আমার পর্যবেক্ষণানুসারে বাংলাদেশে ক্রিকেটপ্রিয় মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য, নায়ক-নায়িকা বা গায়ক-গায়িকার যেমন ফ্যানবেইজ থাকে, সেরকম সুনির্দিষ্ট কিছু ক্রিকেটারের ফ্যানেরাই ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে।

ক্রিকেট সম্ভবত পৃথিবীর জটিলতম খেলা, এর রসাস্বদন করতে হলে একটা ন্যূনতম লেভেলের বুদ্ধিমত্তা আর পর্যবেক্ষণ শক্তি থাকতে হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেললেই সে ক্রিকেট বোদ্ধা হিসেবেও আন্তর্জাতিক মানের এটা সঠিক নাও হতে পারে।

কারণ, মাঠে খেলা এক্সিকিউশন প্রসেস, এটা শারীরিক আর মনস্তাত্ত্বিক চর্চা বেশি। অন্যদিকে বিশ্লেষণ প্রক্রিয়াটি মানসিক দক্ষতানির্ভর, একারণেই কোচ বা স্ট্র‍্যাটেজিক প্ল্যানাররা মাঠের বাইরে থাকে খেলা পর্যবেক্ষণ করে। ফলে যার চিন্তাশক্তি আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যত ভালো সে ক্রিকেট বিশ্লেষক হিসেবে তত উন্নত।

ফ্যান্ডমের ভিত্তিতেই একটি খেলায় বিনিয়োগ বাড়ে-কমে, এবং ফ্যানমাত্রই ইরেশনাল। এই অনিবার্য বাস্তবতার মধ্যে সমস্যাজনক অংশ হলো, ফ্যানরা বিশ্লেষক আর বিশ্লেষকেরা ফ্যানের ভূমিকায় নামতে চাওয়া। তাতে সমগ্র সিস্টেমে ডিসটোপিয়ান আবহ সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের ক্রিকেট সেই সমস্যায় আটকে পড়েছে।

দল হিসেবে বাংলাদেশ কেমন?

এই উত্তর খুঁজতে হলে ১৯৯৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ৭ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন আর রানার আপ দলগুলোর দিকে তাকাতে পারি। প্যাটার্ন পর্যালোচনা করলে, প্রতি দলে ৩ জন ধারাবাহিক পারফর্ম করেছে টুর্নামেন্টজুড়ে, এর সঙ্গে সাপোর্টিভ হিসেবে ২-১ জন অনিয়মিত ঝলক দেখিয়েছে। ২০১৯ বিশ্বকাপেও যে দলের ওই ৩ জনের ধারাবাহিকতা বেশি, তারাই চ্যাম্পয়ন অথবা রানার আপ হবে।

বাংলাদেশ একটি মিডিওকর দল। মিডিওক্রিটির মূল উৎস স্কিলসেটে নয়, মানসিকতায়।

মানসিকভাবে আনস্মার্ট হওয়ার কারণ কী?

ক্রিকেট নিছকই কয়েকঘন্টার এক খেলা মাত্র, এর সাথে জড়িত আর্থসামাজিক ডায়নামিক্সটা না বুঝলে আনস্মার্টনেস কীভাবে আসে তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়বে। সুবিধাবাদী চিন্তাভাবনা এবং অতি সেক্যুলার আর অতি রিচুয়ালভিত্তিক ধর্মীয় মনোভাবজনিত গোঁজামিল— এই দুই অনুষঙ্গের ফাঁদ জয় করতে পারি না বলেই আমাদের অভিযোগ, প্রতিক্রিয়া, কপটতা বেশি গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির চাইতে। যে কারণে সুশীলতা কোনো উৎসাহব্যঞ্জক বৈশিষ্ট্য না হয়ে রূপান্তরিত হয়েছে স্ল্যাং এ।

ক্রিকেটাররা তাই ব্যাটিং-বোলিং শিখেছে, কীভাবে বোর্ড-নির্বাচক-ক্লাব ম্যানেজ করে ক্যারিয়ার গড়া যায় সেই রাজনীতি শিখেছে, কিন্তু মানসিক দক্ষতায় এগিয়ে থাকা দলকে কীভাবে ওভারটার্ম করা যায় সেই অনুশীলন শিখেনি, শেখার তাগিদও অনুভব করেনি।

গত ৭ আসরের মধ্যে এবারের অস্ট্রেলিয়ান দলটাই নিজেদের ইতিহাসে দুর্বলতম, তবু আমার জোরালো ধারণা তারাই চ্যাম্পিয়ন অথবা রানার আপ হবে। এটা কি কেবলই ক্রিকেট অবকাঠামো আর প্রফেশনালিজমের কারণে ঘটছে, নাকি অন্য কোনো ফ্যাক্টর আছে?

ভারতীয় দলে বিভিন্ন প্রদেশের খেলোয়াড় খেলে, প্রদেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের খবর প্রায়ই মিডিয়ায় চলে আছে, তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ভিন্নতাও কাজ করে, এবং দল নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অনিয়ম-অভিযোগ বা নেপোটিজমের টুকটাক অভিযোগ শোনা গেছে অতীতে। তবু ভারতের খেলোয়াড়রা পারফর্ম করে কীভাবে?

বাংলাদেশের সামর্থ্য ৫ বা ৬ এ থাকার, খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যখন আমরা ১০ এ ছিলাম; ৫ বা ৬ এ উঠে আসাটা অবশ্যই উন্নতির লক্ষণ, তবে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো, র‍্যাংকিংয়ে পরিবর্তন আসায় বাংলাদেশের যতটা কৃতিত্ব তার চাইতে ক্রিকেট দুনিয়ায় অস্থিতিশীলতা আর অন্য দলগুলোর অবনমনটাই মূখ্য কারণ। যাদের বয়স ৩১+, এবং ১৯৯৯ এ ইংল্যান্ডের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ দেখেছেন বা স্মরণে আছে, তাদের প্রতি প্রশ্ন- সেই আসরে জিম্বাবুইয়ে যে স্কোয়াড নিয়ে খেলেছিল, সেই দলের সাথে যদি ২০১৯ এর বাংলাদেশ দলের ৫ ম্যাচের সিরিজ হয় রেজাল্ট কী হতে পারে?

এখান থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতির ফাঁকিটা ধরা পড়ে যাবে। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত আর সাউথ আফ্রিকাকে হারানোর মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে ২০১০ এ নিউজিল্যান্ডকে হোমসিরিজে হোয়াইটওয়াশ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্যে জায়ান্ট কিলার এটিচুড গ্রো করেছে। তার পূর্বেও জিম্বাবুইয়ে, ভারত, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে, ৯৯ বিশ্বকাপে তো সেই আসরের রানার আপ পাকিস্তানকেও হারিয়েছিল ( ওই জয়টাকে নিছক আপসেট হিসেবে দেখি বলে বিবেচনায় নিচ্ছি না), তবু জায়ান্ট কিলার প্রবণতা তৈরির পিছনে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করা আর সাকিবের অলরাউন্ডার র‍্যাংকিংয়ে ১ নম্বরে উঠে আসাকে বড়ো কারণ হিসেবে দেখি।

জায়ান্ট কিলার আর প্রমিজিং দলের মধ্যে বিস্তর ফারাক। প্রমিজিং দল পর্ব পেরিয়ে তবেই একদিন বড়ো দল হয়ে উঠা হয়। আইসিসির সহযোগী দলগুলো তখন বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়া বা র‍্যাংকিংয়ে বরাবরই পিছনে থাকা দল উপরের দলকে হুটহাট হারিয়ে দিলে জায়ান্ট কিলার টার্মটা ব্যবহৃত হতো।

কিন্তু বিগত ৫ বছরে ক্রিকেট থেকে জায়ান্ট কনসেপ্টটাই কিছুটা ম্রিয়মান। ওয়ানডেতে ভারত আর ইংল্যান্ড অনেক বেশি এগিয়ে গেছে, অস্ট্রেলিয়া গোল্ডেন জেনারেশনের রিজার্ভ বেঞ্চ এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত করতে না পেরে ভারত-ইংল্যান্ডের কাতারে নেমে গেছে, নিউজিল্যান্ড খেটে খাওয়া কেরানির মতো একটা গড়পড়তা মান ধরে রেখেছে, বাকি প্রতিটি দল যে জায়গায় আছে তাতে ক্রিকেট কম্পিটিশন ফ্রি-মার্কেট ইকোনমিক্সের নীতিতে চলছে।।

তবু অন্য দলগুলোর পুরনো ঐতিহ্যের কারণে হলেও তারা কিছুটা বাড়তি সুবিধা পায়। যেমন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। আমাদের কৈশোরে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানে ছিল বারুদের উত্তেজনা, ক্রিকেটপ্রিয় জনগণ ভারত অথবা পাকিস্তান শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়তো।

কিন্তু গত ১ যুগ ধরে এই দুই দলের দ্বৈরথ উত্তেজনা হারিয়েছে মাঠের লড়াইয়ে। ব্যতিক্রম বাদে প্রতি ক্ষেত্রেই পাকিস্তান অসহায় আত্মসমর্পণ করে।

তবু এই ম্যাচের উত্তেজনার কারণ কী?

একেবারেই সহজ উত্তর। ভারত যতোই ডমিনেন্স দেখাক, দুই দলের খেলা মোট ম্যাচে এখনো জয়ের সংখ্যায় পাকিস্তান বেশ কিছুটা এগিয়ে আছে। জয়ের সংখ্যায় ভারত তাদের ছাড়িয়ে যাওয়া না অবধি উত্তেজনা কমবে না।

পক্ষান্তরে ক্রিকেট বাজারের দিক থেকে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান,দুই দলের ম্যাচে সোস্যাল মিডিয়ায় উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে, তবু বাংলাদেশকে নিয়ে গোটা ভারতে আগ্রহ কম কেন?

কারণ, এখনো পর্যন্ত ৪০+ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ জিতেছে মাত্র ৫ বার; মাঠে নামার আগেই যেখানে ম্যাচের রেজাল্ট জানা থাকে, উপরন্তু ম্যাচ শেষে সোস্যাল মিডিয়ায় অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেই দল নিয়ে আগ্রহ জাগা কঠিন।

আমরা যেমন আফগানিস্তানের এটিচুড নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগি কেন? তারা মাঠে যতটা খেলে, তার চাইতে বেশি বাড়াবাড়ি করে, যেটাকে অনেকেই তাদের কাঙালপনা হিসেবে দেখে। ভারতের সমর্থকদের কনটেক্সট এ আমরা আফগানিস্তানের পরিবর্তিত সংস্করণ মাত্র।

বাংলাদেশ কি তবে প্রমিজিং দল?

আমি প্রমিজিং দলকে সংজ্ঞায়িত করি এভাবে, যাদের বিপক্ষে যে কোনো কন্ডিশনে খেললেও আপনার হেরে যাবার ভয় থাকে।

আমরা যদি বাংলাদেশের বোলিং দেখি এটা কোনো বোলিংয়ের মানের মধ্যেই পড়ে না, ব্যাটিং বিবেচনায় নিলে অবশ্যই কম্পিটিটিভ। আপনি পরীক্ষার ইন্টারনাল অংশে ৫০ এ পেলেন ৪১, কিন্তু এক্সটারনাল এ পেলেন ৫০ এ ৫; আপনিই বলুন আপনাকে কি প্রমিজিং বলা যায়?

বাংলাদেশের বোলিংয়ের এই দৈন্যদশা কি কাটবে না? ভারতের বোলিংকে আমরা স্যাম্পল হিসেবে নিতে পারি। দীর্ঘদিন পর্যন্তই তারা ছিল ব্যাটিংসর্বস্ব দল, ৯৬ আর ২০০৩ এর আসরে তারা যথাক্রমে সেমি আর ফাইনালে খেলেছিল মূলত টেন্ডুলকারের নৈপুণ্যে, তবে ২০০৩ এ তাদের ৩ পেসার ( শ্রীনাথ, জহির, নেহরা) যথেষ্ট ধারাবাহিকতা দেখিয়েছিল৷

এক্ষেত্রে ২০০৭ টি২০ বিশ্বকাপকে একটি বড়ো মাইলফলক হিসেবে দেখতে চাই৷ সিনিয়রদের বসিয়ে একেবারে নতুনদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার যে সাহস কনজারভেটিভ ভারত দেখাতে পেরেছিল, সেটাই ছিল বিশাল মেন্টাল ব্লক কাটানোর উদ্যোগ। তাদের পেস ফাউন্ডেশন অনেকদিন ধরে কাজ করছিল।

এরকম বিচ্ছিন্ন উদ্যোগগুলোই সম্মিলিত হয়ে এক ইতিবাচক ফলাফল এনেছে।

বাংলাদেশ হয়তোবা আরো ১০ বছর বোলিংয়ে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারবে না, তবু তাদের পক্ষে প্রমিজিং দল হওয়া সম্ভব যদি স্কোয়াডে উইকেট টেকিং বোলার খেলানো হয়। ২ জন বোলার রান চেক দিবে, ৩ জনের উইকেট টেকিং সামর্থ্য থাকতে হবে। তাদের ইকোনমি যেমনই হোক, প্রয়োজনের সময় উইকেট আনতে হবে। উইকেট টেকিং একটি অভ্যাস। বাংলাদেশে উইকেট টেকিং বোলিং ইউনিট ছিল ২০১৫ বিশ্বকাপে; আরাফাত সানি, বা তাসকিন বোলার হিসেবে অসাধারণ নয়, মিডিওকরই, কিন্তু তাদের উইকেট টেকিং সামর্থ্য ছিল।

বিপরীতক্রমে আজ প্রথম আলোতে পড়লাম, মুস্তাফিজ-সাইফুদ্দিন নতুন বলে বোলিং করতে চায় না; উইকেটটা আসবে কোত্থেকে?

বাংলাদেশে সুইং বোলার বা এক্সপ্রেস বোলার কোনোটাই পাওয়া যাবে না আপাতত। কিন্তু বাংলাদেশ জেন্টল মিডিয়াম পেসার নিতে পারে যারা ১৪০ এর কাছাকাছিতে বোলিং করতে জানে এবং ফোর্থ স্ট্যাম্প চ্যানেলে রাইজিং ডেলিভারি দিয়ে ব্যাটসম্যানকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের স্পিনাররা বল টার্ন করাতে জানে না, এটা কোনো বড়ো সমস্যা হিসেবে দেখি না। এমন স্পিনার দরকার যে বল স্কিড করাতে জানে এবং পেসের ভ্যারিয়েশনে ব্যাটসম্যানকে ফলস শট খেলতে প্রলুব্ধ করতে পারে৷

কিন্তু বাংলাদেশের ৫ জন বোলারই রান আটকানো বোলিং করতে চায়, উইকেট টেকিং ডেলিভারিই নেই। সাকিবের উইকেট সংখ্যা যদিও অনেক বেশি, তবু এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ৫ উইকেট মাত্র ২ বার- এই পরিসংখ্যান থেকে তার রান আটকানো সামর্থ্যই বেশি প্রমাণিত হয় উইকেট টেকিংয়ের চাইতে।

বাংলাদেশে ক্রিকেটের যে ক্যাপাসিটি এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট তাতে সবমিলিয়ে ৪০ জনের একটা খেলোয়াড় সাইকেল থাকলেই প্রথমে প্রমিজিং, পরে বড়ো দল হওয়া সম্ভব।

৪০ জনের সাইকেলে খেলোয়াড় কমতি দেখা দিলে সেটা রিফিল করা হবে। ফলে প্রতিনিয়ত হায়ারিং-ফায়ারিংয়ের মধ্যে থাকলে প্লেয়ার বিল্ড আপ এবং ট্যালেন্ট নারচারিং প্রসেসটা সুন্দর থাকে।

আমাদের বয়সভিত্তিক দল, হাই পারফরম্যান্স ইউনিট, ক্লাব, একাডেমি মিলিয়ে ৩০০-৪০০ ক্রিকেটার আছে হয়তো; বিসিএল-এনসিএল খেলা চলে, তবু যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাংলাদেশে কি ৪০ জন ক্রিকেটার আছে যারা জাতীয় দলে খেলার মতো?

দেখা যাবে সংখ্যাটা ২০-২২ এর মধ্যেই আটকে আছে, যার প্রমাণস্বরূপ এখনো ইমরুল কায়েস, এনামুল বিজয়রাই ঘুরেফিরে রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে চলে আসে৷

অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডের সাথে আমাদের কালচারে মিলে না, তাদের স্ট্রাকচারে ক্রিকেট চালানো আমাদের দেশে সম্ভব নয়। আমাদের দেশের মানুষ চাকরিজীবী মানসিকতার, তারা মাসশেষে নির্দিষ্ট বেতনের যোগানের নিশ্চয়তা চায়। ক্রিকেট খেলার ঝুঁকিটাই এখানে, জাতীয় দলে খেলতে না পারলে বা প্রিমিয়ার লীগে বা বিপিএল এ দল না পেলে ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়া অসম্ভব। জাতীয় দলে খেলার মতো ৪০ জন ক্রিকেটারের পেছনে বিসিবি যদি ইনভেস্ট করে, এবং ৪০ জন যদি ব্যাটসম্যান-পেসার- স্পিনার- অলরাউন্ডার প্রভৃতি ক্যাটেগরিতে বিভক্ত থাকে, এবং পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ৪০ জনে ঢোকা বা সেখান থেকে বাদ পড়ার বিধান থাকে সেখান থেকে রিটার্ন আসবেই।

তবে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এটাও অবধারিত যে, ৪০ জনের তালিকায় ঢোকার জন্য মন্ত্রী-এমপির সুপারিশ, কিংবা ১৫-২০ লাখ টাকার ঘুষ দেয়া-নেয়ার প্রচুর ঘটনাও ঘটবে। তবু ক্রিকেটের মজাটাই এখানে, সুপারিশ বা ঘুষ দিয়ে আপনি বড়োজোর ৪-৫ টা ম্যাচে সুযোগ পাবেন, পারফর্ম করতে না পারলে রাষ্ট্রপতির সুপারিশও রক্ষা করতে পারবে না আপনাকে।

যাহোক, ২০১৯ বিশ্বকাপ শেষ। ভারত-পাকিস্তান দুই দলের বিপক্ষেই হারার সম্ভাবনা বেশি, পাকিস্তান যেহেতু ব্রেইনলেস ক্রিকেট খেলে, তাদের বিপক্ষে জেতার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তাই সেমিফাইনাল ফ্যান্টাসি সমাপ্ত। তাছাড়া বাংলাদেশের বোলিংয়ের যে মান তারা সেমিতে যাওয়াটা ক্রিকেটের জন্যই লজ্জাজনক। যে দল ফাইনালে খেলার কথা অকপটে বলার সাহস রাখে না, আগেভাগেই সর্বোচ্চ টার্গেট সেমি ফাইনাল, তারা আসলে ডিজার্ভিং না নিশ্চিতভাবেই। সেক্ষেত্রে ৯ ম্যাচের দীর্ঘ ফরম্যাটেও বাংলাদেশ যদি নিয়মের মারপ্যাচে সেমিতে উঠে যেত, তার মানে বাকি দলগুলোর অবস্থা বাংলাদেশের চাইতেও শোচনীয়, যা ক্রিকেটদর্শকদের জন্য বেদনাদায়ক হতো। কম্পিটিটিভ ক্রিকেট দেখতে চাই।

আর নিজেকে আমি নির্দিষ্ট দেশ নয়, বিশ্বনাগরিক হিসেবে কল্পনা করি। কেবলমাত্র ভৌগলিক ইমপ্যাথির দোহাই দিয়ে অযোগ্য কোনো দলকে শীর্ষে দেখতে চাই না।

তাই ২০১৯ এর চিন্তা বাদ দিয়ে ২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে কীরকম দেখতে চাই সেই আলোকে লিখি।

১. প্রথমেই নিশ্চিত হতে হবে আমাদের লক্ষ্যটা কী। বর্তমান ক্রিকেটের যে স্ট্যান্ডার্ড, বিপরীতে বাংলাদেশে ক্রিকেটের যে বিশাল বাজার এবং জনপ্রিয়তা, এফোর্টে তেমন কোনো পরিবর্তন না এনেই বাংলাদেশ র‍্যাংকিংয়ে ৬-৭ এর মধ্যে থাকতে পারবে। এতে আমরা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, বিশ্বকাপ দুটোই সরাসরি খেলার সুযোগ পাবো। তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট? আপনি উত্তরে ‘না’ বলবেন, কিন্তু সত্য হলো, আপনি সন্তুষ্ট। কারণ বছরের পর বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলংকা, জিম্বাবুইয়ে, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের সিরিজ খেলে ২-১ বা ৩-০ তে জিতবেন, খেলোয়াড়দের পরিসংখ্যান সমৃদ্ধ হবে, আপনি আসলে এটাই চান।

২. যদি আমাদের লক্ষ্য থাকে র‍্যাংকিংয়ে ২ নম্বরে উঠা তাহলে হয়তোবা আপনি ২০২৩ এর পূর্বে ৩ বা ৪ এ উঠে আসতে পারেন। মানুষ যা টার্গেট করে প্রাপ্তি বরাবরই তার চাইতে কিছুটা কম হয়।

আমার টার্গেট ২ নম্বরে উঠা, তাই কনভেনশনাল চিন্তাধারার সাথে আমি একমত নই। আমার ভাবনা শেয়ার করি।

১. ব্যাটিং কলাপ্স করলে কী হবে এই চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আপনি জিতবেন, অথবা হারবেন; পৃথিবীর প্রতিটি দলেই ব্যাটিং কলাপ্স করেছে, আগামীতেও করবে। সুতরাং দলে ইউটিলিটি এবং স্ট্রোক প্লেয়ার দরকার। স্ট্রোক প্লেয়ার ওপেন করবে, ইউটিলিটি ক্রিকেটার মিডল অর্ডারে ব্যাট করবে। ইউটিলিটি ক্রিকেটার কারা? যাদের রানিং বিটুইন দ্য উইকেট চমৎকার, এবং যারা প্রচুর সিঙ্গেলস নিতে পারে। ওপেনার আর স্লগার ছাড়া বাকি ব্যাটসম্যানদের জন্য বাউন্ডারি মারার যোগ্যতাকে ম্যান্ডেটরি হিসেবে দেখি না। বাজে বল পেলে যে কোনো আন্তর্জাতিক ব্যাটসম্যানই বাউন্ডারি মারতে পারবে। কিন্তু সিঙ্গেলস সবাই নিতে পারে না। সিঙ্গেলস আটকাতে না পারলে বিপক্ষ দল এমনিতেই বিপদে পড়ে যাবে। মোসাদ্দেক ৭ নম্বরের ব্যাটসম্যান না, তাকে ৫ এ খেলিয়ে মিডল অর্ডার হিসেবে গড়ে তোলা হোক। যদিও তার রানিং বাজে, ডট বল খেলে, তবু তাকে সুযোগ দিলে পে-ব্যাক করবে। মাহমুদুল্লাহ ২০২৩ বিশ্বকাপ খেলতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। সুতরাং ওয়ানডে আর টি২০ থেকে তাকে বাদ দেয়া বেটার সিদ্ধান্ত। মাহমুদুল্লাহ যদি বিশ্বকাপের পরের ২ ম্যাচে সেঞ্চুরিও করে, সিদ্ধান্ত অন্যথা হওয়া উচিত হবে না। প্লেয়ার তৈরি করতে হলে জায়গা ছাড়তে হয়।

২. সৌম্য-লিটনের পাশাপাশি আরো ২ জন ওপেনার খুঁজে বের করা উচিত যারা স্ট্রোক খেলতে পারে। আগামী ৪ বছর এই ৪ জনকেই রোটেশানালি চেষ্টা করা উচিত, তারপর বিশ্বকাপের সময় ৪ জনের মধ্য থেকে ৩ জনকে পিক আপ করা যেতে পারে। তার মানে তামিম ইকবালকে ২০২৩ বিশ্বকাপের জন্য বিবেচনা করছি না আসলে। তবে তাকে আরো ২ বছর ওয়ানডে দলে রাখা যেতে পারে, অন্য ওপেনারদের গ্রুমিং প্রসেসের অংশ হিসেবে। তবে তাকে আর মুশফিককে বিশ্বকাপ শেষেই টি২০ দল থেকে বাদ দেয়া উচিত। এমন নয় যে মুশফিকের ফর্ম খারাপ, কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু ম্যাচ কম খেলে, নতুন প্লেয়ারদের বাজিয়ে দেখতে টি২০ ছাড়া অপশন কোথায়!

৩. মোস্তাফিজকে কয়েকটা সিরিজ ব্রেক দেয়া দরকার। ইত্যবসরে নতুন কয়েকজন পেসারকে সুযোগ দিয়ে দেখা যেতে পারে।

৪. মিরাজের বোলিং কোনো পর্যায়ের মধ্যেই পড়ে না। সে ভবিষ্যতে কী করবে সেটা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে, কিন্তু আপাতত সে মূল স্পিনার হিসেবে খেলছে, যার জন্য সে যোগ্য নয়। বাদ দেয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। কোনোদিন যদি সে জেনুইন ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তখন ফিরিয়ে আনা যাবে। আপাতত সে ৯ নম্বরে ব্যাট কিরে যা জেনুইন ব্যাটসম্যানের স্লট নয়।

৫. ব্যাটিং-বোলিংয়ে রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়, ফিল্ডিংয়ে তা করাই যেতে পারে। আমাদের দলের জন্য প্রধাম এক্স-ফ্যাক্টর হতে পারে ফিল্ডিং আর ফিটনেস। ফলে হাবিজাবি পোস্টে ইনভেস্ট না করে বিসিবির উচিত খুব কঠোর ট্রেইনার নিয়োগ দেয়া এবং উন্নত মানের ফিল্ডিং কোচ নিয়ে আসা। কেবল এই একটি সিদ্ধান্তই পারফরম্যান্স কার্ভে ৩০-৪০% গ্রোথ নিয়ে আসবে।

৬. বাংলাদেশের জন্য সবচাইতে ভালো কোচ হতে পারে অস্ট্রেলিয়া অথবা ভারতের কেউ, যার সাম্প্রতিক ক্রিকেট ট্যাকটিক্স আর গেমপ্ল্যান সম্বন্ধে পর্যাপ্ত ধারণা আছে। স্টিভ রোডস কে কেন নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, কেবলমাত্র এই ব্লান্ডারের কারণেই গ্যারি কারস্টেনকে নিন্দা করা উচি।, সে প্রফেশনালিজমের ধার না ধেরে শর্টকাটে কাজ সেরেছে; এত কম প্রফেশনাল এথিক্সের একজন মানুষ ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী দলের কোচ ছিলেন ভাবলে বিস্মিত হই।

৭. আইসিসির এফটিপিতে যা-ই থাকুক, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের প্রত্যকের সাথে আগামী ৪ বছরে অন্তত ৫টা ম্যাচ খেলা উচিত। ভারত আর সাউথ আফ্রিকার সাথে ৬টি করে। আর এদের সাথে হারার পরই মোরাল বুস্ট আপ করতে শ্রীলংকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সাথে সিরিজ বা টুর্নামেন্ট খেলা উচিত। বোর্ড যদি কূটনীতিতে এতোই অদক্ষ হয়, তাহলে এতোজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বোর্ডে থেকে লাভ কী!

৮. বিপিএল এর প্রত্যেক দলে অন্তত ১ জন দেশী ওপেনার খেলানো বাধ্যতামূলক করা উচিত। সেই সাথে লীগগুলোতে একাদশে ৩ জন জেনুইন পেসার খেলানো আবশ্যক করে দিতে হবে। ৩ জন বললে ক্লাবগুলো নেগোশিয়েট করে ২ জনে নামাবে, তবু এটা নেহায়েত মন্দ নয়।

৯. টেস্টকে আরো বেশি গুরুত্ব না দিলে খেলোয়াড়দের ফিটনেস বাড়বে না। বাংলাদেশ টেস্ট খেলে অনেকটাই ফরমালিটি পালনের মতো করে। তাই যেসব প্লেয়ার টেস্টে খেলতে অনাগ্রহী তাদের জোর করে না খেলানোই বেটার।

পাদটীকাঃ
কী করা উচিত সে ব্যাপারে বহু মানুষই চিন্তা করে, কর্তাব্যক্তিদেরও জানা আছে কী করতে হবে। কিন্তু শেষমেষ কিছুই করা হয় না, কারণ আমরা ৬-৭ এ থাকাই উপভোগ করি, এবং এটাই আনন্দের। যে কারণে আবারো ২০২৩ এ সেমিতে উঠার লড়াইয়ে কোন দল কাকে কীভাবে হারালে নিজেদের সুবিধা হয় সেইসব হিসাব কষবো, কোনোক্রমে হিসাব উলটে গেলে বিভিন্ন দলের বিষোদগার, ম্যাচ ফিক্সিং প্রভৃতি আবিষ্কার করে হম্বতম্বি করবো।

বাংলাদেশে ভিক্ষুক পেশাজীবীর সংখ্যা কত তা হয়তোবা পরিসংখ্যান বলে দিতে পারবে, কিন্তু মানসিকভাবে ভিক্ষুক এই সংখ্যাটা কত সেই হিসাব নির্ণয় করার পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, হবেও না কোনোদিন!

সুতরাং আলিম দার একজন চোর আম্পায়ার এবং ভিরাট কোহলি বেয়াদব।