্রশ্ন হলো, সাকি-তামিম বা মূশফিকরা তবে বিগড়ে গেলো না কেন? সাকিব বা তামিমের অপ্রীতিকর ঘটনা কম নেই, কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই উশৃঙ্খলতাজনিত নয়, এরোগেন্স বা বাজে ব্যবহারের প্রতিফল। তারা যখন তরুণ ছিলো, তখনো বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিপুল পরিমাণ টাকা আসেনি, আসার ফ্লো শুরু হচ্ছে মাত্র। অনেকসময়ই বিত্তবানদের সন্তানরা বখে যায় প্রাচুর্যের কুফলে, তারা মনে করে বাবা-মা যা কামাই করেছে ৩ পুরুষ বসে খেলেও শেষ হবে না। তখন তাদের মধ্যে উশৃঙ্খলতা বাড়তে থাকে। সাকিবদের পরের ব্যাচের ক্ষেত্রেও এই হাইপোথিসিস চলবে কিনা, এটা বলা কিছুটা জোর করে মেলানোর মতো হয়ে যাবে। লিটন, মমিনুল, মোসাদ্দেক, মিরাজ এখনো অব্দি উশৃঙ্খলতার কোনো নিদর্শন রাখেনি। পরের প্রজন্মের স্ট্যান্ডার্ড তাহলে কে; মমিনুল, নাকি সাব্বির-আলআমিন?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চাইতে আলোচনা ভিন্ন এক আঙ্গিকে শিফট করাটা যৌক্তিক মনে হচ্ছে। রিচার্ড ম্যাকিন্স নামে অস্ট্রেলিয়ান এক কোচ ছিলো বয়সভিত্তিক দলে, যার তত্ত্বাবধানে নাফিস ইকবাল, আফতাব, নাজিমুদ্দিন থেকে শুরু করে সাকিব, তামিম, মুশফিকদের সেমি-অস্ট্রেলিয়ান মেন্টাল টাফনেস গড়ে উঠেছে। ক্রিকেটারদের মাইন্ডসেট গঠনে এই অস্ট্রেলিয়ানের অবদান তৎকালীন অনেক তরুণ ক্রিকেটারই স্বীকার করে [যদিও বাংলাদেশে কোনো যোগ্য কোচ নেই মন্তব্য করে বড়োসড়ো বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছিলো ম্যাকিন্স।] এখনকার বয়সভিত্তিক দলগুলোতে ম্যাকিন্সের মতো কোচ কেউ কি আছে কিনা জানি না কেন? ম্যাকিন্সের সম্বন্ধে তো আমার জানারই কথা নয়, কীভাবে জেনেছি? পত্রিকায় বয়সভিত্তিক দল তখন গুরুত্ব পেতো, সেসূত্রে কোচের কথাও থাকতো। বয়সভিত্তিক দল নিয়ে এখন আর তেমন কথা শোনা যায় না তেমন, সকলের একমাত্র আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় দল। আরে ভাই, বয়সভিত্তিক দলই যদি ডেভেলপ না করে তাহলে জাতীয় দলে শক্ত পাইপলাইন তৈরি হবে না, ১০ বছর ধরে ইমরুলের মতো খেলোয়াড়কে বহন করতে হবে, কারণ যাদেরই সুযোগ দেয়া হচ্ছে তারা ব্যর্থ হয়ে ইমরুলকে ফেরার স্কোপ করে দেয়। জাতীয় দলে হাইপ্রোফাইল কোচের দরকার যতটুকু, বয়সভিত্তিক দলের ক্ষেত্রে দরকারটা আরো অনেক বেশি। বাংলাদেশের মতো নাজুক ভিত্তির দলের ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা আরো কঠিন এবং অনিবার্য।

বিগত ১৮ বছরের ডাটা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এই সময়ে জাতীয় দলে যারা ভালো পারফরমার ছিলো বা আছে, প্রত্যেকেই বয়সভিত্তিক দলে খেলার অভিজ্ঞতাসম্প্ন। ঘরোয়া লীগের কোনো পারফরমার কখনোই জাতীয় দলে স্থায়ী হতে পারেনি বা চোখে পড়ার মতো কোনো পারফরম্যান্সই দেখাতে পারেনি। ইনভেস্টমেন্টটা তাহলে বাড়ানো উচিত কোথায়? অবশ্যই বয়সভিত্তিক দলের পেছনে। বিসিবির গভর্নিং বডিতে যারা আছেন প্রত্যেকেই বিজনেসের সাথে জড়িত। সংগঠক হিসেবে নয়, আমি তাদের বিজনেসম্যানশিপের যোগ্যতা নিয়েই সন্দিহান। সম্ভবত, রাজনৈতিক প্রভাব দিয়েই তারা বিজনেসম্যানশিপের অযোগ্যতা আড়াল করে। নইলে কোথায় ইনভেস্ট করলে আরওআই বেশি আসবে, এটা বোঝার মেধা-মনন কি একজনেরও নেই? চলমান প্রক্রিয়ায় যদি ৩৭ কোটি লুটপাট করতে পারে, একটু স্ট্র্যাটেজিক হলে লোপাটের পরিমাণ হবে ৭৩ কোটি। সেই বোধও নেই, অদ্ভুত অযোগ্যতা সব!

লীগের পারফরমাররা ভালো করতে না পারার কারণ কী? মুখস্থ একটা উত্তর টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে শুনে আসছি। আমাদের ঘরোয়া লীগের অবকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল মানের। পাল্টা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, আফগানিস্তানের অবকাঠামো কি মানসম্মত? মুখস্থ উত্তরের ভিতরে যে ওপেন সিক্রেট রয়েছে সেটাকেই ঘরোয়া লীগের কোনো পারফরমারের আজ অব্দি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালো না করার প্রধান কারণ হিসেবে সনাক্ত করতে চাই আমি। দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে এক বোলার আম্পায়ারের দুর্নীতির প্রতিবাদ করে এক ওভারে ৬৯ বা ৮৮ রান দেয়ায় বিসিবি তাকে ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আমার ক্রিকেট টিম, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত যেটিকে রকমারি ডট কম স্পন্সর দিবে, সেখানকার সব খেলোয়াড়ই থার্ড ডিভিশন আর সেকেন্ড ডিভিশন লীগে খেলে। ওদের অভিজ্ঞতার আলোকে জানি, ম্যাচগুলো কীভাবে পাতানো হয়, টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই সবাই কীভাবে জেনে যায় এবার কোন্ দুটি দল উপরে উঠবে, কারা রেলিগেশন খেলবে। বোর্ডে কাউন্সিলর হওয়ার একটা ব্যাপার আছে; কত হিসাব-নিকাশ। ম্যাচগুলো খেলে আম্পায়ার আর অফিসিয়ালরা। ফলে বোর্ডে পাওয়ারফুল কেউ আছে এরকম কোনো কর্তাব্যক্তির ব্যাটসম্যানরা জানে বোল্ড আর ক্যাচের বাইরে তার জন্য কোনো আউট নেই। অন্যদিকে যেসব দলের কর্মকর্তারা বোর্ডে ক্ষমতাধর নয়, তাদের ব্যাটসম্যানরা ভয়ে থাকে- পায়ে বল লাগলেই এলবিডব্লিউ, বল মিস করলে কট বিহাইন্ড, চিকি সিঙ্গেল নিতে গেলে রান আউট। ক্রিকেট খেলাটা রিদমনির্ভর, এক মাইক্রো সেকেন্ডে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কোন্ বলে কী শট খেলবো। মাথায় যদি এরকম প্রেসার নিয়ে খেলতে হয়, সেই ব্যাটসম্যান পারফরম করবে কীভাবে। থার্ড ডিভিশনে খেলা আমার টিমের ২ খেলোয়াড়ের দুটো অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। অভিজ্ঞতা১- সে ব্যাট করতে নেমেছে; আম্পায়ার তাকে জিজ্ঞেস করছে নিজে থেকে আউট হবা, নাকি আমি আউট দিবো? অভিজ্ঞতা২- একটি বিশেষ দলকে সুবিধা দিতে পিচে পানি ঢেলে ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে পয়েন্ট ভাগাভাগি হয়। ফলে মুড়ি মুড়কির মতো উইকেট পাওয়া বা রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে দেয়া কোনোটাই ভ্যালিড কিছু নয়; আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেহেতু এইসব মামদোবাজি চলে না, আম্পায়ার কেনার সুযোগ থাকে না, সেখানে পারফরম করার যোগ্যতাই গড়ে উঠে না তাদের।

বোর্ড, নির্বাচক তারাও এগুলো জানে, যেকারণে লীগের পারফরম্যান্সকে আমলে নেয়াই হয় না সচরাচর। বয়সভিত্তিক দলগুলোতে কিংবা বিদেশী ট্যুরগুলোতে কে কেমন পারফরম করছে তার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয় কে জাতীয় দলে খেলবে, কার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

লীগগুলো চালানোর দরকার কী তবে? কালো টাকা সাদা করা, কিংবা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার কোনো ইস্যু থাকতে পারে। বিস্তারিত জানি না বলে অভিযোগ করতে চাই না। বাংলাদেশের লীগগুলো আসলে চলা না চলা একই কথা।

আমার বক্তব্য আরো গ্রহণযোগ্যতা পাবে যদি জাতীয় দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের লীগের পারফরম্যান্স রেকর্ড বিচার করা হয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রান করা বা উইকেট পাওয়া খেলোয়াড়রা কেন ঘরোয়া লীগে অসফল? এটার একমাত্র কারণ, লীগকে একদমই গুরুত্ব না দেয়া। বাংলাদেশ টেস্ট দলের কতজন খেলোয়াড় বিসিএল বা এনএসিএলে খেলে? তাদের ফার্স্ট ক্লাস খেলার টেম্পারমেন্ট আসে কোত্থেকে তাহলে? সাকিব সারা বছর যতগুলো টি২০ লীগ খেলে, কয়েকটা কমিয়ে সে যদি কাউন্টিতে খেলতো, সেটা তার স্কিল আর টেম্পারমেন্ট বৃদ্ধিতে অনেক কাজে আসতো। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে সে কাউন্টিতে ডাক পেয়েছিলো; সেটা কেন কন্টিনিউ করেনি সে-ই বলতে পারবে। অন্যদের যেহেতু সেই ক্যালিবার নেই তারা বিসিএলটাকে সিরিয়াসলি নিতে পারতো। তার পরিবর্তে তাদের আগ্রহ বিপিএল এ। আমরা ভারতের আইপিএল এর সমালোচনায় মুখর, কিন্তু এটা ভুলে যাই তারা রঞ্জি ট্রফির মতো এতো শক্তিশালী টুর্নামেন্ট চালিয়ে আসছে সুদীর্ঘকাল যাবত।

টি২০, ওয়ানডে, টেস্ট- এই ৩ ফরম্যাটকে আমি যথাক্রমে বিজ্ঞাপনচিত্র, টিভি নাটক, এবং বড়ো পর্দার সিনেমা হিসেবে দেখি। টি২০ আর টেস্ট- দুটো ফরম্যাটের জন্যই স্কিল আর টেম্পারমেন্টের সর্বোচ্চ প্রদর্শনী দিতে হয়। অনেকে মনে করে, টি২০ মানে কেবলই চার-ছক্কা, কিন্তু আমি মনে করি এটা একটা ব্যতিক্রমী স্কিলের খেলা। বাংলাদেশ টি২০ আর টেস্ট- এই দুই ফরম্যাটে বাংলাদেশ কোনোদিনই সাফল্য পাবে না স্কিলের অপূরণীয় ঘাটতির কারণেই। ওয়ানডেতে সাফল্য পাওয়ার ফরমুলাটাও সহজ। এখনকার ক্রিকেটে পার স্কোর ৩০০ এর কাছাকাছি বা ওপরে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ভালো খেলা এখনো সেই ২৬০-৭০ লেভেলের। তবে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, এরকম স্কোর করতে পারলে ইন্ডিয়া ব্যতীত বাকি দলগুলোর বিপক্ষে অজানা কোনো কারণে বেশিরভাগ সময়ই রানটা ডিফেন্ডও করে ফেলে। এই রেসিপিও নিকট ভবিষ্যতে অকার্যকর হয়ে পড়বে; হোয়াট নেক্সট?

সম্ভবত বর্তমান সময়েই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের ব্যালেন্সডতম দল মাঠে নামে। ৫ জন সিনিয়রের বাইরে মুস্তাফিজ, রবিউল, মিরাজ। মাত্র ৩টা পজিশনেই ঘুরেফিরে খেলোয়াড় বদল হয় [২য় ওপেনার, নাম্বার থ্রি, সাত নাম্বার]। একাদশের ৮০% খেলোয়াড় যখন অটোচয়েজ হয়ে যায় তখন সেই দলের পারফরম্যান্স গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখীই হওয়ার কথা। ৯৬ এর শ্রীলংকাও এরকম একটা পজিশনে ছিলো; তারা সেটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে কাপ জিতে নিয়েছিলো। বাংলাদেশ হয়তোবা সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি এখনো, কিন্তু ডিসিলভারা যাওয়ার পূর্বেই সাঙ্গাকারা, জয়াবর্ধনেরা তাদের ব্যাটনটা নিতে পেরেছিলো। ২০২৩ সালের মধ্যেই বর্তমান স্কোয়াডের ৭ জনেরই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৮৯%; সবার আগে অবসরে যাবে মাশরাফি; তারপরে তামিম, মাহমুদুল্লাহ। সাকিব আর মুশফিকের মধ্যে কে আগে বা কে পরে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না । রুবেলের উশৃঙ্খলতা আর মুস্তাফিজের অতি ইনজুরিপ্রবণতা ৫ বছর পরেও তাদের দলে রাখার পথে বড়ো বাধা যা তারা অতিক্রম করতে পারার সম্ভাবনা দেখি না। কেবলমাত্র মিরাজই টিকে যাবে। বয়সভিত্তিক দলে যে ছেলেটা সবসময় জেনুইন ব্যাটসম্যান কাম অফস্পিনার হিসেবে খেলেছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে এসে তার বোলার বনে যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক। তার দরকার কেবল ১টা সুযোগ; কোনো একটা সিরিজে উপরের দিকে ব্যাটিং করে ফিফটি বা সেঞ্চুরি করলেই ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের কনফিডেন্স ফেরত পাবে।

বাকি ১০ জন কারা যারা ২০২৪ এর সিরিজে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে?

এর চাইতেও গুরুতর প্রশ্ন হলো, হঠাৎ কী এমন হলো, কোয়ালিটি ক্রিকেটারের ক্রাইসিস তৈরি হয়ে গেলো?

প্রশ্নটা ক্রিকেটিয় হলেও উত্তর খুঁজতে হবে সম্পূর্ণ অক্রিকেটিয় দৃষ্টিকোণ থেকে। ঢাকা শহরে মিরপুর বাদে ক্রিকেট খেলার মতো মাঠ আছে কয়েকটা মাত্র। সিটি ক্লাব, ঢাকা ভার্সিটি জগন্নাথ হল মাঠ+ সুইমিং পুল মাঠ, ইউল্যাব মাঠ, বুয়েট মাঠ, জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটি মাঠ, কেরানিগঞ্জে নব্য নির্মিত মাঠ, বিকেএসপি। এগুলোতে বড়োজোর প্র্যাকটিস ম্যাচ হতে পারে, আন্তর্জাতিক বা ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ আয়োজনের ধারেকাছেও নেই। ভারচুয়াল গেমস, ফেসবুক এ আসক্তির কারণে ফিজিকাল স্পোর্টস এ তরুণদের আগ্রহ কমে গেছে। ঢাকা শহরের বাইরের জেলাগুলোতে একসময় ফাঁকা জায়গাগুলো ভরাট হয়ে গাঁথা হচ্ছে বিল্ডিং, বেড়ে যাচ্ছে শপিংমলের সংখ্যা। এইসবকিছুর মধ্যে প্রচণ্ড ভোগবাদী জীবনব্যবস্থা নিহিত। সাম্প্রতিক বিজনেস ট্রেন্ডগুলো লক্ষ্য করলে প্রধান যে থিমটা পাওয়া যায় তা হলো- সময় বাঁচায়, ঝামেলাবিহীন নিশ্চিন্ত। বাজার করতে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, খোঁজাখুঁজি করে কিছু বের করার প্রয়োজন নেই, সবই হয়ে যাচ্ছে, এবং এইসকল স্কিলকে এড্রেস করা হচ্ছে সমস্যা হিসেবে, যার সমাধান দিতেই গড়ে উঠছে একেকটি বিজনেস সেক্টর। ফলে নিকট ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মানুষের আর তেমন মিনিংফুল কোনো কাজই থাকবে না হয়তো; তারা কেবল কনজিউম করবে। সেই চক্রে, ক্রিকেট খেলাটা কোনোভাবেই ম্যাচ করে না।

কেবলমাত্র বাংলাদেশের বেলায়ই এই থিওরি প্রযোজ্য তাও নয়; ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড বাদে বাকি দলগুলোতেও কোয়ালিটি খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে ক্রমশ। হয়তোবা কোনো একসময় ক্রিকেটও ফুটবলের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক খেলা হয়ে যাবে।

এই পরিস্থিতিতে ২০১৪ এর বাংলাদেশ দল গঠন করতে গেলে লিটন, মমিনুল, মোসাদ্দেক আর মিরাজের বাইরে কাউকেই এখনো বিশ্বস্ত মনে হচ্ছে না। ২০১৯ বিশ্বকাপের দলেই মমিনুলের সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যদি জিম্বাবুয়ে আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে ভালো করতে পারে। সাকিবের ইনজুরিহেতু জিম্বাবুয়ে সিরিজে মমিনুল সুযোগ পেয়ে যাবে হয়তোবা। সেটা কতটুকু কাজে লাগাতে পারে দেখার বিষয়। সৌম্য আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকবে, তবুও তাকে ক্লোজড চ্যাপটার হিসেবে ধরতে রাজি নই। তার সমস্যাটা সাইকোলজিকাল; হয় সে প্রচুর ফোনে কথা বলে, অথবা ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে, যে কারণে শট খেলার সময় সারক্ষণ ভয়ে থাকে ফেসবুকে তাকে নিয়ে কীসব লেখা হচ্ছে। এই নার্ভাসনেসের বলি হয়েই সাজঘরে ফেরত আসতে হয়। তার মানসিক শক্তি কত কম, নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে শেষ ওভার করার সময়ই বোঝা গেছে।

সাকিব ছাড়া বাংলাদেশের প্রত্যেক ব্যাটসম্যানেরই বর্তমান পরিস্থিতিতে আসতে দীর্ঘ সময় খরচ হয়েছে। মোসাদ্দেক ২০২৪ এর মাহমুদুল্লাহ হবে ধারণা করছি। ব্যাক আপ খেলোয়াড় হিসেবে নাজমুল হোসেন শান্ত, নাজমুল অপু, আফিফ এদের নাম মাথায় আসছে। আবু হায়দার ছেলেটাকে পরিণত মনে হয়েছে; টানা সুযোগ পেলে নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ২য় ওয়ানডেতে জরিমানা খাওয়ার পর তার ব্যাপারেও কিছুটা স্কেপটিকাল হয়ে পড়েছি।

স্পোর্টস কি ইন্টারটেইনমেন্ট, নাকি তীব্র পলিটিক্যাল টুলস? যদি ইন্টারটেইনমেন্টই হবে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড ফুটবল ম্যাচে কেন ফকল্যান্ড দ্বীপ চলে আসে, কারগিল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে কেন পাকিস্তান-ভারত নিজেদের মধ্যে ক্রিকেটিয় সম্পর্ক স্থগিত রাখে, মাহমুদুল্লাহ ছক্কা মারলে কিংবা মাশরাফির বলে শেওয়াগ বোল্ড হলে কেন খুশি লাগে? স্পোর্টস আর পলিটিক্স খুবই সুদৃঢ়ভাবে কানেক্টেড। কিন্তু আমরা পলিটিক্স আর পাওয়ার এক্সারসাইজকে সমার্থক বানিয়ে ফেলেছি। যে কারণে আমরা দল হারলে খেলোয়াড়দের ট্রল করি, জিতলে মাথায় তুলে নাচি।
বিসিবির সেই ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াড, হাইপারফরম্যান্স ইউনিট, কোথায় গেলো? বয়সভিত্তিক দলের সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়রাই বা কোথায়? ২০২৪ এ আফগানিস্তান বা আয়ারল্যান্ডের সাথে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেললে ২-১ এ সিরিজ জেতার সামর্থ্য আছে তো?

এই ভাবনা ভাবার চাইতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জয়ে দলকে সংবর্ধনা দিই এবং সাকিব কেন ভক্তের সাথে অশালীন আচরণ করলো সেই ভিডিও ভাইরাল করে তাকে ট্রল করতে শুরু করি। কোনো বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ কাউকে ট্রল করতে পারে, এটা অবিশ্বাস্য। সম্ভবত একারণেই আমাদের সম্মিলিত বিবেককে বলিউডের বিবেক ওবেরয়ের কাছে বন্ধক রেখে একেকজন হয়ে উঠে ভাইরাসের ডিব্বা।

বিসিবিকে যদি বিজনেস অর্গানাইজেশন ধরি, তার বিজনেস গোল এবং টার্গেট এচিভ করতে স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং কী, এটা বোঝাটা চরম দুর্বোধ্য লাগে আমার। কোনোদিন সুযোগ পেলে ফ্রিতে হলেও বিসিবিতে স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিংয়ে কন্ট্রিবিউট করতাম, কারণ ক্রিকেট শুধুমাত্র একটা খেলা নয়, ক্রিকেট এক গভীর পর্যবেক্ষণসমৃদ্ধ দার্শনিকতাও আমার জীবনে। কেবলমাত্র পরিকল্পনাহীনতায় একটা দল মিনোস থেকে মহীরূহ হওয়ার আগেই নতুন করে ১৯৯৭ সালের পরিস্থিতিতে প্রত্যাবর্তন করবে, এটা একজন ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে মানতে ভয়ঙ্কর আপত্তি আছে আমার।

২০২৪ এ মিরাজের নেতৃত্বে অন্তত ৩টা ওয়ানডে সিরিজ জয় দেখার প্রত্যাশায় রইলাম। বিসিবির প্রত্যাশা গ্যাসবেলুনে চড়ে উড়ে গেছে কিনা, সেটাই দেখবার বিষয়।।।