আমি হিরো আলমকে চিনতাম না। এক সময় হিরো আলমের সম্পর্কে জানি, নিতান্ত অনিচ্ছাতেও তার গানের-সাক্ষাৎকারের ভিডিও, নির্বাচনে প্রার্থীতার সংবাদ, সিনেমার পোস্টার আমার চোখে পড়েছে।
আমাকে হিরো আলম চেনানোর দায় কে নিবে?
অনন্ত জলিলের দুটো সিনেমা দেখেছি। খোঁঁজ দ্য সার্চ, এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। সে পর্যাপ্ত খরচ করে এসব প্রজেক্টে। কিন্তু সে বিন্দুমাত্র অভিনয় জানে না, সঠিক উচ্চারণে কথা বলতে পারে না। স্ত্রী বর্ষার অবস্থা তার তুলনায় কিছুটা ভালো, কিন্তু সেটাও বাণিজ্যিক সিনেমার ৩য় গ্রেড নায়িকার চাইতে উন্নত নয়। জলিলের সিনেমাগুলো তাই ব্যক্তিগত শখ পূরণ প্রজেক্ট, কিছু ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিংও হতে পারে, নিশ্চিত নই। বহু বছর আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি জলিলের কোনো ইন্টারভিউ, সিনেমার পেছনে ২ মিনিট সময়ও অপচয় করবো না। এমন এক বাবলের পৃথিবীতে বসবাস করবো যেখানে অনন্ত জলিল নামে একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী থাকলেও সিনেমার জোকার হিসেবে তার অস্তিত্ব থাকবে না। দৃঢ় সংকল্প নেয়া সত্ত্বেও জলিল মুক্ত পৃথিবী পেলাম না।
আমার সংকল্প ভঙ্গের দায় কে নেবে?
একটা ন্যারেটিভ প্রায়ই শুনি- তোমার ভালো না লাগলে উপেক্ষা কর। মাঝে প্ল্যান করেছিলাম হিরো আলম, অনন্ত জলিল এবং সেফুদা বিষয়ে যারাই স্ট্যাটাস বা নিউজ শেয়ার করবে গণহারে ব্লক করে দিব, অর্থাৎ নিউজের সোর্সগুলোও নিশ্চিহ্ন হবে। প্রথম পাইলটিংয়েই দেখি ব্যক্তিগত জীবনের ঘনিষ্ঠ অসংখ্য মানুষ হিরো আলম অথবা জলিলকে নিয়ে পড়ে আছে।
হিরো আলম বা জলিলকে যদি কেউ পছন্দ করে তার প্রতি পূর্ণ সম্মান রয়েছে আমার। পছন্দের ভিন্নতা থাকতেই পারে৷ কিন্তু অপছন্দের সার্বক্ষণিক ব্রান্ডিং, এই স্কুল অব থটের সাথে কখনোই সম্পৃক্ত বোধ করতে পারি না।
হিরো আলম বা জলিলের সাথে এটিএন বাংলার মাহফুজুর রহমানকে রাখছি না, কারণ ঈদের একটা প্রোগ্রামের বাইরে বছরের অন্য সময়ে তাকে সেভাবে আলোচনায় দেখি না। কিন্তু এই দুজন প্রায় প্রতি মাসেই হাজিরা দেয়, অনেকটা মাসিক চাঁদাবাজের মতো বখরা নেয়া।
আমি চাচ্ছি দুজনকে মুছে ফেলতে, নিজের তরফ থেকে সতর্কতা অবলম্বন করেও পারছি না। তাহলে উপেক্ষা না করতে পারার জন্য যে দোষারোপ তার যৌক্তিকতা কতটুকু? আমার এখন ‘সিগনেচার সরণ’ বইয়ের সম্পাদনায় সময় দেয়ার কথা, ক্রিকেটারদের অবসর কালচার বিষয়ে কিছু ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেসব লেখার কথা। অথচ সারাদিনে হিরো আলম নিয়ে ফেসবুকে একই টোনের এত বেশি লেখা চোখে পড়েছে, অজান্তেই এই বিষয়ে লিখতে হচ্ছে। তার মানে স্রেফ উপেক্ষা যথেষ্ট নয় কুরুচিকে প্রতিহত করতে, এর সাথে মিলিট্যান্ট এক্টিভিটির সংযোগ আবশ্যক।
অনলাইন স্ফিয়ারে কতিপয় কী-ওয়ার্ড ভীষণরকম গ্ল্যামারাস। মোরাল পুলিশিং, জাজমেন্টাল, ব্যক্তিস্বাধীনতা, স্যালুট, ভিক্টিম ব্লেমিং, বুলিং, সাবজেক্টিভ-অবজেক্টিভ, ইজারাদারি প্রভৃতি কী-ওয়ার্ডের অতি ব্যবহারে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, আপনার বক্তব্যের সারবস্তু আদৌ এক্সিস্ট করে কিনা তার চাইতে পলিটিকালি কারেক্ট থাকাটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে মানুষ তার কথার, কর্মের এবং আচরণের নিজস্বতা হারিয়ে দাসত্ব করছে ইমেজ এবং এক্সপোজারের। এইসব মানুষের সংস্পর্শে থাকা না থাকায় কী আসে-যায়!
একজন মানুষ কত বেশি নির্লজ্জ-বেহায়া এটাই যদি তাকে এপ্রিসিয়েট করার একমাত্র প্যারামিটার হয় সেই সমাজের অবক্ষয় এবং ধ্বজভঙ্গতার লক্ষণ বুঝতে ২য় কোনো শর্তের প্রয়োজন পড়ে না।
হিরো আলমের কেইসটা যদি পর্যালোচনা করি।
– সে এত ভিডিও তৈরির অর্থ কোথায় পায়? ইউটিউব ঘাটলে বহু গারবেজ কনটেন্ট পাওয়া যায়, সেসবের ভিউ ৫-১০ এরও কম। হিরো আলমের ভিউ এত বেশি কেন?
– হিরো আলমকে প্রথম ব্রেক কে দিয়েছিল? অখ্যাত বহু লোকই অতীতে ব্রেক পেয়েছে। সে দেশ-বিদেশে এরকম ছড়িয়ে পড়লো কীভাবে? কে বা কারা তার প্রমোশন মেকানিজমে কাজ করে?
– হিরো আলমের নির্বাচনে দাঁড়ানোর ইচ্ছা কেন হলো।
অর্থাৎ তাকে যতটা একমাত্রিক চটুল ক্যারেক্টার ভাবা হচ্ছে বাস্তবতা উলটো। শিল্পমনা বা শৌখিনতা একটা ছদ্মবেশ, সে চায় এক্সপোজার, অথচ ন্যুনতম যোগ্যতা নেই। যখন দেখা যাবে অযোগ্য একজন লোক স্রেফ নির্লজ্জতাকে পুঁজি করে রাতারাতি এক্সপোজার পেয়ে যাচ্ছে সেটা সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে, এক্সপোনেন্টশিয়াল হারে বাড়তে থাকে নির্লজ্জের সংখ্যা।
নির্লজ্জতার এই মহামারি ঠেকাতে আমাদের আদৌ করণীয় কি কিছু আছে?
আমি হিরো আলমের ভিডিও বা নিউজ নিউজফিডে দেখামাত্র ফ্রেন্ডলিস্টের সেই ব্যক্তিকে ব্লক করে দিলাম, অথবা রিয়েল লাইফ আলোচনায় তার প্রসঙ্গ তোলামাত্র থামিয়ে দিলাম, আপনি বললেন এতে ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্বিত হচ্ছে। ওইসব সুশীলতাই আদতে নৈতিক স্খলন।
আগে তো নিশ্চিত হতে হবে স্বাধীনতার চর্চাটা আপনি ডিজার্ভ করেন কিনা। হিরো আলম দেখতে বিশ্রি বা দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে বলে তার শিল্প এবং শৌখিনতা চর্চার অধিকার কেন থাকবে না— এইসব আলবাল আলাপ তুলে তাকে মজলুম এর প্রতিভূ বানিয়ে আদতে তাকে স্বীকৃতি আর এক্সপোজার দেয়া হয়, তার আরেকটা ছ্যাচড়ামি প্রজেক্টের ফান্ড যোগাড় করে দেয়া হয়। একজন ব্যক্তি গরুর গোবর দিয়ে পায়েস রান্না করতে পারে, নিজেও খেতে পারে– এটা ব্যক্তি অধিকার। কিন্তু যখন বলছেন পায়েশ গুড়-চিনি নাকি গোবর দিয়ে রান্না হবে সেটা ঠিক করার মোরাল পুলিশিংয়ের অধিকার আপনি কোথায় পেলেন তখনই নিশ্চিত হয় আপনি গোবরের ভোক্তা নিজে তো বটেই, এখন ডিলারশিপ নিয়ে ঘরে ঘরে গোবরের পায়েশ পৌঁছানোর ব্রত নিয়েছেন।
রবীন্দ্র সংগীত আমার ভালো লাগে না একদমই। লিরিকগুলোতে ম্যানলিনেস-ম্যাডলিনেস কম, রক্ষণাত্মক ঘরানার। দ্বিতীয়ত সুর ধীরলয়ের একঘেয়ে, তৃতীয়ত পরিবেশনের ধরন নির্জীব প্রকৃতির।
দুর্ঘটনাবশত সমাজের প্রিভিলেজড শ্রেণির একটা অংশকে রবীন্দ্রসংগীত আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে, এবং এতে বনেদিয়ানা আরোপ করতে রবীন্দ্রনাথের গানকে সেই কুলীন শ্রেণি রূপান্তরিত করেছে ধর্মীয় শ্লোকে, পুত-পবিত্র না হয়ে সেই শ্লোক উচ্চারণ ব্লাশফেমির পর্যায়ে পড়ে।
হিরো আলম যেভাবে বিষবৃক্ষের ন্যায় বেড়ে উঠছিল তাতে ধাক্কা তার জন্য অনিবার্যই ছিল। কোথাও না কোথাও সেটা শুরু হতোই। রবীন্দ্র সংগীত যেহেতু উন্নাসীক কুলীনদের সম্বল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বেচে অনেকের সংসার চলে, হিরো আলমের ধাক্কা খাওয়ার জন্য এটাই মোক্ষম জায়গা হয়ে উঠেছে।
তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে মুচলেকা আদায় করেছে। তাতেই লোকজন ফুঁসে উঠেছে। এতে যেটা হলো আগে যদি হিরো আলমের অবস্থান থাকতো ৪৭ এ, এই ঘটনায় সে উঠে গেল ৮৯ তে।
হিরো আলমের এই ঘটনাটায় প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে ৩ ধরনের মোটিভ থাকতে পারে ধারণা করি
প্রথমত রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিরূপ একটা গোষ্ঠী সক্রিয় অনেক বছর ধরেই। রবীন্দ্রপ্রতিভাকে অগ্রাহ্য করার অংশস্বরূপ তার ক্রিয়েশনকে বাতিলের খাতায় ফেলা এবং তার ব্যক্তিজীবনের নানা ঘটনাকে সত্য-মিথ্যার মিশেলে উপস্থাপন করে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। তার অনুরাগীদের বৃহৎ অংশ তাকে যেরকম ধর্মগুরু ইমেজে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এই কৌলিন্যপনাতেও অস্বস্তি আছে অনেকের।
দ্বিতীয়ত পুলিশবাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা কমতে কমতে শূন্যের কোটায় প্রায়। সেই সুযোগটাকেই ক্যাশ ইন করে বিরোধীদলীয় এক্টিভিস্টরা। যেখানেই পুলিশের ইন্টারভেনশন দেখে সেটাকে সমালোচনা করতে করতে ভাইরাল ইস্যু বানিয়ে ফেলে। সেই ফাঁদে ধরা পড়ে অরাজনৈতিক গ্রুপও।
তৃতীয়ত, উপমহাদেশীয় চিরন্তনীয় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংবেদনশীলতা এবং সহাবস্থানে অনীহা। আমি নিশ্চিত হিরো আলম যদি নজরুল গীতি বিশ্রিভাবে গাওয়ার কারণে পুলিশের কাছে মুচলেকা দিত, বর্তমানের সমালোচনার অর্ধেকই হয়ত চোখে পড়ত না, যদিও কনটেক্সট একই।
আমরা হিরো আলমের জোশ বাড়িয়ে দিলাম। তার সর্বশেষ ভিডিওর ভিউসংখ্যা টুকে রাখুন৷ পরের ভিডিওতে ভিউসংখ্যা দেড় গুণ হবেই। তাহলে বেনিফিশিয়ারিটা কে হলো?
অনন্ত জলিল এত বেশি মিডিয়া কভারেজ কেন পায়?
প্রায় প্রতিদিন পত্রিকা, টিভিতে তাকে নিয়ে নিউজ। এগুলোর ৮০%ই পেইড ক্যাম্পেইন হওয়ার কথা৷ তার যদি অভিনয়ের এতই প্যাশন থাকে সামান্য অর্থ ব্যয়ে অভিনয়টা শিখুক কোনো বিদেশি স্কুল থেকে, বাচনভঙ্গি ঠিক করুক। সেদিকে তো কোনো কথা পাই না।
বাংলা ফিল্মে জলিলের অবদান কী? যদি কিছু থেকে থাকে সেটা ইনভেস্টর হিসেবে। সে ইনভেস্ট করেছিল বলে মিশা সওদাগর ১টা ফিল্ম বেশি করতে পেরেছে, মিডিয়াগুলো বাড়তি কিছু ইনকাম করেছে। কিন্তু অভিনেতার জায়গা থেকে দেখলে সবটাই ধূ ধূ
অথচ জলিলকে আবর্জনা বললেও বলা হবে তাকে রেসপেক্ট দিতে হবে!
তাই আবর্জনার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে যাওয়াই আগামীদিনের একমাত্র স্ট্রাটেজিকাল টুলস। হিরো আলম এবং জলিল বিষয়ক প্রশংসাসূচক লেখালিখিকে চয়েজের ভিন্নতা গ্রাউন্ডে ছাড় দেয়া হলেও এর বাইরে যে কোনো প্রকার নিউজ বা লেখা চোখে পড়ামাত্র সেই ভাইরাস বাহককে ডিলিট করে দেব। তাতে যদি ফ্রেন্ডলিস্টে ৭ জন মানুষও অবশিষ্ট না থাকে, let it be
হয় আপনি হিরো আলমের প্রমোটার অথবা এলিমিনেটর; মাঝামাঝি অথবা নিস্পৃহ থাকার চুদুরবুদুর এবার বন্ধ হোক।
আমি ২য় দলে যোগদান করলাম নিঃসঙ্গ হওয়ার ঝুঁকিসমেত। যোগ দিয়ে দেখুন, স্রেফ ৬ মাস পরে হিরো আলম নামে কোনোদিন কোথাও কেউ ছিলো মনেও করতে পারবেন না।